গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে মহাপ্রভুর জীবনী

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০১৯ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৯ | ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 2473 বার দেখা হয়েছে

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে মহাপ্রভুর জীবনী

২১/৩/২০১৯— গৌর পূর্ণিমা, চন্দ্রোদয় পর্যন্দ উপবাস

কনিকা গোপ কুমার- স্টানফোর্ড ইউনির্ভাসিটি:

আমরা প্রত্যেকেই জানি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ জগতে আবির্ভূত হন। এটিও একটি জানার বিষয় যে, চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর গৃহস্থ আশ্রমের ২৪ বছর নবদ্বীপেই ছিলেন (চৈঃ চঃ আদি ১৩/১০, চৈঃ চঃ মধ্য ১/১৫)। পরবর্তীতে তিনি তাঁর গৃহস্থ জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং তাঁর জীবনের বাকি ২৪ বছরের জগন্নাথ পুরীতে অতিবাহিত করেন। (চৈ: চ: আদি ১৩/১১) (চৈ: চ: মধ্য ১/১৭)। বাকি ২৪ বছরের প্রথম ছয় বছর তিনি কখনো দক্ষিণ ভারতে, কখনো বঙ্গদেশে কিংবা কখনো বৃন্দাবনে নিরন্তর পরিভ্রমণ করেন। উক্ত এই কালপঞ্জির মাধ্যমে আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের প্রকৃত সময় সমূহই উদ্্ঘাটন করতে পারব। মূলত, তৎকালীন সময়ের উপর ভিত্তি করেই এই সময় তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। যাই হোক, মহাপ্রভুর আত্মজীবনী লেখ শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কর্তৃক রচিত ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ হতে গুরুত্বপূর্ণ সময় সমূহ সংকলন করা হয়েছে। কিছু অন্যান্য ঘটনা সমূহও কবি কর্ণপুর রচিত ‘শ্রীচৈতন্য চন্দ্রোদয়’ এবং শ্রী মুরারী গুপ্ত রচিত শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য চরিতামৃত মহাকাব্য গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে। এসমস্ত কাব্য গ্রন্থ সমূহের আলোকেই চৈতন্য লীলার গুরুত্বপূর্ণ মূহূর্তসমূহ নিম্ল তুলে ধরা হল:
১. আবির্ভাব : ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দ, ১৮ ফেব্রুয়ারি

অষ্টাদশ বৎসর রহিলা নীলাচলে
কৃষ্ণ প্রেম-নামামৃতে ভাসা’ল সকলে॥
(চৈ. চ. আ ১৩/৯)
“বাকি আঠারো বছর তিনি জগন্নাথপুরীতে বাস করেন। অমৃতময় হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে, তিনি কৃষ্ণপ্রেমে সকলে ভাসিয়েছে।”
ফাল্গুনপূর্ণিমা-সন্ধ্যায় প্রভুর জন্মোদয়।
সেই কালে দৈবযাগে চন্দ্রগ্রহণ হয়॥
(চৈ. চ. আ ১৩/২০)
ফাল্গুনী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয়, তখন দৈবযোগে আবির্ভাব : ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দ, ১৮ ফেব্রুয়ারি চন্দ্রগ্রহণ হয়।
আধুনিক জ্যোতিষবিদদের মতে ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হয় এবং তা ভারত বর্ষে ও তৎকালীন সময় পরিদৃশ্যমান ছিল। পূর্ণ চন্দ্র গ্রহণের সময়কাল ৫ ঘন্টা ৪৩ মিনিট বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আংশিক চন্দ্রগ্রহণের সময় নির্ধারণ করা হয় ৩ ঘন্টা ২৯ মিনিট।
সুতরাং সম্পূর্ণ চন্দ্র গ্রহণের সময়কাল ছিল ৪টা ৫১ মিনিট ৫১ সেকেন্ড (আদর্শ সময় মান অনুসারে)।
অতএব, মহাপ্রভু সান্ধ্যকালীন সময় তথা সূর্যস্তের বহু সময় পর এবং চন্দ্র উদিত হওয়ার সময় জন্মগ্রহণ করেন। তার সময় কাল হিসেবে সন্ধ্যা ৬.০০ হতে ৬.৩০ টা মধ্যে বিবেচনা করা যায় (পূর্বে পশ্চিম বাংলার সূর্যাস্ত এবং চন্দ্র উদিত হওয়ার সময় ছিল ৫.৩০ টা হতে ৬.০০টা) সুতরাং তিনি চন্দ্র গ্রহণের প্রথমাংশেই জন্ম গ্রহণ করেন। অধিকাংশ জ্যোতিষবিদগণ এই সময়টিকে রাত ১০ টা হিসেবে বিবেচনা করেন। এটি মহাপ্রভুর জন্মকাল হিসেবে ভুল প্রমাণিত হতে পারে দুটি কারণে। প্রথমত, মহাপ্রভু জন্মের সময়কালে ভারতবর্ষে তখন ছিল সান্ধ্যকালীন সময়। দ্বিতীয়ত, রাত্রির ১০ টার সময়কালে কখনো সিংহ লগ্ন এবং রাশির জাতকের আবির্ভাব সম্ভব নয়। কেননা মহপ্রভুর পিতামহ নীলাম্বর চক্রবর্ত্তী একই জন্ম লগ্নের অধিকারী এবং মহাপ্রভু জন্ম লগ্ন সূচি অনুসারেও তা প্রমাণিত।

