অদ্বৈত পত্নী – শ্রীসীতাদেবী

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 319 বার দেখা হয়েছে

অদ্বৈত পত্নী – শ্রীসীতাদেবী

শ্রীতারক ব্রহ্ম দাস: শ্রীমতী সীতাদেবী ছিলেন শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের ধর্মপত্নী। মহাপ্রভুর জননী শ্রীশচীদেবীর ন্যায় তিনি নিত্যপূজ্য জগন্মাতা। শ্রীসীতাদেবী বা সীতা ঠাকুরাণী মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের প্রতি বাৎসল্য প্রেমে সর্বদা বিহ্বল থাকতেন। তিনি যোগমায়া ভগবতী পৌর্ণমাসীদেবীর অবতার। দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণলীলায় ইনি নন্দগৃহে উপস্থিত হয়ে নন্দ-যশোদাকে বিবিধ উপদেশ প্রদান করতেন। শ্রী গৌরগণোদ্দেশ দীপিকায় বলা হয়েছে, ভগবতী যোগমায়া শ্রীঅদ্বৈতপত্নী শ্রীমতী সীতা ঠাকুরাণী এবং তাঁর প্রকাশক শ্রীদেবীরূপে সম্প্রতি অবতীর্ণ হয়েছেন।
শ্রীসীতাদেবীর পিতা, শ্রীপাদ নৃসিংহ ভাদুরী হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের অন্তর্গত শ্রীনারায়ণপুর নিবাসী বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন। দ্বিজশ্রেষ্ঠ নৃসিংহ ভাদুরী ভাগবত সেবার জন্য প্রত্যহ বাড়ীর নিকটে একটি সরোবর হতে পুষ্পচয়ন করতেন। একদিন একটি শতদল পদ্মে সৌদামিনী তুল্যা এক দিব্য কন্যা প্রাপ্ত হন। ঐ কন্যাই হলো শ্রীসীতাদেবী। তাঁর স্ত্রীর গর্ভজাতা কন্যা শ্রীদেবী। ঐ কন্যাদ্বয়কে তিনি শান্তিপুর নিবাসী শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভুর সঙ্গে বিবাহ দেন। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভুর প্রেম হুঙ্কারে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গদেব নবদ্বীপে আবির্ভূত হন। ফাল্গুনী পূর্নিমার সন্ধ্যাকালে চন্দ্রগ্রহণ আরম্ভকালে চারিদিকে হরিধ্বনি শ্রুত হয়েছিল। শান্তিপুরে সন্ধ্যাকালে চন্দ্র গ্রহণ আরম্ভকালে চারিদিকে হরিধ্বনি শ্রুত হয়েছিল। শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈত ভবনে সকল নরনারী হরিনাম কীর্তনানন্দে বিভোর হয়েছিলেন। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভু ও শ্রীহরিদাস ঠাকুর প্রেমানন্দে উন্মত্ত হয়ে উদ্দণ্ড নৃত্য কীর্তনে তখন রত ছিলেন। কিন্তু কেন এত নৃত্য কীর্তন তা কেউই বুঝতে পারলেন না।
শ্রীশচীদেবীর পুত্রজন্মের সংবাদ পেয়ে শান্তিপুর থেকে শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের গৃহিণী শ্রীমতি সীতাদেবীও পতির অনুমতিক্রমে নবজাত শিশুর জন্য বিভিন্ন উপচার নিয়ে দোলায় চেপে দাস-দাসী সঙ্গে করে নবদ্বীপ অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে সীতা ঠাকুরাণী বাক্সভর্তি দাস-দাসী সঙ্গে করে নবদ্বীপ অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে সীতা ঠাকুরাণী বাক্সভর্তি বিভিন্ন দ্রব্যাদি এবং ভোজ্য বস্তুসহ দোলা যোগে শ্রীজগন্নাথ মিশ্র গৃহে উপনীত হন। তারপর সূতিকাগৃহে প্রবেশ করে নবজাত শিশুকে দর্শন করলেন। তিনি দেখলেন যে, অঙ্গের বর্ণ ব্যতীত সেই নবজাত শিশুটি দেখতে ঠিক গোকুলের শ্রীকৃষ্ণের মতো তাঁর প্রতিটি অঙ্গ অত্যন্ত সুন্দর ভাবে গঠিত এবং সর্ব সুলক্ষণ যুক্ত। শিশুটির অঙ্গকান্তি তপ্ত কাঞ্চণের ন্যায় ঠিক যেন একটি সোনার প্রতিমা। তাঁর অঙ্গের অনুপম রূপ জ্যোতিতে এবং বাৎসল্যের আবেশে শ্রীসীতাঠাকুরাণীর হৃদয় অত্যন্ত দ্রবীভূত হলো।
শ্রীসীতা ঠাকুরাণী আনীত বহু দ্রব্যাদি শিশুকে যথাসময়ে ধারণ করালেন। ডাকিনী-শাখিনী-যোগিণী-সিদ্ধ মন্ত্রপূত রক্ষা কবচ শিশুর অঙ্গে বেঁধে দিলেন। আর যা যা মঙ্গলজনক তাও করতে আদেশ দিলেন। শচী নন্দনের নিমাই নাম শ্রীসীতাদেবীর প্রদত্ত। নিম তিক্ত বলে ডাকিনী শাখিনীগণ কেহ বালককে স্পর্শ করবে না। তাই শ্রীসীতাদেবী নবজাত শচীবালকের নাম রাখলেন “নিমাই”।
এক সময় মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভুকে গুরুবুদ্ধি পোষণ করে তাঁর চরণধূলি গ্রহণ করতেন। কেননা মহাপ্রভুর দাস্যই ছিল শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের ব্রত। সুতরাং মহাপ্রভু কর্তৃক গুরুবুদ্ধি পোষণই শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু নিজের ভাগ্যের বিড়ম্বনা বলে মনে করতেন। তাই এক সময় শ্রীঅদ্বৈত প্রভু মনে করলেন, আমার প্রতি বিরোধী আচরণ তাঁর গুরু বুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়ে ভৃত্যবুদ্ধি উৎপাদন করব। তাই তিনি সংকল্প করলেন,

