ইস্‌কন পদযাত্রার চল্লিশ বছরের ইতিহাস

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২২ | ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২২ | ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 221 বার দেখা হয়েছে

ইস্‌কন পদযাত্রার চল্লিশ বছরের ইতিহাস
বর্তমান প্রযুক্তিময় বিশ্বে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতি এখনো কার্যকর,
এটাই প্রমাণ করে বৈদিক শিক্ষা সর্বজনীন।

গৌরাঙ্গী দেবী দাসী


হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের অধিবাসীগণ বিভিন্ন পবিত্র স্থানসমূহ পদযাত্রার মাধ্যমে পরিক্রমা করে আসছেন এবং এর মাধ্যমে পারমার্থিক শিক্ষা বিতরণ করে আসছেন। ভগবান শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর পূর্বতন আচার্যবৃন্দদের ন্যায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে পদযাত্রা করেছেন। প্রায় ছয় বছর ধরে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের শিক্ষা প্রদান এবং কৃষ্ণভক্তি যে সর্বোত্তম তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৫৩ সালে ভগবানের সেনাপতি ভক্ত শ্রীল প্রভুপাদ পদযাত্রার মাধ্যমে কৃষ্ণভাবনামৃত পৌছে দেন উত্তর প্রদেশের ঝাঁসিতে। তাঁর নিয়মিত সংকীর্তন পার্টি শহরের বিভিন্ন স্থানে পদযাত্রা করতেন। যাতে পঞ্চাশজন অনুসারী কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে যোগদান করে। তাদের মধ্যে শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম শিষ্য আচার্য প্রভাকর ঝাঁসির ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি ছোট্ট শহর চিরগাঁওয়ে পদযাত্রা সম্পন্ন করেন।
১৯৭৬ : শ্রীল প্রভুপাদের উৎসাহে ভারতে গরুর গাড়ির মাধ্যমে পদযাত্রার প্রারম্ভ।
১৯৬৯ সালে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর একজন শিষ্যকে লন্ডনের জন লেনন স্টেইটে তার সাথে অবস্থান করার জন্য উপদেশ দেন। এই স্থানটি জন লেনন শাকসবজি ও বিভিন্ন ফলমূল উৎপাদনের জন্য এবং গরুর গাড়ির মাধ্যমে সেগুলো শহরে বিক্রির জন্য শ্রীল প্রভুপাদকে উপহার দিয়েছিলেন। একবার মরিশাসে এক প্রাতঃভ্রমণের সময় শ্রীল প্রভুপাদ একজন অতিথিকে বলেছেন, “গাড়ি ব্যবহারের উদ্দেশ্য কি? যদি তুমি সবকিছুই তোমার আশেপাশে পেয়ে যাও অর্থাৎ মৌলিক চাহিদাগুলো তবে আর গাড়ি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? তোমার যদি একটি গরুর গাড়ি থাকে সেটাই পর্যাপ্ত। কেন তুমি পেট্রোল, তেল, মেশিন, এটা, সেটা বহু জিনিসের প্রতি ধাবিত হচ্ছ? কেন?”
শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশনায় গরুর গাড়ির মাধ্যমে পদযাত্রা কৃষ্ণভাবনামৃতকে ভারতের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং এর ফলস্বরূপ ১৯৭৬ সালে দুটি বৃহৎ পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীল প্রভুপাদের একজন প্রিয় ভারতীয় শিষ্য শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী যিনি গ্রামেই বড় হয়েছিলেন। বৃন্দাবন, উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিম বাংলার মায়াপুর পর্যন্ত পদযাত্রা সম্পন্ন করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। প্রত্যেক পদযাত্রার পরপরই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পারমার্থিক অনুষ্ঠান পরিচালিত হয় বিভিন্ন হল, ফার্ম, উন্মুক্ত স্থান কিংবা মন্দিরে। যেহেতু গ্রামের উন্মুক্ত স্থানে খুবই কম সংখ্যক বৃহৎ অনুষ্ঠান হয় তাই এই ধরনের কৃষ্ণভাবনামৃত অনুষ্ঠানে সমগ্র গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করে থাকে। অনুষ্ঠান সূচীতে থাকে ভ্রমণরত বিগ্রহের (শ্রীশ্রী গৌর নিতাই) আরতি, একটি দীর্ঘসময় ব্যাপী কীর্তন, প্রবচন এবং পরিশেষে মহাপ্রসাদ বিতরণ। গ্রামবাসীদের কাছে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণ ছিল পাশ্চাত্য ভক্তগণ। কেননা গ্রামবাসীগণ কখনোই বিদেশী ভক্ত ইতোপূর্বে দর্শন করেনি। পদযাত্রায় শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী মহারাজের সর্বোত্তম আশীর্বাদ ছিল শ্রীল প্রভুপাদের হাসি। যা এলাহাবাদের কুম্ভ মেলায় এবং মায়াপুরে পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী ভক্তদের অভ্যর্থনার সময় দর্শন হয়েছিল।

