এই পোস্টটি 781 বার দেখা হয়েছে
সরস্বতী দেবী কে?
সরস্বতী শব্দটি ‘সার’ এবং ‘স্ব’ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সেই অনুসারে সরস্বতী শব্দের অর্থ, যিনি কারো মধ্যে সারজ্ঞান প্রকাশ করেন। আবার সরস্বতী শব্দটি সংস্কৃত ‘সুরস বতি’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জলের আধার। সরস্বতী সাক্ষাৎ দেবী মূর্তি এবং নদী-দুইরূপেই প্রকটিত।
ঋগ্বেদে (২/৪১/১৬) বর্ণনা করা হয়েছে
অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।
অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি।।
অর্থাৎ মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী করো।
সরস্বতী দেবী জ্ঞান, সঙ্গীত, কলা এবং বিদ্যার দেবী।
সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের কণ্ঠদেশ থেকে দেবী সরস্বতী উদ্ভূতা হয়েছিলেন। চৈতন্য ভাগবত আদিলীলা ২/৯-১৪ তে বর্ণনা করা হয়েছেÑ
পূর্বে ব্রহ্মা জন্মিলেন নাভিপদ্ম হৈতে।
তথাপিও শক্তি নাই কিছুই দেখিতে\
তবে যবে সর্ববাবে লইলা শরণ,
তবে প্রভু কৃপায় দিলেন দরশন\
তবে কৃষ্ণ কৃপায় স্ফুরিল সরস্বতী।
তবে সে জানিলা সর্ব অবতার স্থিতি\
এক সময় শ্রীব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। শান্তভাবে ধ্যানস্থ আছেন। কী করবেন, কী করা উচিতÑচিন্তা করছেন। এমন সময় তাঁর শরীর থেকে এক সুন্দরী দেবীমূর্তি প্রকাশিত হয়। দেবী ব্রহ্মাজীকে বললেন, “হে বিধাতা আমি আপনার থেকে প্রকাশিত হলাম। এখন দয়া করে আপনি আমার স্থান এবং আমার কী কর্ম তা নির্দেশ করুন।” ব্রহ্মা বললেন, “তোমার নাম সরস্বতী। তুমি অবস্থান করো সকলের জিহ্বাতে, বিশেষভাবে সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে তুমি নৃত্য করো। পৃথিবীতে তুমি একটি নদীরূপে প্রকাশিত হও।”
দেবী সরস্বতী প্রশ্ন করলেন,হে বিধাতা, আপনি বললেন, আমি সবার জিহ্বাতে অবস্থান করবো; আবার বললেন, সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে অবস্থান করবো; আবার বললেন, নদীরূপে থাকবো। এর ব্যাখ্যা কী? ব্রহ্মা বললেন, সরস্বতী তুমি যখন লোকের জিহ্বাতে অবস্থান করবে, তখন লোকের জিহ্বা থেকে বাক্্শক্তি হবে।
তাই তোমার নাম বাক্দেবী। তুমি আমার মুখ থেকেই প্রকাশিত। তুমি পবিত্রবতী। জগৎ-সংসারে বহু অপবিত্র মানসিকতা সম্পন্ন জীব থাকবে, অপবিত্র মানুষের জিহ্বায় কদর্য বাক্য স্ফুরিত হবে, যেসব জিহ্বাতে তুমি অবস্থান করে সুখী হতে পারবে না। হে সরস্বতী, তুমি সাক্ষাৎ বুদ্ধি স্বরূপিণী। তুমি বলো, কোথায় তুমি আনন্দ লাভ করবে? সরস্বতী বললেন, যে সমস্ত ব্যক্তি পরম সুন্দর পরমেশ^র ভগবানের আরাধনা করেন, তাঁদের জিহ্বায় সর্বদা পরম প্রভুর নাম কীর্তিত হবে। আমি তাঁদের পবিত্র জিহ্বায় অধিষ্ঠান করবো।
ব্রহ্মাজী ব্রহ্মসংহিতায় বর্ণনা করেছেন, সেই পরম সুন্দর ভগবান কে? তিনি বর্ণনা করেছেন,
ঈশ্বর পরমঃ কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ
অনাদির আদি গোবিন্দ সর্বকারণ্ কারণম্্।
