কর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্র (পর্ব-১) কর্মচক্র

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২২ | ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ | ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 201 বার দেখা হয়েছে

কর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্র (পর্ব-১) কর্মচক্র

কর্মচক্র

এই পর্বে বিশেষত কৰ্মচক্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হলেও জ্যোতিষশাস্ত্রের – সঙ্গে কর্মফল সম্বন্ধ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদান করা হল । (১৫ মার্চ ২০১৭, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইস্কন মন্দিরে প্রদত্ত ইংরেজি প্রবচনের বঙ্গানুবাদ)

শ্রীমৎ ভানু স্বামী


জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে সারাবিশ্ব অবগত। এটি বিজ্ঞানসম্মত এটি ভারতে ‘আরও জনপ্রিয় । অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাঝে এ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখ রয়েছে কিভাবে পরীক্ষিত মহারাজের জন্মলগ্নে জ্যোতিষশাস্ত্রের সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। অতীতে ভারতবর্ষে এর প্রচলন অনেক বিস্তৃত ছিল। যারা জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী তাদের বলা হয় জ্যোতিষ। পশ্চিমা বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকে জ্যোতিষশাস্ত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। অনেক সভ্যতায় পূর্বপুরুষরা এটি অনুশীলন করতেন। খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাবের পরেও জ্যোতিষশাস্ত্র অনুশীলনের প্রচলন ছিল। পত্র-পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে কলাম থাকে বা প্রতিদিনের রাশির ক্রিয়া সমূহ উল্লেখ থাকে। শুধুমাত্র জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্যিকভাবে ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষ ছাড়াও পৃথিবীর বহু প্রাচীন সংস্কৃতিতে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রচলন ছিল। তারা বিভিন্ন প্রকার ভবিষ্যদ্বাণী করতো। যদি ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় তার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি আমাদেরকে কেউ না কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই সবসময়ই এ নিয়ে রহস্য বা কৌতুহল সাধারণ মানুষের মাজে বিদ্যমান। অনেক লোক ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য আকাশ নিয়ে গবেষণা করে। এখন প্রশ্ন হল আরো অনেক পদ্ধতি থাকতে তারা আকাশ নিয়ে কেন গবেষণা করত? যদিও কিছু কিছু স্থানে যেমন চায়না, আফ্রিকাতেও লোকেরা ভবিষ্যৎ জানার জন্য অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করে। তবে ভবিষ্যৎ দর্শনের জন্য আকাশ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা পরিলক্ষন করত কিভাবে তারকারাজির গতিবিধি পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন প্রদর্শিত হয়। এগুলোকে জোডিয়াক চিহ্ন বলা হয় এবং এগুলো বিশ্বের অনেক সংস্কৃতিকে বেশ প্রসিদ্ধ। ভারত ও পশ্চিমা অনেক জ্যোতিশাস্ত্রবিদদের জন্যেও এটি প্রসিদ্ধ। এ পদ্ধতিও সুবিধাজনক কেননা আমাদের ১২টি মাস রয়েছে, সূর্য এ সমস্ত জোডিয়াক চিহ্নের চারদিকে প্রায় ৩৬৫ দিনে প্রদক্ষিণ করে এবং এগুলোকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দিনপঞ্জিকা তৈরি করা হয়। অনেক এশিয়ান সংস্কৃতিতে আকাশ নিয়ে গবেষণা করে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
২৬০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের স্টোনহেঞ্জ থেকে এ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। এখানে কিছু পাথর রয়েছে। এ পাথরগুলো ১০০ মাইল দূর থেকে সেই প্রাচীন যুগে কোন আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই ইংল্যান্ডের এই স্থানে নিয়ে এসে এই বিশাল স্থাপনাটি তৈরি করা হয়। যদিও যে প্রাচীন সংস্কৃতির লোকেরা এটি তৈরি করেছিল সে সংস্কৃতি অনেক পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই অনেক বছর ধরে এই স্থাপনাটি সবার কাছে রহস্যময় ছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালে মানুষ পাথরগুলোর অবস্থান সম্পর্কে সঠিকভাবে পরিমাপ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে গবেষণা করে। অনেক গবেষনার পর তারা বুঝতে পারে যে, এটি প্রকৃতপক্ষে গ্রহণ গণনার একটি পদ্ধতি। সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে প্রাচীন লোকেরা ভবিষ্যৎবাণী করতে পারত ঠিক কখন পরবর্তী গ্রহণ হতে যাচ্ছে। এটি অনেক আগের ঘটনা। ঠিক একই সময়ে ভারতবর্ষের ঋষিরা বেদ চর্চা করছিল আর অন্য দিকে ইংল্যান্ডে এ সমস্ত প্রাচীন লোকেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে এভাবে গ্রহণ নিয়ে গবেষণা করছিল।