১৯৮৪-১৯৮৬ : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ৫০০ বছর পূর্তি উৎসব

শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামীর নেতৃত্বে ইস্‌কনের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় যা সার্বিকভাবে সফলতা লাভ করে। এই পদযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি হাতি, কয়েকটি গরুর গাড়ি, একটি উঠের গাড়ি, হাজারো ভক্তের তাবুতে রাত্রিযাপন, বিভিন্ন দেশের ৫০-২০০ ভক্তের কীর্তন দল সাতটি যানবাহনে অনুষ্ঠান পরিচালনা, অসাধারণ অভ্যর্থনা প্রতিদিন ফুড ফর লাইফের প্রসাদ বিতরণ, প্রদর্শনীর ব্যবস্থা, দেশের বহু সংবাদপত্রে পদযাত্রা সম্পর্কিত প্রবন্ধ প্রকাশনা, ভিআইপি রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গদের সাথে সাক্ষাৎ, বহু তীর্থস্থান ভ্রমণ, প্রতিদিন বিশ হাজার জনগণের শ্রীশ্রী নিতাই গৌরসুন্দরকে দর্শন ইত্যাদি। ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছানোর কাজে পদযাত্রা একটি স্বার্থক ও পরিবেশবান্ধব উপযোগী পন্থা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত হয়েছে।

১৯৮৬-১৯৯৬ : শ্রীল প্রভুপাদের জন্মশতবর্ষে বিশ্বব্যাপী পদযাত্রার বিস্ফোরণ

প্রাথমিকভাবে এটি সফলতা লাভ করার পর ভারতে পদযাত্রা আরো বিস্তৃতরূপে সম্পন্ন হতে থাকে। এই সময়ব্যাপী প্রধান আকর্ষণ ছিল ইস্‌কনের বার্ষিক ব্রজমণ্ডল পরিক্রমা এবং নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা, হিমালয়ে বদরিকাশ্রম পরিক্রমা, দ্বারকায় পদযাত্রার সূচনা। এছাড়া ভক্তগণ উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রে পদযাত্রা সম্পন্ন করে। ১৯৯১ সালে শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী মহারাজ (বর্তমান ইস্‌কন পদযাত্রার বিশ্বব্যাপী মন্ত্রী) শ্রীল প্রভুপাদের জন্মশতবার্ষিকীর বিশেষ নিবেদন উপলক্ষে পদযাত্রাকে একশটি দেশে ছড়িয়ে দেয়ার মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্যে সর্বপ্রথম পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় মরিশাস, গায়না, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং আয়ারল্যান্ডে। এটি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী ইস্‌কন ভক্ত ও নেতৃত্ববর্গদের সমর্থন লাভ করে। পদযাত্রার বিস্ফোরনের আর একটি কারণ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের পদযাত্রা আয়োজকগণ তাদের নিজস্ব দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুসারে পদযাত্রাকে সাজান। যেমন কয়েকটি দেশে গরুর গাড়ির পরিবর্তে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হয়। যেসব স্থানে কোনো পশু সুলভ নয় যেমন দ্বীপপুঞ্জ সেখানে নৌকার মাধ্যমে এমনকি উড়োজাহাজে করে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে, বিশেষত ভারত মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশে পদযাত্রার স্থায়ী দল ঘোষিত হয়। পদযাত্রায় উৎসাহী ভক্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ন্ত। তাদের মধ্যে পরশুরাম দাস ৩০টি দেশে পদযাত্রা আয়োজন করেন এবং ১৯৯২ সালে তিনি গরুর গাড়িতে ব্রজমণ্ডল পরিক্রমা শুরু করেন। এছাড়া শ্রীমৎ ভক্তিমার্গ স্বামী সমগ্র কানাডা পদযাত্রা পরিভ্রমন করেন। জয় বিজয় দাস ভারতে দশ বছর ব্যাপী সফলতার সাথে পদযাত্রার আয়োজন করেন। ১৯৯৬ সালে শ্রীল প্রভুপাদের জন্মশতবর্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যার মধ্যে ছিল বৈশ্বিক পদযাত্রা সপ্তাহ, ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে চারটি মহাদেশের ১০৫টি দেশে (যার মধ্যে রয়েছে কমিউনিস্ট কিউবা, মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান) পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

