মৃত্যুর পূর্বে ও পরে কি করণীয়?

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৩ | ২:৩৮ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৩ | ৫:২০ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 176 বার দেখা হয়েছে

মৃত্যুর পূর্বে ও পরে কি করণীয়?

আমাদের জীবনের অন্তিম পরীক্ষার মুহূর্তে সফল হওয়ার ব্যবহারিক নির্দেশনা

আনন্দ মূর্তি দাসেআসন্ন

আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ:
১. জীবন সম্পর্কিত সকল আগ্রহ লুপ্ত হওয়া
২. পৃথিবী সম্পর্কে নীরস ধারণা
৩. খাবারে স্বাদহীনতার অনুভূতি
৪. কোন কিছুর অনুপস্থিতি উপলব্ধি
৫. সব কিছুতেই অনুশোচনা প্রকাশ
৬. অবিনশ্বরতা উপলব্দি
৭. কিছু গৌণ চিহ্ন: নাক শাণিত হয়, দেহটিকে আলাদা বলে মনে করা, কোন প্রকারের মুখের ভাব প্রকাশিত না হওয়া।
মৃত্যুর পদ্ধতি:
১. সমগ্র দেহ অনেক ভারী বলে মনে হয়, বাহ্যিকভাবে শুধুমাত্র চোখ ব্যতীত দেহের অন্যান্য অংশের উপর নিজের সকল নিয়ন্ত্রণ যখন একজন মানুষ তাঁর মৃত্যুর বিভিন্ন ধাপসমূহ সম্পূর্ণ স্পষ্টরূপে অবগত থাকবে তখন তাঁর কোন মৃত্যুর ভয় থাকবে না বরং তিনি ভগবানের শ্রীনাম গ্রহণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার মাধ্যমে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবেন। প্রত্যেকে তাঁদের জাগতিক জীবনের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত। মৃত্যুর সময় মন বিভিন্ন প্রকারের চিন্তার উদ্রেক করতে থাকে এবং সেই মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগ্রত হয় এবং এই ইচ্ছা পোষণের ফলে জীব পরবর্তী জড় দেহ লাভ করে (কিন্তু সেই নতুন দেহটি মানুষ না হয়ে কোন কুকুর কিংবা বৃক্ষও হতে পারে)। জড় জগতে যতই নাস্তিকতা প্রদর্শন করুক কিংবা খামখেয়ালী হোক না কেন মৃত্যুর সময় সকলেই ভগবানকে বিশ্বাস করতে বাধ্য। মৃত্যুর মুহূর্তে একজন ব্যক্তি পরমাত্মা হতে একটি জ্যোতি উৎসরণ হতে দেখেন (এটি ভগবানের প্রকাশ যা আমাদের হৃদয় অভ্যন্তরে অবস্থিত)। যখন আত্মা মধ্য পথ (নদী) দিয়ে গমন করে, মনে হয় যেন একটি নলের বা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গমন করছে এবং এই সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি জ্যোর্তিময় আলোক। প্রাথমিক অবস্থায় সেই জ্যোতির্ময় প্রভা দেখা মাত্রই এবং যেই মাত্র আমাদের অনুভূতি সমূহের অন্ত হবে, তৎক্ষণাৎ আমাদের উচিত পরমেশ্বর ভগবানের নাম জপ ও প্রার্থনা জানানো।

