মৃত্যুকে যারা ধোঁকা দিতে চায়

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ অপরাহ্ণ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 267 বার দেখা হয়েছে

মৃত্যুকে যারা ধোঁকা দিতে চায়

বিশ্বের বিখ্যাত কিছু ধনী ব্যক্তি প্রচেষ্টা করেছেন কিভাবে মৃত্যুকে কৃত্রিমভাবে প্রতিহত করা যায়। তাদের এই প্রচেষ্টা আদৌ কি সম্ভব?

সর্বাত্মা দাস


সম্প্রতি মার্কেট রিসার্চ অনুসারে গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষকরা এক বিস্ময়কর তথ্য প্রদান করেছেন যে, অ্যান্টি এইজিং ইন্ডাস্ট্রি বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে শুধুমাত্র মানুষের বয়স কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়টি নিয়ে গবেষণার জন্য। এ বিষয়ে গবেষকরা দাবি করেছেন, তারা প্রায় এ বিষয়টি সমাধানের পথে এগোচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই একই কথা গবেষকরা অনেক বছর ধরে বলে আসছে। ১৯৭১ সালে গবেষকরা বলে দিয়েছিল যে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে তারা এর সমাধান করবে। পাঁচ বছর পর সানফ্রান্সিসকোতে ক্রনিক্যালের এক রিপোর্টে বলা হয়, “মানুষের বয়স নাকি ৮০০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এভাবে দশকের পর দশক পার হয়ে গেলেও কোনো সমাধানতো নয় বরং গবেষকরা উল্টো সাধারণ মানুষদের আশা দিয়েই যাচ্ছে।
এতো গেল বয়স বৃদ্ধি রোধ বিষয়ে গবেষণার তথ্য। অনেক গবেষক এখন মৃত্যুকে কিভাবে জয় করা যায় সে গবেষণাও করে যাচ্ছে।
পদ্ধতিটি হচ্ছে যখন একজন মানুষ মৃত্যুবরণ করবে তখন ক্রনিক প্রিজারভেশন কোম্পানি বিষয়টি অবহিত করা হলে তারা এসে মৃত ব্যক্তির শরীরে রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখতে সহায়তা করে। এরপর মৃত শরীরকে একটি বরফের আবরণ দ্বারা আবৃত করা হয় এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করা হয়, যাতে রক্ত জমাটসহ মস্তিষ্কের ক্ষতি কমানো যায়।
এরপর এটিকে এমন একটি শীতল অবস্থায় রাখা হয় যার তাপমাত্রা হবে জল বরফে পরিণত হওয়ার যে পর্যায় তার একটু ওপরে। এক্ষেত্রে মৃত শরীরের রক্ত বের করে এনে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণের জন্য একটি দ্রবণ প্রতিস্থাপন করা হয়। এভাবে শেষ পর্যায়ে দেহটিকে একটি বিশেষ কন্টেইনারের মধ্যে রাখা হয় যেটিকে আবার তরল নাইট্রোজেন ভর্তি একটি ট্যাংকের মধ্যে মাইনাস ১৯৬° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়। অনেকে আবার পুরো শরীরটি না রেখে তাদের মস্তক বা মস্তিষ্ককে সংরক্ষণে রাখে।
এভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিজ্ঞানীরা এক পর্যায়ে যখন অমরত্বের তত্ত্ব আবিস্কার করবে তখন তারা তাদের এই সমস্ত শরীরে জীবন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা এতেই ক্ষান্ত নন, তারা মানুষের শরীরের বিভিন্ন কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম শরীর তৈরি করে ইতোমধ্যে মানুষের চারটি ইন্দ্রিয়কে স্থাপন করার পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। এমনকি তাতে মস্তিস্ক প্রতিস্থাপনের গবেষণাও বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এদিকে গবেষণায় সহায়তার জন্য বিশ্বের বড় বড় সব ধনী ব্যক্তিরা ব্যয় করে চলেছে কোটি কোটি অর্থ।


৩২ বছর বয়স্ক কোটিপতি দিমিত্রি ইটস্কভ তো রীতিমতো ঘোষণা করে দিলেন যে, তিনি শতভাগ নিশ্চিত, ২০৪৫ সালের মধ্যে মানুষ অমরত্ব অর্জন করবে। এজন্যে তিনি জৈবিক এই শরীরটি ছেড়ে যত দ্রুত সম্ভব কৃত্রিম মেশিনের শরীরে প্রবেশ করার প্রয়োজন বলে অনুভব করেন। এজন্য তিনিও প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন।