সেই পরমেশ^র ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দ। তিনি অনাদির আদি এবং সর্বকারণের পরম কারণ। সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
কলি সন্তরণ উপণিষদে বর্ণনা করা হয়েছে,
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে\
ইতি ষোড়শকম্্ নামনাং কলির কলুষ নাশনম্।
নাতো পরতর উপায় সর্ববেদেষু দৃশ্যতে\
শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে,
কৃষ্ণবর্ণ তিষাকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গো অন্ত্রপার্ষদম্।
যজ্ঞৈ সংকীর্তন প্রায়ৈর্যজন্তহি সুমেধসঃ\
কলিযুগে সুমেধাসম্পন্ন মানুষেরা কৃষ্ণনাম কীর্তনের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন।
পুরাণে সরস্বতী
বেদের যজ্ঞধাত্রী সরস্বতী পুরাণে ধরা দিয়েছেন বিচিত্র লীলাময়ী রূপে। অনেকগুলো পুরাণেই আমরা সরস্বতীর সাক্ষাৎ পাই। কিন্তু বৈদিককালের সরস্বতী মৌলিক ভাবনিচয় পুরাণের বর্ণনায় কোথাও ক্ষুণœ হয়নি বরং হয়েছে অধিকতর সুপ্রকাশিত।
দেবী ভাগবত (৯ম স্কন্ধ-৭) বলেন, দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাতা। তিনি বাক্য, বুদ্ধি প্রভৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। তিনি বোধস্বরূপিণী, সমুদয় সংশয়ছেদনকারিণী এবং সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী। সঙ্গীতের সন্ধান ও তাল প্রভৃতির কারণ স্বরূপিণীও তিনিই।
দেবী সরস্বতীর উপদেশ
মহর্ষি কশ্যপের এক বংশের ছিলেন তার্ক্ষ্য। সেই তার্ক্ষ্য। সেই তার্ক্ষ্য ঋষি একদিন তপস্যাকালে দেবী সরস্বতীর সাক্ষাৎ পেলেন। শেতবসনা, বীণাধারিণী, দুগ্ধবর্ণা দেবী সরস্বতী। ঋষি তাঁকে প্রণতি নিবেদন করলেন।
দেবী বললেন, হে বৎস, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে বলে জানি। তুমি যদি এখন কিছু জানতে চাও, তবে বলো।
তার্ক্ষ্য ঋষি জানালেন হে ভদ্রে, দয়া করে বলুন, ইহলোকে মানুষের কল্যাণ কীভাবে হবে?
দেবী সরস্বতী বললেন, হে তপবোন, যে ব্যক্তির হৃদয় শুদ্ধ, শাস্ত্র নির্দেশ যে যতœ সহকারে পালন করে, তারই যথার্থ কল্যাণ হয়। কী কর্ম করলে মানুষ এ জীবনের পর উর্ধ্বগতি বা নি¤œগতি লাভ করে? যদি কোনো ব্যক্তি অন্য সাত্তি¡ক ব্যক্তিকে ধন দান, আশ্রয় দান, চিকিৎসা দান, অন্ন দান, বস্ত্র প্রভৃতি দান করে তবে সুখময় স্বর্গীয় গ্রহলোকে উপনীত হবে। যে ব্যক্তি কাম ও ক্রোধ দ্বারা নিরন্তর সমাচ্ছন্ন থাকে, সে ঘোরতর নরকলোকে নিপতিত হবে। হে দেবী, কারা বৈকুণ্ঠ বা গোলোকে ধামে উপনীত হতে পারবে? যাঁরা যজ্ঞাবশেষ ভোজী অর্থাৎ শ্রীহরির মহাপ্রসাদ যাঁরা ভোজন করেন, যাঁরা সত্যব্রত অর্থাৎ ভগবৎ-ভক্তি অনুশীলন করেন, যাঁরা শ্রদ্ধাবান অর্থাৎ ভগবান ও ভক্তের নির্দেশ মেনে চলতে আগ্রহান্বিত, যাঁরা নিরহংকার অর্থাৎ ভগবৎ সম্বন্ধ ছাড়া অন্য কারো সম্বন্ধে আকৃষ্ট নন, তাঁরাই শ্রীহরির সেবা করার উপযুক্ত হন। পরিণামে তাঁরা অতি পবিত্র ধাম গোলোকে লাভ করেন এবং পরম সত্য স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকে তাঁরা নিরীক্ষণ করে থাকেন।
ঋষি তার্ক্ষ্য আবার সরস্বতী দেবীকে প্রশ্ন করলেন, হে পরমাত্মারূপা প্রজ্ঞা, আপনি কে?
