শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টক (পর্ব-২)

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ | ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ | ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 347 বার দেখা হয়েছে

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টক (পর্ব-২)

সনাতন গোপাল দাস ব্রহ্মচারী

এতাদৃশী তব কৃপাঃ এমন শ্রীভগবানের অহৈতুকী কৃপা। হে কৃষ্ণ, দুঃখপূর্ণ জড়বদ্ধ জীবের জন্য অহৈতুকী কৃপা পরবশ হয়ে সর্বমঙ্গল প্রদানকারী সরল নাম ভজন পদ্ধতি দান করেছ। কেবলমাত্র নাম উচ্চারণ করলেই নাম-আভাসেই সর্বপাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। প্রীতি সহকারে নাম করলে ভগবদ্ধামে উন্নীত হওয়া যায়। পরম সিদ্ধি শ্রীকৃষ্ণপ্রেম লাভ করা যায়।
ভগবন্ মম অপি দুর্দৈবম্ ঈদৃশম্ ইহ অজানি ন অনুরাগ ও তবুও হে শ্রীকৃষ্ণ! আমার দুর্দৈব এই যে, তোমার (সর্বমঙ্গলপ্রদ) সুলভ নামে আমার অনুরাগ জন্মালো না। শ্রীমদ্ভাগবতে (৩/৯/৭) বলা হয়েছে, দুর্দৈব কি? যখন কেউ কৃষ্ণনাম কৃষ্ণকথায় মন দিতে থাকে তখন তার সমস্ত অভদ্ররাশি বিদুরিত হয়, তার সমস্ত দুঃখ দূরীভূত হয়। কিন্তু কৃষ্ণনামে, কৃষ্ণকথায়, কৃষ্ণসেবায় বিমুখ হয়ে যখন তার মন জড় তুচ্ছ ইন্দ্রিয়তর্পণ আশায় অভিভূত হয়ে অমঙ্গলজনক কর্ম করতে থাকে তখন দেবতারা তাকে হতবুদ্ধি করে দেন।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন, জীব মায়ারাজ্যে বাস করে শ্রীকৃষ্ণসেবা বাসনা না করে অন্য অভিলাষ, শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সাধন উদ্দেশ্যে কর্ম না করে অন্য কর্ম, শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধ জ্ঞান বাদ দিয়ে অন্য জ্ঞান চর্চায় মন দিয়ে থাকে। এই তিন রকমের ভোগময় পথে জীবের স্বরূপ বিস্মৃতি ঘটে, তখনই তার দুর্বিপাক উপস্থিত হয়।
দুর্বিপাকগ্রস্ত জীবের হরিনামে শ্রদ্ধা থাকে না, কখনও বা সে নিজের জড়জাগতিক লাভ, পূজা, প্রতিষ্ঠা কামনায় নাম করে। সে নাম অপরাধী হয়ে যায়। তাই হরিনামের প্রতি অনুরাগ জন্মায় না।
সাধু গুরু কৃপায় অবিশ্রান্ত নাম করতে করতে সেই অপরাধ ক্ষালন হয়ে যায়। সাধুনিন্দায় মন দিলে নয়।