বিখ্যাত ওরাকল কর্পোরেশনের CEO ও বিশ্বের সপ্তম ধনী ব্যক্তি (ফোর্বস্ অনুসারে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক), ল্যারি এলিসন রীতিমত মৃত্যু নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “মৃত্যু আমাকে অত্যন্ত রাগিয়ে দেয়। আমার কাছে এটি একবারেই বোধগম্য নয়। একজন ব্যক্তি এত দিন ধরে এখানে থাকবে আবার হঠাৎ করে কিভাবে অদৃশ্য হয়ে যাবে? তার মতে মৃত্যু তার কাছে বোধগম্য না হলেও এটিকে পরাজিত করা সম্ভব। এজন্যে এলিসন বছরে ৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করেছেন শুধুমাত্র মৃত্যুকে জয় করার জন্য।

সম্প্রতি ফোর্বস্ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় কিভাবে কোটিপতি টেকনোলজিস্ট, পেপালের সহ প্রতিষ্ঠাতা ফেইসবুকে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী পিটার থায়েল মৃত্যুকে জয় করার জন্য গবেষকদের চালাওভাবে অর্থ দিচ্ছেন। তার প্রশ্ন হল “কেন আমাদের অবশ্যই মরতে হবে?” তার ভাষ্য অনুসারে মৃত্যু হলো একটি সমস্যা এবং এটি নিয়ে ভাবনার তিনটি উপায় রয়েছে। “হয় আপনি এটিকে মেনে নিন, না হয় অস্বীকার করুন নতুবা এর সাথে যুদ্ধ করুন। আমার মনে হয় আমাদের সমাজে বেশিরভাগ লোকই এটিকে মেনে নেয় বা অস্বীকার করে থাকে, কিন্তু আমি এর সাথে যুদ্ধ করাটায় প্রাধান্য দিই।”
থায়েল বলেন, তিনি ১২০ বছর বাঁচার পরিকল্পনা করেছেন, এজন্য তিনি প্রতিদিন মানুষ বেড়ে উঠার বিশেষ হরমোন নেন। বয়স কমানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করা মেথিউলিস্ ফাউন্ডেশনে তিনি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলার দান করেছেন। এছাড়া তিনি বয়স থামিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে এস.ই.এন.এস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কাজে সমর্থন দিয়েছেন। ক্রায়োজেনিকস্ কোম্পানি আলকোরের সঙ্গেও তিনি চুক্তি করেছেন। এ চুক্তির ফলে মৃত্যুর পর তার শরীরটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণে রাখা হবে।

এদিকে গুগলের সহ প্রতিষ্ঠাতা সার্জি ব্রিনের (বিশ্বের ১৩ তম ধনী) উদ্যোগে গুগল সিংগুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ডলার ব্যয় করছেন বয়স কমানো ও অমরত্ব অর্জনের জন্য। সম্প্রতি গুগল ভাড়া করছে রেডিক্যাল ফিউচারিষ্ট রে কার্জুহলকে যিনি দাবি করছেন আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মানুষ অমর হবে। এদিকে ব্রিন এতেই থেমে নেই। মৃত্যুকে জয় করার প্রাণপণ লড়াইয়ের জন্য তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেছেন বিখ্যাত যাদুকর ডেভিড কপারফিল্ডের ব্যক্তিগত দ্বীপ বাহামা থেকে। তার কারণ, এ যাদুকরের দাবি তিনি নাকি সেখানে যৌবনের ফোয়ারা লাভ করেছেন।

এদিকে বিশ্বের এক নম্বর ধনী বিল গেটস্ অবশ্য ধনী ব্যক্তিদের জন্য পরামর্শ দিয়েছে অমর হওয়ার গবেষণার পেছনে না দৌড়ে বরং যে দুরারোগ্য রোগ ব্যাধি হচ্ছে তা দূর করার জন্য অর্থ ব্যয় করা শ্রেয়। এভাবে দীর্ঘদিন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে বলে, তার অভিমত।


