জয় শ্রীমাধবপুরী কৃষ্ণপ্রেমপুর।
ভক্তিকল্পতরু তেঁহো প্রথম অঙ্কুর।।
— (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত আদি ৯। ১০)
স্বয়ং ভগবান্ শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীমাধব পুরী সম্বন্ধে এইরূপ বলেছেন—
প্রভু কহে,— নিত্যানন্দ, করহ বিচার।
পুরী-সম ভাগ্যবান্ জগতে নাহি আর।।
দুগ্ধদান-ছলে কৃষ্ণ যাঁরে দেখা দিল।
তিনবারে স্বপ্নে আসি’ যাঁরে আজ্ঞা কৈল।।
যাঁর প্রেমে বশ হৈঞা প্রকট হইলা।
সেবা অঙ্গীকার করি’ জগত তারিলা।।
যার লাগি’ গোপীনাথ ক্ষীর কৈল চুরি।
অতএব নাম হৈল ‘ক্ষীরচোরা’ হরি।।
—- (শ্রীচৈঃ চঃ মধ্যঃ ৪। ১৭১-১৭৪)
পূর্বে যখন শ্রীমাধব পুরী বৃন্দাবন ধামে এলেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে সতত বিভোর থাকতেন। দিন রাত সম্বন্ধে কোন জ্ঞান থাকত না। কখন ক্রন্দন করছেন, কখন নর্ত্তন করছেন ও কখন প্রেমে ভূমিতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। গোবর্দ্ধন পরিক্রমা করে গোবিন্দ কুন্ডে এলেন এবং স্নান করে একটি গাছের তলায় বসলেন। শ্রীপুরী গোস্বামী কখনও মেগে খেতেন না। শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকের বেশ ধরে এক ভান্ড দুধ মাথায় করে পুরীর কাছে এসে বললেন—পুরী তুমি এই দুধ পান কর। তুমি মেগে খাওনা কেন? দিবারাত্র কার ধ্যান কর? গোপবালকের সেই মধুর কথা শুনে এবং অপূর্ব্ব রূপ দেখে। পুরী বড়ই সুখী হলেন। পুরীর ক্ষুধা তৃষ্ণা চলে গেল।
পুরী বললেন, তুমি কে? কোথায় থাক? তুমি কি করে জানলে যে আমি উপবাসী? গোপবালক-রূপী কৃষ্ণ আত্মগোপন করে বললেন, আমি গোপ-শিশু! এই গ্রামে থাকি। আমার গ্রামেতে কেহ উপবাসী থাকে না। কেহ অন্ন মেগে খায়, কেহ দুধ বা ফল মেগে খায়। অযাচক লোককে আমি আহার দিয়া থাকি। স্ত্রীলোকেরা এই কুন্ডে জল নিতে এসে তোমাকে দেখে গেছেন। তাঁরা আমার হাতে দুধ দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমি শীঘ্রই গোদোহন করতে যাব। তুমি দুধ পান করে ভান্ডটা রেখে দিও। আমি পরে এসে নিয়ে যাব। এই কথা বলে গোপবালক চলে গেল। পুরী গোস্বামী দুধ পান করে ভান্ডটি ধুয়ে বালকটির পথ দেখতে লাগলেন। ক্রমে রাত গভীর হতে লাগল, কিন্তু বালক আর এল না। পুরী বসে নাম নিতে লাগলেন, শেষরাত্রে একটু তন্দ্রা এল। তখন স্বপ্নে দেখতে লাগলেন— সেই গোপশিশু এসে পুরীর হাতে ধরে তাঁকে এককুঞ্জ-সন্নিধানে নিয়ে গেল এবং কুঞ্জ দেখিয়ে বলতে লাগল – আমি এই কুঞ্জে থাকি। শীতবর্ষাদিতে কষ্ট পাই। তুমি গ্রামের লোক নিয়ে কুঞ্জ কেটে আমায় বের কর। পর্ব্বতের উপরে এক মন্দির করে আমায় তথায় স্থাপন কর এবং বহু শীতল জল দিয়ে আমার অঙ্গ মার্জ্জনা কর।
