
হরিদাস ঠাকুরে জন্ম
শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যে নামাচার্য হরিদাস ঠাকুর এক মহান উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তিনি সাতক্ষীরা জেলায় বূঢ়ন গ্রামে ১৩৭২ শকাব্দে গৃহে আবির্ভূত হন।
শ্রীনিত্যানন্দ দাসের “প্রেমবিলাস” গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, ঋচিক মুনি পুত্র মহাতপা ব্রহ্মা পিতাকে অধৌত তুলসী পত্র দিয়েছিলেন বলে পিতৃশাপে তিনি নিম্নকূলে জন্মগ্রহণ করেছেন।
বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মার গোবৎসহরণে ফলে নিম্নকূলে আবির্ভূত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডের আদিজীব ব্রহ্মা ভগবানের ভগবত্তায় সন্দেহপ্রবণ হওয়ায় বৃন্দাবনলীলার গোপবালক এবং গোবৎসদের হরণ করেন। পরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা মোহমুক্ত হওয়ার ফলে তিনি অনেক স্তব-স্তুতি করলেও নিজ অপরাধে অনুশোচনাবশত নবদ্বীপ ধামে এসে শ্রীগৌরাঙ্গের কৃপা প্রার্থনা করতে থাকেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ কিছুকাল পরে কলিযুগে শ্রীগৌরাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হবেন। তখন গৌরাঙ্গের আজ্ঞায় তিনি হরিনামের মহিমা প্রকাশ করতে নিম্নকূলে অবতীর্ণ হন।
এছাড়াও বর্ণিত হয়েছে, একবার অর্চনায় মগ্ন থাকায় শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ মহাভাগবত চতুঃকুমারের যথাযোগ্য অভিবাদন করতে পারেন নি। এই অপরাধের জন্য শ্রীবিষ্ণু তাকে বলেছিলেন, তুমি কলিকালে নিম্ন পরিবারে ভূতলে জন্মলাভ করবে। এছাড়া বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতের সময় শ্রীল হরিদাস ঠাকুর যেভাবে অত্যাচার সহ্য করেছিলেন, তাতে একমাত্র শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজেরই উপমা দেওয়া যেতে পারে।
এভাবে আদিদেব ব্রহ্মা, ঋচিকপুত্র মহাতপা ব্রহ্মা এবং শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ কলিযুগে নিম্নকূলে হরিনামের আচার্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুররূপে অবতীর্ণ হন। তিনি সর্বদাই হরিনাম রসে আপ্লুত থাকতেন। তিনি সারাদিনে তিন লক্ষ হরিনাম জপ করতেন। এভাবে তিনি হরিনামের মহিমা প্রকাশ করেছেন।
বর্তমান বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার অন্তর্গত কেরাগাছি গ্রামে হরিদাস ঠাকুর আবির্ভূত হন। ধারণা করা হয়, এখানে প্রাচীন বূঢ়ন গ্রামের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। শ্রীচৈতন্যভাগবতে (আদি ১৬/১৮) বর্ণিত হয়েছে-
বূঢ়ন গ্রামেতে অবতীর্ণ হরিদাস।
সে ভাগ্যে সেসব দেশে কীর্ত্তন প্রকাশ॥
হরিদাস ঠাকুরের জন্মস্থানে পরিচয় থাকলেও, নিম্নগৃহে আবির্ভাব প্রসঙ্গ ছাড়া তাঁর পিতৃমাতৃবংশের কোনো পরিচয়, এমনকি নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি প্রাচীন গ্রন্থাবলিতে। পর্যাপ্ত গ্রন্থপ্রমাণ না থাকায় পাঁচশতাধিক বছর পূর্বের কোনো বিষয় গবেষণা করা বাতুলতা মাত্র।
নরহরি দাসের ‘অদ্বৈত বিলাস’ নামক গ্রন্থে উল্লেখিত আছে যে, খানাউল্লাহ কাজির ঘরে ১৩৭২ সালে অগ্রহায়ণ মাসে হরিদাস ঠাকুর আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল ‘হারেস’। নরহরি দাসের ‘অদ্বৈত বিলাস’ নামক গ্রন্থে উল্লেখিত আছে যে, খানাউল্লাহ কাজির ঘরে ১৩৭২ সালে অগ্রহায়ণ মাসে হরিদাস ঠাকুর আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল ‘হারেস’। বাল্যকালেই তিনি পিতামাতাকে হারান। তবে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও শ্রীচৈতন্যভাগবতের মতো সর্বজনস্বীকৃত গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই নেই।
শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্য গৃহে অবস্থান
শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্য হরিদাস ঠাকুরকে পেয়ে খুব আনন্দিত হলেন। শ্রীঅদ্বৈত গোঁসাই গঙ্গাতীরে এক নির্জন গোফা প্রদান করলেন। প্রতিদিন তাঁরা ভক্তিকথা আলোচনা করতেন। হরিদাস ঠাকুর প্রত্যহ অদ্বৈতগৃহে প্রসাদ পেতেন।
একদিন অদ্বৈত আচার্যের পিতার শ্রাদ্ধা দিবসে তিনি গ্রামস্থ সকল ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু সব থেকে বিশেষ শ্রাদ্ধপাত্রটি তিনি অব্রাহ্মণ-কুলে আবির্ভূত হরিদাস ঠাকুরকে প্রদান করলেন, যেটি সাধারণত শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকে দেওয়া হয়। হরিদাস ঠাকুর তা দৈন্যবশত গ্রহণ করতেন চাইলেন না।
আচার্য কহেন, “তুমি না করিহ ভয়।
সেই আচরিব, যেই শাস্ত্রমত হয়॥
তুমি খাইলে হয় কোটি ব্রাহ্মণ-ভোজন।
এত বলি শ্রাদ্ধপাত্র করাইলা ভোজন॥ (চৈ.চ. অন্ত্য ৩.২২১-২২২)
সভার ব্রাহ্মণগণ এর বিরোধিতা করতে লাগলেন। অদ্বৈত আচার্য নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের জন্য জ¦ালানি কাঠ এনেছিলেন। তিনি বললেন, “কোনো যোগ্য ব্রাহ্মণ থাকলে এই কাঠে ব্রহ্মতেজ দ্বারা আগুণ জ¦ালিয়ে দেখাক।” সকল ব্রাহ্মণই তাদের পৈতা ধরে নানারকম মন্ত্র পড়তে লাগল। কিন্তু আগুণ জ¦লল না। অদ্বৈতের অনুরোধে হরিদাস ঠাকুর হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতেই আগুন জ¦লে উঠল। এভাবে হরিদাস ঠাকুরের মহিমা প্রকাশিত হলো।
এরপর অবৈষ্ণব জগৎকে ভক্তিকে প্লাবিত করতে কৃষ্ণের আবির্ভাবের জন্য অদ্বৈত তাঁর নিত্যব্রত তুলসী ও গঙ্গাজলে শালগ্রাম অর্চনা এবং হরিনাম করতে লাগলেন। অন্যদিকে হরিদাস ঠাকুর গঙ্গার নিকটস্থ গোফায় হরিনাম করতে লাগলেন।
অদ্বৈত আচার্য হরিদাস ঠাকুরকে প্রাণের অধিক যত্ন করতেন। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে যেদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আবির্ভূত হলেন, সেদিন দুজনে একত্রে কৃষ্ণকথারসে মগ্ন ছিলেন। সন্ধ্যাকালে চন্দ্রগ্রহণ লগ্নে চারদিকে মুহুর্মুহু হরিধ্বনি ও মঙ্গলসূচক লক্ষণাদি দেখতে পেয়ে তাঁরা অনুমানে বুঝতে পারলেন যে, ভগবান অবতীর্ণ হয়েছেন।
মহাসর্পভয় নাশ
শ্রীল হরিদাস ঠাকুর গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে অপর পারে এসে পৌঁছলেন। সেখানে তিনি পরমানন্দে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে এক ব্রাহ্মণ সভায় উপস্থিত হন। তাঁকে দর্শন করে ব্রাহ্মণগণ অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে কৃষ্ণপ্রেমে ভাসতে লাগলেন। তারাও ঠাকুর হরিদাসের সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেমে নৃত্য-কীর্তন করতে লাগলেন। কৃষ্ণপ্রেমে হরিদাস ঠাকুর বাহ্যরহিত হয়ে পড়লেন।
বহুক্ষণ পর যখন তিনি স্থির হয়ে বসলেন, ব্রাহ্মণগণ তাঁর চারপাশে বসলেন। তিনি দৈন্যবশত বলতে লাগলেন, “আমি যেহেতু বিষ্ণুনিন্দা শ্রবণ করেছি, সেই পাপে আমাকে এমন শাস্তি পেতে হয়েছে। কুম্ভীপাক হয় বিষ্ণুনিন্দন-শ্রবণে/তাহা আমি বিস্তর শুলিলুঁ পাপ-কাণে ॥ (চৈ.ভা. আদি ১৬/১৬৮) তাই আমি শাস্তি পেয়েছি। এজন্য তোমরা দুঃখ পেওনা।” এভাবে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে তিনি আবার হরিনাম
শুরু করলেন। এদিকে হরিদাস চরণে অপরাধের ফলস্বরূপ নিম্ন জাতিগণ সবংশে ধ্বংস হলো।
ফুলিয়া গ্রামে ঠাকুর হরিদাস গঙ্গার তীরে এক নির্জন গোফায় দিবারাত্র কৃষ্ণনাম স্মরণে অতিবাহিত করতে লাগলেন। তাঁর প্রভাবে ‘গোফা হৈল তাঁর যেন বৈকুণ্ঠ ভবন।’ সেখানে এক মহানাগ বাস করত। তার বিষের জ¦ালা কোনো প্রাণী সহ্য করতে পারত না। সেখানে যে-ই শ্রীল হরিদাস ঠাকুরের দর্শন করতে যেত, সে-ই নাগের বিষের জ¦ালায় সেখানে ঠিকতে পারত না। তখন গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। সেখানকার জ্ঞানী বৈদ্যগণ তা নির্ণয়ে সমর্থ হলেন।
