মেলকোট

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২২ | ৬:১১ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২২ | ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 158 বার দেখা হয়েছে

মেলকোট

অপূর্ব সব দর্শনীয় মন্দির ও ভগবানদের স্থান

সৰ্বানন্দ দাস


মেলকোট ভারতের মহিসুরের ত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে পর্বত শিখরে অবস্থিত একটি শহর। শ্রী সম্প্রদায়ের চারটি বিশেষ মহিমান্বিত স্থানের মধ্যে এটি অন্যতম। শ্রী সম্প্রদায়ের প্রধান আচার্য শ্রীরামানুজ আচার্য (খ্রিষ্টাব্দ ১০১৭-১১৩৭) এই মেলকোট শহরে তার জীবনের বারটি বছর অতিবাহিত করেছেন। তিনি এই বার বছর যাবৎ যেসব বিগ্রহ অৰ্চনা করেছিলেন, সেই বিগ্রহগুলোর সেবাপূজা এখনো সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। মেলকোট শহরের শেষ প্রান্তে পর্বত শিখরে ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের এক প্রখ্যাত মন্দির অবস্থিত যা শ্রীযোগনৃসিংহ স্বামী মন্দির নামে পরিচিত। এইখানে শ্রীনৃসিংহদেব যোগাসনে সমাসিন তাই তিনি যোগ নৃসিংহ নামে পূজিত হন। যোগাসনে সমাসীন অবস্থায় বিগ্রহটি তিন ফুট উঁচু। বিগ্রহটি মনোহর আভূষণে বিভূষিত। বিগ্রহের সমস্ত দেহ স্বর্ণ দ্বারা আবৃত। স্বর্ণের হস্ত, পদ এবং হস্তে শোভিত অস্ত্রগুলোও স্বর্ণ নির্মিত। মস্তকে স্বর্ণ ও হীরক খচিত মুকুট একটি পুষ্পমাল্য তাঁর মুকুট হয়ে বক্ষ পর্যন্ত নেমে এসেছে। নারদীয় পুরাণে এই বিগ্রহ সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ জানা যায়। প্রহ্লাদ মহারাজ হাজার বছর আগে এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিদিন বিগ্রহের মহাভিষেক সম্পন্ন হয়। কেউ যদি মহাভিষেকের ব্যয়ভার বহন করে তবে সে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থেকেই বিগ্রহের মহাভিষেক দর্শন করতে পারে। অন্যথায় বিগ্রহের অভিষেক সম্পন্ন হয় গর্ভ মন্দিরের রুদ্ধদ্বার কক্ষে। মহাভিষেকের সময় বিগ্রহকে শুষ্ক জল, দুধ, দধি, মধু, চিনি মিশ্রিত জল দিয়ে অভিষেক করানো হয়। এই সময় পূজারীরা পাবন সূক্ত, নারায়ণ উপনিষদ ও বিষ্ণু সূক্ত নামক ভগবানের মহিমা ব্যঞ্জক স্তোত্র পাঠ করেন । মহাভিষেক সমাপনান্তে নিমিষ দর্শন দিয়ে পুনঃরায় পাঁচ মিনিটের জন্য গর্ভ মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় বিগ্রহের সমস্ত অঙ্গে হলুদ লেপন করা হয়। অন্ধকার কক্ষে হলুদ শোভিত বিগ্রহকে সোনালী আভায় অপূর্ব লাগে। এই সময় বিগ্রহকে ঘৃত প্রদীপ, কর্পূর মিশ্রিত পান-সুপারি এবং কলা অর্পণ করা হয়। যে ব্যক্তি ভগবানের এই মহাভিষেকের ব্যয়ভার বহন করেন এবং দর্শন করেন তার জন্য ভগবানের কৃপার দ্বার উন্মুক্ত হয়। এরপর আবার নিমেষ দর্শন এবং আবার গর্ভ মন্দির বন্ধ হয়ে যায় এবং দর্শনার্থীদের কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। এই সময়ে বিগ্রহের অস্তিম শৃঙ্গার সম্পন্ন হয় এবং দর্শনার্থীদের মাঝে কলা, মধু, নারিকেল ও তুলসী মিশ্রিত চরণামৃত বিতরণ করা হয়। কিছুক্ষণ পর পূজারী গর্ভ মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত করলে ভগবানের মনোহরী রূপ সকলেই দর্শন করার অপার সৌভাগ্য লাভ করে।