২. সন্ন্যাস : ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দ, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্ত্তী সময়:
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত এবং মহাপ্রভুর অন্যান্য আত্মজীবনী সমূহতে স্পষ্টভাবেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর জীবনের প্রথম ২৪ বছর নবদ্বীপে অতিবাহিত করেন এবং এরপরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের প্রারম্ভে ফেব্রুয়ারি বা মার্চের মধ্যবর্ত্তী সময় তিনি ২৪ বছরে পদার্পণ করেন।


শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে ব্যক্ত করা হয়েছে, তিনি একই বছরে সন্ন্যাস গ্রহণ কালীন সময়ে অর্থাৎ মাঘ মাসে (জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মধ্যবর্তী সময়ে) তার ২৪ বছর পূর্ণ করেন।
চব্বিশ বৎসর শেষে যেই মাঘমাস।
তার শুক্লপক্ষে প্রভু করিলা সন্ন্যাস॥ (চৈ. চ. মধ্য ১/১৬)
“চব্বিশ বৎসর শেষে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীচৈতন্য মহপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।”
অতএব, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের সময় হিসেবে ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্ত্তী সময় পরিগণ্য করা হয়। সন্ন্যাস :
১৫১০ খ্রিষ্টাব্দ, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্ত্তী সময়।

৩. জগন্নাথপুরী গমন: ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের মধ্যবর্তী সময়
মাঘ-শুক্লপক্ষে প্রভু করিল সন্ন্যাস।
ফাল্গুনে আসিয়া কৈল নীলাচলে বাস॥
(চৈ. চ মধ্য ৭/৪)
“মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। ফাল্গুন মাসে তিনি জগন্নাথপুরীতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে বাস করেছিলেন।”

ফাল্গুনের শেষে দোলযাত্রা সে দেখিল।
প্রেমাবেশে তাঁহা বহু নৃত্যগীত কৈল॥
(চৈ. চ মধ্য ৭/৫)
“ফাল্গুন মাসের শেষে তিনি দোলযাত্রা দর্শন করেছিলেন এবং ভগবৎ-প্রেমে আবিষ্ট হয়ে বহু নৃত্য-গীত করেছিলেন।”
সুতরাং ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের মধ্যবর্ত্তী সময়েই তিনি জগন্নাথপুরী আগমন করেন। জগন্নাথপুরী গমন: ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের মধ্যবর্তী সময়|

৪. দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণ:

১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলের শেষ সময় হতে ১৫১২ খ্রিষ্টাব্দ
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু মূলত বৈশাখ মাসের শুরুর দিকেই দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণের অভিলাষ পোষণ করেন।
যখন, মহাপ্রভু দক্ষিণ ভারত গমনের কামনা ভক্তদের জানান, তখন প্রত্যেক ভক্তই অত্যন্ত বিষাদগ্রস্থ হয়ে যান।