হেন ক্রোধ জন্মাইব প্রভুর শরীরে।
স্বহস্তে আপনে যেন মোরে শাস্তি করে ॥

তাই তিনি শান্তিপুরে নিজ গৃহে মহাপ্রভু দণ্ড প্রসাদ লাভের জন্য ভক্তিবিরোধী “যোগাবাশিষ্ট” গ্রন্থ পাঠ করতে আরম্ভ করলেন। সর্বজ্ঞ মহাপ্রভু শ্রীঅদ্বৈতার্যের মনোভাব অবগত হয়ে শ্রীনিত্যনন্দ প্রভুকে নিয়ে শান্তিপুরে উপস্থিত হলেন। মহাপ্রভু এসেছে দেখে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রমত্ত হয়ে আরো অধিক জোরে ভক্তিবিরোধী জ্ঞান মার্গীয় যোগাবাশিষ্ট পাঠ করতে লাগলেন। মহাপ্রভু রেগে শ্রীঅদ্বৈতাচার্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, “জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে?” শ্রীঅদ্বৈতাচার্য বললেন, “ভক্তি হতে জ্ঞান বড়” মহাপ্রভু একথা শুনেই শ্রীঅদ্বৈতাচার্যকে পিণ্ডা হতে নীচে ফেলে দিয়ে স্বহস্তে পৃষ্ঠে মুষ্ঠির আঘাত করতে লাগলেন।
তখন শ্রীঅদ্বৈতপত্নী শ্রীসীতাদেবী পতির অনিষ্ট আশঙ্কায় ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগলেন, এই বিপ্রকে ছেড়ে দাও, এই বিপ্রের মন্দ কিছু হলে তুমি সেই দায় হতে অব্যাহতি পাবে না। শ্রীসীতাদেবীর বাক্য শ্রবণ করে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হাসতে লাগলেন। মহাপ্রভু তর্জন-গর্জন করে শ্রীঅদ্বৈতকে বলতে লাগলেন,

ভক্তি প্রকাশিবি তুই আমারে আনিয়া।
এবে বাখানিস জ্ঞান, ভক্তি লুকাইয়া।।
যদি লুকাইবি ভক্তি তোর চিত্তে আছে।
তবে মোরে প্রকাশ করিলি কোন কাজে ।।