এরপর দ্বিতীয় প্রকারের জ্যোতি/ আলোক (আরো মৃদু) আমাদের সম্মুখে তখনই প্রকাশিত হবে যখন প্রাথমিক সেই জ্যোতি আমাদের নজরে আসবে না এবং যখন আত্মা ইতিমধ্যে দেহত্যাগ করেছে। সেটি হবে মৃত্যুর সময় ভগবানের মুখাপেক্ষি হওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ। এভাবে পরমাত্মা আত্মার সাথে সাথেই গমন করে। হারায়। সেই মুহূর্তে আমাদের অবশ্যই ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতে হবে অথবা ভগবানের নাম বারংবার জপ করতে হবে (মুখে বলা সম্ভব যদি না হয় তবে মনে মনে, চেতনার মাধ্যমে)।
২. এরপর প্রবল ঠাণ্ডা অনুভূত হয়, শরীর ঠাণ্ডা হয় এবং পরে জ্বর আসে। দৃষ্টিশক্তি থাকে না। এই সময় আমাদের প্রার্থনা ও ভগবানের নাম জপ চালিয়ে যেতে হবে এবং জ্যোতির সাথে মিলনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
৩. তখন হাজার হাজার বৃশ্চিকের অসহ্য কামড়ে (প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হবে) দেহ টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হবে। বাহ্যিকভাবে সেই অবস্থাটি অন্যরা কিভাবে বুঝতে পারবে? সেই মুমূর্ষ ব্যক্তিটি জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকবে। এভাবে সুক্ষ্ম দেহটি স্থূলদেহ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে দেহের সমস্ত অনুভূতির বিনাশ ঘটবে, কিন্তু আত্মা তখনও আমাদের হৃদচক্রে অবস্থান করবে। আমাদের অবশ্যই সেই মুমূর্ষ ব্যক্তির সাথে কথা বলতে হবে। তার নাম ধরে বলতে হবে: “আপনি ভয় পাবেন না, এখন আপনি একটি জ্যোতি দেখতে পাবেন, তাতে সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করুন এবং সেখানে প্রবেশ করুন । ভগবানের নিকট প্রার্থনা করুন।” ৪. যদি সেই মুমূর্ষ ব্যক্তি তখনও ভগবানের সম্মুখবর্তী হতে ব্যর্থ হন এবং দেহত্যাগ করেন তবে মৃত্যুর সাথে সাথে নিজের দেহ ও তাঁর সন্নিকটে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে পাবেন। তিনি একইসাথে তাদের দুঃখ, কান্না, বিলাপ, ভয় এবং হারানোর ব্যথা দর্শন করবেন। কিন্তু আমাদের উচিত বিলাপ না করে মৃত ব্যক্তিকে আশ্বস্থ করে তাঁর নাম ডেকে বলা “আপনি কোন কিছুতে ভয় পাবেন না, সবকিছু ভুলে যান, সবকিছু। আপনার সম্মুখে একটি জ্যোতি আবির্ভূত হবে: ইনিই আপনার ত্রাণকর্তা।”
৫. এরপর একসময় সেই জ্যোতি অন্তর্হিত হবে, যদি সেই জ্যোতির প্রতি আত্মা কোন মনোযোগ দিতে এবং সেখানে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন, তবে তিনি পরবর্তী ৪৯ দিনের জন্য একটি মধ্যবর্তী স্তরে প্রবেশ করবেন, যতক্ষণ না তাঁর পুনর্জন্ম হচ্ছে। আমাদের উচিত মৃত্যুর পর ৪৯ দিন যাবত সেই মৃত ব্যক্তিকে ভগবানের স্মরণ গ্রহণের জন্য নানা নিদের্শনা প্রদান করা। যেহেতু এই সময় সেই মৃত ব্যক্তির আত্মা আপনার আহ্বানে যেকোন স্থান থেকেই চলে আসতে পারেন, সেহেতু প্রতিদিন তাকে আহ্বান করে নিদের্শনা প্রদান করুন। তবে অবশ্যই এই বার্তালাপ হতে হবে মৃত ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত কোন স্থানে যেমন তাঁর বিছানায়, তাঁর ছবির সম্মুখে ইত্যাদি।
৬. নাম ধরে ডেকে তাকে বলুন: “ভগবানের নামবিহীন কোন দেশে জন্মগ্রহণ করার জন্য অগ্রসর হবেন না। একটি আধ্যাত্মিক দেশ চেনার উপায় হল সেখানে বহু মন্দির থাকবে। আপনার মাতা-পিতা নির্বাচনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হবেন না, তাদের ভবিষ্যৎ দেখুন এবং যদি তারা পারমার্থিকতায় যুক্ত থাকে তবে তাদের নির্বাচন করুন” আপনি যদি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য এই সকল নির্দেশনা প্রদান না করেন তবে ৪৯ দিন পর সেই আত্মা সঠিক উপায়ে দেহ ধারণ করতে পারবে না ।
৭. এই জগতের প্রতি আসক্তির কারণে মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে না চাওয়ার আকাঙ্খা সৃষ্টি হয় যা ভঙ্গ হয় আকস্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে। তাই মৃত ব্যক্তির সাথে কথোপকথন খুবই জরুরী। উচ্চৈঃস্বরে তার নাম ডেকে বলুন- “আপনি কোন কিছু নিয়ে অনুতাপ করবেন না, কেবল ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন।”
মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে অন্যেদর যা করণীয়:
আমাদের উচিত সেই মানুষকে কৃষ্ণ নাম গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। কেননা শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় (৮/৯) বর্ণিত হয়েছে, আত্মা কৃ কর্তৃক

যং যং বাপি স্মরন্ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্ ।
তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ ॥
অনুবাদ: অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন ।
তাৎপর্য: যে মানুষ দেহত্যাগ করার সময়ে কৃষ্ণচিন্তা করে, সে পরমেশ্বর ভগবানের পরা প্রকৃতি অর্জন করে। কিন্তু এই কথা ঠিক নয় যে, শ্রীকৃষ্ণবিহীন অন্য কিছু চিন্তা করলেও সেই পরা প্রকৃতি অর্জন করা যায় । …স্বভাবতই, জীবিত অবস্থায় আমরা যে সমস্ত চিন্তা করে থাকি, সেই অনুযায়ী আমাদের মৃত্যুকালীন চিন্তার উদয় হয়। সুতরাং, এই জীবনই সৃষ্টি করে আমাদের পরবর্তী জীবন ।