তাহার বিনয়ে প্রভুর শিথিল হৈল মন।
রহিল দিবস কথো, না কৈল গমন॥
(চৈ. চ মধ্য ৭/৫০)
সার্বভৌম ভট্টাচার্যের অনুরোধ শুনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মন শিথিল হল। তিনি আরও কয়েকদিন সেখানে রইলেন।
দিন পাঁচ রহি’ প্রভু ভট্টাচার্য-স্থানে।
চলিবার লাগি’ আজ্ঞা মাগিলা আপনে॥
( চৈ. চ. মধ্য ৭/৫৪)
পাঁচদিন সার্বভৌম ভট্টাচার্যের গৃহে থেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দক্ষিণ ভারত অভিমুখে যাত্রা করবার জন্য তার অনুমতি চাইলেন।
অতএব, মহাপ্রভুর দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণ সময়কাল হিসেবে ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলের শেষের দিকের সময়ই বিবেচনা করা হয় এবং তিনি দুই বছর পরিভ্রমণে অতিবাহিত করেন।
এইমত মহাপ্রভুর চারি বৎসর গেল।
দক্ষিণ যাঞ্চা আসিতে দুই বৎসর লাগিল॥
(চৈ.চ. মধ্য ১৬/৮৪)
“এইভাবে শ্রীচৈতন মহাপ্রভু চার বছর অতিবাহিত করলেন। দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ তাঁর দুই বছর লেগেছিল।”
সুতরাং, ১৫১২ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মের মধ্যবর্তী সময়ই তিনি জগন্নাথপুরীতে ফিরে যান।

৫. রামানন্দ রায়ের সাথে সাক্ষাৎ :
১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর বা ১৫১১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মধ্যবর্তী সময়


দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণকালে বিদ্যানগরে মহাপ্রভুর সাথে রামানন্দ রায়ের সাক্ষাৎ হয় (যখন মহাপ্রভু তীর্থভ্রমণ করে ফিরছিলেন)। কবি কর্ণপুর (শিবানন্দ সেনের পুত্র) রচিত শ্রীচৈতন্য চন্দ্রোদয় গ্রন্থ অনুযায়ী এ সময়টি ছিল ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর এর মধ্যবর্তী সময়। শ্রীচৈতন্য দেব আনন্দের সাথে শ্রীকান্ত (শিবানন্দ সেনের ভাইপো) কে বললেন, অনুগ্রহ পূর্বক অদ্বৈত আচার্য অন্যান্য মহৎ ভক্তদের বলবে, তারা যেন এবছর আমার সাথে দেখা করতে না আসে। আমিই তাদের দেখতে যাবো। শিবানন্দকে বলো আমি পৌষ মাসেই (ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হতে জানুয়ারির মাঝামাঝি) তার সাথে সাক্ষাৎকার করব। যখন শ্রীকান্ত মহাপ্রভুর এই বার্তা সমস্ত ভক্তদের জানাল, তৎক্ষণাৎ অদ্বৈত আচার্য এবং অন্যান্য ভক্তগণ সাথে সাথেই মহাপ্রভুকে দেখতে যাওয়ার সমস্ত আয়োজন বন্ধ করে দিল। (চৈতন্য চন্দ্রোদয় ৯/৩২) যখন সাক্ষাৎকারের সময় এল তখন মহাপ্রভু রামানন্দ রায়ের সাথে গোদাবরী নদীর তীরেই অবস্থান করছিলেন মহাপ্রভুর ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না। (চৈতন্য চন্দ্রোদয় ৯/৩৪)

৬. জগন্নাথ পুরীত অবস্থান
দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণ শেষে, মহাপ্রভু তাৎক্ষণিকভাবে বৃন্দাবন গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যাই হোক, ভক্তরা যেহেতু মহাপ্রভুর বিরহ সহ্য করতে পারচ্ছিলেন না, তাই ভক্তদের অনুরোধে আরও দুই বছর মহাপ্রভু জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেছিলেন।


আর দুই বৎসর চাহে বৃন্দাবন যাইতে।
রামানন্দ-হঠে প্রভু না পারে চলিতে॥ (চৈ:চ: মধ্য ১৬/৮৫)
“অন্য দু’বছর, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবনে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রামানন্দ রায়ের চাতুরির ফলে তিনি জগন্নাথপুরী ত্যাগ করতে পারেননি।”
তাই এ হিসেবে মহাপ্রভুর জগন্নাথ পুরীতে অবস্থানের সময়কাল ছিল ১৫১২ হতে ১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দ। মহাপ্রভুর ভক্তরাও, ১৫১২, ১৫১৩ এবং ১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দে পুরীতে তথা রথযাত্রায় অংশ গ্রহণ করেন ।
পঞ্চম বৎসরে গৌড়ের ভক্তগণ আইলা।
রথ দেখি’ না রহিলা, গৌড়েরে চলিলা ॥ (চৈ:চ: মধ্য ১৬/৮৬)
“পঞ্চম বৎসরে গৌড়ের ভক্তরা রথযাত্রা মহোৎসব করতে এলেন। রথ দেখে তাঁরা সেখানে রইলেন না, গৌড়ে ফিরে গেলেন।”
যেহেতু রথযাত্রা জুন এবং জুলাই এর মধ্যবর্তী সময় অনুষ্ঠিত হয়, তাই অবশ্যই ভক্তগণ ১৫১৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই এর শেষেই জগন্নাথ পুরী হতে প্রস্থান করেন এবং এর পর পরই বৃন্দাবন গমনের অভিলাষের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা হয়ে যাওয়ার জন্য সার্বভৌম ভট্টাচার্য এবং রামানন্দ রায়ের সাথে সাক্ষৎকার করেন এবং তাঁদের অনুমতি গ্রহণ করেন।
(চৈ:চ: মধ্য ১৬/৮৭) (চৈ:চ: মধ্য: ১৬/৯১)
“গৌড়-দেশ দিয়া যাব তাঁ-সবা দেখিয়া।
তুমি দুঁহে আজ্ঞা দেহ’পরসন্ন হঞা ॥
“গৌড় দেশ হয়ে, তাঁদের দুইজনকে দেখে, আমি বৃন্দাবনে যাব; তোমরা দুইজন প্রসন্ন চিত্তে আমাকে অনুমতি দাও।”

