এই পোস্টটি 269 বার দেখা হয়েছে
সিনেমার গ্ল্যামারাস্ নায়ক নায়িকাদের জীবনের অপ্রিয় বাস্তবতা কোন্টি?ব্রজবিহারী দাস“ সকলের ক্ষেত্রে নিয়ম একই… সকলের জীবনে একটি বিষয় অবধারিত, আর তা হল সকলকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে” –
বব ডিলান, আমেরিকান গায়ক, কবি এবং লেখক।
মনোরমা …কে?আমার ৭৫ বছর বয়সের কাকা, যিনি ছিলেন একসময় একজন ঘোরতর সিনেমাপ্রেমী, ১৯৪০ শতকে বলিউডের সৌন্দর্যের রানি খ্যাত মনোরমাকে স্মরণ করতে পারছিলেন না। কয়েক বছর আগে যখন মনোরমার মৃত্যু হয় তখন সেটি গ্ল্যামার জগতের অলক্ষ্যে থেকে যায়। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১২ জন এবং সিনেমা ও টিভি শিল্পীদের তাঁকে নিয়ে কিছুই বলার ছিল না। সম্প্রতি মারা গেলেন বলিউডের প্রাচীন সময়কালীন কমেডিয়ান রাজিন্দর নাথ এবং পুরষ্কার বিজয়ী বিখ্যাত ফিল্ম কাহিনী লেখক সানিম । এবারও বলিউড তাঁদের নিয়ে কিছুই করল না। কেননা বলিউড তথা মুভি জগতটি এখন ২১ শতকের চাহিদা মেটানোর জন্য সুপারম্যান এবং যৌন আবেদনময়ীদের নিয়ে ব্যস্ত। একসময় ভারতের একটি ট্যাবলয়েডে এক রোমাঞ্চকর খবর ছাপা হয়েছিল- একজন নতুন নায়িকা, পুরনো একজন নায়কের গালে চড় দিয়েছিলেন কিন্তু পরক্ষণে আবার হৃদ্যতা স্থাপন করলেন একে অন্যের সাথে। তাহলে বুঝুন এই জগতের জীবনযাত্রা কতটা বিপরীতমুখী ও দ্রুত অধঃধাবমান।
ছয় দশক আগে মনোরমাকে নিয়ে সিনেমা জগত ও মিডিয়ায় সর্বক্ষণ আলোচনায় মেতে থাকত। এর কয়েক বছর পর মিডিয়ার দৃষ্টি পড়ল সুরাজ সানিমের প্রতি, কেননা তিনি একের পর এক ব্যবসা সফল মুভির কাহিনি লিখছিলেন। এর মধ্যে রাজিন্দর নাথ কিছু বিখ্যাত কমেডি ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন, মনে হল চিরজীবনের জন্য তাঁদের বৃহস্পতি হবে উজ্জ্বল ।
২০০৮ সালে ফিরে চলুন । সেই ক্যামেরা, ভক্ত, প্রেস কোথায়? অভিষেক আওয়াস্থি ও রাখি সাওয়ান্থ এর মধ্যে বিচ্ছেদ, অভিষেক বচ্চন ও ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের ১ম বিবাহ বার্ষিকী এবং ‘মুন্না ভাই’ খ্যাত সঞ্জয় দত্তকে গ্রেপ্তার এগুলো হল মিডিয়ার হেডলাইন।
এবার কল্পনা করুন ২০-৩০ বছর পরের কথা। বচ্চন পরিবার হবেন হারিয়ে যাওয়া অতীত, মুন্না ভাই হবেন ভুলে যাওয়া ইতিহাস এবং নতুন কোনো মুখ তখন দীপ্তি ছড়াবে। এমনকি যখন নতুনরা সময়ের ব্যবধানে চক্রাকারে স্টেজে আবর্তিত হতে থাকবে, তখন পুরানোরা হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে।
সময়ের অসীম শক্তিসময়ের অসীম শক্তিমত্তা সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবত-
“পরমেশ্বর ভগবান বললেন- মেঘপুঞ্জ যেমন শক্তিশালী বায়ুর প্রভাব জানে না, ঠিক তেমনই জড় চেতনায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি কালের অসীম বিক্রম জানতে পারে না, যার দ্বারা সে চালিত হয়।” (ভাগবত-৩/৩০/১)
মনোরমার নীরব মৃত্যু আমাদের কাছে অস্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এক প্রশ্নের অবতারণা করছে : “আমি কি প্রকৃতির নিয়মের কোনো ব্যত্যয় কিংবা পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারব?” কিন্তু অপ্রিয় সত্যটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলছে : “তুমি পৃথিবীর কাছে সমুদ্রের তীরের একটি তুচ্ছ বালির কণার মতো।” বিশাল বড় ঢেউ এর মতো সময় তুচ্ছ বালি সদৃশ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ইতিহাস বহু ব্যক্তির নামে পরিপূর্ণ, কিন্তু সেই নামগুলো আমাদের কাছে মূল্যহীন। এমনকি আমাদের বীরোচিত কর্ম ও আগত ভবিষ্যতের মানুষের কাছে থাকবে মূল্যহীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লিখিয়ে মনে করি যে, আমি চিরতরে স্নেহ ভালবাসা পাব ।