দেবী সরস্বতী বললেন, আমি পরাপর বিদ্যারূপা দেবী। অর্থাৎ পরা বিদ্যা হচ্ছে ভগবান ও ভক্তি সম্বন্ধীয় বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা হচ্ছে জড়জগতের কর্মকান্ডীয় বিদ্যা। এ উভয় বিদ্যাই আমি জীবকে প্রদান করি।
হে ঋষি, যারা বহু বহু বর্ষব্যাপী সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে উচ্চতর লোক ব্রহ্মলোক, স্বর্গলোক ইত্যাদি গ্রহে যাওয়ার জন্য কামনা করে, তাদের আমি দান ব্রত ইত্যাদির নানাবিধ পুণ্য পবিত্র কর্মে প্রবৃত্ত করি। আর যাঁরা ভগবদ্ধধামে গোলোকে বৈকুণ্ঠে যাত্রা করবার আকাক্সক্ষা করেন, তাঁদের আমি ভক্তি বিদ্যা দান করি।
তার্ক্ষ্য বললেন, হে দেবী সকল পন্ডিত ব্যক্তি বিশ্বস্ত মনে যাকে শ্রেয় জ্ঞান করে ইন্দ্রিয় সংযম প্রভৃতি কঠোর ব্রত অনুষ্ঠান করেন, সেই দুঃখশোক শূণ্য মোক্ষ কী? সাংখ্য শাস্ত্রে যাঁকে চিরন্তন ও শ্রেষ্ঠ বলে নির্দেশ করে, সেই পরমাত্মা কে? আমি জানি না, তাই আপনি দয়া করে সেই বিষয়ে উপদেশ দিন।
দেবী সরস্বতী বললেন, হে তার্ক্ষ্য, বিচক্ষণ পন্ডিত ব্যক্তিরা শোকরহিত ও বিষয় বাসনা শূণ্য হয়ে ব্রতপরায়ণ হন এবং ভক্তিযোগে যে আদি পুরুষকে প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তিনি হচ্ছে সেই পরম ব্রহ্ম, পরমাত্মা পরমেশ^র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। হে ঋষি, যে স্থানে ভক্তরা সেই পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে যাবতীয় কর্ম করেন, সেই স্থান আমার আশ্রয়স্বরূপ।
সরস্বতী পূজার বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ধর্মের নামে নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তিতে ব্যস্ত। এমনকি মানুষ মনে করছে তারা ধর্ম করছে, কিন্তু দেব-দেবীদের সামনে যে আচরণ করছে, তা এমনকি সভ্য সমাজে অপাঙক্তেয়। যুবক-যুবতী, মধ্য বয়স্করা বলিউডের গানের তালে তালে নিজেদের ইন্দ্রিয় তোষণের চেষ্টা করছে, আর ভাবছে সে মায়ের বা দেবীর আরাধনা করছে। যে ধরনের আচরণ সে এমনকি নিজের মায়ের সম্মুখে করতে পারে না, সেই অসদাচরণ জগজ্জননী মায়ের তথাকথিত পূজার ছলে করছে। এমনকি শোনা যায়, মায়ের পূজার জন্র যে অর্থ সংগ্রহ করেন, তা তারা নিজেদের ইন্দ্রিয় তোষণের জন্য বিভিন্ন জাগতিক (তথা যৌন উদ্দীপক) গানের আসরের আয়োজন করছে। কখনও কখনও মদ্যপানের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই যথার্থ ধর্মাচরণকারী বা বিদ্যার্থীর কর্তব্য হচ্ছে যথার্থ মনোভাব ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পূজা সম্পাদন করা। সর্বতোভাবে মানে সন্তুষ্ট করে না এমন সব গান বা কার্য থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে, কোন কাযৃ মাতা সরস্বতীকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আমরা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করব কোন মনোভাবে আমাদের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা উচিত, কোন বাহ্যিক বিষয় মায়ের প্রার্থনায় গুরুত্ব বহন করে না, কোন প্রতিমায় মা অবস্থান গ্রহণ করেন।
সরস্বতী পূজা কি লৌকিক প্রথা?