মৃত্যুর সময় যা করা উচিত নয়

(মুমূর্ষ ব্যক্তির সাথে):
১. তার সাথে জাগতিক কোন বিষয়ে কথা বলা । এ প্রকারের বার্তালাপ তাকে জাগতিক বিষয়ে আরো আসক্ত করবে, গোলমাল সৃষ্টি করবে এবং তিনি দেহত্যাগে ইচ্ছুক হবেন না ।
২. বিদায় জানানো, বিলাপ করা, চিৎকার করা। এর ফলে মুমূর্ষ ব্যক্তির মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় ।
৩. দেহ স্পর্শ করা (এমনকি হাতও), কারণ এর ফলে মৃত ব্যক্তি কর্মের ফলে নির্দিষ্ট পথে গমনের পরিবর্তে অন্যকোন পথে গমনের আশংকা দেখা দেয়। তবে যদি সেই ব্যক্তি অচেতন থাকে তবে অবশ্যই তাকে ঝাকানোর মাধ্যমে জাগ্রত করতে হবে। যখন তিনি জাগ্রত হবেন তখন তাকে বিভিন্ন নিদের্শনা প্রদান করতে হবে।
৪. পারমার্থিক উন্নতির স্থিতি অনুসারে, যদি একটি সূক্ষ্মদেহ দেহের নিম্নতর নদী (ছিদ্রপথ) তথা পায়ুপথ দিয়ে নির্গত হয়, তবে সেই আত্মা পরবর্তী জন্মে কোন পশুর দেহ ধারণ করবে, মধ্যম পথে নির্গত হলে কেউ মনুষ্য দেহ লাভ করবে এবং ঊর্ধ্বপথে নির্গত হলে উচ্চতর লোকে গমন করে। বিশেষত সূক্ষ্ম পথে নির্গত হলে অপ্রাকৃত স্তরে গমন করে।
৫. মৃত ব্যক্তি যদি জীবদ্দশায় অত্যাধিক যৌনজীবনে আসক্ত হন, তবে তার সূক্ষ্মদেহ ও আত্মা নিম্নতর নদী পথে নির্গত হবে এবং তিনি হয় পশুদেহ প্রাপ্ত হবেন অথবা নরকে গমন করবেন। তাই, আমাদের অবশ্যই উচ্চতর চক্রের (ভালোবাসা, দয়া, কৃপা) উন্নয়ন সাধন করতে হবে এবং তাহলে আমাদের সূক্ষ্মদেহ নরক থেকে নিস্তার লাভ করবে।

মৃত্যুর সময় যা করা উচিত

(মুমূর্ষ ব্যক্তির সাথে): ১. ভগবান কৃষ্ণ সর্ম্পকে বলুন, তার লীলা ও তাঁর সম্পর্কিত লেখা পড়ুন । তাঁর সম্পর্কিত লেখা পড়ুন ।

মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যখন মাংস উৎসর্গ করা হয় তখন সে ভয় পায়। তিনি তখন বুঝতে পারেন এই প্রকারের পাপকর্মের ফলেই যমদূতেরা তাকে নরকে নিয়ে যায় । সেই তখন তার আত্মীয় স্বজনের কড়জোড়ে মিনতি করে এই প্রকারের কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য ।