বহুদিন তোমার পথ করি নিরীক্ষণ।
কবে আসি’ মাধব আমা করিবে সেবন।।
তোমার প্রেমবশে করি সেবা অঙ্গীকার।
দর্শন দিয়া নিস্তারিব সকল সংসার।।
মাধব। বহুদিন ধরে তোমার পথ চেয়ে আছি, তুমি কবে আসবে। কবে আমার সেবা করবে? তোমার প্রেমে বশীভূত হয়ে তোমার সেবা অঙ্গীকার করছি। আমি দর্শন দিয়ে সকলকে উদ্ধার করব। মাধব! আমার নাম “গোপাল”। আমি গোবর্দ্ধনধারী। আমি রত্নের স্থাপিত বৃন্দাবনের ঈশ্বর। আমার সেবকগণ ম্লেচ্ছ ভয়ে আমায় কুঞ্জে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই দিন থেকে আমি কুঞ্জ মধ্যে আছি। তুমি কুঞ্জ থেকে বের করে আমার সেবা কর। গোপাল এই কথা বলে অন্তর্হিত হলেন। শ্রীমাধব পুরীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। জেগে ভাবতে লাগলেন আমি কৃষ্ণ দর্শন পেয়েছিলাম, কিন্তু ভাগ্য দোষে তাঁকে চিনতে পারলাম না। এই কথা বলে প্রেমাবেশে ভূমিতলে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে চৈতন্য লাভ করে মন স্থির করলেন এবং গোপালের আজ্ঞা পালন করবার জন্য তৎপর হলেন।
শ্রীমাধব পুরী প্রাতঃকালে গ্রামে গেলেন এবং ভব্য লোকদের ডেকে বললেন— তোমাদের গ্রামের ঈশ্বর গোবর্দ্ধনধারী শ্রীকৃষ্ণ এক কুঞ্জ মধ্যে আছেন। কুঞ্জ কেটে তাঁকে বের করতে হবে। গ্রামবাসিগণ পুরীর কথা শুনে সকলে সুখী হলেন এবং কোদাল কুঠার নিয়ে কুঞ্জের দিকে চললেন। বৃক্ষ, লতা আচ্ছাদিত নিবিড় কুঞ্জ। কুঠারের দ্বারা কুঞ্জের বৃক্ষ লতাদি কেটে তার মধ্যে প্রবেশ করে দেখলেন—ঠাকুর মৃত্তিকা দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে আছেন। শ্রীমূর্ত্তিটি অতি সুন্দর এবং প্রকান্ড। সকলে আশ্চর্য্য ও আনন্দিত হয়ে ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গের ধূলা কাদা ঝেড়ে তাঁকে বাইরে আনলেন। শ্রীপুরী গোস্বামী শ্রীমূর্ত্তি দেখে আনন্দাশ্রুসিক্ত নয়নে সাষ্টাঙ্গে দন্ডবৎ হয়ে পড়লেন। চতুর্দিকে লোক আনন্দে হরি হরি বলতে লাগল। ভারী বিগ্রহ, বহু বলিষ্ঠ লোক শ্রীবিগ্রহকে শ্রীগোবর্দ্ধনের উপর উঠাল এবং একটি মঠ তৈরী করে সেখানে স্থাপন করল। শ্রীগোপাল দেবের অভিষেক আরম্ভ হল। গ্রামের ব্রাহ্মণগণ এসে অভিষেকের কার্য্য করতে লাগলেন। গোবিন্দকুন্ড থেকে সহস্র ঘাট জল আনয়ন করা হল। পুষ্প, তুলসী প্রভৃতি সংগ্রহ করতে কিছু ব্রাহ্মণ লেগে গেলেন। শ্রীগোপাল দেবের প্রকট সংবাদ শ্রবণ করে গ্রামের গোপগণ আনন্দে ভারে ভারে দই, দুধ, কলা, চাল, আটা, ঘি ও বিবিধ তরিতরকারী আনতে লাগল। শ্রীগোপাল দেবের ইচ্ছায় কে কোথা থেকে কি আনতে লাগল, তা অবর্ণনীর। বাদ্যকার এসে বাজনা বাজাতে লাগল। গায়কগণ মধুর সংকীর্ত করতে লাগল।
