কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি, যজ্ঞের কি প্রয়োজন?

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০১৮ | ১২:৫৮ অপরাহ্ণ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৮ | ১২:৫৮ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 1149 বার দেখা হয়েছে

কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি, যজ্ঞের কি প্রয়োজন?

২০০৪ সাল, ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে বিশেষভাবে একটি সংবাদ খুব আলোচিত হয়েছিল Artificial rains : Imaginary gains and real pains  অর্থাৎ ‘কৃত্রিম বৃষ্টি মহারাষ্ট্র্রকে স্বস্তি দিল।’ সে সময় মহারাষ্ট্রে অনেকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল না। তাই মেঘের উপর কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নিক্ষেপ করে এই বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। ফলে অনেকে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় উল্লেখিত ‘যজ্ঞের ফলে যে বৃষ্টি হয়।’ এই প্রকার উক্তির পরিবর্তে ‘রাসায়নিক দ্রব্যের ফলেও বৃষ্টি হয়।’ এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আস্থা অর্জন করতে শুরু করে। একই পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পর বিপরীতধর্মী এ মতবাদকে বিশ্লেষণ করে চৈতন্য চরণ দাস Artificial rains : Imaginary gains and real pains  নামক একটি প্রতিবেদন বহুল প্রচারিত ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনে তুলে ধরে। নিম্নের প্রতিবেদনটি তারই বঙ্গানুবাদ। “কৃত্রিম বৃষ্টি মহারাষ্ট্রকে স্বস্তি দিল।” এই ধরনের শিরোনাম ভারতের সাম্প্রতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি প্রচলিত খবর হয়ে দাড়িয়েছে। শিরোনামের সাথে সম্পর্কিত ছবি, ‘একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও একজন বিজ্ঞানী একটি উড়োজাহাজে করে উড়েছেন এবং মেঘের উপর রাসায়নিক দ্রব্য নিক্ষেপ করছেন ও অন্যদিকে বৃষ্টি নেমে আসছে এটি প্রদর্শন করা হয়।’ ক্রমাগত পানির অভাবে অতিষ্ট জনজীবনে যেন নেমে আসে স্বস্তির বৃষ্টি, যা উচ্চ প্রযুক্তির বদান্যতায়, প্রকৃতির কারণে মানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবের জন্য প্রকৃত বৃষ্টির এক হুবহু প্রতিবিম্ব। আমরা যদি এ বিষয়টি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখব, যে কৃত্রিম বৃষ্টি তারা সৃষ্টি করেছে, তা কোথেকে? নিশ্চয়ই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মেঘ থেকে। কিন্তু যেখানে মেঘই নেই সেখানে কি বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব? যার ফলে যেখানে খরা চলছে সেখানে খরাই থেকে যাচ্ছে। প্রযুক্তি তখন কিই বা করতে পারে? সুতরাং কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করা হচ্ছে এটি যথার্থ নয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা তা করতে পারছে না। আমরা আকাশে যে সাধারণ মানের মেঘ দেখি সেরকম ছোট ছোট মেঘ থেকে কোন বৃষ্টি তৈরি সম্ভব নয়। তার উপরে বাতাসের বেগ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাতাসের সাথে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেঘও দ্রুত ভাসতে থাকে। তাই স্থিরভাবে এসব মেঘের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা ঘটানো সম্ভবপর হয়ে উঠে না। যেটি আমেরিকান আবহাওয়াবিদ (Meteorology)   চাক ওস্‌ওয়েল করেন, “একটি দশ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দশ কিলোমিটার ব্যাসের বড় মেঘ থেকে যে বৃষ্টি উৎপাদিত হয় তা মাত্র প্রতি ইঞ্চিতে ১/১০০ অংশ বা ০.০১ অংশ। তাতে শুঘুমাত্র একটি ফুটপাতকে ভেজাতে সমর্থ, এর বেশি ফলাফল আশা করা যায় না।” আর সেজন্যেই তো মহারাষ্ট্র সরকারকে খরচ করতে হয়েছে কোটি কোটি রুপি। মহারাষ্ট্রে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য সে স্থানের সরকার প্রায় ৫.৬ কোটি (১.২৪ মিলিয়ন ইউ.এস ডলার) রুপি খরচ করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হল তারা এটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও ভারতীয় সাধারণ জনগনদেরকে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ব্যক্ত করেননি। জনি মিকোউ এরম ত আমেরিকান বিজ্ঞানীরা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করেছেন বন্যা, টর্নেডো, খরা এবং সিলভার আয়োডিক টক্সিসিটি। তাই মেঘের উপর রাসায়নিক দ্রব্যের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত সৃষ্টি যেমন ক্ষণস্থায়ীভাবে লাভবান হচ্ছে আবার ক্ষতিও হতে পারে। পাবলিক এলাকাগুলোতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোটা মানুষের উপর সিদ্ধ কি সিদ্ধ নয় এমন ঔষধের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মতই। তার জন্য নিরীহ মানুষদের নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে চড়া মূল্য দিতে হবে।