২. তাঁর আসন্ন মুক্তির সম্ভাবনায় আনন্দিত হোন কেননা ভগবানের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য মুমূর্ষ ব্যক্তিকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. জ্যোতির সাথে মিলিত হয়ে মুক্তি লাভের পন্থাসমূহ তাঁকে ব্যাখ্যা করুন।
এই সময় আত্মা অবস্থান করে অনাহত (হৃদচক্রে), যেখানে ৫টি স্তর মিলিত হয়েছে, এটি একটি ঝুলন্ত অবস্থা যাঁর উপর মন নির্ভর করে।
আত্মা তার দেহকে অভ্যন্তর থেকে দেখতে পায় এবং এই কারণে এটি খুবই অন্ধকারময়। পরমাত্মা, সেই আত্মার কর্ম অনুসারে ঊর্ধ্ব কিংবা নিম্ন নদী (আত্মার নির্গমণ পথ) উদ্দিপ্ত করেন এবং সেই মৃত ব্যক্তি সেই সুড়ঙ্গ পথে যেতে যেতে অবশেষে একটি আলোক দেখতে পায়। শুধুমাত্র অত্যাধিক পাপী কিংবা আকস্মাৎ মৃত (উদাহারণস্বরূপ, গাড়ি দুর্ঘটনা) ব্যক্তিগণ এই প্রকারের আলোক দেখতে পান না। সেই আলোক আবির্ভাবের পূর্বেই অত্যাধিক পাপী ব্যক্তিকে সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন ধার্মিক ব্যক্তি সেই জ্যোতির স্পর্শে সুখ লাভ করেন এবং ভক্তগণ সেখানে চতুর্ভূজ বিষ্ণুকে দর্শন করেন। মুমূর্ষ ব্যক্তিকে অবশ্যই জানাতে হবে যে, সেই জ্যোতি হল ভগবান, তিনি তাকে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে রক্ষা করার জন্য এসেছেন।
স্থূলদেহ থেকে সেই সূক্ষ্মদেহ ও আত্মা মুক্ত হওয়ার পর একপাশ থেকে নিজের মৃত দেহ ও আত্মীয়-স্বজনদের দর্শন না করে তৎক্ষণাৎ ভগবানের শরণাগত হওয়া উচিত। মৃত্যুর মুহূর্তটি হল একটি সুড়ঙ্গ পথে গমন করা এবং ভগবানকে স্মরণ করা ও আহ্বান করা ।
 ১. সাধারণ নিদের্শনা: “যা কিছু হোক না কেন, ভগবানকে আহ্বান করুন।”
২. মুমূর্ষ ব্যক্তির দুঃখ দূর করার জন্য তাকে ভগবানের শক্তির কথা স্মরণ করাতে হবে: “যদি আপনি ভগবানের স্মরণ গ্রহণ করেন, তবে আপনি একটি নিত্যদেহ লাভ করবেন যেখানে আপনার স্মৃতিশক্তি হবে প্রখর এবং আপনি সকল ইহজাগতিক ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হবেন। আপনি আপনার পূর্বের এবং পরের ১০০ প্রজন্মকে উদ্ধার করতে পারেন (যদি তিনি মুক্ত ব্যক্তি হোন)।” মুমূর্ষ ব্যক্তির মৃত্যুভয় দূর করে তাকে ভগবানের স্মরণ গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মৃত্যুর প্রক্রিয়া

মৃত্যুর মুহূর্তে অবশ্যই সেই ব্যক্তির কণ্ঠীমালা থাকতে হবে। কণ্ঠীমালা সকল প্রকারের অশুভ শক্তির হাত থেকে আত্মাকে মুক্ত করে। সকলের উচিত কীর্তন করা। কাছের ব্যক্তিগন সবসময় তাঁকে বলুন “যেই মুহূর্তে আপনি জ্যোতি দেখতে পাবেন, সেই মুহূর্তে ভগবানকে ডাকুন। আমাদের অবশ্যই মুমূর্ষ ব্যক্তিকে মৃত্যুর তিনটি চিহ্ন দেখে প্রস্তুত করতে হবে।

মৃত্যুর লক্ষণ

মুমূর্ষ ব্যক্তির অনুভূতি এবং অন্যান্য সকল ব্যক্তিরা যা দর্শন করেন-
১. দেহ ভারী বলে অনুভূত হয় (কেননা সমগ্র দেহটি সীসাতে পূর্ণ হয়)। মুখের মাংশপেশীর নিয়ন্ত্রণ লুপ্ত হয় ।
২. শীতলতা অনুভব হয়, জ্বর জ্বর বোধ হয় ৷ শ্রবণ ও দর্শন লোপ পায় ।
৩. দেহটি পরমাণুর টুকরো হয় (সূক্ষ্মদেহ বিচ্যুতি)। আতঙ্কজনক অবস্থায় শক্তিশালী শ্বাস কম্পন।
যখন কোন ব্যক্তির এই দুইটি অবস্থা অতিবাহিত হয় এবং সেই মুমূর্ষ ব্যক্তিটি খেচুঁনিযুক্ত শ্বাস নিতে থাকে, তবে সেই মুহূর্তে সকলের উচিত উচ্চৈঃস্বরে কীর্তন গাওয়া, সেই সময় মুমূর্ষ ব্যক্তি অন্ধকারে প্রবেশ করে।
সেই মুহূর্তে কৃষ্ণকে নিবেদিত তুলসী পাতা সেই ব্যক্তির জিহ্বায় দিতে হবে। যখন সেই ব্যক্তি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন তিনি অনাহত স্থানে একটি আলোক দেখতে পান। যখনই তার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হবে তৎক্ষণাৎ তার কানে উচ্চৈঃস্বরে বলুন, “এখন আপনি একটি আলোক দেখতে পাবেন, ভয় পাবেন না। ভগবান আপনার জন্য এসেছেন। এখন আপনি সেই জ্যোতিতে উড়ে যাবেন এবং ভগবানের রূপ দেখতে পাবেন । যখনই সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে আপনি গমন করতে থাকবেন, তখন উচ্চৈঃস্বরে ডাকুন হে কৃষ্ণ! কৃষ্ণ, তখন কৃষ্ণ আপনাকে রক্ষা করতে সেই স্থানে উপস্থিত হবেন।” পরবর্তী ২০ মিনিট যাবৎ এই নির্দেশনা অনবরত প্রদান করবেন। একজন সাধারণ ব্যক্তি ২০ মিনিট ধরে সেই জ্যোতি দর্শন করবেন কিন্তু একজন মহাত্মা ৭ দিন যাব? সেই জ্যোতির দর্শন পাবেন। পাপীরা শুধুমাত্র এক ঝলক দর্শন পাবে। সেই উজ্জ্বল জ্যোতি দর্শন করে তাকে বলতে হবে, হে, কৃষ্ণ, আমাকে গ্রহণ করুন, আমি আপনারই।”