নাম সাধনের অধিকারী

তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ॥৩॥

যিনি তৃণ অপেক্ষা নিজেকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করেন, যিনি তরুর মতো সহিষ্ণু, যিনি নিজে মান শূন্য এবং অন্য সবাইকে সম্মান প্রদান করেন, তিনি সর্বক্ষণ হরিকীর্তনের অধিকারী।
তৃণা অপি সুনীচেনঃ তৃণ অপেক্ষাও সুনীচতা। মাটিতে তৃণ বা ঘাস অঙ্কুরিত হয়। তার উপর গরু ছাগল চরে বেড়ায়, তারা ঘাস খায়। তার উপর দিয়ে লোক হাঁটা চলা করে। ইট কাঠ চাপা দিয়ে দেয়। কিন্তু ঘাস কিছুই বলে না। ঘাস স্বভাবতই মর্যাদাহীন জাতি।
কিন্তু সেই ঘাস-জন্ম ধন্য, যদি শ্রীকৃষ্ণের রাতুলচরণ স্পর্শ করতে পারে। গোপ- গোপী প্রমুখ ভগবৎ-পার্ষদদের চরণ স্পর্শ করার সুযোগ লাভ করতে পারে। ঘাসফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে চাক বাঁধে। সেই মধু শ্রীভগবানের সেবায় যুক্ত হতে পারে। অন্যদের শরীর, মন সুস্থ রাখার জন্য, মাটি ধরে রাখার জন্য ঘাস-লতাপাতার গুরুত্ব বা অবদানও কম নয়। যদিও বা সে জড়বৎ নীচ জাতি। কিন্তু বিকৃত স্বরূপ আমার অস্তিত্ব মর্যাদাহীন। আমার মানুষ জীবন লাভের মূল্য তত নেই। কারও উপযোগিতায় আমি নেই। অতএব তৃণ অপেক্ষা আমি আরও হীন ও নীচ, এটি বাস্তব সত্য। সেই কথাটি খেয়াল রেখে বিনয় নম্র সহকারে হরিনাম করতে হবে।
তরোঃ ইব সহিষ্ণুনাঃ বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু হতে হবে। বৃক্ষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, উত্তাপ সহ্য করে থাকে। ফুল-ফল দান করে। ক্লান্ত পথিককে ছায়া দান করে। পরিবেশ স্নিগ্ধ রাখে। তাকে কেউ জল না দিলেও সে চুপচাপ থাকে। তাকে কেউ ছেদন করলেও সে প্রতিবাদী হয় না।
সব উৎপীড়ন সহ্য করেই তার শরীরটা পরের সেবায় নিবেদন করে। কৃষ্ণভক্ত সেইরকম দয়া প্রবৃত্তিক্রমে অন্যদের কৃষ্ণভক্তি দিয়ে শত্রু-মিত্র সবারই উপকার করে থাকেন। এটাই সূচিত হয়। নাস্তিকদের উৎপীড়ন এবং আস্তিকদের ভুল বোঝাবুঝি সব কিছু সহ্য করেও সবার কল্যানার্থে কৃষ্ণনাম গ্রহণ ও প্রচার করে থাকেন।
অমানিনাঃ মিথ্যা অভিমান শূন্য হতে হবে। বদ্ধজীবের অনেক অভিমান বা গর্ব আছে। ধনের গর্ব, রূপের গর্ব, উচ্চকুলের গর্ব, দৈহিক ক্ষমতার গর্ব, প্রতিষ্ঠার গর্ব, উচ্চ পদের গর্ব, উচ্চ জড়শিক্ষার গর্ব, যোগসিদ্ধি কিছু জেনে ফেলেছে সেজন্য গর্ব। এই গর্ব বা অহমিকার ফলে মানুষ অন্যদের কাছে নিজের মান-সম্মান, পূজা আশা করে থাকে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ বা বড় বলে মনে করে।
কিন্তু বাস্তবিক দেহত্যাগের পরই এই সব অনিত্য গর্বের কোনও মূল্য থাকে না। মিথ্যা অভিমান সব বৃথা বলেই পরিগণিত হয়। স্বরূপত আত্মা নিত্য শ্বাশ্বত। তার সত্য অভিমান হচ্ছে, সে পরমচৈতন্যের অতি ক্ষুদ্র অংশকণা মাত্র। সেই হিসেবে সর্বদা তার যথার্থ স্থিতি হচ্ছে পরমপূর্ণের সেবায় যুক্ত থাকা। যখন সে অন্য জীবসমূহকে সেইভাবে দেখে তখন সে অন্যদের অপেক্ষা নিজেকে বড় বা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে না, সে তখন হামবড়া ভাব দেখিয়ে অন্যের কাছে সম্মানও আশা করে না।
মানদেনঃ অন্যদের সম্মান দিতে হবে। সব জীবই শ্রীকৃষ্ণের অংশকণা আত্মা। অতএব কার সাথে আপনি বিদ্বেষভাবাপন্ন হবেন? কাকে হেয় ভাববেন? বরং অন্যদের সম্মান প্রদর্শন করলে নিজের আনন্দ, উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি হবে। অন্যদের সেবা করবার মন থাকলে, অপরকে সমাদর করবার চেষ্টা থাকলে শ্রীকৃষ্ণ বেশী প্রসন্ন হন। অপরকে সম্মান করে তাঁদের কাছে কৃষ্ণভক্তি প্রার্থনা করতে হয়। কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ ঃ সব সময় হরিকীর্তন করতে হবে। শ্রীভগবানের নাম, রূপ, গুণ লীলা পরিকর প্রভৃতি শ্রবণ কীর্তন স্মরণ করতে করতে পরম পুরুষার্থ সাধিত হবে। দৈন্য, দয়া, অভিমানশূন্যতা ও সকলের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান এই সব লক্ষণ নিরপরাধে হরিনামকারী ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়।


 

চৈতন্য সন্দেশ ডিসেম্বর – ২০২১ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।