এই পোস্টটি 257 বার দেখা হয়েছে
জীবন থেকে চলে যাওয়া সময়
আমাদের জীবন থেকে সময় যে কতভাবে চুরি হয় তা আমাদের অনেকেরই খেয়াল থাকে না। উপরোক্ত চিত্রে তালিকা প্রদত্ত হয়েছে। যদি একজন মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর হয় তবে নিদ্রায় ২২ বছর, নিত্য কর্মকাণ্ড যেমন- দাঁত ব্রাশ, শৌচ, স্নান ইত্যাদিতে-২.৫ বছর, ভোজনে-৫.৫ বছর, যাতায়াতে-৫.৫ বছর, কর্মস্থলে-১৬ বছর, বিবিধ কর্মে -২.৫ বছর, ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনায়-১১ বছর কেটে যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে এগুলোতো জীবনের আবশ্যিক করণীয় বিষয়। তবে সময় চুরি হচ্ছে কোথায়? সময় চুরি এজন্যেই বলা হচ্ছে যে, এগুলো কোনোটাই আমরা ভগবৎ সেবার উদ্দেশ্যে ব্যয় করি না। যার ফলে শাস্ত্রানুসারে এটিকে বলা হয় ‘সময় চুরি’ বা সময়ের অপচয়। অথচ ভগবদ্ভক্তরা জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে তার সদ্ব্যবহার করে।
প্রতিটি ক্ষণ কেন গুরুত্বপূর্ণ? শ্রীমদ্ভাগবতের (৩/৩০/১) তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ উল্লেখ করেছেন, “মহান রাজনীতিজ্ঞ চাণক্য পণ্ডিত বলেছেন, কোটি-কোটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়েও এক মুহূর্ত সময় ফিরে পাওয়া যায় না। মূল্যবান সময়ের অপচয়ের ফলে, যে বিরাট ক্ষতি হয়, তা কোন রকম গণনার দ্বারা হিসাব করা হায় না। মানুষের কাছে যতটুকু সময় রয়েছে, তা জাগতিক অথবা পারমার্থিক উভয় ক্ষেত্রেই, অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা উচিত।
বদ্ধ জীব একটি বিশেষ শরীরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাস করে এবং শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে, সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃষ্ণভক্তি সম্পাদন করতে হয় এবং তার ফলে কালের প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যারা কৃষ্ণভক্তিতে যুক্ত নয়, তারা তাদের অজ্ঞাতসারে প্রবল শক্তির দ্বারা বিচলিত হয়, ঠিক যেমন বায়ু মেঘপুঞ্জকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।”
জাগতিক কর্ম কেন সময় অপচয়? শ্রীল প্রভুপাদ এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতের ২/২/৩ এর তাৎপর্যে উল্লেখ করেছেন, “ভাগবদ্ধর্ম বা শ্রীমদ্ভাগবত প্রদর্শিত পন্থা সকাম কর্মের পন্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক; ভগবদ্ভক্তেরা সকাম কর্মের পন্থাকে সময়ের অপচয় বলে মনে করেন। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড, তথা সমগ্র জড় জগৎ কেবল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তার পরিকল্পনায় আবর্তিত হচ্ছে, যদিও দেখা যায়, এই জগতে কারও অস্তিত্বই নিরাপদ নয়; জীবনের কোন অবস্থাতেই মানুষ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যময় অথবা নিরাপদ হতে পারে না। যারা অলীক জড় সভ্যতার মোহময়ী প্রগতির দ্বারা মোহিত, তারা অবশ্যই উন্মাদ। জড় সৃষ্টি কেবল নামের ভোজবাজি; প্রকৃতপক্ষে, তা কেবল মাটি, জল, আগুন ইত্যাদি জড় পদার্থের বিভ্রান্তিকর সমন্বয়। বাড়িঘর, আসবাবপত্র, গাড়ি, কলকারখানা, শান্তি, যুদ্ধ, এমনকি জড় বিজ্ঞানের সর্বোত্তম সাফল্য, যথা আণবিক শক্তি এবং ইলেকট্রনিক্স, এসবই প্রকৃতির তিনটি গুণের প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে উদ্ভূত জড় উপাদানগুলির বিভ্রান্তিকর নাম মাত্র। যেহেতু ভগবানের ভক্তেরা সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত, তাই তারা সমুদ্রের তরঙ্গের বুদ্বুদের মতো অবাস্তব বস্তুসমূহের দ্বারা অবাঞ্ছিত বিষয়ে উৎসাহী নন।