দেহত্যাগের পর

মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যখন মাংস উৎসর্গ করা হয় তখন সে ভয় পায়। তিনি তখন বুঝতে পারেন এই প্রকারের পাপকর্মের ফলেই যমদূতেরা তাকে নরকে নিয়ে যায়। সেই তখন তার আত্মীয় স্বজনের করজোড়ে মিনতি করে এই প্রকারের কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য। কিন্তু কেউই তাঁর সূক্ষ্মদেহের কথা শ্রবণ করতে সক্ষম নয়। যদি এই কারণে সেই ব্যক্তি রাগান্বিত হয়, তবে সে অবশ্যই নরকে গমন করবে। তাই তাকে বলতে হবে: “দেখুন কিভাবে আপনার আত্মীয়রা আপনার উদ্দেশ্য পাপকর্ম করছে এবং অসৎ ভাবে আপনার সম্পত্তি ভাগ করছে। এইসব ভুলে যান এবং ভগবানের নামজপে মনোযোগী হন অন্যথাই আপনি নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবেন।” মৃত ব্যক্তি যদি অত্যাধিক পাপী হয় তবে সে এইসকল নির্দেশনা শুনতে পাবে না ।

অন্তষ্টিক্রীয়ায় যা করা উচিত নয়

– মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য মাছ, মাংস ও ডিম নিবেদন
– মদ প্রদান ও জাগতিক কথা বলা
– মৃত ব্যক্তির জাগতিক কৃতকর্ম আলোচনা (এরফলে সে ব্যক্তি দেহ, ঘর ও জিনিসের প্রতি বন্ধন হবে)

যা করা উচিত

– ভগবানের নাম সংকীর্তন, ভগবানের কথা আলোচনা, ভগবানের নিবেদিত প্রসাদ ও মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রসাদ নিবেদন করুন

অন্যান্য নিদের্শনা

জড় দেহ ত্যাগ করার পর সেই ব্যক্তি একটি অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে খুঁজে পায়। যদি সে পারমার্থিক কার্যে নিয়োজিত না হয় তবে সে সেই নতুন অবস্থাকে ভয় পাবে। ভয় পেয়ে সে নিজের পরিচিত স্থানসমূহে ছুটে আসবে, তার স্বজনদের সাথে কথা বলতে চাইবে, তার নিজের দেহে পুনরায় প্রবেশ করতে চাইবে কিন্তু তার শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সে জীবন ফিরে পাবে না। তাই, সেই মৃত দেহ অবশ্যই পোড়ানো উচিত, অন্যথায় সেই দেহ বহু বছর যাবত সম্মানে থেকে যাবে এবং ভূতের উপদ্রব হবে।
যদি মৃতদেহ পোড়ানোর সময় তুলসী জলে ফোঁটা সেই অগ্নিতে প্রবেশ করে, তবে সেই ব্যক্তি অবশ্যই ভগবানের চিন্ময় ধামে প্রবেশ করবে। মৃত্যুবরণ করার ৩-৪ দিন পর, অপ্রস্তুত মৃত ব্যক্তি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে (কেননা তিনি একটি শক্তিপ্রভা দর্শন করেন) তার প্রতি নির্দেশনা সমূহ উপেক্ষা করতে পারেন ।
মৃত ব্যক্তির বিছানায় অথবা তাঁর চিত্রপটের সম্মুখে ৪ দিন যাবৎ সময়ে সময়ে তার উদ্দেশ্য বলতে হবে, “শান্ত হোন, আপনি এখন সুক্ষ্মদেহে অবস্থান করছেন। এটি কোন বিশেষ কিছু নয়, পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যান। সর্বদা কৃষ্ণকে আহ্বান করুন। আপনি এরূপে ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হবেন ।