সাপের সাথে বসবাস অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই হরিদাস ঠাকুরের বিপদ আশঙ্কায় তারা তাঁকে অন্যত্র গমন করতে অনুরোধ করার জন্য সেই গোফায় এসে উপস্থিত হলেন। তারা হরিদাস ঠাকুরকে এ বিষয়ে জানালে তিনি বললেন, “আমি বহুদিন যাবৎ এই গোফায় আছি, কিন্তু কোনো বিষ অনুভব করছি না। তবে যেহেতু তোমরা চাচ্ছ, তাই আমি অন্যত্র গমন করব। যদি এখানে সত্যই সর্প থেকে থাকে, তবে কাল যদি উনি চলে না যান, তবে আমি এখান থেকে অন্য কোথাও যাব। তোমরা নিশ্চিন্তে হরিনাম কর।” তখন এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যার সময় সেই মহানাগ গর্ত থেকে উঠে সবার সামনেই অন্য দেশে চলে গেলেন। নাগকে চলে যেতে দেখে ব্রাহ্মণগণ আনন্দিত হলো। হরিদাস ঠাকুরের অপার শক্তি দর্শন করে তাঁরা ভক্তিপূর্ণ চিত্তে তাঁর মহিমা আলোচনা করতে লাগলেন।
মহানির্যাণ
একদিন হরিদাস ঠাকুর মহাপ্রভুকে বলেন- প্রভু, বহুদিন ধরে আমার মনে একটি বাসনা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে শীঘ্রই তুমি এই জড়জগতে তোমার লীলা সংবরণ করবে। আমি তোমার অনেক লীলাই দর্শন করেছি। প্রভু তোমার পূর্বেই আমি যেন আমার দেহত্যাগ করতে পারি। তাই, আমাকে কৃপা করে বর দান করো। আমি চাই যেন তোমার মুখপদ্ম দর্শন ও চরণ দুটি আমার হৃদয়ে ধারণ করে এবং মুখে ‘কৃষ্ণচৈতন্য’ বলতে বলতে এ দেহত্যাগ করতে পারি। তুমিই কেবল আমার এই বাসনা সফল করতে পারো।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন- “হরিদাস, কৃষ্ণ অত্যন্ত কৃপাময়, তুমি তাঁর কাছে যা প্রার্থনা করবে তা তিনি অবশ্যই পূর্ণ করবেন। কিন্তু আমার সমস্ত সুখ তোমাকেই নিয়ে। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, তা তোমার উপযুক্ত বাসনা নয়।”
পরদিন সকালবেলা শ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভক্তদের নিয়ে হরিদাস ঠাকুরকে দেখতে এলেন। হরিদাস ঠাকুর তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও অন্য সমস্ত বৈষ্ণবের শ্রীপাদপদেদ্ম তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জিজ্ঞাসা করলেন, “হরিদাস, তুমি কেমন আছ? হরিদাস ঠাকুর উত্তর দিলেন, “হে প্রভু, সবই যে তোমার কৃপা।”
তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অঙ্গনে মহাসংকীর্তন আরম্ভ করলেন এবং সেই কীর্তনে বক্রেশ্বর পণ্ডিত নাচতে লাগলেন। স্বরূপ দামোদর গোস্বামী প্রমুখ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমস্ত ভক্ত হরিদাস ঠাকুরকে বেষ্টন করে নাম সংকীর্তন করতে লাগলেন। রামানন্দ রায়, সার্বভোম ভট্টাচার্য প্রমুখ সমস্ত মহান ভক্তদের সামনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের গুণ বর্ণনা করতে লাগলেন। যতই তিনি তাঁর মহিমা বর্ণনা করতে লাগলেন, ততই তাঁর আনন্দ বর্ধিত হতে লাগল।
হরিদাস ঠাকুরের অপ্রাকৃত গুণাবলি শ্রবণ করে সকলে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং তাঁরা সকলে হরিাদস ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম বন্দনা করতে লাগলেন। হরিদাস ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে তাঁর সামনে বসালেন এবং তাঁর দুটি ভ্রমরসদৃশ নয়ন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে মুখপদ্মে নিবদ্ধ করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্ম তিনি তাঁর হৃদয়ে ধারণ করলেন এবং সমস্ত ভক্তের পদরেণু মস্তকে গ্রহণ করলেন।
