সহিষ্ণুতা

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০১৯ | ১২:৩৩ অপরাহ্ণ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ | ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 1154 বার দেখা হয়েছে

সহিষ্ণুতা

ডাঃ প্রেমাঞ্জন দাস
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেন শীত এবং গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকূল-প্রদীপ, সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর। (গীতা ২/১৪)
আধুনিক মানুষ কোনো কিছুই সহ্য করতে রাজী নয়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপলক্ষ্য করে জগতের সমস্ত জীবকে যথাসাধ্য সহ্য করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। সহ্য করলে কী লাভ? সহ্য না করলে কী ক্ষতি? নিম্নে কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করা হল।
১) প্রাচীনকালে মানুষ জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে রান্না করত। আধুনিক মানুষ বিদ্যুৎচুল্লী বা গ্যাসের চুল্লী ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। কাঠের জ্বালানীতে ধোঁয়া হয়, চোখে জল নিয়ে আসে, হাঁড়ি বাসন কালো হয়ে যায়, দীর্ঘকাল ধরে মাজা ঘষা করলেও পরিষ্কার হতে চায় না। বিদ্যুৎচুল্লী বা গ্যাসের চুলায় এসব ঝামেলা নেই। কাঠের জ্বালানীতে রান্না করার কষ্ট তাই আধুনিক মানুষেরা সহ্য করতে রাজী নয়।
সহ্য না করার ফলে কী কী প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হচ্ছে দেখা যাক:
কাঠ এবং ঘুঁটের রান্না সবচাইতে সুস্বাদু। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, ঘুঁটের রান্না প্রথম শ্রেণির, কাঠ দ্বিতীয় শ্রেণির, গ্যাস তৃতীয় শ্রেণির এবং বিদ্যুৎ চতুর্থ শ্রেণির। বিদ্যুতের চুলায় করা রান্না খেতে অনেকটা কাগজের মত নীরস মনে হয়।
খনিগর্ভ স্থিত গ্যাস পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু সেই গ্যাস যখন নিঃশেষিত হয়ে যায়, তখন প্রবল ভূমিকম্প হওয়াটা অনিবার্য হয়ে পড়ে। গ্যাস এবং বিদ্যুৎএর বিকিরণ (radiation) স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয়। এই বিকিরণ থেকে বিভিন্ন প্রকারের রোগ সৃষ্টি হয়। গ্যাস ফেটে লোকের মৃত্যু হয় এবং গৃহে আগুনের ঘটনা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট কিংবা বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও অহরহ।
গ্যাসের দাম এবং বিদ্যুতের বিল দিন দিন শুধু বাড়ছেই। অধিকাংশ মানুষ তাই বিকল্প হিসাবে ভগবানের দেওয়া জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করার কথা পুনরায় ভাবছে। এছাড়া বাড়িতে যদি শুধু একটি মাত্র গরু থাকে, সে যদি দুধ নাও দেয়, তার গোবর থেকে ঘুঁটে তৈরি করে তিনজন মানুষের রান্না সারা বছর ধরে চালানো সম্ভব। কৃষি ভিত্তিক সমাজে গরুর খাদ্য বাজার থেকে কিনতে হয় না। তাই কৃষকরা দুধ দানে অক্ষম একটি বৃদ্ধ গরু থেকেই সারা বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্বালানী পেয়ে যায় বিনামূল্যে। বৈদিক যুগে প্রত্যেক বাড়িতেই এরকম গরু কমপক্ষে ডজন খানেক থাকত। গোবর থেকে সহজেই গোবর গ্যাস তৈরি করে রান্না করা যায়। গোবর গ্যাসের radiation বিভিন্ন রোগ নিরাময় করতে পারে। এইভাবে মানুষ ‘সরল জীবন উচ্চ চিন্তা’ সুত্রে পূর্ণভাবে জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ গ্রামবাসী এবং গ্রামবাসীই হওয়া উচিত। আর গ্রাম কেন্দ্রিক জীবনে এই প্রস্তাব ষোল আনা সম্ভব এবং উত্তম প্রস্তাব। তবে একান্নবর্তী পরিবারে তা আরো সহজে সম্ভব।
২) মানুষ গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য ফ্রিজ এবং এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করে। গরম সহ্য করতে অনিচ্ছুক মানুষকে কী কী সহ্য করতে হয় দেখা যাক।
ডাক্তাররা বলেন, ফ্রিজ এবং এয়ার কন্ডিশনার থেকে ৫ প্রকার রোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ব্রঙ্কাইটিস এবং সাইনাস রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে ফ্রিজ এবং এ.সি.।