সূক্ষ্মদেহের বৈশিষ্ট্য

১. বাহ্যিকভাবে, এটি স্থূলদেহের (ঘন) একটি অনুলিপি মাত্র । এটি স্থুলদেহের মতই বিবেচ্য হয় ।
২. এই দেহের একটি ওজন আছে এবং অভিকর্ষণ রয়েছে। নিরুদ্বেগ অবস্থায় এই দেহটি ধীরে ধীরে ভূমিতে নেমে আসে ।
৩. এই দেহকে বিস্তার করা যায়, যেকোন আকার ধারণ করতে পারে। যখন নিশ্চিন্ত থাকে, তখন এটি স্থূলদেহ রূপ ধারণ করে।
৪. এটি ঘনত্ব কম। এটি দেওয়াল ও যেকোন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম (অণুর মধ্যদিয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম)। যদিও, এই দেহের একটি প্রতিবন্ধক রয়েছে, তা হল তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র।
৫. এই দেহ দ্বারা জাগতিক বস্তু সমূহ নাড়ানো সম্ভব। (উপদ্রবকারী ভূত)
৬. বিশেষ পরিস্থিতিতে, সূক্ষ্মদেহ দর্শন করা যাবে এবং তারা অন্যান্য সূক্ষ্মদেহকে দর্শন করতে পারবেন।
৭. সূক্ষ্মদেহের স্পর্শ স্থূলদেহের মত।
৮. একটি সূক্ষ্মদেহ স্থূলদেহের সাথে তথাকথিত রূপালী সুতা দ্বারা যুক্ত থাকে। মৃত্যুর সময় এই সুতা ছিড়ে যায়।
৯. সূক্ষ্মদেহ বিদ্যুৎ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১০. চিন্তাশক্তি দিয়ে সূক্ষ্মদেহ চলাচল করতে পারে।

অবিরতভাবে ভগবানের স্মরণ

সূক্ষ্মদেহের সম্মুখে আগত জ্যোতির উৎসের পার্থক্য নিচে উল্লেখ করা হল:
– উজ্জ্বল জ্যোতিপ্রভা/ আলোক: ভগবানের ধাম থেকে আগত । এটির জন্য লালায়িত হতে হবে।
– নিষ্প্রভ আলোক : স্বর্গলোক, দেবলোক থেকে আগত ।
– নিষ্প্রভ সবুজ : অসুরলোক থেকে আগত ।
– হলুদ: মানব ।
– নিষ্প্রভ নীল: পশু,
– নিষ্প্রভ লাল: সুবাস
– নিষ্প্রভ ধূসর : পাতাল লোক
যদি নিষ্প্রভ আলো বিভিন্ন রঙে আবির্ভূত হয়, তবে আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে হবে। একজন মৃত ব্যক্তির আত্মা ৪৯ দিন যাবৎ ঝুলন্ত ও মধ্যবর্তী অবস্থায় উপনীত হয়। ৪৯ দিন সম্মুখবর্তী হলে সে তার ভবিষ্যৎ পিতা-মাতা ও তাদের ভাগ্য দেখতে পায়। আমাদের তখন তাড়াহুড়া না করে আরো বহু পরিবারের খোঁজ নিয়ে পারমার্থিক ভাবাপন্ন পরিবার গ্রহণ করা উচিত। যদিও কর্ম অনুসারে একজন ব্যক্তি একটি দেহ ধারণের দণ্ড পায়। কিন্তু যদি সে স্থূলদেহে পাপকর্ম করার ফলে কিংবা পারমার্থিক নির্দেশনা গ্রহণ না করার ফলে অবধারিতভাবে সে একটি কুকুর দেহ পাবে, কিন্তু সূক্ষ্মদেহে সে অন্যর নির্দেশনা শুনতে পারে, তাই সে অবস্থায় কৃষ্ণের শরণাগত হওয়া উচিত। যদি সেই আত্মা নরকে গমন করে, তাহলেও তাকে নির্দেশনা মেনে নরক থেকে মুক্ত হতে হবে।
কেউ যদি সর্বক্ষণ শুদ্ধ সাত্ত্বিকভাবে জীবন যাপন করেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবায় ও চিন্তায় মগ্ন থাকেন, তা হলে তাঁর পক্ষে জীবনের অন্তিমকালে কৃষ্ণচিন্তা করা সম্ভব। সেটিই তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের পরা প্রকৃতিতে স্থানান্তরিত করতে সাহায্য করবে।


কেউ যদি সর্বক্ষণ শুদ্ধ সাত্তিকভাবে জীবন যাপন করেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবায় ও চিন্তায় মগ্ন থাকেন, তা হলে তাঁর পক্ষে জীবনের অন্তিমকালে কৃষ্ণচিন্তা করা সম্ভব। সেটিই তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের পরা প্রকৃতিতে স্থানান্তরিত করতে সাহায্য করবে।


শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত সেবায় মগ্ন হয়ে থাকলে, পরবর্তী জীবনে অপ্রাকৃত শরীর ধারণের সৌভাগ্য অর্জিত হয়। তাঁকে আর জড় দেহ ধারণ করতে হয় না । তাই, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে । এই মহামন্ত্র কীর্তন করাই হচ্ছে জীবনের অন্তিমকালে ভাব পরিবর্তনের সফলতম শ্রেষ্ঠ উপায় ।

মৃত্যু সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন মৃত্যু নিকটবর্তী হলে মানুষের কেমন আচরণ করা উচিত?

