যখন অ্যাপল ও ব্ল্যাকবেরি ফল ছিল, তখন জীবন অনেক সহজ ছিল  (পর্ব-১)

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২০ | ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২০ | ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 473 বার দেখা হয়েছে

যখন অ্যাপল ও ব্ল্যাকবেরি ফল ছিল, তখন জীবন অনেক সহজ ছিল  (পর্ব-১)

শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী (ভাষান্তর: রবীন দাস)


বৈজ্ঞানিক প্রগতি, প্রযুক্তির উন্নয়ন, চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতি এ সমস্ত উন্নতি খুবই উপযোগী এবং উপকারী হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এগুলো সঠিক মনোভাব নিয়ে ব্যবহার করব।

শ্রীল প্রভুপাদের গুরুদেব এবং আমার পরম গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর সরলতাকে ভক্তি জীবনের ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছিলেন সরলতা ছাড়া শুদ্ধভক্তি যাজন করা সম্ভব নয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই জানতে ইচ্ছা হয় সরলতা কাকে বলে?

সরলতা কাকে বলে?

একভাবে বলতে গেলে সরলতা মানে, ‘আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার প্রয়াস করি’। সুখী হওয়ার জন্য আমার অনেক কিছু দরকার এরকম মনে করি না। যেমন সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত ও নদী দর্শন করে, পাখির কলরব শোনে, প্রকৃতিকে অবলোকন করে তার কাছ থেকে আমরা অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আহরণ করে খুবই সরল জীবন যাপন করতে পারি। সাধারণত শিশুরা স্বভাবতই সরল হয়। তারা শুধু অন্যদের থেকে ভালবাসা কামনা করে এবং অন্যদের ভালবাসতে চাই। আর এটার জন্য কোন অর্থের প্রয়োজন হয় না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তির ব্যবহার এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। খুবই সহজ সরল জিনিস, অন্যদের ভালবাসা ও কামনা করা। যখন ভালবাসা কৃষ্ণের প্রতি অর্পিত হয় এবং আমরা যখন বুঝতে পারি কৃষ্ণ আমাদের কতই না ভালবাসেন, তখন জীবনের সকল পরিস্থিতিতে আমরা সুখে থাকতে পারি, অন্য কোনো কিছু আমাদের বিচলিত করতে পারে না। কিন্তু আমরা যখন নিজেদের ভিতরে শূন্যতা, একাকীত্ব অনুভব করি, তখন তা কাটানোর জন্য অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে মনে করে বিভিন্ন কিছুর পিছনে ছুটি। যেমন- নেশা, ধূমপান, ইত্যাদি করে কষ্ট ও হতাশাকে এড়িয়ে যেতে চাই কিন্তু এসব জিনিস হৃদয়ের শূন্যতাকে পূর্ণতা দিতে পারে না।

বর্তমানে আমাদের মূল সমস্যাটি কি?

