এই পোস্টটি 385 বার দেখা হয়েছে
![শ্রীরাধারমণ দেবের প্রকট লীলা](http://csbtg.org/wp-content/uploads/2022/05/367-3671252_radha-raman-e1652706943869.jpg)
“সাধন দীপিকা” গ্রন্থে শ্রীরাধারমণ দেবের প্রকট সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তাঁর মর্মার্থ এরূপ- “শ্রীবৃন্দাবনস্থ গোবিন্দদেবের পাদপদ্ম যাঁর সর্বস্ব, সেই গোপাল ভট্টকে বন্দনা করি, যিনি শ্রীমদ্ রূপ গোস্বামীর আজ্ঞাক্রমে পৃথক শ্রীঅর্চ্চা সেবা প্রকাশ করেছেন। উক্ত পৃথক সেবার উপাস্য বস্তু শ্রীরাধারমণদেব। প্রেমিকবর শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভু যে শ্রীগোবিন্দদেবকে প্রকট করেছেন, এই শ্রীরাধারমনদেব তিনিই। ঐরূপ সেবা প্রকাশ বিষয়ে আজ্ঞার কারণ প্রমাণ্য ব্যাক্তিগণের মুখ হতে জ্ঞাত। সেই কারণ বৃন্দাবনাদি স্থানে প্রসিদ্ধ। “শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীপাদ অত্যন্ত যত্নের সাথে শালগ্রামের সেবা করতেন। তাঁর মনে শ্রীবিগ্রহসেবার ইচ্ছা হল। এ সময় একজন ধনী ব্যবসায়ী শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীকে দর্শনের জন্য এলেন। শেঠজী শ্রীগোপালভট্ট গোস্বামীকে দর্শন ও সম্ভাষণাদি করে বড়ই সুখী হলেন, শ্রীভগবানের সেবার জন্য বহু উপকরণ বস্ত্রালঙ্কার অর্পণ করলেন। শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী সমস্ত দ্রব্য শ্রীশালগ্রামের সামনে রেখে দিলেন। শেঠজী শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীর নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করলে ভট্ট গোস্বামী সন্ধ্যাকালে শালগ্রামের আরতি করে শয়ন দিলেন। এবং রাত্রে ভজনাদির পর শয়ন করলেন। শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গের উপযোগী বস্ত্র-অলঙ্কার শ্রীশালগ্রাম কিরূপে পরিধান করবেনÑ এরূপ চিন্তা করতে করতে শ্রীল গোপালভট্ট গোস্বামীপাদ রাত্রি যাপন করলেন। রাত্রি প্রভাত হলে স্নানাদির পর শালগ্রাম জাগরণ করতে গিয়ে দেখলেন যে শ্রীশালগ্রাম ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম দ্বিভূজ মুরলীধর, মধুর, ব্রজ কিশোর শ্যামরূপে প্রকটিত হয়ে অবস্থান করছেন। এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীপাদের আনন্দের সীমা রইল না। তিনি আনন্দ সাগরে ভাসতে ভাসতে সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করে বিবিধ-স্তব-স্তুতি করলেন। এই শুভ সংবাদে শ্রীরূপ-সনাতনাদি গোস্বামীগণ এবং অন্যান্য সব বৈষ্ণবগণকে আহ্বান করে শ্রীবিগ্রহের অভিষেক মহোৎসব অনুষ্ঠান করলেন। ১৫৯৯ সম্বতে (বা ১৫৪২ খৃষ্টাব্দে) বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে এই অভিষেক-মহামহোৎসব সম্পন্ন হয়েছিল। ঐ তিথিতে এই বিগ্রহ প্রকট হয়েছিলেন। গোস্বামীগণ ঐ বিগ্রহকে “শ্রীরাধারমণ দেব” নামে অভিহিত করেন।