প্রহ্লাদ মহারাজের গুহা

নারদীয় পুরাণ অনুসারে প্রহ্লাদ মহারাজ যখন প্রায়শ্চিত্ত সম্পন্ন করার নিমিত্তে বিষ্ণুর চিট্টায় আসেন তখন এই বিগ্ৰহ প্রতিষ্ঠা করেন। এখনো এই মন্দিরের নীচে প্রহ্লাদ মহারাজের গুহা অবস্থিত। কথিত আছে প্রহ্লাদ মহারাজ এই গুহায় নৃসিংহদেবের ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কেউ যদি এই গুহা দর্শন করতে চায় তবে মন্দিরের পিছনে উত্তর পার্শ্বে বহু সংকীর্ণ সিডি অতিক্রম করে সেই স্থানে পৌঁছাতে হয়। গুহার প্রবেশ পথে বিশাল এক পাথর, প্রবেশ পথকে সংকীর্ণ করে রেখেছে। কেউ যদি এই গুহায় প্রবেশ করতে চায় তাহলে তাকে নীচু হয়ে ও শরীরকে সঙ্কুচিত করে প্রবেশ করতে হবে। কথিত আছে, এই গুহার ভিতর দিয়ে একটি রাস্তা মন্দিরের দিকে গিয়েছে। এই পথে এগোলে গর্ভ মন্দিরের ঠিক নীচে পৌছানো যায়। প্রহ্লাদ মহারাজ যে স্থানে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন সেই স্থানটি গর্ভ মন্দিরে বিরাজিত বিগ্রহের ঠিক নীচে। এই কথার সত্যতা জানা যায় বিগ্রহের অঙ্গকান্তি থেকে। মহাভিষেকের সময়ই শুধুমাত্র এটি দেখা যায়। বিগ্রহের পদতলে ধ্যানস্থ অবস্থায় প্রহ্লাদ মহারাজের শ্রীমূর্তি, এই কথার সত্যতা প্রমাণ করে ।

মেলকোটে দর্শনীয় স্থানসমূহ পঞ্চকল্যানী সরোবর

চেলুব নারায়ণ স্বামী মন্দির দর্শনের পূর্বে দর্শনার্থীরা পঞ্চকল্যানী সরোবর দর্শন করে। সরোবরটি খুব গভীর এবং বিশাল আকার । সরোবরের সাথেই আছে ভুবনেশ্বরী মণ্ডপ । পঞ্চকল্যাণী সরোবর মেলকোটের মহিমান্বিত সরোবরগুলোর একটি। তীর্থযাত্রীরা এই সরোবরে নেমে মস্তকে জল সিঞ্চন করে। ঈশ্বরসংহিতা অনুসারে যখন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বরাহ অবতার রূপে এই পৃথিবীকে মহাসমুদ্র থেকে তার নাকের ডগায় করে উত্তোলন করেন তখন তার দিব্য শরীর বেয়ে এক ফোটা জল এই মেলকোটের পর্বত শিখরে পতিত হয় এবং সেই জল থেকেই পঞ্চকল্যাণ সরোবরের উৎপত্তি। পদ্মপুরাণ ও মৎস্যপুরাণ অনুসারে, গরুড়দেব শ্বেতদ্বীপ থেকে শ্বেত মৃত্তিকা এনে এই কল্যানী সরোবরে স্থাপন করে ।