শ্রীমাধব পুরী স্বয়ং শ্রীগোপাল দেবের মহাস্নান অভিষেক কার্য্য করতে লাগলেন। দশজন ব্রাহ্মণ অন্ন, পাঁচজন তরকারী, পাঁচজন ত্রুটি ও কিছু লোক বিবিধ মিষ্টান্ন প্রভৃতি তৈরী করতে লাগলেন। নব বস্তু পেতে তদুপরি পলাশ পাতা বিছিয়ে অন্নের ও রুটির রাশি করা হল। পূর্বে শ্রীনন্দ মহারাজ যেমন অন্নকূট মহোৎসব করেছিলেন, ঠিক সেই প্রকার অন্নকূট মহোৎসব যেন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। রন্ধন সমাপ্ত হলে শ্রীমাধব পুরী শ্রীগোপাল দেবকে নিবেদন করতে বসলেন। “বহুদিনের ক্ষুধায় গোপাল খাইল সকল।।” (শ্রীচৈঃ চঃ মধ্য ৪।৭৬) গোপাল বহুদিন ক্ষুধার্ত্ত, সব কিছু ভোজন করলেন। শ্রীমাধব পুরী সব দেখতে পেলেন। তাঁর কি আনন্দ, সুখে দেহস্মৃতি নাই, প্রেমানন্দে তিনি ভরপুর! শ্রীগোপাল দেব ভোজনান্তে বিস্তর সুগন্ধি জল পান করলেন। শ্রীমাধব পুরী স্বচক্ষে এ সব লীলা দেখতে পাচ্ছিলেন। শ্রীগোপাল সব কিছু ভোজন করলেন ও তাঁর দিব্য শ্রীহস্ত স্পর্শে সবকিছুই পূর্ণ ভাবে রইল। শ্রীমাধবপুরী গোপালকে আচমন করায়ে তাম্বুল দিলেন এবং পরে শয়ন করালেন। অতঃপর শ্রীমাধব পুরী প্রসাদ পাওয়ার জন্য সকলকে আদেশ করলেন। আগে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীদের ভোজন করান হল। পরে দীন-দুঃখী সকলের ভোজন হল। শ্রীপুরী গোস্বামীর প্রভাব দেখে সকলে আশ্চর্য্য হল। শ্রীপুরী গোস্বামী সারাদিন পরিশ্রম করবার পর রাত্রে কিছু দুধ পান করলেন। শ্রীকৃষ্ণপ্রেমানন্দে শ্রীমাধব পুরীর ক্ষুধা তৃষ্ণা নাই। পরদিন প্রাতঃকালে অন্যান্য গ্রামের লোকজন আগের দিনের ন্যায় সেবা সম্ভার নিয়ে এল। সেদিনও সেইরূপ অন্নকূট হল।
ব্রজবাসী লোকের কৃষ্ণে সহজ পিরীতি।
গোপালের সহজ প্রীতি ব্রজবাসি-প্রতি।।
(শ্রীচৈঃ চঃ মধ্যঃ ৪।৯৫)
ব্রজবাসীগণ “শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত আর কিছু জানে না। কৃষ্ণও ব্রজবাসী ভিন্ন আর কিছু জানেন না। ব্রজজনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের স্বাভাবিক প্রীতি।” অনন্তর দিনের পর দিন অন্নকূট হতে লাগল। গোপালকে বহু বস্ত্রালঙ্কার ভক্তগণ অর্পণ করতে লাগলেন। গোপালদের দশ হাজার গাভী দান পেলেন, গোপালের সেবা দেখে পুরীর মনে বড়ই আনন্দ হল। গৌড়দেশ থেকে আগত দুই জন বৈরাগী ব্রাহ্মণকে শিষ্য করে শ্রীমাধব পুরী তাঁদের গোপালের সেবাভার দিলেন।