এই পৃথিবীতে সাধারণত দুই ধরনের লোক দেখা যায়। একদল মৃত্যু নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন এবং বিষয়টি সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞানের অভাব বা অজ্ঞানতার ফলে তারা এর দ্বারা ভীতসন্ত্রস্ত। অন্য দল ইন্দ্রিয় উপভোগে এতই নিমগ্ন যে, তারা মৃত্যু নিয়ে চিন্তাই করতে পারে না। উভয় ক্ষেত্রেই মৃত্যু সম্বন্ধে অজ্ঞানতা সুস্পষ্ট। উপরোক্ত বিখ্যাত এসব ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে স্টিফেন হকিং ছাড়া সবাই প্রথম দলের পর্যায়ে পড়ে এবং স্টিফেন হকিং দ্বিতীয় দলে। মৃত্যু এমনই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, এর জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় প্রায় পুরো একটি অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। ভগবদ্গীতার অক্ষর ব্রহ্মযোগে নামক অষ্টম অধ্যায়ে মৃত্যু সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সমগ্র শ্রীমদ্ভাগবতের মূল ভিত্তি এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। যা হোক, এক্ষেত্রে প্রথমেই এটি জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে কি? এ বিষয়ে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ
শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় (২/১৩) বলেছেন—

দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ॥

“দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোনো দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনো এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।”
অর্থাৎ মৃত্যু বলতে দেহের পরিবর্তনকে বোঝায়, প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেহ প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন হয়, ফলে প্রত্যেকে মৃত্যুর দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। শ্রীল প্রভুপাদ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : যেহেতু প্রত্যেকটি জীবন হলো স্বতন্ত্র আত্মা, প্রতিটি মুহূর্তেই প্রত্যেকেই দেহ পরিবর্তন করে চলেছে। সে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, ফলে কখনো শিশু, কখনো কিশোর, কখনো যুবক এবং কখনো বা বৃদ্ধ হয়। কিন্তু জীবের প্রকৃত সত্তা আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না।” স্টিফেন হকিংস যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তা চার্বাক দর্শনেও বর্ণিত হয়েছে :-

ঋনং কৃত্ব ঘৃতং পিবেৎ যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য কুতঃ পুনরাগমনো ভবেৎ ॥

“কেউ মারা যাওয়ার পর তার দেহ ছাইয়ে পরিণত হয়, তখন আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই। যতদিন বাঁচো শুধু ভোগ করে যাও। এ রকম প্রবল ভোগবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করতে পারে।”
যেরকমটি পূর্বে বলা হয়েছিল বিজ্ঞানীফেশ এ সমস্ত ধারণা নিতান্তই অজ্ঞানতা প্রসূত। জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। “যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী।” (ভ.গী. ২/২৭)
এরপর শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার ১৮/১২ এ বলা হয়েছে, অনিষ্টমিষ্টং মিশ্রং চ ত্রিবিধং কর্মণঃ ফলম্ ॥ “যারা কর্মফল ত্যাগ করেননি তাদের পরলোকে অনিষ্ট, ইষ্ট ও মিশ্র এ তিন প্রকার কর্মফল ভোগ হয়।”
“সূর্যদেবের অত্যন্ত শক্তিশালী পুত্র যমরাজ
পিতৃদের রাজা । তিনি স্বপার্ষদ পিতৃলোকে বাস করেন এবং ভগবানের আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন না করে, মৃত্যুর পর তাঁর দূতদের দ্বারা তাঁর অধিকারের মধ্যে আনীত প্রাণীদের পাপকর্ম অনুসারে যথযথভাবে বিচার করে নরকে দণ্ডদান করেন।” (ভাগবত-৫/২৬/৬)
শ্রীল প্রভুপাদ এই শ্লোকের তাৎপর্যে লিখেছেন, “যমরাজ কোন কাল্পনিক বা রূপকথার চরিত্র নন; তাঁর নিজের ধাম রয়েছে, তা হচ্ছে পিতৃলোক এবং তিনি সেখানকার রাজা। নাস্তিকেরা নরকের বিশ্বাস না করতে পারে, কিন্তু শ্রীল শুকদেব গোস্বামী নরকের অস্তিত্ব প্রতিপন্ন করেছেন তা গর্ভোদক সমুদ্র এবং পাতাললোকের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।”