শ্রীল প্রভুপাদ মৃত্যুশয্যায় শায়িত একজন ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন : “সংসারে আসক্ত মানুষ চায় যে, তার মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের লোকেরা এক বিশাল শোভাযাত্রা সহকারে তাকে বহন করে নিয়ে যাবে। যদিও সে নিজে সেই শোভাযাত্রাটি দেখতে পাবে না, তবুও সে আকাঙ্ক্ষা করে যে, জাঁকজমক সহকারে শোভাযাত্রার মাধ্যমে তার দেহটি যেন নিয়ে যাওয়া হয়। সে যদিও জানে না যে, তার দেহত্যাগের পর পরবর্তী জীবনে সে কোথায় যাবে, তবুও সে নিজেকে সুখী বলে মনে করে।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৩/৩০/১৫, তাৎপর্য)
স্বপ্ন চুরমারপ্রতিদিন হাজারো অভিনেতা স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র বলিউডে স্থান পায় অপরিচিত জুনিয়র আর্টিস্ট বা এক্সট্রা হিসেবে। লাখে একজন সুযোগ পেয়ে খবরের শিরোনাম হতে পারে ঠিক, তবে পরিশেষে তাদের করুণ পরিণতির খবর শোনা যায়। সৌন্দর্য এবং শারীরিক ক্ষমতা সময়ের সাথে সাথে হ্রাস পায় । সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দর্শক নতুন কোনো নায়ক-নায়িকার দর্শন লাভ করতে চায়। পুরনোরা অবাক হয়ে ভাবে, “আমার ভাগ্যে কী এটি ছিল?”
সময় মহাশয় খুব ধীর গতির হলেও কার্যকরী। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর বৃন্দাবন ভজনে (১৯৫৪) সেই বাস্তবতা তুলে ধরেছেন :
“…আছে মোর স্ত্রী-পুত্র কন্যা-নাতি সব ।
কিন্তু অর্থ নাই বলি’ বিফল বৈভব ॥
অর্থহীন দেখি’ মোরে ছেড়েছে সবাই।
কুটুম্ব-আত্মীয় আর বন্ধু জন ভাই ॥
দুঃখ হয় হাসি পায়, একা বসে হাসি।
মায়ার সংসার এই কাকে ভালবাসি ?
কোথা গেল মাতা-পিতা আর স্নেহময়।
কোথা গেল জ্যেষ্ঠ যারা স্বজনাদি হয় ॥
তাদের খবর কেবা দেবে মোরে বল।
নামে মাত্র তাদের সংসার রয়ে গেল ॥
সমুদ্রের ফেনা যেন ক্ষণে সৃষ্টি ক্ষণে লয় ।
মায়ার সংসারে খেলা সেইভাবে হয় ॥
কেহ নহে পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন ৷
সবাই ফেনার মতো থাকে অল্পক্ষণ ॥
সমুদ্রের ফেনা যেমন সমুদ্রে মিশয় ৷
পঞ্চভুতের দেহ তথা হয়ে যায় লয় ॥
কত দেহ এইভাবে ধরয়ে শরীরী।
অনিত্য শরীরে মাত্র আত্মীয় তাহারি ॥ …”
আমাদের খ্যাতি ও সম্মান লাভের অভিলাষটি ঠিক একটি শিশুদের গবেষণাগার কর্তৃক সুউচ্চ বিল্ডিং নির্মাণের মতই উচ্চাসা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের নির্মিত ভবন ভেঙ্গে চুরমার হতে পারে। তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৮/১৬) আমাদের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, সেই ফলহীন প্রচেষ্টা স্থগিত করে প্রকৃত ফল লাভের চেষ্টা করতে :
“হে অর্জুন! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না।
কৃষ্ণভাবনামৃত : একটি অপ্রাকৃত জাহাজএই মানবদেহে মানুষের অস্তিত্বটি একটি খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মত আবার সেই সাথে এটি আত্মজ্ঞান লাভের একটি দুর্লভ সুযোগও, এমন সুযোগ যা যথাযথভাবে সদ্ব্যবহার করে আমরা পরমেশ্বর ভগবানের চিন্ময়ধামে ফিরে যেতে পারি। উচ্চস্তরের আধ্যাত্মবাদীদের কাছে এই পৃথিবীতে মানবজীবনটি হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের ধামে ফিরে যাওয়ার একটি জাহাজ সদৃশ। তাই একজন প্রকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তি অপ্রাকৃত আনন্দ লাভের প্রত্যয়ে অনুসন্ধান করেন সে পথের। ভক্তিমূলক সেবা হল খুবই দৃঢ়প্রত্যয়ী ভক্তদের অপ্রাকৃত সঙ্গ, যাদের মাধ্যমে আমরা সেই অপ্রাকৃত চিন্ময় আনন্দের সুযোগ লাভ করতে পারি। ভক্তিযোগের পন্থা একজন অধ্যাত্মবাদীকে তার নিজের