ভক্তবৎসল ভগবান্ ভক্তের সঙ্গেই লীলা করেন। একদিন শ্রীগোপাল- দেব শ্রীমাধব পুরীকে স্বপ্নে বললেন—“পুরী! আমার অঙ্গতাপ যাচ্ছে না। তুমি যদি নীলাচল থেকে মলয়জ চন্দন ও কর্পূর এনে আমার অঙ্গে প্রলেপ দিতে পার, তবে আমার অঙ্গতাপ নিবৃত্ত হবে।” পুরী বললেন—“ঠাকুর আমি বৃদ্ধ, তোমার এই সেবা করতে কি পারবো ?” — গোপাল বললেন—“পুরী। তুমিই করতে পারবে। তোমাকেই করতে হবে, অন্যের দ্বারা হবে না। পুরীর স্বপ্ন ভঙ্গ হল। স্বপ্নকথা স্মরণ করে প্রেমে বিহ্বল হতে লাগলেন। গোপাল আমাকে আদেশ করেছেন –চন্দন কর্পূর আনতে। আহা! গোপালের কত করুণা। শ্রীমাধব পুরী বৃদ্ধ। তবুও তাঁকেই মলয়জ চন্দন আনতে আদেশ করলেন। শ্রীমাধব পুরী শ্রীগোপাল দেবের আজ্ঞা শিরে ধারণ করে মলয়জ চন্দন আনবার জন্য নীলাচলের দিকে চললেন। শ্রীমাধব পুরী ক্রমে ক্রমে চলতে চলতে গৌড় দেশে এলেন। শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্যের গৃহে উঠলেন। শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য তাঁকে দেখেই বুঝতে পারলেন ইনি শ্রীকৃষ্ণপ্রিয় মহাভাগবত শিরোমণি। আচার্য্য তৎক্ষণাৎ তাঁর শ্রীচরণাদি ধৌত করে পাদমর্দন পূজাদি করলেন এবং সমাদরে তাঁকে ভোজনাদি করালেন। শ্রীমাধব পুরী অদ্বৈত আচার্য্যের গৃহে কয়েক দিন কৃষ্ণ-কথানন্দে অবস্থান করলেন। শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য প্রভু শ্রীমাধব পুরীপাদের থেকে মন্ত্র দীক্ষাদি গ্রহণ করলেন। শ্রীমাধব পুরীকে একদিন শ্রীজগন্নাথ মিশ্র আমন্ত্রণ করে স্বীয় গৃহে আনয়ন করেন এবং পাদধৌতাদি পূর্ব্বক, পাদ-পূজাদি করে বহুবিধ তরকারী ব্যঞ্জন অন্নাদি খুব যত্নের সহিত ভোজন করান। শচী জগন্নাথের প্রগাঢ় ভক্তি দর্শনে শ্রীপুরী গোস্বামী তাঁদের প্রচুর আশীর্ব্বাদ করেন। সেই আশীর্ব্বাদের ফলেই যেন শ্রীমহাপ্রভু তাঁদের ঘরে আবির্ভূত হলেন।
শ্রীমাধব পুরী কিছুদিন নবদ্বীপ পুরে অবস্থান করবার পর উড়িষ্যাভিমুখে যাত্রা করলেন। ক্রমে এলেন রেমুনায়। তথায় শ্রীগোপীনাথকে দেখে পুরী প্রেমে ক্রন্দন ও নৃত্য-গীতাদি করলেন। শ্রীমাধব পুরীর অলৌকিক কৃষ্ণপ্রেমাদি দেখে পূজারিগণ আশ্চর্য্য হলেন। অতঃপর শ্রীমাধব পুরী পূজারীদের জিজ্ঞাসা করলেন—শ্রীশ্রীগোপীনাথের ভোগে কি কি লাগে। পূজারীরা বললেন, সন্ধ্যায় দ্বাদশটি অমৃতকেলী (ক্ষীর) ভোগ লাগে। অন্যান্য সময়ের ভোগের বিবরণও দিলেন। শ্রীমাধব পুরী অমৃতকেলীর নাম শুনে চিন্তা করতে লাগলেন, অমৃতকেলীর স্বাদ কি রকম—তা যদি বুঝতে পারি, আমার গোপালকেও ঠিক সে