২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মিশরের লোকেরা অনেক সময় ধরে দূরদূরান্ত থেকে নির্দিষ্ট আকৃতির খোদাইকৃত পাথর একটি স্থানে নিয়ে এসে পিরামিড তৈরি করেছিল। পিরামিডগুলো তৈরি করতে অনেক সময় অথবা হয়তো এক জীবনও লেগেছিল। জ্যামিতিক উপায়ে যথোপযুক্তভাবে তারা এগুলো তৈরি করেছিল। পূর্বে বলা হত পিরামিডগুলোতে মমি রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে সবচেয়ে বৃহৎ একটি পিরামিডের ভেতরে ঢুকে দেখা যায় সেখানে কোন মমি নেই, বরং তারা অন্য কিছু দেখেছিল। সেগুলো প্রকৃতপক্ষে কেন তৈরি করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই তবে গাঠনিক দিক থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিভিন্ন তথ্যের সঙ্গে এগুলো বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে পিরামিডগুলোর মাধ্যমে নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হত বলে ধারণা করা হয়।
তৎকালীন সিরিয়াতে জুগুগারাট নামে আরেকটি স্থাপনা অবস্থিত, যেটি বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত। এটি ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেও প্রাচীন সভ্যতার লোকেরা এটি তৈরি করে আকাশ নিয়ে গবেষণা করত। তারাও জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে আগ্রহী ছিল। এজন্যে আকাশ ও নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্যে এ স্থাপনাটি তৈরি করা হয়। আমেরিকায় আরেকটি স্থাপনা রয়েছে যেটি প্রাচীন সংস্কৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। আজটেক শ্রাইনস্ (১৫০০ খ্রিস্টাব্দে) নামে এই স্থাপনাটি বিশাল আকৃতির। ৭০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি মায়ান পিরামিড তৈরি হয় মধ্য আমেরিকাতে, এটিও প্রাচীন ভিন্ন এক সংস্কৃতি কর্তৃক তৈরি হয়। মায়ান সংস্কৃতির একটি বিখ্যাত দিনপঞ্জিকা রয়েছে, যেটি ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর সমাপ্তি হয়েছিল।
দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে ২০০ খ্রিস্টাব্দে বৃত্তাকার আকৃতির আরেকটি স্থাপনা স্থাপিত হয় ভিন্ন সংস্কৃতির মাধ্যমে। তারাও আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থাপনার বিভিন্ন স্তর অনুসারে সূর্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করে মাস ও বছর নির্ধারণ করত। ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে ইচ্ছা সভ্যতার মাধ্যমে আরেকটি স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় এবং তারাও এর মাধ্যমে আকাশের তারাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করত। এশিয়াতে কম্বোডিয়ায় অবস্থিত অ্যাঙ্কর ভাট মন্দির যেটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ হিন্দু মন্দির হিসেবে পরিচিত, সেটিও শুক্র গ্রহের উদয় অনুসারে মন্দিরটি সুবিন্যস্তভাবে তৈরি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এটি মূলত পূর্বে বিষ্ণু মন্দির ছিল। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে চায়ানতে গাও চেং এবং ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত জন্তর মন্তর নামে আরেকটি স্থাপনা গ্রহ ও তারাদের গতিবিধি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য বিশেষত ভারতে এই ধরনের অনেক স্থাপনার নিদর্শন রয়েছে। কোনার্কের সূর্য মন্দির নামে একটি স্থাপনা পুরীতে অবস্থিত। কোনার্কের মন্দিরটি সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এটি বেশ প্রতীকী একটি মন্দির কেননা এখানে অনেকগুলো রথের চাকা রয়েছে। চাকাগুলো মাস ও বছরকে প্রতিনিধিত্ব করে অথবা রাশিচক্র বা জোডিয়াক সূর্যরথের সঙ্গে সম্বন্ধীয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে ব্যবহৃত চক্র কর্মচক্রকেও নির্দেশ করে। এই কর্মচক্র বিষয়ে বৌদ্ধ ও ভারতীয় বিভিন্ন ধর্মীয় সাহিত্যে বর্ণনা রয়েছে।