আমরা বেশির ভাগই ধর্ম করি, পূর্বপুরুষের ধারা অনুযায়ী অথবা সকল কর্মের ফল লাভের জন্য অথবা না বুঝে আনন্দ পাই বলে পূজার লৌকিক প্রয়াস করি। এধরনের প্রয়াসের ফলে মনের শান্তি অনুভব হয় বটে; কিন্তু তা কি আমাদের বিদ্যা লাভের প্রকৃত উদ্দেশ্যে সাধিত হয়? এ ধরণের লৌকিক প্রয়াসই লৌকিকতা বা প্রথাগত ধর্মাচার বলে পরিগণিত হয়।
ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ -এর সংজ্ঞানুযায়ী, লৌকিকতা ও কর্তব্যবোধে আচরিত অনুভূতিবিহীন ধর্মাচরণেকে জরঃঁধষ বলা হয়। আমরা হয়ত বেশির ভাগই লৌকিকতার কারণেই পূজা করছি; কিন্তু কীভাবে ধমৃাচরণ করলে বা পূজা করলে লৌকিকতা মুক্ত হয়ে প্রকৃত অর্থেই বিদ্যা লাভের পথে এগিয়ে যেতে পারব, সেই ভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। প্রার্থনা বলতে শাস্ত্রে বলা হয়েছে-“প্রার্থনা হলো এমন একটি কার্য যার দ্বারা একজন ব্যক্তি তার মন ও চিত্তকে ভগবানে/দেবতার কাছে নিদিষ্ট করতে পারে।
প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা ভগবানের/দেবতার কাছে আমাদের অসহায়ত্ব ও ক্ষুদ্রত্ব স্বীকার করে তাঁ চরণে সমর্পিত হই। প্রাথনা মগ্ন হওয়ার অর্থ বলতে বলা হয়েছে, পরমেশ^র ভগবান/আরাধ্য দেবতার কথা স্মরণ করা, তাঁকে দর্শন করা, তার সঙ্গে কথা বলা অথবা তাঁর বিষয়ে চিন্তা করা। শ্রীমদ্ভাগবতে প্রার্থনায় আমাদের যা করতে বলা হয়েছে তা হলো:
১. তাঁর মহিমা কীর্তন
২. কৃতজ্ঞতা স্বীকার
৩. হৃদয়ের আকুলতা
৪. ক্ষমা প্রার্থনা
প্রার্থনা আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত হওয়া উচিত। যদি প্রার্থনা হৃদয় থেকে না আসে, তবে সেটা শুধুমাত্র মুখের কসরত ছাড়া আর কিছু হবে না। প্রাথমিক অবস্থায় হৃদয় থেকে প্রার্থনা করা কঠিন হতে পারে, তাই ভগবান/দেবতার কাছে আমাদের বিনীত হওয়ার অক্ষমতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিনীত প্রার্থনা করা উচিত।
আমরা কোন বিদ্যা চাইব?