রকম ভোগ দিবার চেষ্টা করতে পারি। কিছুক্ষণ পরে পুরী গোস্বামী আবার চিন্তা করলেন—আমার অপরাধ হয়েছে। ঠাকুরকে ভোগ দিবার পূর্বেই আমি স্বাদ নিতে চেয়েছি। পুরীগোস্বামী এই সমস্ত কথা ভেবে সেখান থেকে কিছুদূরে এক শূন্য হাটে রাত্রে এসে নাম-কীৰ্ত্তন-স্মরণাদি করতে লাগলেন। এদিকে পূজারী ঠাকুর শয়ন দিয়ে নিজের অন্যান্য কৃত্যাদি সেরে শয়ন করলেন। একটু নিদ্রিত হতেই পূজারীকে গোপীনাথ স্বপ্নে বলছেন — “পূজারী! উঠ, আমি আমার বস্ত্রাঞ্চলের আড়ালে একটি ক্ষীর ভান্ড লুকিয়ে রেখেছি। মাধব পুরী নামে এক সন্ন্যাসী শূন্য হাটে বসে নাম করছেন। তাঁকে এই ভান্ড দিয়ে এসো।” পূজারী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ শয্যা থেকে উঠলেন এবং স্নান করে মন্দিরে প্রবেশ করলেন। দেখলেন শ্রীগোপীনাথের অঞ্চলের নীচে একটি ক্ষীর ভান্ড রয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই ক্ষীর ভান্ড নিয়ে হাটে এলেন এবং ” কোথায় মাধব পুরী।”“কোথায় মাধব পুরী ?” বলে খোঁজ করতে লাগলেন। দেখলেন এক সন্ন্যাসী অশ্রুসিক্ত নয়নে ভগবানের নাম করছেন। পূজারী দেখেই বুঝতে পারলেন, এই সেই মাধব পুরী। তথাপি বললেন—আপনি কি মাধব পুরী? গোপীনাথ আপনার জন্য ক্ষীর পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই ক্ষীর নিয়ে সুখে ভোজন করুন। পুরী গোস্বামী পূজারীর কথা শ্রবণে আশ্চর্য্য হলেন। গোপীনাথ তাঁর জন্য এত রাত্রে ক্ষীর পাঠিয়ে দিয়েছেন। গোপীনাথের কৃপা স্মরণে শ্রীপুরীপাদের নয়ন দিয়ে দর দর ধারে প্রেমাশ্রু পড়তে লাগল। অধমের প্রতি গোপীনাথের এত করুণা। এই কথা বলে বহু যত্ন সহকারে ক্ষীর ভান্ডটি হাতে নিয়ে বারংবার শিরে স্পর্শ করতে লাগলেন। তারপর পূজারী সমস্ত কথা বললেন। শুনে মাধব পুরীর অঙ্গে প্রেমবিকার ও পুলকাদি প্রকাশ পেতে লাগল। পূজারী ব্রাহ্মণটি এ সমস্ত দেখে মনে মনে বলতে লাগলেন এমন ভক্তশিরোমণি পুরুষ ত কখনও দেখিনি। কৃষ্ণ এঁর বশীভূত। পূজারী ব্রাহ্মণটি মাধব পুরীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার করে গৃহে ফিরলেন। অতঃপর শ্রীমাধব পুরী শ্রীগোপীনাথের দেওয়া ক্ষীর প্রেমাশ্রুপূর্ণ নয়নে সানন্দে ভোজন করতে লাগলেন এবং ভান্ডটি খন্ড খন্ড করে ভেঙ্গে চাদরে বেঁধে নিলেন। প্রতিদিন এক এক টুকরা গ্রহণ করবেন এই আশায়।