প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা

এই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ভুল নয় বরং তা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রচলিত বিশ্বাস মতে যদি প্রকৃতিকে বুঝতে পারা যায় তবে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা (ভগবদ্ভভক্তরা) আবিষ্কার করছি যে, প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগী হওয়াটাই জরুরী। ঐ ধরণের নিয়ন্ত্রণ মনোভাব প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন করে একটি চরম দুর্যোগের দিকে ঠেলে দেয়ার সামিল। সাইন্স ম্যাগাজিন ‘নেচার’(মে ১৫,১৯৯৭) এ ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডের গবেষকগণ ‘প্রকৃতির টাকার হিসাব’ (Bill of nature) নামে একটি সমীক্ষা তুলে ধরে। যেখানে বলা হয় ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ৫৪ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ প্রতি বছর আমরা প্রকৃতি থেকে নিয়ে থাকি। যেমন: খাবার, জল, বায়ু, ভার (lumber), পাথর, ধাতু, মনি, তেল ইত্যাদি। সূর্যের আলোর বিলও কম নয়। আমেরিকান বিজ্ঞানী ড. এডউইন কেসলার হিসাব করেছেন যে, যদি ওকলাহোমা রাষ্ট্রের প্রতিদিনকার সূর্য কর্তৃক সরবরাহ শক্তির মূল্য বিবেচনা করা হয় তবে প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় পাঁচ সেন্ট প্রদান করতে হবে যা প্রতিদিনের জন্য প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার।

বৈদিক দর্শন

বৈদিক শাস্ত্র মতে সবকিছুর মূল কারণ পরম চেতন শক্তি ভগবান, এবং আরো জোড় প্রয়োগ করা হয়েছে যে, প্রকৃতির সাথে যেন আমরা ছন্দ বজায় রাখি। যেমন-এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সরকার ভগবানের আদেশ নির্দেশ মেনে চলা এবং সেসাথে আলো, তাপ, বায়ু এবং জল ইত্যাদির জন্য বিশ্বজাগতিক কর প্রদান করা ইত্যাদি। তাই বৈদিক পদ্ধতিতে এই বিশ্বজাগতিক কর প্রদান করা যায় শুধুমাত্র বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের সাহায্যে অগ্নিযজ্ঞ সম্পাদনের মাধ্যমে। যদিও যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ যেমন-ঘি, দুধ এবং শষ্যকে অগ্নিতে আহুতি দেয়া হয় এবং তা আপাতদৃষ্টিতে অপচয় মনে হতে পারে। কিন্তু বেদের অনুসারীরা এ আহুতি দিয়ে থাকে শুধুমাত্র বিশ্বজগতের নিয়ন্তাকে তুষ্ট করার জন্য এবং এর মাধ্যমে প্রকৃতির সমস্ত উপহারসমূহ পুনরায় গ্রহণ করা যায়। এ প্রকার যজ্ঞের ফলে সম্পদের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।