কর্মচক্র

কর্মচক্রটি একটি বৃত্তাকার সদৃশ, যেটি নির্দেশ করে যে কর্মের কোন শুরু বা শেষ নেই। চিরকাল এটি ঘূর্ণায়মান কিন্তু এই কর্ম আমাদেরকে অনেক ভবিষ্যৎবাণী প্রদান করে থাকে। জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারে সূর্য বৃত্তাকার গতিপথে ঘূর্ণায়মান। অন্যান্য গ্রহগুলোও সূর্যের চতুর্দিকে ঘূর্ণায়মান। রাশিচক্র বা জ্যোতিস্কও অবিরতভাবে ঘূর্ণায়মান। এভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়।

বাসনা ও কার্যকলাপ

কর্ম বিশেষত নির্ভর করে আমাদের বাসনা ও কার্যকলাপের ওপর। কর্মকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, যে কার্যকলাপ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রদর্শন করে। সংস্কৃতে ‘কর্ম’ শব্দটির পরিবর্তে ‘দৈব’ বা ‘অদৃষ্ট’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ‘দৈব’ মানে দেবতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যেটি অদৃশ্যভাবে হয়। প্রকৃতপক্ষে দেবতারা নয় বরং আমরাই আমাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে থাকি। অর্থাৎ, আমাদের ভোগ বাসনা ও দুঃখ-দুর্দশা এড়িয়ে চলার বাসনা রয়েছে এবং এই বাসনার মাধ্যমে আমাদের কার্যকলাপ প্রদর্শিত হয়। কিছু কিছু কর্মের ফল তাৎক্ষণিক পাই। যেমন- অজান্তে বা অসাবধানতায় বিদ্যুতের তারে হাত দিলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশংকা, শরীরে হঠাৎ বেশি ঠাণ্ডা লাগালে তাৎক্ষনিক সর্দির ইত্যাদি। কিছু কিছু কর্মফল বহু দিন পর প্রকাশিত হয়। যেমন, ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাবে ক্যান্সার, অবৈধ যৌনসঙ্গের পর এইডস ইত্যাদি। যা হোক আমরা যখনই কোন কর্ম করি তখন তৎক্ষণাৎ এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করি। ভালো বা মন্দ কর্মের প্রতিফলন আমাদের জীবনে প্রাপ্ত হই । আমাদের সমগ্র জীবনে এভাবে আরেকটি চক্র দৃশ্যমান হয়।
প্রথমে মন বাসনার সৃষ্টি করে ফলে বাসনানুসারে কর্ম করা হয় এবং সেই কর্মের একটি প্রতিক্রিয়া বা ছাপ আমাদের মনে গেঁথে যায় এবং তখন মন সেই অনুসারে আরও বাসনা করতে থাকে। এরপর করবো কি করব না এরকম দ্বন্দের মাধ্যমে কার্যকলাপ প্রদর্শিত হয় এবং এভাবে সেই কার্যকলাপ বা কর্মের ছাপ পুণরায় মনের মধ্যে রেখে যায়। এভাবে ইন্দ্রিয়গুলো দ্বারা মনে বাসনা সৃষ্টির মাধ্যমে কর্ম প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যা জীবনকাল ধরে ঘূর্ণায়মান হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় নরকের তিনটি দ্বার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে: কাম, ক্রোধ ও লোভ। যদি এই তিনটির মাধ্যমে আমরা কোন কর্ম করি তবে আমাদের ভবিষ্যৎ সুখের হয় না। এই সবকিছুই ঘটে আমাদের অবিদ্যা বা অজ্ঞতার কারণে।
সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র, বৌদ্ধ ধর্মসহ বিভিন্ন দর্শনে দেখতে পাই অবিদ্যার কারণে আমরা বাসনা তৈরি করি এবং বিভিন্ন কর্ম করি। অবিদ্যা থেকে ক্লেশ উৎপন্ন হয়।

দীর্ঘ সময় জাত কর্মের প্রভাব

দীর্ঘ সময়ের কর্মের প্রভাবে ফলভোগ করার জন্য আরেকটি দেহ ধারণ করতে হবে। বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, আমাদের এক জীবনেই অগণিত কর্মফল সঞ্চিত হয়, সেই কর্মফল ভোগ করার জন্য জন্মজন্মান্তর পর্যন্ত প্রতীক্ষা করতে হয়। এ জন্মে কর্মফল ভোগ এবং আবার এই জন্মেই নতুন নতুন কর্মফল সৃষ্টি করে অনেক জন্মজন্মান্তর ধরে এভাবে কর্মফলের স্তুপ জমা হয়। মৃত্যুতেই কর্মফল নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং পূর্বকৃত কর্ম ও নতুন নতুন কর্মের প্রভাবে অন্তহীন কর্মচক্রের সৃষ্টি হয়। এভাবে জন্ম-মৃত্যুর মধ্যদিয়ে কর্মফল উপভোগ ও এর দুঃখদুর্দশা অব্যাহত থাকে। এই কর্মচক্র ভেঙে ফেলা অত্যন্ত দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার।

কর্ম অনুসারে বিভিন্ন দেহ

কর্মফল অনুসারে ৬ প্রকার দেহ আমরা লাভ করতে পারি, এই ছয়টি দেহ কালের নিয়ন্ত্রণাধীন।
বৌদ্ধ ধর্মেও এই ধরনের একটি কর্মচক্রে ৬টি ভাগ। রয়েছে। কেউ যদি খুব ভাল কর্ম করে তবে স্বর্গলোকের দেবতার শরীর লাভ করবে। মন্দ কর্ম করলে অসুরদেহ ও প্রাণীদেহ। অধিক মন্দ কর্ম করলে নরকের জীব হিসেবে দেহ লাভ করবে। আরো অধিক মন্দ কর্ম করলে ভূত বা প্রেতাত্মার দেহ লাভ করবে। বৌদ্ধদের সেই কর্মচক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সাপ, মুরগী ও শূকর যেগুলো কাম, ক্রোধ ও লোভকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এই তিনটি শক্তি আমাদেরকে কর্ম করতে অনুপ্রাণিত করে এবং পরিশেষে এ দেহগুলো প্রাপ্ত হই।
এ বিষয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উপরোক্ত ছবিটি বেশ উল্লেখযোগ্য। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে আমাদের জন্ম-মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি অসীম। এর কোন আদি বা অন্ত নেই। বিভিন্ন যোনীতে জীবাত্মা অন্তহীনভাবে ভ্রমণ করে থাকে।