তীরু নারায়ণ স্বামী মন্দির

তীরু নারায়ণ স্বামী মন্দিরটি মেলকোটের প্রধান মন্দির। তামিল শব্দ ‘তীরু’ শব্দের অর্থ ‘শ্রী’। মন্দিরটি বর্গাকার। দেখতে অনেক বিশাল হলেও এর অঙ্গসজ্জা খুব সাধারণ। কথিত আছে, ভগবান নারায়ণ মেলকোটে আসেন ব্রহ্মার মাধ্যমে। ব্রহ্মা প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্তে এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। ভগবান ব্রহ্মার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দান করেন, তিনি এই স্থানে দিব্য মন্দির রূপে অনন্ত কাল বিরাজ করবেন। তীরু নারায়ণ মন্দিরটি সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্মিত নয় তা স্বয়ং প্রকটিত। তাই এটি পঞ্চরত্নম নামে খ্যাত । মন্দিরে প্রবেশদ্বারের সম্মুখেই পাঁচ থেকে ছয় ফুট উঁচু তীরু নারায়ণ বিগ্রহ সর্বদা দণ্ডায়মান। একজন পূজারী সর্বদা বিষ্ণু অষ্টোসহস্রোত্তর মন্ত্র (১,০০৮) বিষ্ণু নাম পাঠ করে। ভগবান তার এক হস্তে অভয়, অন্য তিন হস্তে শঙ্খ, চক্র ও গদা ধারণ করেন। রামানুজ আচার্য এই বিগ্রহটি আবিষ্কার করেন। রামানুজ আচার্য স্বয়ং ভগবান কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই বিগ্রহকে পাহাড়ের শিখরে পিঁপড়ার ডিবির মধ্যে থেকে উদ্ধার করেন। মন্দিরের প্রবেশ পথের দক্ষিণ ভাগে আরেকটি আলাদা মন্দিরে ছোট নারায়ণ বিগ্রহ পূজিত হয়। মূলত এটি হল তীরু নারায়ণের বিজয় বিগ্রহ। এই বিগ্রহটি চেলুব নারায়ণ, চেলুব পিল্লাই, সম্পদ কুমারা এবং রাম প্রিয়া নামে খ্যাত। ‘রাম প্রিয়া’ শব্দের অর্থ যিনি “রামের খুব প্রিয়’। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এই বিগ্রহকে গভীর প্রেমে সর্বদা অর্চন করতেন।নারদীয় পুরাণ অনুসারে নারদ মুনিকে ঋষিরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে মুনিশ্রেষ্ঠ! ভগবান রামপ্রিয়া কিভাবে এস্থানে এসেছিলেন?” তিনি তাদের বলেন, “সর্ব প্রথম এই বিগ্রহ ব্রহ্মাকে আরাধনা করার জন্য প্রদান করা হয়। ব্রহ্মা তাঁর পুত্র সনৎ কুমারকে দেন, পরবর্তীতে বিষ্ণু অনন্ত শেষকে আদেশ করেন অনন্ত শেষ যেন পর্বত রূপে। মেলকোটে আবির্ভূত হয়ে ভগবানের আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে। সনৎ কুমার এই বিগ্রহ মেলকোট পর্বত শিখরের ওপরে মন্দিরে স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সনৎ কুমার এই বিগ্রহ সেবার ভার অর্পণ করেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে। শ্রীরামচন্দ্র তার পুত্র কুশকে সেবা ভার অর্পণ করেন। কুশ পরবর্তীতে তার কন্যার বিবাহে উপহার হিসেবে তাকে এই বিগ্রহ প্রদান করেন। কুশ দুহিতার বিবাহ হয় যদুবংশে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন যদুবংশে যার ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণও এই বিগ্রহের সেবার অধিকার লাভ করেন। একসময় ক্ষীরসমুদ্রে শায়িত ভগবান বিষ্ণুর মস্তকে শোভিত হীরার মুকুটটি চুরি করে নিয়ে আসে বিরোচন। বিরোচন ছিল প্রহ্লাদ মহারাজের বংশোদ্ভূত। ভগবান নৃসিংহদেব প্রহ্লাদ মহারাজকে বর প্রদান করেছিলেন, তিনি তাঁর বংশের কাউকে হত্যা করবেন না। তাই গরুড়দেব বিরোচনকে হত্যা করে মুকুটটি পুনঃরায় উদ্ধার করেন। গরুড়দেব মুকুটটি উদ্ধার করে আসার পথে দেখতে পান শ্রীকৃষ্ণ তার গোপসখা ও গাভীদের নিয়ে ক্রীড়া করছে। গরুড়দেব শ্রীকৃষ্ণকে চিনতে পেরে তাকে সেই মুকুটটি প্রদান করে । কৃষ্ণ সেই মুকুটটি রামপ্রিয় বিগ্রহের মস্তকে পড়ান। সে থেকে মুকুটটি ব্রজমুক্তি নামে পরিচিত।” মন্দিরের একটি বিশেষ উৎসব হলো বাইরামোদি ব্রহ্ম উৎসব। বিগ্রহকে শুধুমাত্র এইদিনেই মুকুটটি পড়ানো হয়। যখন বলরাম তীর্থ পরিক্রমা শেষে দ্বারকায় পৌঁছেন তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বলেন, “তাদের রামপ্রিয়া বিগ্রহের মতো অবিকল আরেকটি বিগ্রহ তিনি মেলকোটে দর্শন করে এসেছেন।” তখন তারা রামপ্রিয়াকে মেলকোটে তীরুনারায়ণ মন্দিরে তীরু নারায়ণের বিজয় বিগ্রহ রূপে স্থাপন করেন। রামপ্রিয়া ও তীরু নারায়ণ বিগ্রহ দুটি এতটাই অবিকল যে, বিগ্ৰহ দুটির মধ্যে পার্থক্য নিরূপন করা কঠিন। এরপর থেকে সমস্ত যদুকুল তাদের পারিবারিক বিগ্রহ হিসেবে সেবা-পূজা করেছেন। তাই রামপ্রিয়া বিগ্রহের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটি ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক পূজিত। এই ইতিহাস চলতে থাকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ।একাদশ শতাব্দীতে শ্রী রামানুজ আচার্যের শিক্ষার প্রভাবে বিউটি দেব নামে এক জৈন রাজা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে যবন রাজ কর্তৃক নারায়ণ পুরাম আক্রা ন্ত, বিধ্বস্ত ও লুণ্ঠিত হয়। যবন রাজ অন্যান্য নারায়ণ বিগ্রহের সাথে রামপ্রিয়াকেও লুট করে নিয়ে যান। কিন্তু রামানুচার্য বিষ্ণু কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই বিগ্রহটি কোথায় আছে তা জানতে পারেন। তিনি দেখতে পান যদুগিরি নামক পর্বতে একটি পিঁপড়ার ডিবি তুলসী বৃক্ষ দ্বারা চারদিক থেকে ঘেরা এবং সেই পিপড়ার ডিবির মধ্যে অনেকগুলো বিগ্রহ। তিনি সেখান থেকে তীরু নারায়ণকে উদ্ধার করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। বিট্টদেব পরবর্তীতে যিনি বিষ্ণুবর্ধন নামে খ্যাত হন তার গুরুসেবার অংশ হিসেবে এই তিরু নারায়ণ মন্দিরটি পুনঃনির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আরো পাঁচটি বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেন। রামানুজ আচার্য পাহাড় থেকে প্রাপ্ত বিগ্রহগুলো সেই মন্দিরগুলোতে প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঁচটি মন্দিরকে পঞ্চ নারায়ণ মন্দির নামে আখ্যায়িত করা হয়। যবন রাজ যেসব বিগ্রহগুলো লুট করে দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছিলেন সে বিগ্রহগুলোর মধ্যে ছিল রামপ্রিয়া । যবন রাজকন্যা এই বিগ্রহটি দেখে খুব মুগ্ধ হন এবং তার খেলার পুতুল হিসেবে এটিকে নির্বাচন করেন। রামানুজ আচার্য স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে তার শিষ্যসহ দিল্লির দরবারে গিয়ে যবন রাজের কাছে বিগ্রহটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। রামানুজ আচার্যের এই অনুরোধ শুনে যবনরাজ অট্টহাস্যে বলেন, “আমার সংগ্রহশালায় অনেক বিগ্রহ আছে। তার মধ্য থেকে যেটি আপনার বিগ্রহ তাকে নাম ধরে ডাকুন। তিনি যদি স্বয়ং আপনার সম্মুখে উপস্থিত হন তবে আপনি বিগ্রহটি নিয়ে যেতে পারবেন।” তখন রামানুজ আচার্য রামপ্রিয়া বলে হুংকার দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিগ্রহটি তার হাতের ওপর এসে উপস্থিত হয়। এরপর বিগ্রহ নিয়ে রামানুজ আচার্য মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যেহেতু যবন রাজকন্যা বিগ্রহটির প্রতি আসক্ত ছিল তাই তিনিও তখন মেলকোটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কিন্তু সে যবন হওয়ায় মন্দিরের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবুও রামপ্রিয়া তার প্রতি বিমুখ হননি পরিণামে তিনি চিরমুক্তি লাভ করেছিলেন। সমাপ্ত হয়েছিল তার অন্তহীন যাত্রা। বিগ্রহের কাছে এখনো সেই যবন কন্যার মূর্তি মন্দিরে পূজিত হয়। রামপ্রিয়া বিগ্রহটি গর্ভ মন্দিরের ঠিক সামনে রঙ্গ মণ্ডপম্ নামক একটি প্রকোষ্টে বিরাজমান যা প্রবেশদ্বারের ঠিক দক্ষিণে। রামপ্রিয়া বিগ্রহ ছাড়াও মন্দির চত্বরে বৈকুণ্ঠনাথ, চক্রতু আলোয়ার, অঞ্জনে প্রভৃতি বিগ্রহের মন্দির আছে। এছাড়াও যদুগিরি নাচিয়ার (লক্ষ্মীদেবী) এবং কল্যাণী নাচিয়ারের অপূর্ব সুন্দর মন্দির মূল মন্দির চত্বরের বাইরে অবস্থিত ।
লক্ষ্মীদেবীর মন্দির অতিক্রম করে যাওয়ার পর একটি বিস্তৃত কক্ষে অনেকগুলো স্তম্ভের সারি দেখতে পাওয়া যায় । প্রত্যেকটি স্তম্ভ বৈশিষ্ট্যগতভাবে অন্যন্য। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে কারুকাজ অন্যটি থেকে আলাদা। স্তম্ভের গায়ে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, বিষ্ণুর বিভিন্ন অস্ত্র ও রামানুজ আচার্যের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন ঘটনা খোদিত আছে। এই স্তম্ভগুলোর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে স্তম্ভগুলোকে একটি পাথর থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে অর্থাৎ স্তম্ভগুলো কোথাও জোড়া নেই। মন্দিরটিকে ঘিরে বিভিন্ন বৈষ্ণব সন্তদের মন্দিরও আছে। সেসব মন্দিরগুলোর মধ্যে রামানুজ আচার্যের মন্দিরটি অন্যতম। শ্রী রামানুজ আচার্য যখন রঙ্গনাথ থেকে মেলকোটে এসেছিলেন তখন তাঁর বিগ্রহ সমেত এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে তিনি বার বছর অতিবাহিত করেন। যখন তিনি মেলকোট থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর অনুসারীদের অনুরোধে তিনি তাঁর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। সেজন্য শ্রী সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের কাছে এই স্থানটি বিশেষভাবে মহিমান্বিত ।