শ্রীমাধব পুরী প্রসাদ পাওয়ার পর চিন্তা করলেন, ঠাকুর আমাকে ক্ষীর দিয়েছেন, একথা শুনে দিনের বেলা আমার কাছে লোকের ভিড় হবে। অতএব এইক্ষণেই এখান থেকে রওনা হওয়া ভাল। পুরী গোস্বামী এই সমস্ত চিন্তা করে সেখান থেকে গোপীনাথকে দত্তবৎ করে পুরীর দিকে রওনা হলেন। যদ্যপি শ্রীমাধবপুরী প্রতিষ্ঠার ভয়ে পালিয়ে গেলেন, প্রতিষ্ঠা তাঁর পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল ।
“প্রতিষ্ঠার স্বভাব এই জগতে বিদিত।
যে না বাঞ্ছে তার হয় বিধাতা-নির্মিত।।
প্রতিষ্ঠার ভয়ে পুরী রাহে পলা এর।
কৃষ্ণ-প্রেমে প্রতিষ্ঠা চলে সঙ্গে গড়াঞা ।।
শ্রীমাধব পুরী নীলাচলে এলেন এবং শ্রীজগন্নাথ দর্শন করলেন। পুরীর অঙ্গে তৎকালে কত শত প্রেমবিকার প্রকাশ পেতে লাগল। তাঁর মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শ্রীমাধব পুরী গোপালের আজ্ঞা স্মরণ করে মলয়জ চন্দন ও কপূর সংগ্রহের জন্য বিশেষ যত্ন করতে লাগলেন। বিশিষ্ট লোক পরম্পরা রাজা একথা শ্রবণ করলেন। ভক্ত রাজা তা শুনেই বড়ই সুখী হলেন। তিনি অমাত্যবর্গকে শীঘ্রই মলয়জ চন্দন ও কর্পূর সংগ্রহ করে পুরী গোস্বামীর হাতে দিতে বললেন। পুরী-গোস্বামীর বাসনা পূর্ণ হল। চন্দন ও কর্পূর সংগ্রহ করা হল। রাজা চিন্তা করলেন এত চন্দন ও কর্পূর বৃদ্ধ গোঙ্গানী কি করে নিয়ে যাবেন? তিনি তাঁর সঙ্গে একটি বলবান সেবক দিলেন এবং রাজ্য সীমা পার হবার জন্য সরকারী কাগজ পত্রাদিও দিলেন। শ্রীপুরীগোঙ্গানী পুরী থেকে রওনা হয়ে পুনঃ রেমুনায় এলেন। তথায় শ্রীগোপীনাথকে বহু প্রীতিপুরনের দন্ডবৎ স্মৃতি প্রভৃতি করতে লাগলেন। পূজারী পুনঃ তাঁকে দেখে খুব আনন্দ সহকারে কল্পনানি করতে লাগালেন এবং বলতে সাগলেন—এর জন্যই গোপীনাথ ক্ষীর চুরি করেছিলেন। তারপর পূজারী খুব যত্ন সহকারে শ্রীগোপীনাথের ক্ষীর প্রসাদ এনে নিলেন। পুরীরানী অতি ভক্তি সহকারে তা নিয়ে বারংবার বলনা করতে করতে ভোজন করলেন এবং রাত্রে দেবালয়ে শয়ন করলেন। একটু তন্দ্রা হলে দেখতে লাগলেন
“গোপাল আসিয়া কহে, শুন হে মাধব।
কর্পূর-চন্দন আমি পাইলাম সব।।
কর্পূর সহিত ঘসি, এসব চন্দন ।
গোপীনাথের অঙ্গে নিত্য করহ লেপন।।
গোপীনাথ আমার সে একই অঙ্গ হয়।
ইহাকে চন্দন দিলে হবে মোর তাপ ক্ষয়।।
দ্বিধা না ভাবিহ, না করিহ কিছু মনে।
বিশ্বাস করি, চন্দন দেহ আমার বচনে।।”
– (শ্রীচৈঃ চঃ মধ্যঃ ৪১৫৮-১৬১)
শ্রীগোপাল বলছেন—মাধব। শুন কর্পূর চন্দন আমি সব পেয়েছি। এ সমস্ত কর্পূর চন্দন ঘসে তুমি গোপীনাথের অঙ্গে লাগাও। তাতেই আমার অঙ্গতাপ নিবৃত্ত হবে। গোপীনাথ ও আমাতে কিছু ভেদ বুদ্ধি করো না। গোপীনাথের ও আমার অঙ্গ অভিন্ন। তুমি এতে দ্বিধা করো না। বিশ্বাস করে গোপীনাথের অঙ্গে চন্দন লাগাও। এই কথা বলে গোপাল অন্তর্হিত হলেন। মাধব পুরীও জেগে