অমর হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা

ডিজনি ল্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা এবং সত্ত্বাধিকারী মৃত্যুর ভয়ে সম্পূর্ণরূপে ভীত ছিলেন। সেই সময় মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার গবেষণায় একজন বিজ্ঞানী অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন। ওয়াল্ট ডিজনি তার মৃতদেহকে সংরক্ষণ এবং সেই জাদুর সূত্র পাওয়ার সাথে সাথে তাকে জীবিত করার জন্য ঐ বিজ্ঞানীকে ১০ মিলিয়ন ডলার উপহার দেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ওয়াল্ট ডিজনি মারা যান এবং তার মৃতদেহকে একটি উন্নত হিমাগারে রাখা হয়। তখন তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তুমুল আলোচনা হচ্ছিল। যদি ঐ বিজ্ঞানী তার গবেষণায় সফল হয় তবে ওয়াল্ট ডিজনি আবার জীবিত হয়ে যাবে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত সম্পদ তারা হারাবে। তাই তারা ঐ বিজ্ঞানীকে গবেষণা বন্ধ করার এবং হিমাগারের সুঁইচ বন্ধ করার অনুরোধ জানাল। গবেষণা বন্ধ করার বিনিময়ে বিজ্ঞানীটি ২০ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিল, আসলে গবেষণার মাথামুণ্ডু কিছুই সে করে নি। মানুষের ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা আয় করছে। মানুষ যদি চুল হারানোর ভয় থেকে মুক্তি পায় তবে বাহারি রকমের চুলের তৈল, স্যাম্পু, জেল, চিরুনি এবং সে জাতীয় শিল্প কারখানাগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। যদি মানুষ বৃদ্ধাবস্থায় কুৎসিত হওয়ার ভয় থেকে মুক্ত হয় তবে প্রসাধনী শিল্পসমূহ বন্ধ হয়ে যাবে।
কিভাবে জাগতিক ব্যক্তিরা অজ্ঞানতা প্রসূত অমর হওয়ার পরিকল্পনা করে তা শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। সুতরাং আধুনিক ব্যক্তিদের আর কি কথা। শ্রীমদ্ভাগবতের ৭ম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ের সারমর্ম অংশে প্রভুপাদ সেই রকম একটি কাহিনি তুলে ধরেছেন :-
হিরণ্যকশিপু অমর হতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল কেউ যেন তাকে পরাজিত করতে না পারে, সে যেন কখনও জরা এবং ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত না হয় এবং তার যেন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকে। এই বাসনা নিয়ে সে মন্দর পর্বতের উপত্যকায় অত্যন্ত কঠোর তপস্যা আরম্ভ করেছিল। দেবতারা হিরণ্যকশিপুকে তপস্যারত দেখে তাঁদের নিজ নিজ আবাসে প্রস্থান করেছিলেন। কিন্তু হিরণ্যকশিপু যখন এইভাবে তপস্যা করছিল, তখন তার মস্তক থেকে এক প্রকার অগ্নি উত্থিত হয়ে পশু, পক্ষী, দেবতা আদি ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত অধিবাসীদের উত্তপ্ত করতে লাগল। যখন ঊর্ধ্ব এবং অধঃস্থ সমস্ত লোক অত্যন্ত উত্তপ্ত হওয়ার ফলে বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল, তখন দেবতারা অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়ে স্বর্গলোক পরিত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তিনি যেন সেই অসহ্য তাপ প্রশমিত করেন। দেবতারা ব্রহ্মাকে বলেছিলেন যে, হিরণ্যকশিপু অমরত্ব লাভ করে ধ্রুবলোকসহ সমস্ত লোকের অধিপতি হওয়ার অভিসন্ধি করেছে।
ব্রহ্মা হিরণ্যকশিপুর তপস্যার উদ্দেশ্য অবগত হয়ে, ভূত এবং দক্ষ আদি মহাত্মাগণ সহ তাঁকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি তাঁর কমণ্ডলু থেকে জল নিয়ে হিরণ্যকশিপুর মস্তকে তা সিঞ্চন করেন।
দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সম্মুখে বার বার শ্রদ্ধা সহকারে প্রণতি নিবেদন করে তাঁর স্তব করতে লাগল। ব্রহ্মা যখন তাকে বর দিতে সম্মত হয়েছিলেন, তখন সে প্রার্থনা করেছিল সে যেন কোনো জীব থেকে, আবৃত অথবা অনাবৃত কোনো স্থানে, দিনে অথবা রাত্রে, কোনো অস্ত্রের দ্বারা ভূমিতে অথবা আকাশে এবং মানুষ বা পশু, চেতন বা অচেতন কারোর দ্বারা নিহত না হয়। সে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের আধিপত্য এবং অণিমা, লঘিমা আদি অষ্টসিদ্ধিও প্রার্থনা করেছিল ।
এই জড়জগতে যে মৃত্যুকে প্রতিহত করার কোনো উপায় নেই সে বিষয়ে প্রভুপাদ ১/১৩/১৯ নং শ্লোকে তাৎপর্য অংশে উল্লেখ করেছেন;
“কোনো মহান শক্তিই মৃত্যুর নির্মম কবল প্রতিরোধ করতে পারে না। মানুষের শারীরিক দুর্দশার কারণ যতই উৎকট হোক্ না কেন, মরতে কেউই চায় না। এমনকি, জ্ঞান চর্চার তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রগতির যুগেও, বার্ধক্য অথবা মৃত্যুর কোনো প্রতিকার পন্থাই নেই, নির্মম কালের হুকুমনামায় মৃত্যুর আগমন হলে তারই বিজ্ঞপ্তি হলো বার্ধক্য এবং মহাকালের হুকুমনামা কিংবা চরম বিচার গ্রহণ না করে প্রত্যাখ্যান করতে কেউই পারে না।
এই কথাই বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ আসন্ন ভয়াবহ পরিস্থিতির কোনো রকম প্রতিকারের পন্থা খুঁজে বার করবার জন্য তিনি হয়তো বিদুরকে বলতে পারতেন, এবং সেই রকম আদেশ তিনি পুর্বেও বহুবার করেছিলেন। তাই আদেশ দেওয়ার পূর্বেই অবশ্য বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিলেন যে, এই জড় জগতের কোনো ব্যক্তির দ্বারা অথবা কোনো উপায়ে তার প্রতিকার পন্থা নেই। আর যেহেতু জড় জগতে সেই রকম কোনো পন্থাই নেই, তাই পরম পুরুষোত্তম ভগবানই হলেন মৃত্যুর অভিন্ন রূপ এই কথা পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং ভগবদ্‌গীতায় (১০/৩৪) ব্যক্ত করেছেন। যারা মৃত্যুকে প্রতিহত করা ছাড়াও আয়ু বৃদ্ধি করার জন্য পরিকল্পনা করে চলেছে, যেরকম প্রথমদিকে বিভিন্ন ব্যক্তির পরিকল্পনা বর্ণনা করা হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। যে, “এই প্রকার কামুক ব্যক্তিরা মৃত্যুর জন্য কখনই প্রস্তুত হয় না, তারা কেবল তথাকথিত বৈজ্ঞানিক প্রগতির মাধ্যমে তাদের আয়ু বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে। কিছু মূর্খ রুশ বৈজ্ঞানিক সম্প্রতি দাবি করেছে যে, তারা বৈজ্ঞানিক প্রগতির মাধ্যমে মানুষকে অমরত্ব দান করতে চলেছে। এই প্রকার উন্মাদ ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আজকের সভ্যতা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু, চিরকাল বেঁচে থাকার বাসনা সত্ত্বেও, নিষ্ঠুর মৃত্যু এসে তাদের অন্য লোকে নিয়ে চলে যায়।
মৃত্যুকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য অথবা বিলম্বিত করার জন্য মানুষ এভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে। বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই শুধু এমন সব কাজেই নিয়োজিত হচ্ছে, যা মৃত্যুর কাছাকাছিই তাদের নিয়ে যাচ্ছে।
এই প্রকার মনোভাব হিরণ্যকশিপু প্রদর্শন করেছিল, কিন্তু যথা সময়ে ভগবান স্বয়ং এসে নিমেষের মধ্যে তাকে সংহার করেছিলেন।” (ভাগবত ৪/২৭/১২ তাৎপর্য)