কর্মের সমান প্রতিক্রিয়া

যে কেউ দুই ধরনের কর্ম করতে পারে। আপনি অনুকম্পাময় বা দয়াশীল কর্ম করতে পারেন যাতে ভালো ফলাফল আসে। এ প্রকার কর্মের ফলে ভবিষ্যতে কষ্টকর বা ঝুঁকিপূর্ণ কর্ম করা ছাড়াই আপনি সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারেন। এজন্যে আপনি হয়ত ভালো কোন পরিবারে জন্ম নিয়ে আরাম-আয়েশের জীবন উপভোগ করতে পারেন বা কম পরিশ্রমে অধিক অর্থ অর্জন করতে পারেন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারবেন ইত্যাদি। এজন্যে আমরা কি কর্ম করছি সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ এর মাধ্যমেই আমাদেরকে ভবিষ্যতের শরীর লাভ করতে হবে। বেশী পাপ করলে নিম্ন শরীর লাভ করতে হবে। যেখানে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদি ভালো। কর্ম করা হয় তবে উচ্চতর দেহ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যেখানে কম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন: দীর্ঘ আয়ুষ্কাল, সুস্বাস্থ্য ইত্যাদি। অবশ্য এ সমস্ত নির্দেশনা মনুষ্য দেহের জন্য। পশু শরীরে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয় না। সাধারণত দেখা যায় কুকুরের মত জীবজন্তুদের কর্মগুলো পূর্ব থেকেই বলে দেওয়া যায়। কোন পাগল কুকুরের ক্ষেত্রে সেটি ভিন্ন হতে পারে। তবে তারা তাদের নির্দিষ্ট প্রকৃতি লঙ্ঘন করে না। পক্ষান্তরে মনুষ্যদের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা রয়েছে আর এজন্যে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। তাকে বিচার করতে হয় কিভাবে যথাযথভাবে প্রকৃতির নিয়মে কর্ম করতে হবে। নতুবা পশুদের মত মনোভাব থাকলে পরবর্তী জন্মে পশু শরীর লাভ করতে হবে। যে রকম মনু-সংহিতায় বলা হয়েছে, – মাংস ভক্ষসায়িত…
“আমি এই জন্মে তোমার মাংস ভক্ষণ করছি, পরবর্তীতে তুমি আমার মাংস ভক্ষণ করবে।” এগুলো হচ্ছে কতগুলি আইন। আপনি যেরকম সহিংস আচরণ করবেন, ঠিক সেরকম আচরণ আপনি প্রাপ্ত হবেন। আপনি যদি কাউকে হত্যা করেন তবে আপনাকেও হত্যা করা হবে।

দুষ্ট চক্র

সহিংস কার্যক্রমের জন্য আমাদের অধঃপতিত হতে হয়। এজন্যে নির্দিষ্ট শরীরে বহু কষ্ট পেতে হয়। যদি মনুষ্য শরীর লাভ হয় তবে পূর্বকৃত কু-কর্মের ফলস্বরূপ অনেক ক্রোধ প্রকাশিত হয় এবং সেই ক্রোধের ফলে নতুন নতুন কর্মফল সৃষ্টি হয়। আমরা আরো নিম্ন শ্রেণীর কর্ম করতে বাধ্য হতে পারি। এজন্য পরবর্তীতে আরো নিম্ন শ্রেণীর শরীর লাভ হবে এবং আরো নিম্ন শ্রেণীর কর্ম করতে বাধ্য হতে পারি। এভাবে মনুষ্য শরীর থেকে নিম্ন যোনী প্রাপ্ত হওয়ার মাধ্যমে অধঃপতন ঘটতে পারে । এই দুষ্ট চক্র থেকে বের হয়ে আসাটা প্রায় দুঃসাধ্য। তবুও এই চক্র ভাঙার একটি আশা রয়েছে।

দুষ্ট চক্র ভঙ্গ

দুষ্ট চক্র ভঙ্গ করতে হলে সঠিক কার্য করতে হবে। বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্রে এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আমাদেরকে এ বিষয়ে চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিজেকে প্রশিক্ষিত হতে হবে। আপনার কোন বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত এই দুষ্টচক্র ভেঙে দিতে পারে। আপনি যদি নতুন মূল্যবোধ অর্জন করেন। তবে সে অনুসারে কর্ম করে সুকর্মফল ভোগ করতে পারেন। এটি সম্ভব একমাত্র মনুষ্য জীবনেই । এই প্রক্রিয়া হয়তো কঠিন হতে পারে কিন্তু সম্ভব।