একথা বলে মহাপ্রভু মুষ্ঠাঘাত হতে বিরত হলেন। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য বললেন, শাস্তি তো দিলে এখন পদছায়া দাও। একথা বলার পরে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভু মহাপ্রভুর শ্রীচরণতলে পতিত হলে মহাপ্রভু তাঁকে ক্রোড় দেশে ধারণ করে রোদন করতে লাগলেন এবং পরে লজ্জিত হয়ে শ্রীনিত্যনন্দের প্রতি বললেনÑ আমার যদি কোন চাঞ্চল্য থাকে তাহলে আমাকে ক্ষমা করবে। একথা শুনে উপস্থিত সকলে হাসতে লাগলেন। মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীমতী সীতাদেবীকে বললেন, মাতা! শীঘ্রই শ্রীকৃষ্ণের জন্য রন্ধন করুন, আমি প্রসাদ পাব। একথা শ্রবণ করে শ্রীসীতাদেবী রন্ধন করতে চলে গেলেন। তখন মহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য প্রভু গঙ্গাস্নানে গেলেন। স্নানের পরে এই তিন প্রভু এক পংক্তিতে বসলে শ্রীমতী সীতাদেবী শ্রীমদনগোপালের মহাপ্রসাদ পরিবেশন করলেন।
একদিন নীলাচলে অবস্থানকালে সীতাপতি শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভু ভিক্ষা গ্রহণের জন্য মহাপ্রভুকে নিজ বাসায় নিমন্ত্রণ করলেন। মহাপ্রভু নিমন্ত্রণ অঙ্গীকার করলে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভু বাসায় এসে শ্রীমতী সীতাদেবীর সহিত মিলিত হয়ে শ্রীমন্মহাপ্রভুর ভোগের আয়োজন করতে লাগেলন। মহাপ্রভু যা ভোজন করতে ভালবাসেন শ্রীসীতা ঠাকুরাণী তা জানেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীসীতা ঠাকুরাণী রন্ধনের সমস্ত আয়োজন করলেন। মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের নাম স্মরণ করে শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু পাক কার্য আরম্ভ করলে। শাকে মহাপ্রভুর অতিশয় প্রীতি জেনে শ্রীমতি সীতাদেবী দশ প্রকার শাকের ব্যবস্থা করলেন। শ্রীসীতাদেবী সকল উদ্যোগ করছেন আর শ্রীঅদ্বৈত প্রভু প্রেমানন্দে রন্ধন কার্য করছেন। নানা প্রকার ব্যঞ্জন প্রস্তুত হলো।
মহাপ্রভু যদি একাকী এসে ভোজন করেন তা হলে তাঁরা উদর ভরে ভোজন করাতে পারেনÑ একথা তাঁরা রন্ধন সময়ে ভাবছেন এবং আলোচনা করছেন। অন্তর্যামী মহাপ্রভু তাঁদের মনোভাব জানতে পারলেন। মধ্যাহ্ন কাল উপস্থিত হলো। হঠাৎ প্রবল ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলো। মহাপ্রভুর সঙ্গে যে সকল সন্ন্যাসী ভিক্ষা করতেন ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তাদের কোন হদিশ পাওয়া গেল না। এদিকে শ্রীসীতাদেবী অদ্বৈতপ্রভু রন্ধন কার্য সমাপন করে ভোগ সকল প্রস্তুত করলে মহাপ্রভু একাকী এসে উপস্থিত হলেন। শ্রীঅদ্বৈত প্রভু তাঁর চরণ বন্দনা করে চরণ প্রক্ষালন করে অঙ্গে চন্দনাদি লেপন র্প্বূক দিব্যাসনে বসিয়ে ভোগ পরিবেশন করতে লাগলেন। শ্রীঅদ্বৈত প্রভু শ্রীসীতাদেবীর মনোস্তুষ্টির জন্য ভক্তবৎসল মহাপ্রভু পরম আনন্দে পরিবেশিত সকল দ্রব্যই ভোজন করলেন। ভোজন শেষে আচমন পূর্বক মুখশুদ্ধি গ্রহন করে দিব্যাসনে বসলেন। কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করে শ্রীঅদ্বৈত-সীতাদেবীর মনোভীষ্ট এভাবে পূর্ণ করে মহাপ্রভু নিজ বাসায় গমন করলেন।

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।