মৃত্যু সুনিশ্চিত

মৃত্যু যে অবধারিত সত্য তা পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মীয় শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। আব্রহ্মভুবন্নাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন। “হে অর্জুন! এ ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল, অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয় (ভ.গী. ৮/১৬)। অতএব মৃত্যু সবার জীবনে সুনিশ্চিতভাবে আগমন ঘটবে। এ সম্পর্কে শাস্ত্রের একটি কাহিনি বেশ প্রাসঙ্গিক।
ব্যাসদেবের পিতামহ একবার ব্যাসদেবের কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করে বলেন, “প্রিয় দৌহিত্র, আমি মৃত্যুভয়ে ভীষণ ভীত। আমি মরতে চাই না। দয়া করে আমার জন্য একটা ব্যবস্থা করো, আমি মরতে চাই না।” শ্রীল ব্যাসদেব উত্তরে বলেন, “হে পিতামহ, এটি কিভাবে সম্ভব হতে পারে যে, আপনি মরবেন না? যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, তাকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হবে। এটাই শাশ্বত নীতি। আমি কখনোই এমন কারো কথা শুনিনি, যিনি মৃত্যুবরণ করেননি। আপনি আমাকে এমন একটা কাজের জন্য অনুরোধ করছেন, যা কখনোই সম্ভব নয়।” পিতামহ জোর করে বললেন, “হে পৌত্র, তুমি ভগবানের একজন অবতার। তুমি যেকোনো কাজই করতো পারো। তোমার অসাধ্য কিছুই নেই। দয়া করে আমার অনুরোধ রক্ষা করো। অন্তত যমরাজের কাছে গিয়ে তুমি তাঁকে মৃত্যুর মাধ্যমে আমাকে শাস্তি না দেওয়ার কথা বলতে পারো।” পিতামহ এভাবে পীড়াপীড়ি করলে শ্রীল ব্যাসদেব তাঁকে নিয়ে যমরাজের কাছে গেলেন। শ্রীল ব্যাসদেব বললেন, “হে যমরাজ, আমি আপনার কাছে আমার পিতামহের জন্য একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আমার পিতামহ মৃত্যুকে এতই ভয় পান যে, তিনি মৃত্যুবরণ করতে চান না। আমার সবিনয় অনুরোধ, যেহেতু মৃত্যুবরণকারীর গন্তব্য আপনিই, তাই মৃত্যুর দায় থেকে তাঁকে মুক্তি দিন। এ বিষয়ে যদি সাহায্য করা সম্ভব হয়, তবে দয়া করে আমার অনুরোধ রক্ষা করুন।” যমরাজ উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ, এটি সত্য যে, জীবাত্মা মৃত্যুর পর আমার কাছেই আসে। কিন্তু আমি মৃত্যুর নিয়ন্তা নই। আমি শুধু তাদের কর্মের বিচার করি এবং কর্ম অনুসারে তাদের পুরস্কৃত করি। কিন্তু আমি মৃত্যু রোধ করতে পারি না। শ্রীল ব্যাসদেব জিজ্ঞেস করলেন, “মহাকাল পুরুষই মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক। আপনি তাঁর কাছে যেতে পারেন। তিনি আপনার উদ্দেশ্য সাধনে সাহায্য করতে পারেন।” এ কথা শুনে শ্রীল ব্যাসদেব মহাকাল পুরুষের সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হলেন। এ স্থান ত্যাগের পূর্বে শ্রীল ব্যাসদেবের পিতামহ যমরাজের কাছে গিয়ে তাঁকে তাঁদের সঙ্গী হতে অনুরোধ করেন, যাতে মহাকাল পুরুষকে তিনি মৃত্যু রোধ করার জন্য বলতে পারেন। অগত্য শ্রীল ব্যাসদেবের কথায় যমরাজ রাজি হলেন।
মহাকাল পুরুষের গৃহে পৌঁছে ব্যাসদেব তাঁদের আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, “হে মহাকাল পুরুষ, আপনি হলেন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক । মৃত্যুর প্রতি অতি ভয়ের কারণে আমার পিতামহ মরতে চান না। আপনি উনাকে করুণা করুন!”
