বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচিত ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসটি একটি বহুল আলোচিত উপন্যাস, আর এই আলোচিত উপন্যাসটিতে তিনি ইস্কন আচার্য্য ও প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদকে পাঠকদের সামনে অন্যভাবে তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন যুক্তি ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে কিভাবে আমেরিকার মত ম্লেচ্ছ দেশে প্রভুপাদ এ হরেকৃষ্ণ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছেন তারই রোমাঞ্চকর কাহিনী তুলে ধরেছেন। আর এ তর্ক বিতর্ক ছিল এ উপন্যাসের তারই কল্পনার মাধুরীতে সৃষ্ট দু’জন ব্যক্তির মধ্যে, তাদের একজন সিদ্ধার্থ এবং অন্যজন অতীন। দু’জনই খুব ভাল বন্ধু এবং প্রভুপাদ আমেরিকা থাকাকালীন সময়ে তারাও আমেরিকায় বাস করতেন। অবশ্য দু’জনই ভারতীয়। শুধুমাত্র ক্যারিয়ার গঠনের লক্ষ্যে আমেরিকায় পাড়ি জমান। একদিন তারা আমেরিকার একটি শহরে গাড়ী চালিয়ে তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে যাচ্ছিল। তাদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে সিদ্ধার্থ প্রভুপাদ সম্পর্কে বলতে লাগলেন। চলুন না ঘুরে আসি ঐ উপন্যাসের ২য় খন্ডের উপসংহার অংশের ২য় অংশে ঠিক তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছিল?
![](http://csbtg.org/wp-content/uploads/2022/07/CamScanner-07-29-2022-12.49_2-3.jpg)
সিদ্ধার্থ : ভদ্রলোকের আসল নাম অভয়চরণ দে। কলকাতায় হ্যারিসন রোডে থাকতেন, ওর বাবার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। বাড়ির সবাই বৈষ্ণব। ভদ্রলোক পড়াশোনা করেছেন স্কটিশ্চার্চ কলেজে, বৈষ্ণব বাড়ির ছেলে তো মাছ, মাংস খেতেন না, চা ও খেতেন না, ঝোঁক ছিল পূজা-অর্চনার দিকে, সে রকম তো অনেকেরই থাকে, যৌবনে উনি একবার এক বন্ধর পাল্লায় পড়ে গৌড়ীয় মঠের এক সাধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। ঐ গৌড়ীয় মঠের সাধু অভয়চরণকে বলেছিলেন, তোমরা শিক্ষিত যুবকেরা সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করছো না কেন? এটা একটা উদ্ভট প্রস্তাব। সেই ১৯২০ সালের কথা, দেশ পরাধীন, এরকম একটা অবস্থায় সেখানকার ছেলেরা সারা পৃথিবীতে চৈতন্যের বাণী শোনাতে যাবে? আর কেনই বা তাঁরা শুনবে? তাছাড়া তাছাড়া অভয়চরণ নর সংসারী মানুষ, ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব তাঁর এর নয়। তবে, ঐ গৌড়ীয় মঠের গুরুর কথাবার্তা তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। মাঝে মাঝে কলকাতায় এলে তিনি ঐ গুরুর সঙ্গে দেখা করতেন। প্রভুপাদের স্ত্রী আর পরিবারের অন্যান্য লোকজনেরা ও প্রভুপাদের এ পারমার্থিক ভাবধারা খুব ও একটা পছন্দ করত না। অভয়চরণ চা খান । না, কিন্তু তাঁর স্ত্রীর চা খুব প্রিয়। বৃদ্ধ বয়সে অভয়চরণ যখন সংসার ছাড়বেন রী ঠিক করলেন, তখন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণটা বেশ মজার। উনি স্ত্রীকে আলটিমেটাম দিলেন, চা এবং স্বামী, এই দুটোর মধ্যে তোমাকে একটা বেছে নিতে হবে, ওঁর স্ত্রী হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, তা হলে তো স্বামীকেই ছাড়তে হয় । ছেলে