উঠলেন। স্বপ্নের কথা চিন্তা করে তিনি আনন্দে বিভোর হলেন। তারপর পূজারীগণকে ডেকে শ্রীগোপালদেবের আজ্ঞা জানিয়ে শ্রীগোপীনাথের শ্রীঅঙ্গে চন্দন কর্পূর লেপন করতে বললেন। গ্রীষ্মকালে গোপীনাথ অঙ্গে চন্দন ধারণ করবেন শুনে পূজারীগণ আনন্দে বিহ্বল হলেন। সমস্ত ব্যবস্থা হল। চারজন লোক চন্দন ঘসতে লাগলেন। গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন গোপীনাথের শ্রীঅঙ্গে চন্দন দেওয়া হ’চ্ছে দেখে শ্রীপুরী গোস্বামীর আর আনন্দের সীমা রইল না। অনন্তর শ্রীপুরী-গোস্বামী গ্রীষ্মকাল অতীত করে তীর্থ ভ্রমণে বের হলেন।
“জয় জয় শ্রীমাধব পুরী।
গোপীনাথ যাঁর লাগি ক্ষীর কৈল চুরি”।।
শ্রীমদ্ কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীকে কৃষ্ণ- প্রেমকল্পবৃক্ষের মূল বলেছেন। শ্রীগৌরসুন্দর যখন বাল্যলীলাদি করছেন, তখন শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী বার্দ্ধক্য দশা প্রাপ্ত হয়েছেন। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বা শ্রীচৈতন্য ভাগবতে মহাপ্রভুর সহিত শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী গোস্বামীর সাক্ষাৎ মিলনের কোন প্রসঙ্গ নাই। তবে শ্রীচৈতন্য ভাগবতে শ্রীমদ্ বৃন্দাবনদাস ঠাকুর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর তীর্থ ভ্রমণ প্রসঙ্গে শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর মিলনের কথা বর্ণন করেছেন।
“মাধবপুরীরে দেখিলেন নিত্যানন্দ।
ততক্ষণে প্রেমে মূৰ্চ্ছা হইলা নিস্পন্দ ।।
নিত্যানন্দে দেখি, মাত্র শ্রীমাধবপুরী।
পড়িলা মুচ্ছিত হই আপনা পাসরি।।”
(শ্রীচৈঃ ডাঃ আঃ ৯। ১৫৯)
শ্রীমদ্ বৃন্দাবন দাস ঠাকুর আরও বলেছেন যে, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রী মাধবেন্দ্র পুরীকে গুরু বুদ্ধি করে সেবাদি করতেন।
শ্রীমাধবেন্দ্র-প্রতি নিত্যানন্দ মহাশয়।
গুরু বুদ্ধি ব্যতিরিক্ত আর না করয়।।
-( শ্রীচৈঃ ভাঃ ৯। ১৮৮)
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে কিছুদিন তীর্থ ভ্রমণাদিও করেছিলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে পেয়ে শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী কত সুখী হয়েছিলেন, তা শ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুর এই ভাবে বলেছেন—
“জানিলু কৃষ্ণের কৃপা আছে মোর প্রতি।
নিত্যানন্দ হেন বন্ধু পাইনু সংহতি ।।
যে সে স্থানে যদি নিত্যানন্দ সঙ্গ হয়।
সেই স্থান সৰ্ব্বতীৰ্থ বৈকুণ্ঠাদি-ময়।।”
(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ৯। ১৮৩)