পদযাত্রার স্থায়িত্ব

পদযাত্রা ভক্তদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, পুনঐক্য প্রতিষ্ঠা, পারমার্থিক উৎসাহ প্রদান এবং পুনর্জীবন লাভের প্রমাণিত সত্য। পারমার্থিক প্রগতি লাভের সমস্ত বিষয়াদি একত্রে মন্দির পদযাত্রায় পর্যবসিত হয় যেখানে থাকে অনবরত হরিনাম জপ, শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ লাভ, বিগ্রহের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন, গ্রন্ত্র বিতরণ, কৃষ্ণভাবনামৃত সাধারণ জনগণের মাঝে বিতরণ, বিচিত্র অভিযানের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগদান, সুস্বাদু কৃষ্ণপ্রসাদ আস্বাদন এবং শ্রীল প্রভুপাদ ও শ্রীশ্রী গৌর নিতাই এর কৃপাশীর্বাদ লাভ করার অপূর্ব সুযোগ।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১২৩টি দেশে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় কিংবা একটি ক্ষুদ্র পরিসরে পদযাত্রা সম্পন্ন হয়। শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামী মহারাজ বিশ্বাস করতেন যে, যতদিন ভারতে পদযাত্রা চলবে ততদিন বিশ্বব্যাপীও পদযাত্রার বিপুল প্রসার ঘটবে এবং এখনো পর্যন্ত পদযাত্রা ভারতে চলছে। হয়তো বা অংশগ্রহণকারী ভক্তের পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু পদযাত্রার মূল বিষয়টি রয়ে গেছে। তা হলো গ্রন্থ বিতরণ, যার মাধ্যমে পদযাত্রা স্বনির্ভরশীল। ১৯৮৪ সাল থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পদযাত্রা সম্পন্ন হয়ে আসছে এবং বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশে পদযাত্রা চলছে। পদযাত্রা শুধুমাত্র সাধারণ জনগণের কাছেই সমাদৃত নয়। এটি মিডিয়ার কাছেও সমান জনপ্রিয় এবং এটি ইস্‌কন ভক্তদের জন্য একটি পারমার্থিক আশীর্বাদ যার কারণে পদযাত্রা এখনো বর্ধনশীল। বৈষ্ণব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গো বাহন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শ্রীল প্রভুপাদ প্রায়ই ভক্তদের সতর্ক করতেন যে, আধুনিক সভ্যতা যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ঠিক যেমন পৃথিবীতে একসময় জ্বালানী তেলের তীব্র অভাব হবে, যার ওপর সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্ভর। কিন্তু সেরকম পরিস্থিতি এলেও কৃষ্ণভক্তরা যেহেতু ভগবানের ওপর নির্ভরশীল তাই তারা তখনো গো-বাহনে করে তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করতে পারবে। ভারতে ইস্‌কন দৈব বর্ণাশ্রম মন্ত্রী শ্রীমৎ ভক্তিরাঘব স্বামী আশা প্রকাশ করেছেন, খুব শীঘ্রই ভারতের প্রতিটি রাজ্যে গো-বাহন সমেত নিজস্ব পদযাত্রা দল থাকবে। ইতোমধ্যে ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে অন্ধ্র প্রদেশে বিষ্ণুস্বামী দাস এর নেতৃত্বে একটি ছোট পদযাত্রা দল নিরবচ্ছিন্নভাবে ভ্রমণ করে চলছে।