বর্তমান সময়ের একটা বিশাল সমস্যা হচ্ছে আমরা বুঝতে পারি না সত্যিই আমাদের কি প্রয়োজন? আমাদের মূল সমস্যাটি কি? আমরা বাহ্যিক অনেক বিষয়ের উপর আমাদের জীবনকে উৎসর্গ করছি। সভ্য সমাজে মানুষ মানুষকে ভালবাসে এবং সেজন্য যা প্রয়োজন সে সমস্ত জিনিসকে ব্যবহার করে। কিন্তু বর্তমানে ঠিক তার উল্টোটাই হচ্ছে।
মানুষ এখন জিনিসকে ভালবাসে এবং সেগুলো অর্জনের জন্য মানুষকে ব্যবহার করে। আমাদের জীবনে যে কোন গভীরতা নেই এটা হচ্ছে তার অন্যতম একটা লক্ষণ। সরলতা মানে হচ্ছে ভগবান যে উপহারসমূহ আমাদের প্রদান করেছেন তা নিজে অনুভব করে অন্যদের সাথে তা ভাগাভাগি করা।
আমরা হৃদয়ে যেরকম কৃষ্ণভাবনামৃতের সুখ আস্বাদন করি তা যদি করুণা ও সততার মাধ্যমে অন্যদের বিতরণ করি, তখনই আমরা প্রকৃত সন্তুষ্টি লাভ করি। তার কারণ হচ্ছে আমরা ভালবাসা গ্রহণ করছি একই সাথে তা বিতরণও করছি। এভাবে যখন আমরা এ সমস্ত মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলি এবং তা বজায় রাখি তখন সেটিই হচ্ছে “সরল জীবন উচ্চ চিন্তার” নীতি।
এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে প্রহ্লাদ মহারাজের একটা উপাখ্যান রয়েছে। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এবং শ্রীল প্রভুপাদের মতে, প্রহ্লাদ মহারাজ হচ্ছে সরলতার প্রতিমূর্তি। তিনি ছিলেন ৫ বছরের একজন বালক। তিনি যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন নারদ মুনি থেকে শ্রীমদ্ভাগবতের জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কৃষ্ণই হচ্ছে জীবনের পরম লক্ষ্য যখন এই জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারব তখন আমরা জীবনের যেকোনে পরিস্থিতিতে সুখে থাকতে পারব।
প্রহ্লাদ মহারাজের এই উপদেশের প্রতি খুবই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপু ছিল একটা মস্ত বড় অসুর। সে ভগবানকে ঘৃণা করত। এই ঘৃণার কারণ হচ্ছে সে ভগবানকে ঈর্ষা করত। সে চেয়েছিল পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মালিক ও নিয়ন্তা হতে। কিন্তু হিরণ্যকশিপু যেহেতু খুবই পরাক্রমশালী ছিল তাই সে ভগবনকে বিশ্বাস করত না। হিরণ্যকশিপু একদা প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করল, হে পুত্র! গুরুগৃহে তুমি কোন্ শ্রেষ্ঠ জ্ঞানটি শিখেছ আমাকে তা বল।
তখন প্রহ্লাদ মহারাজ অকপটে ও সততার সহিত তার পিতাকে উত্তর দিয়েছিল-“হে অসুরশ্রেষ্ঠ দৈত্যরাজ, আমার গুরুদেবের কাছে আমি জেনেছি, যারা তাদের অনিত্য দেহকে কেন্দ্র করে গৃহব্রতের জীবন-যাপন করে, তারা জনশূন্য অন্ধকূপে অবশ্যই দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করে কেবল উদ্বেগ প্রাপ্ত হয়। মানুষের কর্তব্য সেই পরিস্থিতি পরিত্যাগ করে বনে গমন করা। বিশেষ করে বৃন্দাবনে এবং সেখানে কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা অবলম্বন করে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করা।”
এখানে লক্ষ্যণীয় একটা ব্যাপার হচ্ছে সরলতা মানে কোনরকম শঠতা বা কপটতা ছাড়া আচরণ করা। প্রহ্লাদ মহারাজ হৃদয়ে যা লালন করেন তা তার পিতার সম্মুখে অকপটে বলে ছিলেন। আবার সরলতা দেখানোর জন্য রুক্ষ ও কঠোর হতে হয় না। এখানে প্রহ্লাদ মহারাজ বিনম্রভাবে সম্মানের সহিত তার পিতাকে অসুরশ্রেষ্ঠ বলে সম্বোধন করেছিলেন এবং তার কারণ হচ্ছে প্রহ্লাদ মহারাজ সমস্ত জীবকে ভালবাসতেন এবং সম্মান দিতেন।

সমাজ তখনই উন্নত হয়

একদিন প্রহ্লাদ মহারাজ যখন ওনার কিছু অন্তরঙ্গ পার্ষদদের নিয়ে রাজ্য ভ্রমণ করছিলেন তখন তিনি দেখলেন, একজন মহাত্মা রাস্তায় শায়িত আছেন, যাঁর দেহ ধূলি ধূসরিত হলেও আধ্যাত্মিক চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত। তখন তিনি ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে মহাত্মা আপনার কোন রকম জাগতিক সম্পদ নেই, কিছু করার জন্য আপনি প্রয়াসও করছেন না, কিন্তু তবুও আপনি এত স্থূলকায় কেন হলেন দয়া করে আমায় বলবেন কি?
উত্তরে ঐ মহাত্মা বললেন, “আমি অনেক যোনি ভ্রমণ করে এই মনুষ্য শরীর প্রাপ্ত হয়েছি, আমার পূর্বজীবনে আমি অনেক বছর রাজ্য শাসন করেছি, এই সবকিছুর পরে আমার উপলব্ধি হচ্ছে জড় জগতের সাথে সংগ্রাম করে আমরা কখনও প্রকৃত সুখ ও শান্তি লাভ করতে পারি না। প্রকৃত সুখ নির্ভর করছে আমাদের অভ্যন্তরীণ সরলতা, আমাদের প্রতি ভগবানের ভালবাসা ও অন্যদের ভালবাসা-এগুলোকে মূল্যায়ণের উপর এবং সাধ্যমত অন্যদের বিতরণ করার উপর।

আপনি কি সুখী ও সন্তুষ্ট?