অতীন বললো, ধ্যাৎ! শুধু চা খাওয়ার জন্য যদি কেউ বউয়ের ওপর রাগ করে, তা হলে বুঝতে হবে, সে একটা হামবাগ। সিদ্ধার্থ হেসে বললো শুধু ঐ জন্যেই বউকে ছাড়েননি নিশ্চয়ই। আসলে পারিবারিক জীবনটাই তার ভালো লাগছিল না। গৌড়ীয় মঠের সেই সাধুর নির্দেশ পালন করতে অভয়চরণ কাজে লেগে গেলেন। ‘ব্যাক টু গড হেড’ নামে একটি পত্রিকার লেখক, সম্পাদক, প্রুফ রিডার আর সেলসম্যানের দায়িত্ব তিনি একা নিজেই সামলিয়ে বের করতে লাগলেন ইংরেজীতে। ভদ্রলোকের বয়স তখন ছাপ্পান্ন-সাতান্ন । অতীন বললো, এই রকম ক্ষ্যাপাটে ধরণের লোক কিছু থাকে । সিদ্ধার্থ বললো, বেশ কিছু থাকে, তারা এক সময় হারিয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্য এই বুড়ো লোকটির জেদ । বাড়ি থেকে তো পয়সা-কড়ি কিছু নেন না, খাওয়ার ঠিক নেই, শীতের জামা কাপড় নেই। তবু চালিয়ে যেতে গেলেন এই পত্রিকা, সেই সঙ্গে ভগবদ্গীতার অনুবাদ টীকা রচনা করতে লাগলেন ইংরেজীতে, সেগুলোও ছাপাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন ।
অতীন বললো, সেই বুড়ো লোকটি আমেরিকাতে এলো কী করে ? সিদ্ধার্থ বললো, স্রেফ ইচ্ছা শক্তিতে, এছাড়া কোনো ব্যাখ্যা নেই। একদিন ভাবলেন মহাপ্রভুর বাণী তিনি পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে প্রচার করতে যাবেন, টাকা পয়সা কিছুই নেই। কিন্তু তার বন্ধু আগরওয়াল ও শ্রীমতি মোরাজী যিনি সিন্ধিয়া স্টিমশীপ লাইনের একজন মালিক তার সহায়তায় আমেরিকায় গিয়েছিলেন। তার পকেটে ছিল মাত্র আট ডলার। তার পকেটে ছিল মাত্র আট ডলার। একজন সত্তর বৎসরের বৃদ্ধ এত দূর বিদেশে এসছিলেন কিসের ভরসায়? কিন্তু অভয়চরণের ধারণা, উনি আমেরিকা জয় করতে এসেছেন ?
অতীন : পরশুদিন ম্যানহাটনে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে নাচতে নাচতে মিছিল করে রাস্তা জ্যাম করে দিল, টিভিতে দারুণ কভারেজ দিয়েছে, কিছু ছেলে আবার মাথায় টিকি রেখেছে দেখলুম এতগুলো আমেরিকান ছেলেমেয়েকে উনি দলে টানলেন কী করে?
সিদ্ধার্থ : সেই জন্যেই তো এত সবিস্তারে বলছি। এটা একটা দিগ্বিজয়ী কাহিনী। মাত্র আট ডলার পকেটে নিয়ে এসেছিলেন আমেরিকায়, আর মিঃ আগরওয়ালের ছেলে গোপালের সহায়তায় একটি ঘরে থাকার জায়গা পেয়েছিলেন। প্রভুপাদের একটা গুণ ছিল, স্মৃতিশক্তিটা খুব ভালো ছিল। আমাদের দেশের অনেকেই সাহেবদের নাম শুনে একটু পরেই ভুলে যায়। অন্য কারুর সঙ্গে পরিচয় করাতে গেলে নাম ভুলে যায়। উনি কিন্তু যার সঙ্গেই পরিচয় হতো, প্রত্যেকের নাম মনে রাখতেন, রাস্তায় দেখা হলে নাম ধরে ডাকতেন।
অতীন : তুই এত ডিটেইলস জানলি কি
করে?l
সিদ্ধার্থ ঃ আমার কৌতুহল হয়েছিল বলেই
খোঁজ-খবর নিয়েছি। ( চলবে…….)।
হরেকৃষ্ণ।