মেলকোটের এই মন্দিরটি মহিসুরের রাজ পরিবার দ্বারা সর্বদাই

পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এসেছে। মন্দিরের ধন ভাণ্ডারও খুব সমৃদ্ধ । এই ধন ভাণ্ডারে এমন সব রত্ন আছে যা বহু রাজার ভাণ্ডারেও নেই। মহিসুরের রাজা উদয়ার যিনি সর্বপ্রথম শ্রীরঙ্গা পাঠনা অধিকার করেন, তিনি ছিলেন শ্রী সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব রাজা। তিনি সমগ্র মন্দিরের ভূমি, বিগ্রহ এবং মেলকোটের ব্রাহ্মণদের নামে দান পত্র করেন। তিনি এই সমগ্র ভূমি বিজয় নগরের রাজা বেঙ্কটপতি রায়য়া থেকে ক্রয় করেছিলেন। তার এই কৃতিত্বকে অমর করে রাখার জন্য তীরু নারায়ণ স্বামী মন্দিরে রাজা উদয়ারের দণ্ডায়মান মূর্তি খচিত একটি বিশাল স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। রাজা ছিলেন বিগ্রহের পরম ভক্ত এবং মন্দিরের একজন নিত্যদর্শনার্থী। তিনি স্বর্ণ, মণি, মাণিক্য, হীরা খচিত বহু অলঙ্কার প্ৰদান করেন। তার প্রদত্ত অলঙ্কারগুলোর মধ্যে মুকুটটি বেশ প্রসিদ্ধ এখনো তা বিগ্রহের মস্তকে শোভা পাচ্ছে। মেলকোট মন্দিরে এই মুকুটটি রাজমুদি নামে প্রসিদ্ধ। মন্দিরের পূজারীদের মুখে শোনা যায় মৃত্যুর পরও সেই রাজাকে বহুবার গর্ভ মন্দিরে প্রবেশ করতে দেখা গিয়েছে কিন্তু বেরিয়ে যেতে দেখা যায় নি। তার পরবর্তী উত্তরসুরী রাজা উদয়ার বিগ্রহের বহু মূল্যবান অলঙ্কার দান করেন। মহিসুরের অন্যতম শাসক টিপু সুলতানও তীরু নারায়ণের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তিনি বিগ্রহের শোভাযাত্রার জন্য বহু হাতি উপহার হিসেবে প্রদান করেন ।

তীরু নারায়ণ স্বামী মন্দিরের প্রধান উৎসব বায়রামুদি ব্রহ্ম উৎসব

বায়রামুদি ব্রহ্ম উৎসব হলো মন্দিরের একটি বার্ষিক মহোৎসব যেখানে প্রতি বছর প্রায় তিন থেকে চার লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। উৎসবের দিনগুলোতে বায়রামুদি নামক সেই জগৎ বিখ্যাত মুকুটটি তীরু নারায়ণ পরিধান করে থাকেন। যা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তীরু নারায়ণকে প্রদান করেছিলেন। এই সময়ে ভগবান স্বর্ণময় গরুড়দেবের পিঠে আরোহণ করে তার নিত্য সঙ্গী ভূদেবী ও শ্রীদেবীসহ মেলকোটের রাস্তা পরিক্রমা করেন। জনশ্রুতি আছে বিরোচন কর্তৃক ক্ষীরোদকশায়ী সমুদ্রে শায়িত বিষ্ণুর মস্তক হতে এই মুকুটটি চুরি হওয়ার পর বিষ্ণুর আদেশে বিরোচনকে বধ করে গরুড়দেব এই মুকুট উদ্ধার করে নিয়ে আসার সময় মুকুটের মধ্যস্থলে নীলকান্ত মণিটি মেলকোটের নিকটে নাচিয়ারকলিতে পতিত হয় । এটি তামিলনাডুর জেলা শহর। নীলকান্ত মণিটি যে স্থান থেকে পতিত হয় সে স্থান থেকে একটি জলধারা উত্তিত ঐ স্থানে নদীরূপে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্ম উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয় কমপক্ষে দুইমাস থেকে এবং উৎসবটি পালিত হয় তেরদিন ধরে। তেরদিনের এই উৎসবের মধ্যে গরুড় উৎসব নামে একটি উৎসব পালিত হয় । মুকুটটি রক্ষিত থাকে মেলকোটের প্রশাসকের কাছে। প্রতি বছর এই দিনে প্রশাসক স্বয়ং এসে এই মুকুটটি মন্দির কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে। মুকুটের গায়ে এমন সব রত্ন খচিত আছে যা একটি অন্ধকার গৃহকে আলোকিত করতে সক্ষম। প্রশাসন কর্তৃক মুকুটটি যতদিন মন্দিরে থাকে সেটিকে বিশেষ সুরক্ষা প্রদান করা হয়। উৎসবের প্রতি রাতে তীরু নারায়ণ এই মুকুটটি পড়ে সমগ্র রাস্তা পরিক্রমা করেন । এই সময় শোভাযাত্রার কেন্দ্রস্থলে যে স্থানে তীরু নারায়ণ অবস্থান করেন সেই স্থানে কোনো আলো থাকে না। মুকুটের আলোতে সমগ্ৰ কেন্দ্রস্থলটি | আলোকিত হয়ে থাকে ৷ ঐতিহ্যগতভাবে মন্দিরে প্রধান পুরোহিত এটি তীরু নারায়ণের মস্তকে স্থাপন করেন। উল্লেখ্য এই সময় প্রধান পুরোহিতের চক্ষু কালো বস্ত্ৰ দ্বারা আবৃত থাকে। প্রধান পুরোহিত চোখ বন্ধ অবস্থায় তীরু নারায়ণের সস্তকে এই মুকুটটি স্থাপন করে। জনশ্রুতি আছে, যদি প্ৰধান পুরোহিত সুনিপুণভাবে কোনো সময় মুকুটটি তীরু নারায়ণের মস্তকে স্থাপন করতে অক্ষম হন তবে জগতের বিশাল ক্ষতি সাধিত হবে। মুকুটটি স্থাপনের সময় সমগ্র মন্দির কক্ষ অন্ধকার করে রাখা হয় এবং সে দিন বিগ্রহ তার রত্ন খোচিত পোশাক পরিধান করেন। মুকুট ও পোশাকের রত্নের আলোকে মন্দির গৃহ আলোকিত হয়। উৎসবের তেরদিন ধরে তীরু নারায়ণ এই মুকুটটি পরিধান করেন। উৎসবের দিনগুলোতে কল্যাণীস্তব, নাগাবালী মহাস্তব প্রভৃতি মহা কল্যাণদায়ীনী স্তব দ্বারা ভগবান তীরু নারায়ণকে প্রসন্ন করা হয়।