দুই জমজের কাহিনি

দুই জমজের একটি কাহিনি রয়েছে। তারা দুজনই একই সময়ে জন্ম নিয়ে একই জ্যোতিষ চার্ট প্রাপ্ত হয়। এজন্যে তারা একই কর্মফল নিয়ে একটি পরিবারে জন্ম নেয়। তারা প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার একটি শহরে কোন দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল তারা যখন বেড়ে উঠে তখন পরস্পর বিপরীতমুখী জীবন যাপন করে। তাদের একজন অপরাধমূলক কর্মে লিপ্ত এবং অন্যজন সম্মানিত ব্যক্তি, কঠোর পরিশ্রম করে সমাজ সেবামূলক কর্মে লিপ্ত। এটি কিভাবে সম্ভব হল? খারাপ ছেলেটি যখন জেলে যায় তখন তার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সে তখন সব প্রতিকূল অবস্থার কথা বলতে লাগল যে, পরিবেশ বিদ্যালয় ইত্যাদি ভালো ছিল না। তো এমতাবস্থায় তার কি করার ছিল? এজন্যেই সে অপরাধী হয়ে উঠল এবং তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হল । অপরদিকে অন্য ভাইটি সাক্ষাৎকারে বলল, সে একটি মন্দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূল, যা ছিল অসহনীয়। এজন্য সে এই প্রতিকূল অবস্থা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে। এজন্য সে অনেক পরিশ্রম করে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে জীবনের প্রেক্ষাপট পাল্টে দেয় ।
এভাবে প্রকৃতপক্ষে আমরা সম্পূর্ণরূপে কর্মের নিয়ন্ত্রণাধীন নই। জন্মের জ্যোতিষ চার্ট নির্দিষ্ট কর্মফল থাকলেও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আমরা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। যদিও অজ্ঞানতার কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দুরুহ হতে পারে। তবুও কোনভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কর্মচক্রের পরিবর্তন সম্ভব। আমরা বলতে পারি না “যা কিছু হয়েছে কর্মফলের কারণে।” এখানে বিষয়টি হল এর মাঝেও আপনি কিরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সুকর্মের ফলে এমনকি এ জন্যেই আমরা সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারি।
অতএব, আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতি এবং সর্বোপরি আমাদের জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। আমি বলতে পারি না “এই কাজটি করার জন্য আমি বাধ্য হয়েছি।” তা নয়, প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধান্তটি আমাদেরই। এই সিদ্ধান্তগুলিই জন্মান্তরের গতি নির্ধারণ করে।

নতুন মূল্যবোধ অভ্যাসের অনুশীলন

সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমাদেরকে নতুন নতুন মূল্যবোধের অনুশীলন করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে জন্ম নেওয়ার পর আমরা সেখানকার অবস্থার সঙ্গে বদ্ধ হয়ে পড়ি। ফলে নির্দিষ্ট অভ্যাস, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি গড়ে উঠে। যদি এ অবস্থা বা পরিস্থিতি ভালো না লাগে তবে সে অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা যায়। যদিও অভ্যাস বা নির্দিষ্ট অবস্থা পরিবর্তন করাটা কিছুটা কঠিন । বিশেষত জন্মের প্রথম ১৫ বছর যে অভ্যাসগুলো গঠিত হয় তা পরিবর্তন করা অত্যন্ত কঠিন। প্রথম ১৫ বছর যে অভ্যাস গঠিত হয় সাধারণত তা সমগ্র জীবন অব্যাহত থাকে। কিন্তু কোনভাবে পূর্বের চিন্তা-চেতনা, অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারলে কর্মচক্রের সমাধান সম্ভব।

ব্যক্তিগত লক্ষ্যের অনুসন্ধান

এই পরিবর্তনের জন্য প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত আমি কে? আমার জীবনের লক্ষ্য কী? এ প্রশ্নগুলো আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। অন্তদর্শন বা নিজেকে আবিস্কারের মাধ্যমে যে নতুন মূল্যবোধগুলোর উদয় ঘটে সেগুলো হল : সহিষ্ণুতা, অনুকম্পা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি। এ প্রকার মূল্যবোধগুলো অবলম্বনের মাধ্যমে এই জন্মে ও পরবর্তী জন্মের সুকর্মের জন্য সুফল প্রাপ্তি ঘটে। এ জন্যে নিজের কল্যাণের জন্য সুচিন্তা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মের সিদ্ধান্ত