মহাকাল পুরুষ বললেন, “হ্যাঁ, আমি মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক, আমি সকল জীবের গন্তব্য অনুযায়ী তাদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করি; কিন্তু আমি সঠিকভাবে জানিনা আপনার পিতামহের গন্তব্যস্থল কোথায়। দয়া করে আপনারা চিত্রগুপ্তের কাছে যান। তিনি আপনার পিতামহের সকল তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছেন।” চিত্রগুপ্তের সাথে দেখা করার পূর্বে ব্যাসদেবের পিতামহ মহাকাল পুরুষকে যমরাজ, ব্যাসদেব এবং তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। এভাবে চারজন চিত্রগুপ্তের কার্যালয়ের দিকে রওনা হলেন। ব্যাসদেব চিত্রগুপ্তের নিকট গিয়ে বিনয়ের সাথে তাঁর পিতামহের মৃত্যু সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বের করার অনুরোধ করলেন। চিত্রগুপ্ত ব্যাসদেবের অনুরোধে নথিটি পরীক্ষা করে জানালেন যে, ব্যাসদেবের পিতামহের কোনো মৃত্যু নেই। তা শুনে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে এলো এবং তাঁরা খুবই উল্লাস করতে লাগল। পরক্ষণেই চিত্রগুপ্ত চিৎকার করে বলে উঠলেন, “থামুন, থামুন। আসলে তথ্য বলে যে, ব্যাসদেবের পিতামহ তাঁর এ জীবনে মৃত্যুকে এড়াতে পারতেন, যদি না তিনি ব্যাসদেব, যমরাজ এবং মহাকালপুরুষত্রয়ীর একত্রে সাক্ষাৎ না করতেন। যাই হোক, এ তিনজনের একত্র উপস্থিতির কারণেই তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত…।” চিত্রগুপ্ত তাঁর কথা শেষ করতে না করতেই ব্যাসদেবের পিতামহ ঐ স্থানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
এ বর্ণনা থেকে আমরা দেখতে পাই, ব্যাসদেবের পিতামহ যদিও মরতে চাননি, কিন্তু মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ না করার জন্যই তিনি কত প্রচেষ্টা করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল মৃত্যুকে এড়ানোর, কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টাই তাঁকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেল। যদিও মরণশীল ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। কিন্তু এতসব সমস্যার মধ্যে গিয়েই তিনি ঠিক ওই তিনজন ব্যক্তির একত্র উপস্থিতি নিশ্চিত করলেন; এভাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তাঁর নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনলেন।
মৃত্যুকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য অথবা বিলম্বিত করার জন্য মানুষ এভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে। বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই শুধু এমন সব কাজেই নিয়োজিত হচ্ছে, যা মৃত্যুর কাছাকাছিই তাদের নিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুকে রোধ করার সকল প্রচেষ্টা মৃত্যুকেই ত্বরান্বিত করছে। ঠিক শ্রীল ব্যাসদেবের পিতামহের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল। তিনি এত দূর ভ্রমণ আর কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন শুধু তাঁর মৃত্যুকে প্রকট করার জন্যই।
অনেকেই আবার মৃত্যুকে ভুলে থাকতে চায়, কিন্তু জড়জগতে আতঙ্ক বা মৃত্যু সবদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ভূমিকম্প, ঝড়-ঝঞ্জা সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অদৃশ্য ভয়ংকর ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবসহ নিত্য নতুন ভয়ংকর রোগ-ব্যাধি, আচমকা কোনো দুর্ঘটনাসহ কতোভাবেই না মৃত্যু ওঁত পেতে রয়েছে। তাই মৃত্যু সুনিশ্চিতভাবে প্রত্যেকের জীবনে আগমন হবে। মৃত্যুর সাথে ধূর্ততা করাটাই মূর্খতা।