মেলকোটের পার্শ্ববর্তী দর্শনীয় স্থানসমূহ বেলুঢ়-চেন্নাই কেশব মন্দির

রাজা বিষ্ণু বর্ধনের রাজত্ব কালীন সময়ে বেলুড়ে বহু বিষ্ণু মন্দির নির্মিত হয় তার মধ্যে চেন্না কেশব মন্দিরটি প্রধান। মন্দিরে চতুর্ভূজ কেশব মূর্তি পূজিত হয় যা ব্রহ্মা কর্তৃক পূজিত হয়েছিল সত্যলোকে। পরবর্তীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কর্তৃক এই বিগ্রহ পৃথিবীতে আনিত হয়। তিনি এই বিগ্রহ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেবা করে গিয়েছেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পর রাজা বিষ্ণুবর্ধন এই বিগ্রহের সেবা পূজা করেন। রাজা বিষ্ণুবর্ধন এই বিগ্রহটি পুনঃউদ্ধার করেন। একদিন রাজা বিষ্ণুবর্ধন এই স্থানটিতে ভ্রমন করছিলেন। ভ্রমন করতে করতে রাজা নগরের শেষ প্রান্তে এসে একটি বিশাল সরোবর দেখতে পান। হঠাৎ তিনি এক আশ্চর্য ঘটনা দেখতে পান। একটি কুষ্ঠ রোগাগ্রস্ত লোক সেই সরোবরে স্নান করতে যান কিন্তু লোকটি সরোবরে ডুব দেবার পর পরই সুস্থ শরীরে জল থেকে উঠে আসেন। এই ঘটনা রাজাকে স্তম্ভিত করে। রাজা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন যে, এটি একটি বিশেষ সরোবর। সরোবরটি বিষ্ণুর সমুদ্র নামে পরিচিত।
জনশ্রুতি আছে যখন গরুড়দেব অমৃত কলস নিয়ে আকাশ মার্গে যাচ্ছিলেন। তখন অমৃত কলস থেকে এক ফোটা অমৃত এই স্থানে পতিত হয়। সেই এক ফোটা অমৃত থেকে এই সরোবরের উৎপত্তি। রাজা তখন তার রাজ প্রাসাদে ফিরে যান। সেইদিন রাতেই ভগবান রামানুচার্য ও রাজা বিষ্ণুবর্ধনকে একই সময়ে স্বপ্নাদেশ দেয়। ভগবান রাজাকে বলেন, “আমি চন্দ্ৰদ্ৰোণ পর্বতে অবস্থান করছি তুমি আমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করে সেবা-পূজার ব্যবস্থা কর।” রাজা চন্দ্রদ্রোণ পর্বত থেকে বিগ্রহকে শ্রীনারায়ণ পুরে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে সেখানে থেকে বেলাপুরাই নিয়ে আসেন যা বর্তমানে বেলুর নামে পরিচিত। মন্দিরটি ধূসর সবুজ কোরাল পাথর দ্বারা নির্মিত এবং মন্দিরের সমগ্র দেওয়াল ও চূড়া মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনি দ্বারা খোদিত। ‘চেন্না’ শব্দের অর্থ হচ্ছে খুব সুন্দর, ‘কেশব’-কেশব শব্দের অর্থ হচ্ছে “যিনি কেশী নামক দানবকে হত্যা করেছেন’। কেশবের আরেকটি অর্থ যার সুন্দর ঘনকালো লম্বা কেশ রয়েছে এই অর্থটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেশব শ্রীকৃষ্ণের লম্বা ঘনকালো কেশযুক্ত একটি ছয় ফুট উঁচু চতুর্ভুজ বিগ্রহ। বিগ্রহটি এক মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত। চার হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। মন্দিরের দক্ষিণভাগে কাপ্পাচেননিগা রায়য়া নামে আরেকটি মন্দির আছে । মন্দিরে দুটি বিগ্রহ প্রকোষ্ট আছে। বিগ্রহদ্বয়গণ হলো কাপ্পাচেননিগা রায়য়া ও