কালীয় নাগ এখন কোথায়?

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 781 বার দেখা হয়েছে

কালীয় নাগ এখন কোথায়?

শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় কালীয় নাগ দমন লীলার কথা নিশ্চিতভাবে আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আপনি কি জানেন কালীয় নাগ কিংবা তাঁর বংশধরদের অস্তিত্ব এখনো পৃথিবী আছে। এমনকি কালীয় নাগ পৃথিবীর কোথায় আছে তাও জানা গেছে। “চৈতন্য সন্দেশে”র এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আমরা জানব কালীয় নাগের বর্তমান অবস্থান।

রামানক দ্বীপ হল বর্তমান ফিজি
কালীয় নাগের ধামকে বলা হয় রামাণক দ্বীপ। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বাহন শ্রীগরুড় দেবের ভয়ে কালীয় নাগ একবার রামাণক দ্বীপ ছেড়ে চলে আসেন বৃন্দাবনের যমুনা নদীতে, তিনি জানতেন গরুড়দেব কখনোই যমুনায় আসবেন না। কালীয় নাগের বিষের প্রভাবে যমুনার জল ছিল বিষাক্ত। যখনই গাভী, বাছুরেরা সেই জল পান করে তৎক্ষণাৎ তারা মৃত্যুবরণ করে। সকলে কালীয়র ভয়ে ছিল তটস্থ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
একদিন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সখাদের সাথে বল খেলছিলেন। খেলার কোন এক মুহূর্তে বল গিয়ে পড়ল যমুনা নদীতে। তৎক্ষণাৎ নদীর সন্নিকটে একটি বৃহৎ বৃক্ষের উপর উঠে তিনি সবকিছু অবলোকন করতে লাগলেন। এরপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বল নিতে যমুনায় ডুব দিলেন। কালীয় ভগবানকে তৎক্ষণাৎ সেই স্থান পরিত্যাগ করতে বললেন। কিন্তু ভগবান সেই কথায় কর্ণপাত না করে নদীতে সাঁতার কাটতে লাগলেন। কালীয় কৃষ্ণের সম্মুখে এসে তাকে বহুবার দঃশন করতে লাগলেন, কিন্তু তাতে সেই ছোট্ট গোপালের কোন ক্ষতিই হল না। সুবৃহৎ কালীয় সর্প বিষ উদ্্গীরন করতে করতে শ্রীকৃষ্ণকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। তখন শ্রীকৃষ্ণ এতই বৃহৎ আকার ধারণ করলেন যেন কালীয় নাগ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে আঘাত করতে লাগলেন এবং তার ফনার উপর নৃত্য করতে লাগলেন। এভাবে কালীয় হলেন পরম সৌভাগ্যবান দুইজনের মধ্যে একজন যার মস্তকে ভগবান তার শ্রীচরণ রেখেছিলেন! শ্রীকৃষ্ণের ছন্দময় অপূর্ব নৃত্যর কারণে কালীয় নাগের জীবন বিপন্ন প্রায় এবং তার সকল বিষ বমির মাধ্যমে বের হয়ে গেল। তখন কালীয় নাগের স্ত্রীগণ শ্রীকৃষ্ণের কাছে নত মস্তকে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণ ১টি শর্তে রাজী হন।
শর্তটি ছিল কালীয়কে অবশ্যই যমুনা ও বৃন্দাবন পরিত্যাগ করে দূরে মধ্য সমুদ্রের অবস্থিত রামাণক দ্বীপে ফিরে যেতে হবে। কালীয় নাগ ভগবানের চরণে ক্ষমাভিক্ষা করেন এবং কারো অনিষ্ট করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে ক্ষমা করেন এবং রামাণক দ্বীপে (ফিজি) ফিরে যেতে অনুমতি দেন। এভাবে কালীয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহত্ব উপলব্ধি করে তার নিত্য সেবকে পরিণত হন।
দেগিই না কালীয়