সাথে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধ উপলব্ধিতে সহায়তা করে। আমাদের এই দেহগত সকল উপাধি বা খেতাব দেহের মতই বিনষ্ট হবে, কিন্তু এই দেহের অভ্যন্তরে বিদ্যমান নিত্য শাশ্বত আত্মাই হল আমাদের প্রকৃত স্থিতি। কৃষ্ণ সকল আত্মার প্রতি যত্নবান এবং সর্বদাই অপেক্ষাই আছেন কবে জীবাত্মাগণ তাঁকে লাভের জন্য সচেষ্ট হবেন। নিয়মিত কৃষ্ণনাম জপের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে বিদ্যমান কৃষ্ণপ্রেম উদিত হয়। যখনই আমাদের সাথে পরমেশ্বর ভগবানের সম্পর্কের ফুল প্রস্ফুটিত হবে, তখন আমাদের জীবনে ফুলের সজীবতা বিদ্যমান থাকবে এবং প্রকৃত আনন্দ উদ্দীপনা উপলব্ধি করতে পারবো।
মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হলেও একজন ভক্ত কখনই এই জগতের কোনো কিছু হারানোর ভয় পান না। বিয়েতে দেখা যায়, কনে তাঁর পিত্রালয় ত্যাগ করার সময় কান্না করে থাকে। তাঁর পরিবারের প্রতি অসীম আকর্ষণ থাকা এবং স্বামীর ঘরে তাঁর অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি কান্না করে থাকেন। কিন্ত যখন কিছুদিন পর সে স্বামীর সঙ্গ পায়, তখন সে নীরবে আনন্দ উপভোগ করতে থাকে। ঠিক একইভাবে একজন ভক্ত কৃষ্ণসঙ্গ পাওয়ার পর, কৃষ্ণসেবা এবং স্মরণের মাধ্যমে তাঁর জীবনে প্রশান্তি ও আশীর্বাদ নেমে আসে এবং সে খুব সহজেই জড় আসক্তি পরিত্যাগ করতে পারে।
জড়জগতের খ্যাতি পরিত্যাগবৈদিক শাস্ত্রে মহারাজ পরীক্ষিতের ভক্তিসেবার মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি পাঁচ হাজার বছর পূর্বে সমগ্র পৃথিবীর শাসক ছিলেন। যখন তিনি শুনলেন যে, সাত দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবেন এই অভিশাপ পেয়েছেন, তখন তিনি খুশি হলেন। যেহেতু তিনি সমগ্র জীবন ভক্তিযোগ তথা পরমেশ্বর ভগবানের সেবায় অতিবাহিত করেছেন, তাই তাঁর রাজ্য, পরিবার ফেলে মৃত্যুবরণ করতেও তাঁর কোনো আপত্তি বা দুঃখ ছিল না। তিনি এই অবস্থাকে পরমেশ্বর ভগবানের আশীর্বাদরূপে বিবেচনা করলেন এবং তাঁর জীবনের অসীম ঐশ্বর্য পরিত্যাগ করলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর এমনই আকর্ষণ, যা অসীম ধন ও খ্যাতির কাছে তুচ্ছ। তিনি আনন্দের সাথে কৃষ্ণ স্মরণে তার সময় অতিবাহিত করেছিলেন। কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে এমন এক ঔষধ যা সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা দূর করে এবং এই পৃথিবীতে আমাদের উদ্দেশ্যহীন, বিগলিত দেহের অস্তিত্ব থেকে মুক্তি দান করে।
যখন নানা দেশে সরকারের পতন হচ্ছে কিংবা ভূমিকম্প হচ্ছে, কলঙ্কজনক এবং বিয়োগাত্মক ঘটনা বার বার আসছে, মুভির সুপার হিরোগণের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু ঘটছে, ঠিক তখন আমরা পরমেশ্বর ভগবানের সাথে আমাদের সম্বন্ধ পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে সান্তনা ও শক্তি অর্জন করতে পারছি। এই প্রকারের বন্ধনের ফলে পৃথিবীর ভাগ্যে নানা পরিবর্তন আসলেও আমরা সুরক্ষিত থাকব। প্রতিনিয়তই মিডিয়া কুৎসা (স্ক্যান্ডাল) রটিয়ে তারকাদের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত করে। পক্ষান্তরে, এই জড় জগতের নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও কৃষ্ণভাবনামৃত আমাদের সমভাবে এবং সর্বদা আনন্দময় উপলব্ধিতে থাকতে সহায়তা করে ৷
ব্রজবিহারী দাস ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে MBA সম্পন্ন করেছেন। তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষ্ণভাবনা বিষয়ক সেমিনার এবং ট্রেনিং প্রোগ্রাম নিয়মিত পরিচালনা করে থাকেন।
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জানুয়ারী – মার্চ ২০১৪ |
|