বেনুগোপাল এর পাশেই সোমানায়তি মন্দির। এই মন্দিরটির গম্বুজ বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। মন্দিরের পশ্চিমে অর্থাৎ বীর নারায়ণ মন্দিরের পেছনে রয়েছে লক্ষ্মীদেবীর মন্দির। মন্দিরের দেওয়াল কারুকার্য শোভিত, এই কারুকার্যের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে হস্তি । সমগ্র মন্দিরের দেওয়ালে মোট ৬৪৫টি হস্তি চিত্র আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিটি হস্তিমূর্তি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য যুক্ত। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে স্তম্ভের মধ্যে অনেকগুলো বিষ্ণু বিগ্রহ খোদিত আছে। পৌরাণিক চিত্রগুলোর মধ্যে আছে বামন ও বলির কাহিনি, ভক্ত প্রহ্লাদ ও নৃসিংহদেবের কাহিনি ও কৃষ্ণের কংসবধ কাহিনি। এছাড়াও আছে কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলায় বধকৃত সমস্ত অসুরদের কাহিনি। এই মন্দিরের আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হলো মন্দিরের অভ্যন্তরে মণ্ডপম্ হলে কাঁচের বাক্সের মধ্যে রয়েছে একজোড়া বিশেষ চপ্পল । স্থানীয় মুচিরা বিশ্বাস করে যে, প্রতিদিন ভগবান এই চপ্পল জোড়া পায়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী বাবুধুদানগিরি পর্বতে অবস্থিত লক্ষ্মীদেবীর মন্দিরে সাক্ষাৎ করতে যান। চপ্পল জোড়া পড়তে পড়তে যখন মেরামতের প্রয়োজন হয় তখন ভগবান প্রধান মুচিকে এক স্বপ্নাদেশ দেন মুচি তখন মন্দিরে এক গামলা কুম কুম রেখে আসেন। ভগবান যাওয়ার সময় কুম কুমে চরণ ডুবিয়ে মন্দিরের মেঝেতে পদ চিহ্ন রেখে যান। প্রধান মুচি সেই পদ চিহ্ন অনুসারে নতুন চপ্পল তৈরি করেন। মন্দিরের বাইরে যুদ্ধরত একটি সিংহমূর্তি আছে। সিংহটি হয়সেলা রাজ বংশের প্রতিভূ।

হেইলিবাদ-হয়শেলেশ্বর মন্দির

এই শহরটি হয়শেলের রাজধানী। এটি পূর্বে দোয়ারা সমুদ্র নামে পরিচিত ছিল। দিল্লির সুলতান এটি হেইলবাদ নামকরণ করেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মিত হয়শেলেশ্বর এর মন্দিরটি মূলত একটি শিব মন্দির। মন্দিরটি নির্মাণ হতে ৮৭ বছর সময় লেগেছে, কেননা নির্মাণাধীন সময়ে দিল্লীর সুলতান দ্বারা হেইলবাদ আক্রান্ত হলে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। মূল মন্দির ও গর্ভ মন্দির দুই ভাগে বিভক্ত । এই মন্দিরে দুটি নন্দী বিগ্রহ আছে একেকটি বিগ্রহ ষোল ফুট উঁচু। এরা ভারতের সপ্তম বৃহৎ বিগ্রহ। মন্দিরের দেওয়ালে অপূর্ব কারু কার্য সমন্বিত বিশ হাজারটি প্রস্থর আছে। এর মধ্যে পৌরাণিক ঘটনা হাতি, বাঘ, সিংহ ও ঘোড় সওয়ারি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে বারশোটি হস্তিমূর্তি আছে দেওয়ালে। পৌরাণিক কাহিনি গুলোর মধ্যে স্থান করে আছে শিব পুরাণের কাহিনি ছাড়াও কৃষ্ণ, বিষ্ণু লীলা ও রামায়ণ, মহাভারতের ঘটনা ।