অন্যদিকে দূষণের ফলে মানুষ না পাচ্ছে বিশুদ্ধ পানীয় জল, না পাচ্ছে শ্বাস নেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ বায়ু। একটি গর্দভও বুঝতে পারে যে, যানবাহন থেকেও জীবনে বিশুদ্ধ বায়ু এবং বিশুদ্ধ জল অনেক বেশী অপরিহার্য।
ডাক্তাররা আজ মেদ কমাবার জন্য মোটা টাকা নিয়ে রোগীকে ব্যায়াম, প্রাতঃভ্রমণ ইত্যাদি শ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত করেন। অথচ প্রাচীনকালে মানুষ যখন পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত, ঢেঁকিতে চাল ভাঙ্গত, শিলনোড়ায় মশলা বাটত, কুয়ো থেকে জল টেনে তুলত, তখন তাদের হাত পা সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে সক্রিয় থাকত। মেদ কমাবার জন্য ডাক্তারকে মোটা টাকা দেওয়ার দরকার হতো না।
গল্প আছে, এক দেশে খরগোশ অনেক ফসল নষ্ট করতো। খরগোশ মারার জন্য পণ্ডিতেরা অন্য দেশ থেকে জাহাজ ভর্তি শেয়াল নিয়ে এল। শেয়ালেরা দু’দিনের মধ্যে সব খরগোশ খেয়ে নিল। আর খাবার না পেয়ে শেয়ালেরা এবার মানুষকে আক্রমণ করতে শুরু করল। আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরা এভাবে খরগোশ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে শেয়াল সমস্যার সৃষ্টি করল এবং শেয়াল সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বাঘ সমস্যার সৃষ্টি করলেন।শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থার সৃষ্টি করলেন যে, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বিশুদ্ধ বায়ু নেই, পান করার জন্য বিশুদ্ধ জল নেই, কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে মানুষ আজ বিশুদ্ধ জৈব (organic) খাবার পাচ্ছে না, গোবর সার পরিত্যাগ করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে হাজার হাজার একর জমিকে বন্ধ্যা করে দিচ্ছে। পৃথিবীর নিরাপদ বেষ্টনী ওজন স্তরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং সৃষ্টি করে পৃথিবীকে দ্রুত ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে।
যন্ত্রসভ্যতারই ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বেকার সমস্যা। একটি যন্ত্র হাজার হাজার মানুষের কর্ম হরণ করছে এবং এইভাবে অলস মস্তিষ্করূপ শয়তানের কারখানা সৃষ্টি করছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ছোট্ট একটি উপদেশ “তিতিক্ষস্ব ভারত” (হে ভারতবংশীয় অর্জুন, সহ্য কর) আসলে কিন্তু ছোট্ট নয়। সাত ঘাটের জল খাওয়ার পর মানুষ একদিন বুঝতে পারবে, খিদের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে মাছ যেমন বড়শী গিলে ফেলেছে, মানুষও তেমনি কলকারখানামুখী কাগুজে টাকা ভিত্তিক শ্রমবিমুখ এক কৃত্রিম সভ্যতার সৃষ্টি করে এক সুবিশাল অদৃশ্য বড়শীকে গিলতে শুরু করেছে যার ভয়াবহ প্রভাব ইতোমধ্যেই সুস্পষ্ট। শ্রীল রূপ গোস্বামী তাই তাঁর উপদেশামৃত গ্রন্থে শিক্ষা দিয়েছেন, ‘যে সংযমী ব্যক্তি বাক্যের বেগ, মনের বেগ, জিহ্বার বেগ, উদর বেগ এবং যৌন বেগকে দমন করতে সমর্থ, তিনি সমগ্র পৃথিবী শাসন করতে পারেন’ (শ্লোক-১) সহ্য করার একটি গভীরতম তাৎপর্য রয়েছে। মনুষ্য জন্মের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধির ভয়ংকর জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবদ্ধামে গমন করা এবং কৃষ্ণপ্রেম লাভ করা। কিন্তু মায়ার সংসারের মায়িক সমস্যা সহ্য করতে না পেরে যদি একের পর এক সমাধান করার চেষ্টা করি, তাহলে তিল তিল করে দুর্লভ মনুষ্য জন্মের সীমিত আয়ুষ্কাল কর্পূরের মতো উবে যাবে। তাই কৃষ্ণ বলেছেন, সহ্য কর। মায়িক সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় পাগলের মতো ব্যস্ত হয়ে এই দুর্লভ সুযোগকে নষ্ট করো না। যথাসাধ্য সময় বাঁচিয়ে শুধু নববিধা ভক্তির অনুশীলনে সময় দাও। হরে কৃষ্ণ।

(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ২০১৪ জুন মাসে প্রকাশিত)

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।