মহান রাজা, নেতা এবং সৈনিকেরা ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লিপিবদ্ধ করার জন্য পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কালের প্রভাবে ইতিহাসের আর একটি যুগকে স্থান দেওয়ার জন্য তারা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। কিন্তু ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তি যে প্রবাহমান কালের কিরকম অর্থহীন উৎপাদন, সে সম্বন্ধে ভক্তরা উপলব্ধি করতে পারেন। সকাম কর্মীরা প্রভূতভাবে ধন-সম্পদ স্ত্রী-রতন এবং জাগতিক যশ লাভের আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু যারা বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছেন, তাঁদের কাছে তা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
মানব জীবনে এক মুহূর্তও যদি জড় জগতের সুখ ভোগের পরিকল্পনায় নষ্ট করা হয়, তা হলে কোটি কোটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়েও তা ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই মায়ার বন্ধন থেকে বা জীবনে মোহময়ী কার্যকলাপ থেকে মুক্ত হতে ইচ্ছুক অধ্যাত্মবাদীকে এখানে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, তিনি যেন সকাম কর্মের বাহ্যিক রূপে মোহিত না হন। ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন করা কখনই মানব জীবনের উদ্দেশ্য নয়; মানব জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মতত্ত্বজ্ঞান লাভ করা। শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সেই উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।
আত্ম-উপলব্ধি করাই হচ্ছে মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। যে সভ্যতা এই পরম সিদ্ধিকে লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করে, তা কখনো অর্থহীন বস্তু তৈরির কাজে লিপ্ত হয় না এবং সেই প্রকার সর্বাঙ্গ সুন্দর সভ্যতা মানুষকে কেবল জীবনের ন্যূনতম আবশ্যকতাগুলি গ্রহণ করতে শেখায়, বা খারাপ সওদার সর্বোত্তম উপযোগ করার সিদ্ধান্ত পালন করার ব্যাপারে প্রস্তুত করে। আমাদের জড় দেহ এবং সেই দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের জীবন হচ্ছে একটি খারাপ সওদা, কেননা প্রকৃতপক্ষে জীব হচ্ছে চিন্ময় আত্মা এবং পারমার্থিক প্রগতি হচ্ছে জীবের পরম প্রয়োজন। মানব জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপলব্ধি করা এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অন্য উদ্দেশ্যে শক্তির অপচয় না করে ও জড় সুখভোগের প্রতি উন্মত্ত না হয়ে ভগবানের দানের ওপর নির্ভরশীল থেকে জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করা।
জড় সভ্যতার প্রগতিকে বলা হয় “আসুরিক সভ্যতা’, যা পরিণামে যদ্ধ এবং অভাবে পর্যবসিত হয়। পরমার্থবাদীদের এখানে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে যে, তাঁরা যেন তাঁদের মনকে স্থির করেন যাতে উচ্চতর চিন্তাধারা সমন্বিত সরল জীবন যাপনেও যদি প্রতিকূলতা আসে, তা হলেও যেন তাঁরা তাঁদের দৃঢ় সংকল্প থেকে একটুও বিচলিত না হন। জড় জাগতিক ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থাকার অধ্যাত্মবাদীদের পক্ষে আত্মহত্যার পন্থা, কেননা । এই প্রকার পন্থা জীবনের চরম উদ্দেশ্য সাধনে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।
শুকদেব গোস্বামী মহারাজ পরীক্ষিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, যখন মহারাজ পরীক্ষিৎ সেই সাক্ষাতের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। অধ্যাত্মবাদীদের কর্তব্য হচ্ছে প্রকৃত মুক্তির অভিলাষী ব্যক্তিদের সাহায্য করা এবং মুক্তির উদ্দেশ্য সাধনে সহযোগিতা করা। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে যে, মহারাজ পরীক্ষিৎ যখন একজন মহারাজ রাজা রূপে রাজ্য শাসন করছিলেন, তখন শুকদেব গোস্বামী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।”