নতুনত্ব ও বার্ষিক অনুষ্ঠান হিসেবে পদযাত্রার আবির্ভাব

১৯৯৬ সালে শ্রীল প্রভুপাদের জন্মশতবার্ষিকীর পর থেকে পদযাত্রা জ্বর আরো শক্তিশালীভাবে বেড়ে যায়। বহু দেশ সর্বপ্রথম পদযাত্রার আয়োজন করে। হাঙ্গেরি, ইতালি, রাশিয়া, নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউজিল্যান্ড সেই সাথে মাদাগাস্কার ও থাইওয়ানও। পদযাত্রাকে একটি বার্ষিক উৎসব হিসেবে পালন করে চেক রিপাবলিক, গায়না, মরিশাস, উড়িষ্যা এবং স্লোভেনিয়া। অদ্ভুত শিরোমনি দাস এবং তার পত্নী চন্দ্রভাগা দাসী উত্তর আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর পর্যন্ত হর্ষবাহনে পদযাত্রা সম্পন্ন করেন। সমগ্র বিশ্বে ইস্‌কন ভক্তরা পদযাত্রায় অনেক নতুনত্ব যোগ করেন। তার মধ্যে একটি সফল বিষয় ছিল বিভিন্ন হাঁটা উৎসবে যোগ দান। যেমন ইতালির ‘শান্তির জন্য হাঁটা’ উৎসব, স্পেনে সেন্ট জেমস ওয়ে এবং ভারতে মহারাষ্ট্রে ‘দণ্ডি যাত্রা’ এর ফলশ্রুতিতে ভক্তদের বিভিন্ন সংস্থাগত সেবা পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং বিপুল পরিমাণ জনগণের কাছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী এবং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র বিতরণ করা সম্ভব হয়। সর্বশেষ ১৮ বছর ধরে ইস্‌কন ভক্তগণ চারটি বার্ষিক ‘দণ্ডি যাত্রা’ অংশগ্রহণ করে যা গত কয়েক শতাব্দী ধরে ভগবান বিউলের (পান্ডারপুর এবং সমগ্র মহারাষ্ট্রে সেবিত শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ) ভক্তগণ করে আসছে। এই দণ্ডি পদযাত্রায় বিভিন্ন ভক্তিমূলক গান গাওয়া হয় এবং ভগবানের নাম জপ করা হয়। জুলাইর শুরুতে ইস্‌কন পুনের ১৪০ জন ভক্ত একটি বৃহৎ দণ্ডি যাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল ১৮ দিন ব্যাপী তুকারাম দণ্ডি, দেহু (তুকারামের জন্মস্থান) থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে পাণ্ডারপুর পর্যন্ত। প্রতি বছর তিন লক্ষেরও বেশি তীর্থযাত্রী দণ্ডি উৎসবে যোগদান করে। এছাড়া ভগবান বিট্রলের দর্শন লাভ এবং পবিত্র চন্দ্রভাগ নদীতে স্নানের উদ্দেশ্যে প্রধান চারটি একাদশীর দিনে পান্ডারপুরে ৩০ লক্ষেরও বেশি ভক্ত সমবেত হয়। মহারাষ্ট্রে বিভিন্ন ইস্‌কন কেন্দ্র যেমন-গুআরাবাদ, সোলাপুর এবং বিডণ্ড তাদের নিজস্ব বার্ষিক দণ্ডি উৎসবের আয়োজন করে।
হাঁটা : গত শতাব্দীর একটি দ্রুত ক্রমবর্ধমান প্রবণতা বিভিন্ন দেশের বহু প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, হাঁটা হচ্ছে বর্তমানে দ্রুত জনপ্রিয় হওয়া একটি প্রবণতা। বিশ্বে বহু মানুষ সুস্বাস্থ্যবান থাকার জন্য তাদের কাজের পাশাপাশি হাঁটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এমনকি বিভিন্ন সংস্থা ছুটির দিনগুলিতে হাঁটা ভ্রমণের আয়োজন করে। এমনকি খ্রিস্টানদের মধ্যেও পদব্রজে তীর্থ ভ্রমণের প্রবণতা পুনঃ চালু হয়েছে। ২০১৩ সালে ২ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষ ফ্রান্সের সেন্ট জেমস ওয়ে এবং স্পেনে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। তাহলে কেন শ্রীল প্রভুপাদ এবং ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাথে পদযাত্রা হবে না? আমাদের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য একবার বলেছিলেন যে, ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কারণে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন ১০ হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে- যাকে বলা হয় কলিযুগের সোনালী অধ্যায়। পদযাত্রা হল এই ভবিষ্যৎবাণীর অন্যতম হৃদয়স্বরূপ এবং পরিবেশবান্ধব গোবাহন হলো যে কোনো সময়ের জন্য উপযোগী বাহন। আমাদের পৃথিবী দিন দিন অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে, দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়েই চলেছে। তাই পবিত্র কৃষ্ণনাম এবং কৃষ্ণভাবনা বিতরণের পাশাপাশি পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা গাভী সুরক্ষা, বৃষের শক্তি এবং ভূমাতার জন্য শ্রদ্ধা শিক্ষা বিতরণ করতে পারেন।
ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ইস্‌কন বৈষ্ণবদের হরিনাম প্রচারে অধিক থেকে অধিকতর উৎসাহ প্রদান করছেন যার সম্মিলিতরূপ দেখা যায় পদযাত্রায়, যখন মরিশাসে বার্ষিক বিশ্ব হরিনাম সপ্তাহ পালিত হয়। আমরা প্রার্থনা করি যাতে আরো অনেক মন্দির এই ভক্তদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং ইস্কনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন দেশে নবরূপে পদযাত্রা বিস্ফোরণ হয়। পদযাত্রা হলো একটি সহজ, আনন্দময় পন্থা যার মাধ্যমে ভগবানকে ভালোবাসার ফল বিতরণ করা যায় এবং পৃথিবীর ক্লেশগ্রস্ত জীবদের জন্য ভগবানের যে উদ্বিগ্নতা, তা থেকে মুক্ত করা যায়।