ফিজিতে সাধারণত কোন সাপ নেই কিন্ত সকল ফিজিবাসী বিশ্বাস করেন সেখানে রয়েছে একটি সুবৃহৎ সাপ। যার নাম ‘দেগিই’, যেটি ফিজির উত্তর,পশ্চিম অংশের একটি বৃহৎ দ্বীপ বনুয়া লেবুতে অবস্থিত নকভদ্র পাহাড়ের একটি গুহায় এখনো অবস্থান করছে। ফিজির পৌরাণিক কথা অনুসারে ‘দেগিই’ হলেন একজন পৌরাণিক সর্প দেবতা যিনি সকল ফিজিয়ানদেরকে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ফিজিতে নিয়ে আসেন।
স্থানটি ছিল লাউটোকার সন্নিকটে ভুদা। ভিইসিইসিই হল ভুদার একটি গ্রাম যেখানে প্রথম উপনিবেশ হয়েছিল। দেগিই ভুদা থেকে উত্তরে ভ্রমণ করে নকভদ্র পর্বতে চলে যান এবং সেখানেই তিনি স্থায়ীভাবে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনার সাথে কালীয়ের ঘটনা মিলে যায়। দেগিই যদিও ছিলেন এক দৈত্যকার সর্প তথাপিও তিনি তার ইচ্ছায় মনুষ্যরূপ ধারণ করতে পারতেন। ঐতিহাসিক মতে, এই সর্প যখন গড়িয়ে পড়তেন তখন ভূমিকম্পন হত। বহু ঐতিহাসিক তাদের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক গবেষণাপত্রে ফিজির এই পৌরাণিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।
ফিজির প্রাচীন ইতিহাস
যখন ভারতীয়রা ফিজিতে প্রথম আসেন তখন থেকে তারা বিশ্বাস করতেন, এই ফিজিই হল রামাণক দ্বীপ, যেখানে কালীয় নাগকে পাঠিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এই লীলা স্মরণ করে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন), তথা হরেকৃষ্ণ আন্দোলন এখানে তাঁদের প্রথম মন্দির স্থাপন করে। ১৯৭৬ সালে ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ফিজি ভ্রমণ করে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণ কালীয়া মন্দির, যেটি লাউটোকাতে অবস্থিত।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, এই স্থান হল কালীয় নাগের যিনি গরুড়দেবের তাড়ায় বৃন্দাবনে গমন করেন এবং পুনরায় শ্রীকৃষ্ণের আদেশে ফিরে আসেন। প্রভুপাদ আরো উল্লেখ করেন, ফিজিতে কোন সাপ নেই কেননা কালীয় নাগ বহুকাল পূর্বে সকল সর্পকে ভক্ষণ করেছিলেন। এই মন্দিরের আরাধ্য বিগ্রহ কালীয়ের মস্তকের উপর নৃত্যরত শ্রীকৃষ্ণ। এখানের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শত শত বছর যাবৎ বিশ্বাস করে আসছে, দেগিই সর্পই হলেন কালীয় নাগ, যার মস্তকে রয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের ছাপ। শুধুমাত্র দেগিই কিংবা কালীয় নাগই নয় সনাতন ধর্ম ও ফিজিয়ান প্রাচীন ধর্মের মধ্যে বহু সাদৃশ্য রয়েছে। ফিজিতে খ্রিস্টান মিশনারীরা রয়েছেন প্রায় দুই দশক যাবৎ, এই সময়কালের পূর্বে এখানের সকলে প্রাচীন বৈদিক ধর্ম পালন করতেন। ফিজিয়ানদের প্রাচীন ধর্মীয় প্রথার সর্ম্পকিত তথ্যাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন প্রাচীন মিশনারীদের অন্যতম থমাস জেগার ও থমাস উইলিয়াম। এখানে ১৯ শতকে ফিজি ও ফিজিবাসীদের ধর্মীয় ও প্রাত্যহিক আচার আচরণের কথা উল্লেখ আছে।
দুভার্গ্যক্রমে, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কুসংস্থার বলে মনে করলেন। থমাস জেগার উল্লেখ করেছেন ফিজিবাসীগণ নিকট আত্মীয় বা বন্ধুর মৃত্যুতে নিজের মস্তকের কেশ মুন্ডন করে শোক প্রকাশ করতেন। তারা সর্পদেবতা তথা কালীয় নাগের পূজা করত। এছাড়া বিগ্রহকে চন্দনে সজ্জ্বিত করত। উইলিয়াম উল্লেখ করেছেন প্রাচীন ফিজিবাসীগণ আরো দুইজন দেবদেবীর পূজা করত যাদের ছিল অষ্ট বাহু, অষ্ট চক্ষু। অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ আকৃতির ছিল একটি বিগ্রহ। এছাড়া ছিল যাগযজ্ঞের আয়োজন। এখানের প্রাচীন ভক্তগণের ছিল উষ্ণ পাথরের উপর হেটে যাওয়ার ক্ষমতা। বৈদিক সনাতন ধর্মের সাথে এই সকল রীতিনীতি পুরোপুরি মিলে যায়।