৭. প্রথমে বঙ্গদেশ হয়ে বৃন্দবন গমন
সার্বভৌম ভট্টাচার্য এবং রামানন্দ রায় বহু কলা কৌশলের দ্বারা মহাপ্রভুকে পুরীতে অবস্থান করাতে চাইছেন। কিন্তু, পরবর্তীতে মহাপ্রভুর অনুরোধে, তারা ঠিক করলেন বর্ষার শেষেই যাতে মহাপ্রভু বৃন্দাবনে গমন করেন,

দুঁহে কহে,-এবে বর্ষা চলিতে নারিবা।
বিজয়া-দশমী আইলে অবশ্য চলিবা ॥ (চৈ:চ: মধ্য ১৬/৯৩)
তারা দুজনেই বললেন, “এখন বর্ষার সময়, তোমার ভ্রমণ করতে অসুবিধা হবে, তাই বিজয়া-দশমী পর্যন্ত অপেক্ষা কর, এবং তারপরেই যেও।” পরবর্তীতে, মহাপ্রভু বিজয়া দশমীর দিনই বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, (চৈ: চ: মধ্য ১৬/৯৪) যা ছিল, ১৫১৪ খ্রিষ্টব্দের সেপ্টেম্বরের শেষ কিংবা অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ভ্রমণ কালে, মহাপ্রভু বাংলার বিভিন্ন ভক্তদের সাথেই ছিলেন। পরবর্তীতে উড়িষ্যা সীমান্ত পার করার পর তিনি নৌকায় পানিহাটিতে এসে পৌঁছান, তারপর তিনি রাঘব প-িতের বাড়ি যান এবং ওখান থেকে কুমার-হট্ট এবং অবশেষে কুলিয়া যান। অতঃপর, রামকেলীতে মহাপ্রভুর সাথে রূপ এবং সনাতন গোস্বামীর সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি তাদের তাঁর মুখ্য ভক্ত রূপে গ্রহণ করেন । রামকেলী হতে ফিরে আসার সময় মহাপ্রভুর সাথে রঘুনাথের দেখা হয়। যিনি শান্তিপুরেই সাতবছর অদ্বৈত আচার্যের নিকট ছিলেন। শান্তিপুরে, মহাপভু অত্যন্ত আনন্দের সাথে মাধবেন্দ্রপুরীর ব্যাসপূজার আয়োজন করেন, যা ছিল ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের মধ্যবর্তী সময় হতে এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে। শ্রী মাধবেন্দ পুরী ছিলেন কৃষ্ণ প্রেমানন্দের আনন্দের এক সাগর। তাঁর আবির্ভাব সময়কাল ছিল, চৈত্র মাসের দ্বাদশী তিথিতে (মার্চের মধহতে এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়)। এই তিথিতে, অদ্বৈত আচার্য সকল ভক্তদের একত্রিত করে চৈতন্য মহাপ্রভু এবং নিত্যানন্দ প্রভুকে ভোজন করাতেন, (শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য চরিত মহাকাব্য ১৫/৮-৯) পরবতীর্কালে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু সমস্ত ভক্তদের একত্রিত করে, তাদের সকলের উদ্দেশ্যে জগন্নাথপুরী ফিরে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। (চৈ: চ: মধ্য ১৬.২৪৫-২৪৬) মহাপ্রভু বৃন্দাবন যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করলেন এবং তৎক্ষণাৎ জগন্নাথ পুরীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন কেননা, সহ¯্রাদিক লোক তাঁকে অনুসরণ করছিল। (চৈ: চ: মধ্য ১৬/২৭২) তার ফলে এত ভিড় হল যে, তিনি পথ দিয়ে চলতে পর্যন্ত পারছিলেন না (চৈ: চ: মধ্য ১৬.২৫৮)।