যদি আমরা সুকর্ম করতে চাই তবে নিজেদেরকে ৫টি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা উচিত, ৫টি প্রশ্নের উত্তরই ইতিবাচক হতে হবে। যদি আমাদের বর্তমান জীবনে এ প্রশ্নগুলোর কোনটি নেতিবাচক আসে তবে সেটি বর্জন করতে হবে।
১। শারীরিক : এটি কি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী? যদি না হয় তবে তা বর্জন করুন। খুবই সরল ব্যাপার। এই সরল প্রশ্নটির সরল উত্তরই প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সবার জীবন এমন হয়ে গেছে যে, পর্যাপ্ত তথ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা বিভ্রান্ত । যেমন, সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে “ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।” তবুও লোকেরা প্রচুর অর্থ খরচ করে ধূমপান করে। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য এই সরল প্রশ্নটি করা উচিত এবং ইতিবাচক উত্তরটিই অনুসরণ করা উচিত।
২। এটি কি মনের জন্য ভাল? শরীরের উর্ধ্বে মনের জন্য এই প্রশ্নটি করা উচিত। এই কর্মটি কি আমার জন্য দুশ্চিন্তা নিয়ে আসবে? এভাবে বিবেচনা করা উচিত। যদি কর্মটি মনের স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি নিয়ে আসে তবে সেই কর্মই করা উচিত।
৩। এটি কি সত্য? মূল্যবোধের স্তরে এই প্রশ্নটি করা উচিত। এই কর্মটি কি মিথ্যা নাকি সরল সোজা বা সত্য এভাবে বিবেচনা করা উচিত।
৪। এটি কি সৌন্দর্য নিয়ে আসে? ভাবাবেশের স্তরে এই প্রশ্নটি করা উচিত। এই কর্মটি কি সবার জন্য সৌন্দর্য নিয়ে আসে নাকি ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে কুৎসিততা নিয়ে আসে এভাবে বিবেচনা করা উচিত।
৫। এটি কি অহৈতুকী ভালোবাসা বা প্রেম নিয়ে আসে? নাকি ঘৃণা নিয়ে আসে এভাবে বিচার্য।
অতএব সবকিছুর মধ্যে এই ৫টি প্রশ্ন করে যদি ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যায় তা করণীয়। যদি নেতিবাচক উত্তর পাওয়া যায় তবে তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। এটি খুবই সরল পন্থা যা সামগ্রীক সমস্যার সমাধান করবে।
এই পাঁচটি প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে পুরাতন মূল্যবোধগুলো পরিত্যাগ করে নতুন মূল্যবোধের পথে পরিচালিত করে।
আমরা শাস্ত্রের মাধ্যমে এই দুষ্ট কর্মচক্র থেকে পরিত্রানের দিক নির্দেশনা লাভ করতে পারি যার মাধ্যমে নিম্ন চেতনা সম্পন্ন মন থেকে উচ্চতর চেতনাসম্পন্ন আত্মার প্রতি মনোনিবেশ ঘটবে।

জ্যোতিষশাস্ত্র এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জ্যোতিষশাস্ত্র আপনাকে নিম্নচেতনাসম্পন্ন মনোভাব থেকে অনুকম্পার মনোভাবের পথে পরিচালিত করতে পারে। আপনি তখন দয়াশীল হয়ে ক্ষুধার্তদের খাদ্য দান, বন্যার্তদের ত্রান দান, শীতার্তদের বস্ত্র দান ইত্যাদি করবেন।আপনি বিভিন্ন পূজার্চনা করতে পারেন।


শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে তিনি নিজেকে বিতরণ করেছেন “কোন মূল্য ছাড়া আমাকে নাও, আমাকে গ্রহণ কর।” এই হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি স্বয়ং কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণচৈতন্য রূপে নিজেকে | বিতরণ করার জন্য অবতরণ করেছেন। তাই তিনি নমো মহাবদান্যায়, পরম দাতা। অন্য কোন অবতারে, এমনকি রামচন্দ্র বা ভগবান কৃষ্ণ অবতারেও তারা এতটা উদার ছিলেন না।

জ্যোতিষশাস্ত্রে বিভিন্ন গ্রহের বিগ্রহের উপাসনার কথা বলা আছে। সবারই ভালো বা মন্দ অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। এগুলো বিবেচনা করে আমরা কর্মের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সঠিক সাধুসঙ্গ। যদি আমরা ভক্তসঙ্গ করি তবে অবশ্যই উচ্চতর জ্ঞান লাভ করতে পারি। আমরা তখন কর্মের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরও গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে পারব। এভাবে উপরোক্ত বিষয়সমূহ উচ্চতর চেতনা লাভ করতে সহায়তা করবে। আমরা তখন কাম, ক্রোধ, লোভের বশবর্তী হয়ে কর্মচক্রের বন্ধন ও অধঃপতন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হব। তখন পরবর্তী জন্মে উচ্চতর শরীর লাভ করতে পারব। মনুষ্য জাতি চাইলে উর্ধ্বগতি, না হয় অধোগতি করতে পারে এভাবে। শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় তৃতীয় অধ্যায়ে কৃষ্ণ বলছেন, “মন জীবের শত্রু কিংবা বন্ধু মন বন্ধু হবে যদি আপনি নিজেকে উর্ধ্বগতি করেন, শত্রু হবে যদি অধোগতি করেন। যদি আপনি মনের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভকে নিয়ন্ত্রণ করেন তবে আপনি নিজেকে উর্ধ্বগতি করছেন। সঠিক সিদ্ধান্তটি আপনাকেই নিতে হবে ।