সময় চুরি কিভাবে রোধ করা সম্ভব সময় চুরি কিভাবে রোধ করা যায় এ বিষয়ে শ্রীমদ্ভাগবতের (২/৩/১৭) গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে।
আয়ুহরতি বৈ পুংসামুদ্যনস্তঞ্চ যন্নসৌ।
তস্যর্তে যক্ষণো নীত উত্তমশ্লোকবার্তয়া ॥
সূর্যদেব প্রতিদিন উদিত ও অস্তগত হয়ে সকলের আয়ু হরণ করেন, কিন্তু যারা সর্বমঙ্গলময় পরমেশ্বর ভগবানের কথা আলোচনা করে তাঁদের সময়ের সদ্ব্যবহার করেন, তাঁদের আয়ু তিনি হরণ করেন না। তাৎপর্য: এই শ্লোকে পরোক্ষভাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, মানব জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য অতি শীঘ্র ভগবদ্ভক্তিপরায়ণ হওয়া। কাল এবং জোয়ার ভাটা কারোরই প্রতীক্ষা করে না। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মাধ্যমে কালের যে গতি, তা ব্যর্থ হচ্ছে যদি পারমার্থিক উপলব্ধির উদ্দেশ্যে তার যথাযথ সদ্ব্যবহার না করা হয়। পৃথিবীর সমস্ত স্বর্ণের বিনিময়েও জীবনের অপব্যবহৃত একটি ক্ষণও ফিরে পাওয়া যায় না। এই মনুষ্য জীবন জীবনকে এই জন্য প্রদান করা হয় যাতে সে তার চিন্ময় স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে এবং তার নিত্য আনন্দের উৎস খুঁজে পেতে পারে। প্রতিটি জীব, বিশেষ করে মানুষ আনন্দের অন্বেষণ করে, কেনা আনন্দ হচ্ছে জীবের প্রকৃতিগত অবস্থা। কিন্তু সে বৃথাই জড় পরিবেশে সেই আনন্দের অন্বেষণ করছে। জীব তার স্বরূপে পূর্ণতমের একটি চিৎ-স্ফুলিঙ্গ এবং চিন্ময় কার্যকলাপের মাধ্যমে সে পূর্ণরূপে সেই আনন্দ আস্বাদন করতে পারে। ভগবান হচ্ছে পূর্ণ চিন্ময় এবং তাঁর নাম, রূপ, গুণ লীলা, পরিকর এবং বৈশিষ্ট্য তাঁর থেকে অভিন্ন। কেউ যখন ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে যথাযথভাবে ভগবানের উপরোক্ত শক্তিগুলির মধ্যে যে কোন একটির সংস্পর্শে আসে, তৎক্ষণাৎ তার জন্য সিদ্ধির দ্বার খুলে যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (২/৪০) ভগবান সেই সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে বলেছেন—“ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন কখনো ব্যর্থ হয় না, তার স্বল্প আচরণও মানুষকে ভবসাগরের মহা ভয় থেকে উদ্ধার করার পক্ষে যথেষ্ট।” অত্যন্ত শক্তিশালী ওষুধ ধমনীতে প্রবেশ করানোর ফলে যেমন তৎক্ষণাৎ তা সারা শরীরের ওপর ক্রিয়া করে। ঠিক তেমনই ভগবানের অপ্রাকৃত কথা শুদ্ধ ভক্তের কর্ণকুহরের মাধ্যমে প্রবিষ্ট হলে তৎক্ষণাৎ কার্যকরী হয়। শ্রবণের দ্বারা অপ্রাকৃত বাণীর উপলব্ধি বলতে পূর্ণ উপলব্ধি বোঝায়, ঠিক যেমন গাছের এক জায়গায় ফল ধরলে বুঝতে হবে গাছের অন্যান্য অংশেও ফল ধরেছে।
শুকদেব গোস্বামীর মতো শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গে প্রভাবে ক্ষণিকের উপলব্ধিও মনুষ্য জীবনকে অমরত্ব প্রদান করে। তার ফলে সূর্য সেই শুদ্ধ ভক্তের আয়ু হরণ করতে পারে না, কেননা ভগবদ্ভক্তিতে নিরন্তর যুক্ত থাকার ফলে তার অস্তিত্ব বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। মৃত্যু হচ্ছে অমৃতময় জীবের ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থার লক্ষণ; জড় জগতের ভবরোগ নামক সংক্রামক ব্যাধির প্রভাবেই নিত্য জীবন জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধির কবলগ্রস্ত হয়। হরে কৃষ্ণ
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ এপ্রিল ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