জীবনের অন্তিম সময়ে মৃত্যুভয়ে ভীত না হয়ে অনাসক্তিরূপ অস্ত্রের দ্বারা দেহ ও দেহ সম্পর্কিত সমস্ত বন্ধন ছেদন করা উচিত।(ভাঃ-২/১/১৫) সকলে কেন মৃত্যুকে এড়াতে চায়?
এ জড়জগতে আমরা দেখি, কেউ মরতে চায় না। সকলেই আরও জ্ঞান অর্জন করতে চায়, চায় সুখী হতে। কিন্তু এগুলোর বিপরীতে মৃত্যু কেন মানুষের কাছে জনপ্রিয় নয়? কেন এ মৃত্যু জীবদের কাছে অনাকাঙ্খিত? কিন্তু জ্ঞান লাভ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হবে কি? কেউ কি স্বেচ্ছায় অসুখী হওয়ার চেষ্টা করে? এই সমস্ত উত্তরে বৈদিক শাস্ত্রে যে বর্ণনা করা হয়েছে তা নিম্নে বর্ণনা করা হলে : পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় । পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার কারণে জীবাত্মাও সচ্চিদানন্দময়। ‘সচ্চিদানন্দময়’ শব্দটি তিনটি বিশেষ গুণের সমন্বয়। সৎ, চিৎ ও আনন্দ। ‘সৎ’ অর্থ ‘চিরন্তন’। ‘চিৎ’ অর্থ জ্ঞান এবং ‘আনন্দময়’ অর্থ আনন্দ । জীবাত্মা যখন তার স্বরূপে অবস্থান করে তখন সে সচ্চিদানন্দময়। কিন্তু যখন জীব জড় জগতে আসে, তখন তার স্বরূপ আবৃত হয়ে যায়। ফলে জীবের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, সে মরণশীল। সে একটি পঞ্চভৌতিক দেহ গ্রহণ করে এবং তার সাথে থাকে অনেক নশ্বর স্থানের সম্পত্তি। বাস্তবিকপক্ষে আত্মা নিত্য। মৃত্যু মানে দেহের পরিবর্তন ।
আত্মা তার স্বরূপে জ্ঞানময়। কিন্তু যখন জড়জগতে আত্মা আসে তকন সে চিন্ময় জ্ঞান থেকে বিচিক্ষুন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু আত্মা তার স্বরূপ পুনরুদ্ধার করার জন্য অনবরত জ্ঞালাভের চেষ্টা করে। একইভাবে আত্মা তার স্বরূপে আনন্দময়। কিন্তু জড় জগতের সংস্পর্শে আসার ফলে আত্মা চিন্ময় আন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রকৃতির প্রভাবে অনেক দুঃখ ভোগ করে । যখন আত্মা দুঃখ দুর্দশাপূর্ণ জড়জগতে আসে, তকন সে নিত্য আনন্দ লাভ করতে পারে না। আত্মা ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে সুখ অনুভব করে। চিন্ময় জগতে আত্মা পরমেশ্বর ভগবানের সাথে প্রেমময়ী সম্পর্ক স্থাপন করে আনন্দ আস্বাদন করে। ভগবান এবং ভগবানের শক্তি অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় জীবের স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে ভগবানকে ভালোবাসা । তাকে ভালোবাসার মাধ্যমে আনন্দ লাভ করা। যেহেতু আনন্দ হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম। তাই এ আত্মা যখন জড় জগতে আসে, তখন সে আনন্দ লাভের পেছনে ছোটে। কিন্তু জড়জগৎ দুঃখময় ।
জীবনে সুখী হতে গেলে কাউকে না কাউকে ভালোবাসতে হবে। জড়জগতে মানুষ জানে না কীভাবে ভগবানকে ভালোবাসতে হয়। তাই তারা যাকে পায়, তাকেই ভালোবাসে। কৃষ্ণনকে বাদ দিয়ে অন্য কারোর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে তারা অজ্ঞাত সুখ ও আনন্দ অনুভব করে। কিছুদিন পড়ে সেই ভারোবাসার সম্পর্ক ভেঙে যায়। তখন মানুষ খুব কষ্ট পায়। এ জড়জগতে ভালোবাসার সম্পর্ক খুবই ক্ষণস্থায়ী। আপনি যাকেই ভালোবাসতে যাবেন, সে-ই আপনাকে দুঃখ দেবে। আমরা আমাদের শরীরকে অত্যন্ত ভালোবাসি। কিন্তু একসময় আমারও আমাদের শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবো। আত্মা চিন্ময়, ভগবানও চিন্ময়। যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা ভগবানকে না ভালোবাসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মা প্রকৃত আনন্দ লাভ করতে পারবে না।

মৃত্যু সম্বন্ধে মহাভারত কী বলে?