উৎকৃষ্ট পন্থা

জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে মনুষ্য শরীরের ওপরে রয়েছে বিভিন্ন গ্রহ যেগুলো অদৃশ্যভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ গ্রহগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন দেব-দেবী ও অবতারগণ । তারা কর্মের বিধান অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করেন। এক্ষেত্রে কালের প্রাধান্য রয়েছে। সেই কালের উর্ধ্বে রয়েছে পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ।
গ্রহগুলোর গতিবিধির মাধ্যমে কর্মের বিধান সম্পর্কে জানা যায় । এটি অন্যতম একটি পন্থা। অন্যান্য পন্থায় কর্মফল বা ভবিষ্যত সম্পর্কে জানা গেলেও জ্যোতিষশাস্ত্রই হল বহুবিধ সুবিধাজনক পন্থা। কারণ নির্দিষ্ট সময়ে গ্রহগুলো কোথায় সঠিক অবস্থান করে সে সম্পর্কে জানা যায়। যেখানে অন্যান্য পন্থাগুলো (শুরুতে বর্ণিত পন্থাসমূহ) ততটা কার্যকরী নাও হতে পারে। এজন্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা অধিক সুবিধাজনক ।
প্রসঙ্গত এই প্রতিবেদন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। সেই প্রশ্নোত্তর সমূহের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হল ।
কিভাবে বুঝব কোনটি পূর্বকৃত কর্মফল এবং কোন কর্ম আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে?
উত্তর : আপনি ভারতে কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন, সেটি আপনার কর্মফল এতে আপনার কিছু করার নেই। এছাড়াও রয়েছে যেমন, নির্দিষ্ট পরিবারে জন্মগ্রহণ, নির্দিষ্ট ভাষা পরিবার থেকে শেখা, পিতা-মাতা কর্তৃক স্কুলে ভর্তি হওয়া। এগুলো অপরিবর্তনীয় ও নির্দিষ্ট কর্মফল। তবুও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। যেমন কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানের নির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিজের। কিংবা পড়াশুনার জন্য শিক্ষার্থী কতটুকু পরিশ্রম করবে বা করবে না সেটা নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এভাবে কিছু সিদ্ধান্ত থাকে ব্যক্তিগত। এক্ষেত্রে কেউ যদি নিম্নতম গুণসমূহে (রজ, তমগুন) অবস্থান করে, তখন সঠিক সিদ্ধান্তটা নেওয়া কঠিন বৈকি। তবে উচ্চতর গুণে (সত্ত্ব) থাকলে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ হয়। বর্ণাশ্রম ধর্মে শূদ্রদের কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি, তাদেরকে বলা হয় না যে, “তোমাকে অর্থ দিলাম, তোমার যা খুশি তা কর।” তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটি বেশ সীমিত।
ক্ষত্রিয়দেরকে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় বলে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা কিছুটা প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বেশ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু তমোগুণের লোকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন তাই তারা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করাটা উত্তম। নিজেরা সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হওয়ার আশংকা থাকবে।
একজন মনোবিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি লক্ষ্য করলেন, সেখানে প্রতিকূল পরিবেশের জন্য অধিকাংশ লোক মারা যায়। আবার কিছু লোক মারা যায় না। কিছু লোক কেন মারা যায় না, সেই নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষন করতে করতে দেখলেন, ওখানকার সমস্ত লোকেরা প্রতিকূল পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মারা যায়। কিন্তু যারা সে পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত নয় বা নিরাসক্ত তারা মারা যান না । তিনি উপলব্ধি করলেন, পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও আমরা যেন পরিস্থিতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হই। সে ক্যাম্পে কি খাবার দেওয়া হচ্ছে, কোথায় থাকা হচ্ছে এসব কিছু তিনি হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, কিন্তু যেটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেটি হল তার মুক্ত সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, সে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হচ্ছে। এভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রভাব অতিক্রম করা যায়। এভাবে তিনি সে ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। যেখানে অন্য অনেকেই মারা গিয়েছিল। এটিই হল চেতনার পার্থক্য।
যারা সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত তারা বৈদিক শাস্ত্র থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে ।
প্রাণী হত্যা করলে কি রকম পাপ হয়?
উত্তর : বৃক্ষ, প্রাণী, মানুষ ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে হত্যা করলে সেই অনুযায়ী পাপের স্তর বা প্রতিক্রিয়া উচ্চতর হয়। সাধারণ সমাজেও দেখা যায় কেউ যদি মানুষ হত্যা করে তবে জেলে যেতে হয়। পক্ষান্তরে প্রাণী বা বৃক্ষ হত্যার জন্য রয়েছে লঘু শাস্তি অনেক সংস্কৃতিতে প্রাণী হত্যা অনুমোদিত হলেও বৈদিক সংস্কৃতিতে তা পাপকর্ম। সেই সংস্কৃতি অনুসারে যদি আপনার আহারের প্রয়োজন হয় তবে মাংসাহার করবেন (বিধিসম্মতভাবে)। এভাবে বিভিন্ন ধর্মে এ সংক্রান্ত বিধান আছে। আবার প্রাণীদের আত্মা আছে কি নেই এ নিয়ে অনেক সংস্কৃতিতে বিভ্রান্তি প্রচলিত রয়েছে। যা হোক উচ্চতর চেতনাসম্পন্ন জীবদের হত্যা করলে উচ্চতর পাপ হয়। আবার নিম্নতম প্রাণীদের হত্যা করলে নিম্নতর পাপ হয়।
প্রশ্ন : ভক্তরা কি কর্মফল ভোগ করবে?
উত্তর : হয়তো ‘হ্যাঁ’ হয়তো ‘না’। এক্ষেত্রে পাপী অজামিলের দৃষ্টান্ত লক্ষনীয়। কিন্তু তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুর সময় নারায়ণ নাম উচ্চারণ করেছিলেন। এজন্য তার অন্তিম যাত্রা হয়েছিল সুখপ্রদ। ঠিক শেষ ভাল যার সব ভাল তার এই প্রবাদের মতোই ।
ভক্তিপূর্ণভাবে ভগবানের নাম জপ করলে সর্বোত্তম প্রক্রিয়া পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কর্মফল নিঃশেষ করা একজন ভক্তের উদ্দেশ্য না হলেও ভক্তির প্রভাবে সে কর্মফল আপনা আপনি নিঃশেষিত হয়ে যায়। অজামিলের পাপ কর্মের ফল নিঃশেষিত হয়েছিল কেননা তার কোন অপরাধ ছিল না। যদি আমাদের অপরাধ থাকে তবে পাপ কর্মের ফল অত্যন্ত ধীরগতিতে নিঃশেষিত হয়।
সবাইকে বুঝতে হবে পাপ কর্ম আর অপরাধের পার্থক্য । যেমন, একজন ফকিরকে অন্যায়বশত চড় মারলে সেটা পাপ। কিন্তু যদি কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির সদস্যের ক্ষেত্রে একই কর্ম করলে সেটা অপরাধে পরিণত হবে। ভক্তের ক্ষেত্রে এ অপরাধের কারণে ধীরগতিতে অর্থাৎ সাধুসঙ্গ, অনর্থ নিবৃত্তি, রুচি, নিষ্ঠা ইত্যাদি পন্থায় অগ্রসর হয়ে কর্মফল নিঃশেষিত হয়। যদি ভক্তের কোন অপরাধ না থাকে তবে এই সমস্ত পন্থা ছাড়াই দ্রুত গতিতে কর্মফলকে নিঃশেষিত করতে পারে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কর্মফল নিঃশেষিত হলেও কর্মের যে ছাপ বা নকশা সেটি রয়ে যায়। অজামিলের ক্ষেত্রে ভগবানের নাম উচ্চারণের ফলে সমস্ত কর্মফল নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একজন পাপী ব্যক্তি ছিলেন। অর্থাৎ সাধারণ ব্যক্তি বুঝতে পারে না কিভাবে সে পাপকর্মে জড়াচ্ছে। অতএব ভক্তের প্রতি, ভগবানের প্রতি অপরাধ ভক্তি জীবনের প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ।
[পরবর্তী পর্বে জ্যোতিষশাস্ত্র কিভাবে ক্রিয়া করে তার স্বচ্ছ বিশ্লেষণ সচিত্র আকারে তুলে ধরা হবে। তদুপরি কর্মচক্র বা কর্মবন্ধনকে কিভাবে পুরোপুরি নিঃশেষ করা যায় সেই পন্থাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