বামনদেব যখন বলি মহারাজ থেকে ত্রিপাদ ভূমি প্রার্থনা করেছিলেন তখন বলি মহারাজ বলেছিলেন, “আপনি এত কম চাইছেন কেন? আপনি যেটা চাইবেন আমি সেটাই দিব।” বামনদেব বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি আত্মতৃপ্ত তাঁকে পুরো বিশ্বের সব দিলেও বা কোন কিছু না দিলেও সে সুখী ও সন্তুষ্ট থাকবে। আমি যেহেতু আত্মতৃপ্ত তাই আমার অন্য কোন কিছুর দরকার নেই শুধু ত্রিপাদ ভূমি দিলে হবে। কিন্তু আপনি যেহেতু আত্মতৃপ্ত নন, তাই পুরো বিশ্বের রাজা হয়েও আপনি সুখী ও সন্তুষ্ট নন।”
সে মহাত্মাটি প্রহ্লাদ মহারাজকে আরো জানিয়েছিলেন-“আমি মৌমাছি থেকে শিক্ষা নিয়েছি। মৌমাছিরা অত্যন্ত কষ্ট করে উড়ে উড়ে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক তৈরি করে। কিন্তু মানুষ পুরো মৌচাকটি কেঁটে নিয়ে চলে যায়। তদ্রুপ এই জগতের জীবেরা অত্যন্ত পরিশ্রম করে সবকিছু সংগ্রহ করে, কিন্তু মৃত্যু সবকিছু হরণ করে নিয়ে যায়।” মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রহ্লাদ মহারাজ সবকিছু শ্রবণের পর রাজ প্রসাদে ফিরে গিয়ে রাজ্য শাসন করেছিলেন। তিনি সে মহাত্মার মতো সবকিছু ত্যাগ করে রাস্তায় শায়িত ছিলেন না। কিন্তু হৃদয়ে প্রহ্লাদ মহারাজ সে মহাত্মার মত একই চেতনা লালন করেছিলেন এবং তা হল সরলতা।
সমাজ তখনই উন্নত হয়, যখন মানুষ ভগবানকে ভালবাসা ও অন্যদের ভালবাসাকে মূল্যায়ণ করতে জানে। ছোট বেলায় আমার মা তা আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ওনার জন্মদিনে একজন আমার মাকে একটা হীরার মালা উপহার দিয়েছিল। আমি যখন জানলাম আমার মায়ের জন্মদিন তৎক্ষণাৎ আমি বাগান থেকে একটা গোলাপ এনে আমার মাকে অর্পণ করেছিলাম। আমার মা সেটি পেয়ে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন, তিনি কান্না করেছিলেন এবং বলেছিলেন এই গোলাপটি আমার কাছে হীরার থেকেও মূল্যবান। তিনি সব সময় বলতেন- কোন জিনিস আমাদেরকে সুখ বা সন্তুষ্টি দেয় না, জিনিসটি যে ভাব বা ভালবাসা নিয়ে দেওয়া হয় তা আমাদের সুখ দেয়। তাই কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন কেউ যদি ওনাকে প্রীতি সহকারে পত্র, পুষ্প, ফল ও জল দান করেন তা তিনি গ্রহণ করেন। কৃষ্ণ এতটাই সরল।
মহাভারতে বর্ণিত আছে দুর্যোধন একবার কৃষ্ণকে তার রাজ প্রাসাদে দুপুরের ভোজন গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করে কিছু সুবিধা সে নিবে। বিশাল রাজকীয় মহোৎসবে সে কৃষ্ণের জন্য রাজভোগের আয়োজন করেছিল। কিন্তু কৃষ্ণ ঐ সমস্ত ঐশ্বর্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করলেন না এবং তিনি তার ভক্ত বিদুরের গৃহে গমন করলেন। বিদূর ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। সে থাকত কুড়েঁঘরে। তাঁরা জানত না ভগবান আসবেন তাদের গৃহে। ভগবানকে দেখে তারা এতই বিহ্বল হয়ে পরেছিল যে ঘরে যে একটি মাত্র কলা ছিল, তাঁরা তার ভিতরের অংশটি ফেলে দিয়ে কলার খোসাটি কৃষ্ণকে খেতে দিয়েছিল।
আর কৃষ্ণ সে প্রীতিপূর্ণ উপহার তৃপ্তিসহকারে গ্রহণ করেছিলেন। আমরা যেহেতু ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমাদেরও ভগবানের মত সমস্ত গুণগুলো রয়েছে। আমরাও ভগবানের মত সরল। আমাদের প্রকৃতি হচ্ছে আমরা ভালবাসা চাই এবং ভালবাসতে চাই। আমরা যদি মিথ্যা বলি, ছলনা করি, ঈর্ষা করি তা আমাদের হৃদয়কে কলুষিত করে তখন আমরা আসল জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করি। প্রহ্লাদ মহারাজের সমস্ত ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু অন্তরে তিনি ছিলেন খুবই সরল। তাই আমাদের পদমর্যাদা, ঐশ্বর্য, সম্পদ কোনো কিছু ত্যাগ করতে হবে না, আমাদের শুধু জানতে হবে কিভাবে সঠিকভাবে শুদ্ধ হৃদয় দিয়ে এগুলো ব্যবহার করা যায়।

সূত্র:ব্যাক টু গডহেড (এপ্রিল – জুন) 
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ও ব্যাক টু গডহেড এর ।। গ্রাহক ও এজেন্ট হতে পারেন
প্রয়োজনে : 01820-133161, 01758-878816, 01838-144699
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।