(স্টিফেন ন্যাপ- শ্রীনন্দনন্দন প্রভুর লেখা ‘মৃত্যুকে অলিঙ্গন: পারলৌকিক জীবনকে বরণ করা’ হতে সংগৃহীত)
মহান বৈদিক সাহিত্য মহাভারতে মহারাজ যুধিষ্ঠির মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন- কিসের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রযত্ন করা উচিত? এর উত্তরে ভীষ্মদেব বললেন- “এ বিশ্ব সব সময় মৃত্যুভয়ে ভীত। রাত্রির গমনাগমনের মধ্য দিয়ে মানুষের আয়ু কমতে থাকে। মৃত্যু কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এটি প্রতি মুহূর্তে নিকটে আসতে থাকে। এর আগমন বোঝা না গেলেও, তা প্রতিনিয়ত কাছে আসছে। এক একটি দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের আগেই মৃত্যু তাকে শিকার বানিয়ে নেয় ঠিক যেভাবে শিকারি পশু ভেড়াকে আক্রমণ করে। তুমি কাল যা করতে চাইছ, তা অবশ্যই আজকে করতে হবে। তুমি যা বিকেলে করার পরিকল্পনা করছ, তা অবশ্যই সকালে করতে হবে। মৃত্যু বড়ই নিষ্ঠুর। তোমার সব কাজ শেষ হয়েছে কি না তার জন্য কখনো অপেক্ষা করবে না। তাই তৎপর হয়ে সৎগুণাবলির অনুশীলন করা উচিত । জীবন অনিশ্চিত; শুধু মৃত্যুই নিশ্চিত । এটি এখনও আসতে পারে, কয়েক বছর পরও আসতে পারে। এর জন্য প্রস্তুত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সদ্‌গুণ এ জগতে তোমাকে খ্যাতি দেবে আর মৃত্যুর পরে দেবে সুখ। মানুষ কামনা বাসনার জালে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে বিভিন্ন বস্তু ও জীবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তার কর্ম, জায়গা-জমি, তার ছেলে মেয়ে, তার পরিবার এসব কিছু তাকে সম্পর্কের জালে আবদ্ধ রাখে, যা পরিণতিতে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছিন্ন হয়। সত্য ব্যতীত সম্পর্কের এ জালের শক্তিকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না ।
কোনো একটি জিনিস সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান এ বিশ্বের অনিত্যত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি করায়। যিনি সেটি জানেন, তার কাছে মৃত্যুর আতঙ্ক নেই । এক দেহে মৃত্যুর বীজ যেমন থাকে, তেমনি অমরত্বের বীজও থাকে। এ আসক্তির বৃক্ষকে খুব সহজে লালন করা যায়। কিন্তু এর অপর নাম মৃত্যু। বিজ্ঞ ব্যক্তি তার ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি তার ইচ্ছে এবং রোষের নিগড় থেকে মুক্ত থাকেন। তিনি জানেন, কীভাবে আনন্দ এবং দুঃখকে সমজ্ঞান করতে হয়। প্রশান্তিই তার কাম্য। তার কথা, তার চিন্তা, তার বৈরাগ্য ও তার যোগ সর্বোপরি নিত্য ব্রহ্মে স্থাপিত হয় এবং তিনি মৃত্যুকে জয় করেন। জ্ঞানের চক্ষু সবচেয়ে উৎসুক চক্ষু । সত্য সবচেয়ে বড় তপস্যা। আসক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ দুঃখ। তাই বৈরাগ্যই শান্তির পথ।”
যুধিষ্ঠির মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন: “মানুষের প্রকৃত বন্ধু কে? তার পিতা, মাতা, গুরু, আত্মীয় নাকি বন্ধু? যখন কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তার দেহটি একটি কাঠের টুকরো বা মাটির পিণ্ডের মতো পরিত্যক্ত হয়। তার কোন্ বন্ধু তাকে পরবর্তী জীবন পর্যন্ত অনুসরণ করবে?”
ভীষ্মদেব উত্তর দিলেন, “মানুষ একাকী জন্মগ্রহণ করে এবং একাকী মৃত্যুবরণ করেন। এ সুন্দর পৃথিবীতে সে একাকী আসে এবং তাকে একাই জগৎ ত্যাগ করতে হয় ।
জীবন নামে কথিত কুচকাওয়াজে তার একজনও সঙ্গী থাকবে না । যাদের কথা তুমি বললে পিতা, মাতা, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু বা গুরু সবাই চলে যাবেন। কয়েক মূহূর্ত শোক করার পর তারা কাঠের টুকরো কিংবা মাটির ঢেলার মতোই পরিত্যাগ করবে। তারা তোমাকে ফেলে রেখে তাদের কাজে চলে যাবে। তোমার পরিত্যক্ত মৃতদেহে কারোর কোনো আকর্ষণ থাকবে না। একমাত্র তোমার ধর্ম বা ন্যায় পরায়ণতাই থাকবে তোমার পাশে। এটিই তোমার প্রকৃত বন্ধু এবং মানুষের এটিই চাওয়া উচিত।”

 

ব্যাক টু গডহেড জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।