পদযাত্রা সম্বন্ধে শ্রীল প্রভুপাদের কিছু উক্তি

“গ্রাম থেকে গ্রামে প্রচারের জন্য গোবাহন ব্যবহার করা যায়। কেন তাদের হত্যা করতে হবে? এখানে ভারতে লোকনাথ মহারাজ অত্যন্ত সফলতার সাথে এই ধরনের আয়োজন করছেন এবং এগুলো অত্যন্ত সফল। তিনি সমগ্র ভারত ভ্রমণ করেছেন এবং গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গ্রন্থ বিতরণ, প্রসাদ বিতরণ ও সংকীর্তন করেছেন। প্রতি রাতে তারা বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করেন। আমরা সমগ্র বিশ্বে এই ধরনের লাখো বাহন প্রবর্তন করতে পারি।”
(১৬ মার্চ ১৯৭৭, আমেরিকার তালবন ফার্ম কমিউনিটির প্রধান নিত্যানন্দ দাসের প্রতি পত্র)
“যদি তোমার মত যুবক আমার সাথে যোগদান করে, তবে আমার কয়েকজন পাশ্চাত্য শিষ্যদের নিয়ে আমি দ্রুতই গ্রাম থেকে গ্রামে এবং শহর থেকে শহরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। এটি হবে খুবই, খুবই ফলপ্রদ।”
(১৬ এপ্রিল ১৯৭৬, পদযাত্রার প্রতি আগ্রহী একজন ভারতীয় যুবক পাঞ্জাবী প্রেমানন্দের চিঠির উত্তর)
“তোমার সুন্দর কার্যাবলীসমূহ শুনে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমার অভিলাষ যদি আমি তোমার সাথে যুক্ত হতে পারতাম। আমি তোমার অনুষ্ঠান খুবই পছন্দ করি। যদি তুমি এই অনুষ্ঠান চালু রাখ, তুমি উপকৃত হবে, লোকদের উপকার হবে এবং সকলেই খুশি হবে।”
(সেপ্টেম্বর ১৯৭৬, শ্রীমৎ লোকনাথ স্বামীর
প্রথম পদযাত্রা রিপোর্টের প্রত্যুত্তর)