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কিছুদিন শ্রীমাধব পুরীর সঙ্গে থাকার পর বৃন্দাবনে চলে আসেন। শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীও দক্ষিণদেশে তীর্থভ্রমণে চলে যান। শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে শ্রীঈশ্বর পুরী, শ্রীরঙ্গপুরী ও পরমানন্দ পুরী প্রভৃতি সন্ন্যাসিগণ প্রায় সময় থাকতেন। শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী অপ্রকট কালে এই শ্লোকটী উচ্চারণ করেন।
“অয়ি দীনদয়াৰ্দ্ৰ নাথ হে মথুরানাথ কদাবলোক্যসে।
হৃদয়ং ত্বদলোককাতরং দয়িত ভ্রাম্যতি কিং করোম্যহম্।।”
—শ্ৰীচৈঃ চঃ মধ্যঃ ৪।১৯৭)
গৌড়ীয়গণ এই শ্লোকটিকে বিপ্রলম্ভ রসের সার স্বরূপ মনে করেন। ভগবান্ শ্রীগৌরসুন্দর এই শ্লোক স্মরণ মাত্রই প্রেমাবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ইনি বাহ্যতঃ দশনামী শঙ্কর সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমকল্পবৃক্ষের মূল। ভগবান্ ধরাতলে অবতীর্ণ হবার পূর্ব্বেই এই সমস্ত প্রেমিক পরিকরগণকে আবির্ভূত করিয়েছিলেন। শ্রীমন্ কৃষ্ণদাস কবিরাজ ও শ্রীমদ্ বৃন্দাবন দাস ঠাকুর শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর জাগতিক কোন জাতি-বংশাদির কিছুমাত্র আলোচনা করেন নাই। তজ্জন্য সে সমস্ত বিষয় অজ্ঞাত। শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী সুদীর্ঘকাল ধরাতলে অবস্থান করে প্রেম ভক্তি বিতরণ করেন। তিনি পরিব্রাজকরূপে ভারতের সর্ব্বত্র পরিভ্রমণ করতেন। তিনি বহুলোককে কৃপা করেছেন। তাঁর কৃপা-পাত্রগণের পূর্ণ সংখ্যা পাওয়া না গেলেও মুখ্য মুখ্য কিছু সন্ন্যাসী ভক্তের পরিচয় পাওয়া যায়।
শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য, শ্রীপুন্ডরীক বিদ্যানিধি, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, শ্রীঈশ্বর পুরী, শ্রীপরমানন্দ পুরী, শ্রীরঙ্গ পুরী, শ্রীব্রহ্মানন্দ পুরী, শ্রীব্রহ্মানন্দ ভারতী, শ্রীকেশব ভারতী, শ্রীকৃষ্ণানন্দ পুরী, শ্রীরামচন্দ্র পুরী, শ্রীনৃসিংহতীর্থ, শ্রীরঘুপতি উপাধ্যায় ও শ্রীসুখানন্দ পুরী ইত্যাদি।
অতঃপর শ্রীমদ্ বৃন্দাবনদাস ঠাকুরকৃত শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর প্রশস্তি কীর্তন করে এইখানে প্রবন্ধ শেষ করলাম।
“মাধবেন্দ্রপুরী প্রেমময় কলেবর।
প্রেমময় যত সব সঙ্গে অনুচর।।
কৃষ্ণরস বিনু আর নাহিক আহার।
মাধবেন্দ্র পুরী-দেহে কৃষ্ণের বিহার”।।
শ্ৰেীচৈঃ ভাঃ আদি ৯।১৫৫-১৫৬)