আসেসিলা রাভুভু নামক একজন ফিজি বিশেষজ্ঞ বলেন, “যদিও শত বছর যাবৎ খ্রিস্টানধারার অনেক প্রভাব ছিল ফিজির উপর, তথাপিও প্রাচীন ফিজির বহু রীতি এখনো প্রচলিত রয়েছে। ফিজিবাসীগণ এখনো খ্রিস্টান মতের ঈশ্বর ও তাদের প্রাচীন দেবতা একই বলে বিশ্বাস করেন। ”
এই কারণেই ফিজিতে সনাতন ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে একটি সুন্দর সহবস্থান এবং এই কারণে এখানে কখনোই ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি হয়নি।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
১. ফিজির একটি স্থানীয় বিগ্রহের নাম “কালাউ”। এই নামের সাথে “কালীয়” নামের সাথে মিল রয়েছে। প্রসঙ্গত বর্তমানে ফিজিতে প্রাচীন ফিজিয়ান ধর্মের মানুষের অবস্থান স্বল্প। কেননা এই প্রাচীন ধর্মের মানুষগণ পরবর্তীতে ধর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে খ্রীস্টান ধর্মে অন্তভুক্ত হয়েছেন।
২. ফিজির লামবাসাতে একটি নাগ মন্দির রয়েছে। অদ্ভুতভাবে এখানে রয়েছে বাড়ন্ত পাথর (সময়ের সাথে সাথে যে পাথরের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে)। এই সকল পবিত্র পাথরসমূহকে ইংরেজীতে ঝহধশব জড়পশ ও বলা হয়। প্রতি ১-২ বছরে এই মন্দিরের উচ্চতা বাড়তে থাকে। স্থানীয়দের মতে, কোবরা সদৃশ পাথরটি ১৫০ বছর পূর্বে ছিল ২ ফুট। বর্তমানে এই পাথরটির দৈর্ঘ্য ১৫ ফুট। ব্রিটিশগণ ফিজিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে এলে, এখানে নিয়মিত পূজার্চনা হত। এই মন্দিরের উপরিভাগে রয়েছে একটি বিশাল পাহাড় যেখানের পাথরে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন মূর্তি আবির্ভূত হয়েছে। এই মন্দিরের পাশাপাশি রয়েছে একটি বিস্ময়কর ভাসমান দ্বীপ, যেটি ঘন ঘন তার স্থান পরিবর্তন করতে থাকে।
৩. এই সর্প পাথরটি সরিয়ে একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই কাজ করতে এসে নির্মাণ শ্রমিকেরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই সেই চেষ্টা সফল হয় নি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপাধন্য কালীয় নাগের সংস্পর্শ পাওয়া এই দ্বীপগুলোতে সর্প পাথরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কালীয় নাগ বর্তমানে ফিজির বনুয়া লেবু দ্বীপে (রাকিরাক) অবস্থান করছেন, কিন্তু তিনি কাউকে দর্শন দান করেন না। তবে সৌভাগ্যবান কয়েকজন দাবী করেছিলেন তারা কালীয় নাগের দর্শন লাভ করেছেন। যদি কালীয় নাগ ফিজিতে অবস্থান করেন, তাহলে ফিজি তথা রামাণক দ্বীপ কোন সাধারণ দ্বীপ নয়, এটি একটি পবিত্র তীর্থ স্থান। সামর্থ্যবানেরা, সেই আশ্চর্যপূর্ণ অদ্ভুত নাগ মন্দির ও রামানক দ্বীপ দর্শনের জন্য ফিজি যাত্রা করতে পারেন নতুবা ইউটিউবে গিয়ে ভার্চুয়াল দর্শন লাভ করতে পারেন।
সূত্র: ১. ফিজি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আর্কাইভ ২. ফিজি টাইমস্ ৩. ইস্কন নিউজ ৪. বহু গবেষণা প্রবন্ধ ৫. ইউটিউব

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।