পারমার্থিক সমাধান

বৈদিক বিজ্ঞান তাই জল অভাবের এই প্রকার কারণ ব্যাখ্যা করে। যারা ভগবান কর্র্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগিতা না করে মেঘ থেকে কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করার চেষ্টা করে, তাদেরকে চোর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তাতে শেষ পরিণতি দুঃখদায়ক। উদাহরণস্বরূপ আমরা কৃষি জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম উপায়ে তৈরি সার ব্যবহার করি যার শেষ পরিণতি মাটির উর্বরতা নষ্ট হওয়া, আমরা জীবজন্তুদের কৃত্রিম খাবার খাওয়াই মোটা হওয়ার জন্য যার ফলে শেষ পরিণতি হচ্ছে ম্যাড কাউ রোগ। বিশ্বজাগতিক কর পরিশোধ না করার চেষ্টা কখনোই সুফল হয় না। বর্তমান যুগে এ বিশ্বজাগতিক কর পরিশোধ করার জন্য বৈদিক শাস্ত্রে একটি প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে যা অগ্নি যজ্ঞের চেয়েও অধিক বাস্তব। বর্তমান কলি যুগের জন্য পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা স্তুতি করার কথা বলা হয়েছে। ভগবদ্‌গীতায় ভগবান কৃষ্ণ তা প্রতিপন্ন করেছেন,“যজ্ঞনাম জপ যজ্ঞোস্মি, সমস্ত যজ্ঞের মধ্যে আমি হচ্ছি পবিত্র নাম জপযজ্ঞ” (১০/২৫)। তাই ভগবানের পবিত্র নাম হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥ জপ কীর্তনের মাধ্যমে ভগবানকে সন্তুষ্ট করতে সমর্থ হলে সমস্ত অভাব দূরীভূত হয়ে সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।

এটি কি অন্ধ বিশ্বাস

মন্ত্র জপের মাধ্যমে বৃষ্টি নিয়ে আসা সরাসরিভাবে হয়ত একটু কষ্টসাধ্য হতে পারে (চৈতন্য সন্দেশ ডেস্ক: যদিও গত কয়েক বছর আগে ভারতের একটি স্থানে ইস্‌কন ভক্তরা বিরতিহীনভাবে ২৪ ঘন্টা সম্মিলিত হরিনাম জপের মাধ্যমে বৃষ্টি নিয়ে এসেছিল। যা ভারতের মিডিয়াগুলোতে খুব আলোচিত হয়।) কিন্তু ভগবান অন্যভাবে প্রকৃতির মাধ্যমে বৃষ্টি নিয়ে আসতে সক্ষম। যেমন, আমরা যদি প্রকৃতির পানি সরবরাহ পদ্ধতির দিকে তাকাই তবে দেখব বাতাসের মাধ্যমে মেঘে মিলিয়ন গ্যালন জল জমা হয়। এই প্রকার জল জমা রাখার ট্যাংক এতটাই আশ্চর্যপ্রদ যে, একটি এয়ারপ্লেন সেগুলোর মধ্যে দিয়ে গেলেও সেগুলোকে ছিদ্র করতে পারে না। চাপ এবং তাপমাত্রার ভিন্নতার মাধ্যমে জলীয় বাস্প পরিবর্তিত হয়ে বৃষ্টির ফোটায় রূপান্তরিত হয়, যা একসাথে পৃথিবীতে নেমে আসে। এ ফোটাগুলো একটি নির্দিষ্ট আকার পর্যন্ত বাড়ে, এর বেশি নয়। যদি বৃষ্টির ফোটার আকৃতি বিশাল হত তবে তা জনজীবনকে ধ্বংস করে ফেলত। খুব আলতোভাবে, তা পৃথিবীতে নেমে আসে যা একটি ক্ষুদ্র ঘাসকেও আঘাত করে না। তাই এ সুন্দর ব্যবস্থাপনা আপনা আপনিই হয় না, তার পেছনে রয়েছে একটি অচিন্ত্য শক্তি ভগবান। যেটি বিখ্যাত পদার্থবিদ কেলভিনও স্বীকার করেছিলেন। তাই সরাসরি তৎক্ষণাৎ অনেক সময় বৃষ্টি না আসলেও মহামন্ত্র জপের মাধ্যমে নিদিষ্ট সময়ে বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব। এর জন্য মেঘে রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োজন নেই। মহামন্ত্র জপ যজ্ঞ তাই সুন্দর ব্যবস্থাটি খুব সহজেই আয়োজন করতে সক্ষম। যেমন-একটি ঔষধ খেলে কিভাবে শরীরে এর অপূর্ব কার্য সম্পাদন করে আমরা দেখতে পায় না, তেমনি জপযজ্ঞের মাধ্যমে বৃষ্টি নিয়ে আসা আমরা দেখতে না পেলেও তা বাস্তবিকই ঘটে থাকে। তাই আমাদের উচিত মহামন্ত্র জপের এই সহজ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে প্রকৃতিকে সহযোগিতা করা বা প্রকৃতির সাহায্যে কামনা করা পক্ষান্তরে প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে নয়। কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করার চেষ্টার মত আধিপত্য করার ফল খুব একটা ভাল নয়। হরে কৃষ্ণ।

(মাসিকচৈতন্য সন্দেশ মার্চ ২০১১ সালে প্রকাশিত)

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।