সোমনাথ পুর

সোমনাথপুর মন্দিরটি মহিসুর থেকে ৪০ কিলোমিটার পূর্বে । এটি মূলত বিষ্ণু মন্দির, এটি ১২৬৮ খ্রিষ্টাব্দে হয়শেলা রাজ বংশীয় রাজা সোমনাথ কর্তৃক নির্মিত হয়। কথিত আছে যে, এই মন্দিরটি এতই সুন্দর যে, দেবতারা পর্যন্ত এটির দ্বারা মোহিত হয়ে চুরি করে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। মন্দিরটি দেখতে তারকা আকৃতির। মূল মন্দিরের অভ্যন্তরে তিনটি ছোট মন্দির আছে। তিনটি ছোট মন্দিরে তিনটি বিগ্রহ, বিগ্ৰহত্রয় হলেন-শ্রীকেশব, শ্রীজনার্দন ও শ্রীগোপাল। শ্রীকেশবজী বিরাজ করছেন মধ্যস্থ মন্দিরটিতে, জনার্দন বিরাজ করছেন উত্তরের মন্দিরে, শ্রীগোপাল দক্ষিণে বিরাজ করছেন । সারা মন্দির জুড়ে বিভিন্ন বিষ্ণু মূর্তি খোদিত আছে যার মধ্যে নৃসিংহ, বরাহ, বেনুগোপাল প্রধান। দেব-দেবীদের মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মা, শিব, লক্ষ্মী, দুর্গা, সূর্য ইত্যাদি। প্রতি বছর বহুলোক এই মন্দির দর্শন করে ভগবানের কাছে কৃষ্ণ ভক্তি প্রার্থনা করে।

জ্যোতি শীলা

যখন রামানুজ আচার্য শ্রীরঙ্গম থেকে মেলকোটে আসেন তখন সন্ন্যাসী হওয়া সত্ত্বেও তার গায়ে গৈরিক বসনের পরিবর্তে ছিল শ্বেত বসন। এক শৈব রাজা রামানুজ আচার্যকে হত্যা করার জন্য লোক প্রেরণ করলে তার এক শিষ্যের অনুরোধে তিনি শিষ্যের শ্বেত বসন ধারণ করে গোপনে শ্রীরঙ্গম থেকে পালিয়ে আসেন । জনশ্রুতি আছে, ভগবান দত্তাত্রেয় এই স্থানে আবির্ভূত হয়ে স্বয়ং রামানুজ আচার্যকে পুনঃরায় গৈরিক বসন প্রদান করেন। এই ঘটনাকে অম্লান করে রাখার জন্য এ স্থানে একটি মন্দির স্থাপিত হয়েছে।

ধনুষ্কুটি

জ্যোতি শীলা থেকে কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর পর্বতের পাদদেশে এই স্থানটি দেখতে পাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে যে, ভগবান রামচন্দ্র তার ধনুকের বাণের মাধ্যমে এই স্থানে গঙ্গাকে প্রকট। করেন। এখনো সেই গঙ্গা প্রবাহমান । ছোট্ট একটি গিরি গহ্বর থেকে কুল কুল রবে গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে রাম-সীতা ও লক্ষ্মণের মন্দির আছে।

মেলকোট মন্দিরের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

নারায়ণাদ্রি নারায়ণ নামক পর্বত; বদ্রীবেদা পর্বত- এখানে ভগবান দত্তাত্রেয় তার শিষ্যদের বেদ শিক্ষা দিয়েছিলেন; যাদবাদ্রি-কৃষ্ণ ও বলরাম এই স্থানে ভগবানের পূজা করেছিলেন; তীরু নারায়ণ পুরা এই স্থানটি নারায়ণের গৃহ নামে পরিচিত। ভূলোক বৈকুণ্ঠ-এই স্থানটিকে বৈকুণ্ঠলোকের সাথে অভিন্ন তুলনা করা হয়; বৈকুণ্ঠ বর্ধনা কেষ্ট্রা এই স্থানটি বিষ্ণুর গৃহ । যে স্থান থেকে সর্বপ্রথম পৃথিবীতে প্রজা সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল; জ্ঞান মণ্ডপ-এটি জ্ঞান চর্চার মুখ্য ভূমি নামে পরিচিত, এই স্থানে অজ্ঞানী ব্যক্তিদেরও জ্ঞান লাভের কথা শোনা যায়, দক্ষিণ বদ্রীকা আশ্রম একে বদ্রীনাথ থেকে অভিন্ন জ্ঞান করা হয়, দোদা গাড়ু ডাঙাহালি-এই স্থানটি মন্দিরের অদৃশ্য দিব্য প্রহরীদের আবাস ভূমি, যারা লক্ষ্যে থেকে সর্বদা মন্দির সংলগ্ন সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, দোদাগুরু গালাহালি-এটি মহান গুরু শ্রীরামানুচার্যের নিবাস ভূমি ।


 

এপ্রিল-জুন ২০১৭ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।