বার্ধক্য ও মৃত্যকে
জয় করার যথার্থ কৌশল

বার্ধক্যকে প্রতিহত করার বিজ্ঞানীদের যে প্রচেষ্টা তা নিরর্থক। এই সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতের ৯/১৮ অধ্যায়ে নুহুষের পুত্র মহারাজ যযাতির কাহিনি বর্ণিত আছে। মহারাজ যযাতি স্ত্রী সম্ভোগের জন্য এত নিবিষ্ট ছিল যে, একসময় শুক্রাচার্য রাজা যযাতিকে ক্ষুদ্ধ হয়ে জরাগ্রস্থ হওয়ার অভিশাপ দেন। কিন্তু যযাতি যখন শুক্রচার্যের কৃপা ভিক্ষা করেন তখন শুক্রাচার্য অন্যের যৌবনের সঙ্গে তার বার্ধক্য বিনিময়ের শক্তি প্রদান করেন। যযাতি তখন তার কনিষ্ঠ পুত্র পূরুর যৌবন গ্রহণ করে যুবতী রমণীদের সঙ্গসুখ উপভোগ করতে সক্ষম হন। এইভাবে এই জড় জগতে বহু বছর ইন্দ্রিয় সুখ উপভোগ করার পর, মহারাজ যযাতি অবশেষে এই প্রকার জড় বিষয় ভোগের প্রতি বিরক্ত হন। তিনি জড় সুখ ভোগের অনিত্যতা সম্পর্কে উপলব্ধি করেন যে, কেউ যদি কামুক ও লোভী হয়, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত স্বর্ণ তাঁর সেই কামনা-বাসনা তৃপ্ত করতে পারে না। এই বাসনা ঠিক অগ্নির মতো, সেই জলন্ত অগ্নিতে ঘি ঢেলে আগুন নেভানো যায় না। সেই আগুন নেভাতে হলে শাস্ত্র অনুমোদিত যথার্থ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। পরবর্তীতে তিনি সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় যুক্ত হন। অর্থাৎ, ভগবানের সেবা করার মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে নিত্য যৌবন লাভ করেন। এটি হলো যথার্থ কৌশল ।
ব্রহ্মাণ্ডে এমন কেউ কি আছেন যিনি বলতে পারেন “আমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নই” প্রত্যেকেরই মৃত্যু সন্নিকটে। ভগবানের এক মহান ভক্ত পরীক্ষিৎ মহারাজ যদিও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ছিলেন তবুও তাঁকে সাত দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল। “সম্রাট, আপনি তক্ষক নাগের দংশনে সাত দিনের মধ্যে মারা যাবেন।” এ অভিশাপই তাকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। মহারাজ পরীক্ষিৎ বৈষ্ণব ছিলেন, তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশালীও ছিলেন। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, “হ্যাঁ, আমি অপরাধী। ব্রাহ্মণের পুত্র আমাকে শাপ দিয়েছে, আমি এটি সার্থক করব।” তাই তিনি নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সাত দিন, তিনি এমনকি এক ফোটা জল পর্যন্ত গ্রহণ না করে গঙ্গার তীরে সাত দিন ব্যাপী বিরতিহীনভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করেন। তিনি এ সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। ‘হরেরনামানুকীর্তনঃ। জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে শ্রবণ কীর্তনেরই পরামর্শ দেওয়া হয়। শুকদেব গোস্বামী বললেন, মহারাজ পরীক্ষিৎ, মৃত্যুর সময় কী করা কর্তব্য তা ইতোমধ্যেই আমি ব্যাখ্যা করেছি।” তাই মহারাজ পরীক্ষিতের আচরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে আমাদের কী করা কর্তব্য? প্রত্যেকেই মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, কিন্তু মূর্খরা তা জানে না। মূর্খরা ভাবে যে,
“আমি চিরদিন বেঁচে থাকব।” এটাই মূর্খতা। তাই আমরা অমর হতে পারি না। আবার ভগবদ্‌গীতা বলছে, মৃত্যুকে রোধ করা একটি চমৎকার বিষয়। সমগ্র পারমার্থিক জীবনের উদ্দেশ্য হলো মৃত্যুকে রোধ করা। এটাই ভাগবতের শিক্ষা। ভাগবতের ৫/৫/১৮নং শ্লোকে ভগবান শ্রী ঋষভদেব তার শত পুত্রের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিয়েছেন-

গুরুন স স্যাৎ স্বজনো ন স স্যাৎ
পিতা ন স্যাজ্জননী ন সা স্যাৎ
দৈবং ন তৎস্যান্ন পতিশ্চ স স্যান্
ন মোচয়েদ য সমুপেত মৃত্যুম ৷৷

“অনিবার্য মৃত্যুরূপ সংসার মার্গ থেকে যিনি তার আশ্রিত জনকে উদ্ধার করতে না পারেন তাঁর পক্ষে গুরু, কিংবা স্বজন, কিংবা পিতা, মাতা, পূজনীয় দেবতা কিংবা পতি হওয়া উচিত নয়।”
কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো মৃত্যুকে রোধ করে ভগবদ্ধামে ফিরে গিয়ে নিত্যকাল শ্রীকৃষ্ণের সাহচর্য লাভ করা। গুরুগণ আমাদের মৃত্যুকে রোধ করার এ অপূর্ব সুযোগ প্রদান করেছেন। ত্যজ্ঞা দেহং পূনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন… এ দেহ পরিত্যাগের পর তুমি আর কোনো নতুন দেহ গ্রহণ করবে না। আর যদি তুমি কোনো দেহ গ্রহণ না করো, তবে তোমার কোনো মৃত্যুও থাকবে না। যত শীঘ্র তুমি পারমার্থিক অগ্রগতি অর্জন করবে, এক চিন্ময় শরীর তুমি তত শীঘ্র লাভ করবে এবং তোমার মৃত্যু হবে না। এমনকি জন্মও হবে না। যেখানে জন্ম রয়েছে, সেখানে মৃত্যু অবশ্যই থাকবে। যদি মৃত্যুকে জয় করা যায়, তবে আর জন্মও হবে না। আর যদি জন্ম না থাকে, তবে কোনো রোগ, শোক, ব্যাধিও থাকবে না। এটাই পদ্ধতি। সুতরাং জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধিকে রোধ করার একমাত্র উপায় হলো কৃষ্ণভাবনা।


 

জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।