তিনি বারবার বলতে লাগলেন ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মুখপদ্মের মাধুরী পান করে তাঁর চোখ দিয়ে অনর্গল ধারায় অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। সিদ্ধিপ্রাপ্ত মহান যোগীর মতন হরিদাস ঠাকুরকে এভাবে স্বচ্ছন্দে দেহত্যাগ করতে দেখে সকলের ভীষ্মদেবের নির্যাণের কথা মনে হলো। ভক্তরা তখন ‘হরে কৃষ্ণ’ উচ্চারণ করতে লাগলেন। তার ফলে প্রবল কোলাহলের সৃষ্টি হলো। প্রেমানন্দে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বিহ্বল হলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হরিদাস ঠাকুরের দেহ কোলে নিয়ে, প্রেমাবিষ্ট হয়ে, অঙ্গনে নাচতে লাগলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবেশে সমস্ত ভক্ত তখন আবিষ্ট হলেন। সেই প্রেমাবেশে তাঁরা সকলে নৃত্য কীর্তন করতে লাগলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এভাবে কিছুক্ষণ নাচলেন এবং তখন স্বরূপ দামোদর গোস্বামী তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন যে, হরিদাস ঠাকুরের দেহ নিয়ে অন্যান্য কৃত্য সম্পাদন করা বাকি রয়েছে। তখন হরিদাস ঠাকুরের দেহ সমুদ্রের জলে স্নান করানো হলে এবং তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে এই সমুদ্র মহাতীর্থে পরিণত হলো।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীহস্তের দ্বারা সামাধিতে বালু দিলেন। বালুকায় হরিদাস ঠাকুরের দেহ আচ্ছাদিত করার পর তার ওপরে একটি পিণ্ডা বাঁধানো হলো এবং বেড়া দিয়ে তা ঘিরে দেওয়া হলো। তাঁকে বেষ্টন করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নৃত্য-কীর্তন করলেন। হরিধ্বনির কোলাহলে চতুর্দশ ভুবন পূর্ণ হলো। তার মহাপ্রভু তাঁর ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে মহারঙ্গে জলকেলি করতে করতে সমুদ্রে স্নান করলেন। হরিদাস ঠাকুরের সমাধি প্রদক্ষিণ করে ভক্তদের নিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারে এলেন। এরপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিজে সিংহদ্বারে এসে আঁচল পেতে পসারিদের বলতে লাগলেন- আজ স্বয়ং ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর প্রিয় ভক্ত নামাচার্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুরের নির্যাণ মহোৎসবের জন্য ভিক্ষা করছেন দেখে সমস্ত পসারি বড় বড় প্রসাদের ঝুড়ি উঠিয়ে দিতে এলেন। তখন স্বরূপ দামোদর গোস্বামী তাদের নিষেধ করলে তারা ফিরে গেলেন। তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ঘরে পাঠিয়ে চারজন বৈষ্ণব ও চারজন বাহককে নিয়ে সমস্ত পসারির নিকট চার মুষ্টি করে প্রসাদ নিলেন। এছাড়া বাণীনাথ পট্টনায়ক এবং কাশীমিশ্র অনেক প্রসাদ পাঠালেন।
তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রসাদ পরিবেশন করতে শুরু করলেন, মহাপ্রভু তাঁর হাতে অল্প পরিমাণ প্রসাদ তুলতে পারতেন না, তাই তিনি একজনের পাতে পাঁচজনার প্রসাদ দিতে লাগলেন। তখন স্বরূপ দামোদর গোস্বামী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে অনুরোধ করলেন, “আপনি দয়া করে বসে এদের সকলের প্রসাদ গ্রহণ দর্শন করুন। আমি এদের পরিবেশন করি।” স্বরূপ-দামোদর, জগদানন্দ, কাশীশ^র এবং শঙ্কর এই চারজন মিলে নিরন্তর প্রসাদ পরিবেশন করতে লাগলেন। প্রেমাবিষ্ট হয়ে সকলকে নিজ শ্রীহস্তে মালা-চন্দন পরিয়ে মহাপ্রভু সকলকে বর দিলেন, যারা হরিদাস ঠাকুরের নির্যাণ মহোৎসব দর্শন করছে, নৃত্য-কীর্তন করছে, বালুকা দিয়েছে বা মহাপ্রসাদ সেবা করেছে অচিরেই সকলের কৃষ্ণপ্রাপ্তি হবে। তারপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সমস্ত ভক্তকে বিদায় নিয়ে হর্ষ ও বিষাদের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বিশ্রাম করলেন। হরেকৃষ্ণ!