ভক্তগণও সরস্বতী পূজা করেন। কিন্তু মায়াবদ্ধ ও মায়ামুক্ত জীবের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে তাদের পূজায়ও পার্থক্য আছে। মায়াগ্রস্ত জীবের মায়িক বস্তুতে আসক্তি থাকে। যখন জীব মায়ার সেবায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনি কর্মী; আবার যখন মায়ার বিদ্যাবৃত্তির সেবায় রত হন, তখন তিনি জ্ঞানী। ঈশোপনিষদে (শ্লোক-৯) বলা হয়েছে-
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ\
“যারা অবিদ্যা অনুশীলন করে, তারা অজ্ঞানের ঘোর অন্ধকারময় লোকে প্রবেশ করে, যারা তথাকথিত বিদ্যা অনুশীলনে রত, তারা আরও ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে গতি লাভ করে।”
অর্থাৎ, অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক, তবে বিপথচালিত বা ভ্রান্ত বিদ্যা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। গণশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সভ্যতা যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু জীবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পারমার্থিক বিদ্যা বা পর বিদ্যা। সেখান থেকে বিমুখ হয়ে জড়-জাগতিক উন্নতিতে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায়, মানুষ পূর্বাপেক্ষা আরও অধিক অসুখী হয়ে পড়ছে। বিদ্যাবৃত্তি জড় আসক্তিকে বিনাশ করে, আর অবিদ্যাবৃত্তি জড় বিষয়ে আসক্তি বৃদ্ধি করে। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ জীবগণ অবিদ্যায় অবস্থিত। অবিদ্যার আবরণে তাদের প্রকৃত স্বরূপ আচ্ছাদিত। যারা মায়ামুক্ত, তাঁরা বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ের স্বরূপ সম্যক প্রকারে অবগত আছেন। তারা নিজেদের ভগবানের দাস জ্ঞান করে ভগবানের সেবায় প্রবৃত্ত হন। মায়াবশীভূত জীবগণ সত্ত¡, রজ ও তমো গুণে আবদ্ধ হয়ে দেবতাদের ভজনা করেন। বিভিন্ন গুণসম্পন্ন জীবগণ তাদের নিজ নিজ রুচি অনুসারে শান্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্র বা বৈষ্ণব নামে অভিহিত হন। তারা ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য ধন কামনায় ল²ী এবং বিদ্যালাভ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লৌকিক প্রথা অনুসারে দেবী সরস্বতীর পূজা করেন।
তারা যে বিষয় কামনায় পূজা করেন তা সবই নশ^র। আমি ধনী হবো, পÐিত হবো, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবো, সমগ্র জগতে আমার যশ কীর্তিত হবে। এসমস্ত বাসনা সবই নশ^র। চারবেদ ষড় দর্শন অধ্যয়ন করেও যদি ভগবানের প্রতি অহৈতুকী ভক্তির উদয় না হয় তবে সবই বৃথা শাস্ত্রে বর্ণনা করা হচ্ছেÑ
আচারহীনং ন পুনন্তি বেদা…। যে বস্তু দেহত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ত্যাগ করে সেসমস্ত বিষয় নিয়ে নিত্য আত্ম্যার কতটুকু স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে। তাই যারা উন্নত বিচারবোধসম্পন্ন, তারা কখনো নশ^র বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের সুযোগটুক হেলায় হারাতে ইচ্ছা করেন না। ঐকান্তিকী ভক্তগণ সরস্বতী দেবীকে চিৎ-শক্তিরূপে পূজা করেন। ভাগবত কীর্তনের প্রারম্ভে শ্রীল সূত গোস্বামী মঙ্গলাচরণের মধ্যে পরাবিদ্যাস্বরূপিণী সরস্বতীর প্রণাম করছেন যে, “দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ”। আদিগুরু শ্রীব্রহ্মার হৃদয়ে সৃষ্টি বিষয়ক স্মৃতি প্রকাশের জন্য যে সরস্বতী দেবী ভগবানের প্রেরণায় প্রকটিত হন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই উপাস্য মনে করেন।
যে সরস্বতী দেবী ভগবানের প্রেরণায় প্রকটিত হন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই উপাস্য মনে করেন।