লেখক পরিচিতি : শ্রীমৎ ভানু স্বামী মহারাজ ১৯৪৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর জাপানি বংশোদ্ভূত পিতা-মাতার গর্ভে কানাডাতে জন্মগ্রহণ করেন। ইস্‌কন প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম শিষ্য। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে অরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস হিস্ট্রি’র ওপর বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৭০ সালে ভারতে ইস্‌কনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে শ্রীল প্রভুপাদ থেকে হরিনাম দীক্ষা নেন এবং ১৯৮৪ সালে সন্ন্যাস দীক্ষা লাভ করেন। তিনি প্রভুপাদের অনেক গ্রন্থ জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন। শ্রীল প্রভুপাদ ভানু স্বামী মহারাজকে ব্যক্তিগতভাবে বিগ্রহ অর্জনের কৌশল সম্পর্কে শিক্ষা দেন। তিনি মূলত জাপান, মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও ভারতে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেন। তিনি মার্শাল আর্ট রিকি হিলিং এবং কার্নাটিক মিউজিকের ওপর পড়াশুনা করেন এবং এ বিষয়ে তিনি বেশ পারদর্শী। তিনি একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। চেন্নাইয়ে একটি ইসকন মন্দির এবং টোকিওতে নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি জিবিসি’র একজন সদস্য।


 

অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।