৮. বৃন্দাবন পরিভ্রমণ
মহাপ্রভু মনস্থ করেছিলেন, বৃন্দাবনে তিনি একা যাবেন অথবা সঙ্গে কেবল একজন ভৃত্য যাবে। তাই তিনি সমস্ত ভক্তদের অনুমতি নিলেন (চৈ: চ: মধ্য ১৬/২৭৩)। সমস্ত ভক্তের পক্ষে গদাধর পন্ডিত বললেন, শীঘ্রই বর্ষার চার মাস শুরু হবে।

তিনি যাতে এই চার মাস জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেন, (চৈ: চ: মধ্য ১৬/২৮২) ভক্তদের অনুরোধে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথ পুরীতে চার মাস থাকতে সম্মত হলেন (চৈ: চ: ১৬/২৮৫)। সুতরাং, এ থেকে আমরা সম্মত হতে পারি তিনি ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়েই বৃন্দাবন পরিত্যাগ করেন, মহাপ্রভু বৃন্দাবনের সকল পবিত্র স্থান ভ্রমণ করলেন, মাঘ মাসের শুরুতে (জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে) মহাপ্রভুর সাথে ভ্রমণকারী ভক্তরা প্রস্থাব দিলেন। এখন মাঘ মাস শুরু হয়েছে । তাঁরা যদি এখন প্রয়াগে যায় এবং আমরা যদি এখন প্রয়াগে যাই, তাহলে সেখানে মকরসংক্রান্তির সময় স্নান করার সুযোগ পাব (চৈ: চ: মধ্য ১৮/১৪৫)। পরদিন সকালে মহাপ্রভু সকলের সাথে বৃন্দাবন পরিত্যাগ করলেন।
৯. প্রয়াগ ও বারানসীতে রূপ ও সনাতন গোস্বামীর সাথে সাক্ষাৎ
এইমত চলি’ প্রভু ‘প্রয়াগ’ আইলা।
দশ-দিন ত্রিবেণীতে মকর-স্নান কৈলা॥
(চৈ.চ: মধ্য ১৮/২২২)
“এইভাবে চলতে চলতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রয়াগে এসে উপস্থিত হলেন, এবং মকর সংক্রান্তি (মাঘ মেলা) উপলক্ষে দশদিন ত্রিবেধীতে স্নান করলেন। ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়রির শেষবর্তী সময়। কিছুদিন অতিক্রান্তের পর অর্থাৎ ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে মহাপ্রভু বারাণসীতে এসে পৌঁছান এবং এ সময় মহাপ্রভুর সাথে সনাতন গোস্বামীর সাথে সাক্ষাৎ হয় (চৈ. চ: মধ্য ২০/২৪)। সনাতন গোস্বামী এ সময় ব্যয়বহুল/দামী উলের কম্বল (ভেট কম্বল) পরিধান করেছিলেন কেননা মহাপ্রভুর সাথে তার সাক্ষাৎকারের সময়টি ছিল শীতকাল (চৈ: চ: মধ্য: ২০/৮২)। বারানসী থাকাকালীন সময়ে বারাণসীর সকল সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রকাশানন্দ স্বরস্বতী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্ত হযে ওঠেন। (চৈ: চ: মধ্য ২৫)।

১০. জগন্নাথপুরীতে অবস্থান

অতপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মধ্য ভারতের একটি গহীন অরণ্যে ঝাড়খন্ডের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ পুরীতে ফিরে আসলেন। ইহ জগত ত্যাগ করে নিজ ধামে প্রত্যাবর্তণের আগ পর্যন্ত তিনি জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেছিলেন।

স্বরূপ কহে,-‘তোমার ইচ্ছা, কি কহিতে পারি?
শয্যা উপেক্ষিলে পণ্ডিত দুঃখপাবে ভারী॥
(চৈ: চ: আদি: ১৩/১৩) “তখন স্বরূপ দামোদর মহাপ্রভুকে বললেন, “আমি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারি না, কিন্তু আপনি যদি এই শয্যা উপেক্ষা করেন তাহলে জগদানন্দ পণ্ডিত অত্যন্ত দুঃখিত হবেন।”

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।