ভক্তিমার্গ স্বামী, দ্যা ওয়াকিং মঙ্ক

ইস্‌কনের একজন সন্ন্যাসী শ্রীমৎ ভক্তিমার্গ স্বামী ১৯৯৬ সাল থেকে পদযাত্রা করছেন এবং ইতোমধ্যে তিনি ৩০,৯৬৪ কি.মি (১৯,২৪০ মাইল) হেঁটে পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি কানাডা, আয়ারল্যান্ড, ফিজি, গায়ানা, ত্রিনিদাদ, ইসরায়েল এবং মরিশাসে পদযাত্রা সম্পন্ন করেছেন। তিনি বলেন, “আমার শক্তির শেষ বিন্দু পর্যন্ত আমি হেঁটে যাব।”
শ্রীল প্রভুপাদের আমেরিকা গমনের ৫০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বোস্টন থেকে পেনেসিলভেনিয়ার বাটলার, সেখান থেকে নিউইয়র্ক সিটি পর্যন্ত পদব্রজে পরিভ্রমণ করেন। ২০১৬ সালে ইস্‌কনের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তিনি নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিসকো শহরে অবস্থিত ইস্কনের ২য় স্থাপিত মন্দির পর্যন্ত পদব্রজে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। যদিও তিনি একাকী হাঁটেন, কিন্তু তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষিরা তাকে যানবাহন প্রদান করেন, বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে থাকার ব্যবস্থা করেন এবং প্রসাদের ব্যবস্থা করেন। মহারাজ বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন পরিবারে এমনকি হাসপাতাল, জেলখানা এবং স্কুল লাইব্রেরীতে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বিতরণ করেন। শ্রীমৎ ভক্তিমার্গ স্বামী আলাদা কোনো ব্যাগ নেন না, তার সাথে থাকে কেবলমাত্র রেইনকোট অথবা স্যুয়েটার এবং একটি জপ মালা, কিছু প্রচার পত্র এবং একটি মোবাইল ফোন কিংবা ক্যামেরা। তার সাধারণ হাঁটা, মানুষের মাঝে মিশে যাওয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ ক্ষমতা সকলকে আকর্ষণ করে, তাই অসংখ্য সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনে তার সম্বন্ধে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। শ্রীমৎ ভক্তিমার্গ স্বামীর দয়া এবং তার হাঁটার সাহস, শক্তি ও ধৈর্য দেখে মানুষ আকর্ষিত হয় এবং হাঁটাকে তিনি পারমার্থিক রোগমুক্তি হিসেবে গণ্য করেন। তিনি অত্যধিক যন্ত্র ব্যবহারের বিরোধী বিশেষত কার (গাড়ি), তার মতে বর্তমান গাড়িগুলো হল বড়, উজ্জ্বল কফিন বিভিন্ন প্রবন্ধে তার জীবনকাহিনি, কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন এবং দর্শন সম্বন্ধে ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন সাংবাদিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ভক্তিমার্গ স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ তাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে। বহু গণমাধ্যমে তার বহু সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করা হয়েছে, তার মধ্যে বৃহত্তর স্যাটেলাইট চ্যানেল সিবিসিও রয়েছে। তিনি ১৮ বার টেলিভিশন ডকুমেন্টারি দ্যা লারজেস্ট রোড এ আবির্ভূত হয়েছেন, এই ডকুমেন্টারিটি ২০০২ সালে ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অব কানাডা রিলিজ করে। “আমি যখন নতুন কোনো পদযাত্রায় বের হই তখন শুরুতে মন্দ প্রতিক্রিয়া হলেও পরবর্তীতে এটি সফলতায় পর্যবসিত হয়। যেমন আমি যখন ওতায়াতে পদযাত্রা করছিলাম তখন সকল ধরনের মিডিয়া-টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং রেডিও প্রচারের নামে এবং পথে বহু লোক আমার অটোগ্রাফ নেয়, আমার সাথে করমর্দন করে। গড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক কৃষ্ণ সম্পর্কে পড়তে ও শ্রবণ করতে পারে। আমার জন্য পদযাত্রা হল একটি আবেশ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শরীরের অর্ধেক অংশব্যাপি পা দিয়েছেন, তাই শরীরের এই অংশটি শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ব্যবহার করা উচিত। আমি মনে করি, পায়ে হেঁটে সাধারণ মানুষের সাথে যেভাবে অন্তরঙ্গভাবে যোগাযোগ করা যায় আর কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। পা দেওয়া হয়েছে হাঁটার জন্য এবং মুখ দেওয়া হয়েছে পরম সত্য কথা বলার জন্য। কি নিখুঁত সমন্বয়!”

লেখক পরিচিতি : গৌরাঙ্গী দেবী দাসী ২০১২ সাল : থেকে পদযাত্রা বৈশ্বিক মন্ত্রণালয়ের সহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে সেবারত আছেন। দিল্লিতে ৫ বছর পদযাত্রা অফিসে সেবা সম্পাদনের পর তিনি পদযাত্রা নিউজলেটার এবং পদযাত্রা ম্যানুয়েলে বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশ করছেন। তিনি বর্তমানে নিউজলেটার প্রকাশনা, পদযাত্রা ওয়েবসাইটের সহ ব্যবস্থাপনা এবং পদযাত্রা সম্পর্কিত দুই গ্রন্থের সম্পাদনার সেবায় নিয়োজিত আছেন।


 

জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।