এক সময় শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামী যমুনা স্নান সমাপন পূর্বক স্বীয় ভজন কুটিরে প্রত্যাবর্তন করলে দেখতে পান তাঁর ভজন কুটীর দ্বারে একটি বালক বসে রয়েছেন। গোস্বামীপাদ পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন দেববন্দ্য গ্রামের যে ব্রাহ্মণ গৃহে তিনি আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন উক্ত বালক তাঁরই পুত্র শ্রীগোপীনাথ। ব্রাহ্মণ বালক গোপীনাথ ক্রমে পরিণত বয়স্ক হলে শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীপাদ তাঁকে দীক্ষিত করে তাঁরই উপর শ্রীরাধারামণ দেবের সেবার ভার সমর্পণ করেন। তিনি পরবর্তীতে শ্রীগোপীনাথ পূজারী গোস্বামী নামে পরিচিত হন। তিনি কোনো দারপরিগ্রহ করেন নাই। ব্রহ্মচারীরূপে ইনি আজীবন শ্রীরাধারমণ দেবের সেবায় যুক্ত ছিলেন। শ্রীগোপীনাথ পূজারী গোস্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীদামোদর দাস ও শ্রীল গোপালভট্ট গোস্বামীর আদেশক্রমে দেববন্দ্য গ্রাম হতে শ্রীবৃন্দাবনে এসে শ্রীগোপীনাথের কৃপাভিষিক্ত হলেন।
শ্রীল গোপালভট্ট গোস্বামীপাদের ইচ্ছানুযায়ী যাতে পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীরাধারমণ দেব জীউর সেবা পূজা নির্বিঘ্নে এবং সুচারুরূপে সম্পন্ন হতে পারে সে জন্য বংশ পরম্পরা ও গুরু পরম্পরা ঠিক রাখার জন্য শ্রীদামোদর দাস বিবাহ করেন। ভট্ট গোস্বামীর আদেশে দামোদর দাস সস্ত্রীক বৃন্দাবনে বাস করেন। এ বংশের হাতেই বৃন্দাবনে শ্রীরাধারমণ দেবজীর সেবা ন্যস্ত রয়েছে। শ্রীবল্লভাচার্য নামান্তর শ্রীবল্লভ ভট্ট সম্প্রদায়ের পরম্পরাগত শ্রীগোকুলের গোস্বামীগণের কথিত বিবরণ এই যে, শ্রীপাদ বল্লভ ভট্ট শ্রী নীলাচল ক্ষেত্রে যখন শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত মিলিত হন তখন তথায় শ্রীগোপালভট্ট গোস্বামী পাদের কথা শ্রবণ করেছিলেন। অনন্তর তিনি শ্রীবৃন্দাবনে আগমন করে শ্রীল গোপালভট্ট গোস্বামীপাদের অন্বেষণ করতে থাকেন। তখন শ্রীধাম বৃন্দাবন কেবল মাত্র বনের শোভাতেই শোভিত ছিল।
শ্রীবল্লভট্ট অনুসন্ধানে অবগত হলেন যে, শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীপাদ শ্রীযমুনা স্নানে গিয়েছেন তখন তিনি উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে শ্রীযমুনাতীরে গিয়ে দূর হতেই শ্রীল গোপালভট্ট গোস্বামী পাদের জ্যোতির্ময় মনোহর দিব্য মূর্তি দর্শন করে তাঁর শ্রীচরণে প্রণাম করেন। পূর্ণরূপে বিকশিত প্রেমভক্তির প্রজ্জ্বলিত কিরণ তদীয় শ্রীঅঙ্গ হতে বিচ্ছুরিত দেখে শ্রীবল্লভ ভট্টের হৃদয়ে তরঙ্গ উদ্বেলিত হতে থাকে। শ্রীগোপাল ভট্টকে কি দিয়ে সেবা করা যায় তা তিনি চিন্তা করতে লাগলেন। এমন সময়ে তাঁর মনে হলো তাঁর নিকট গলদেশে ঝোলাতে অতি সুন্দর একটি শ্রীশালগ্রাম মূর্তি আছেন যা তাঁর প্রাণধন স্বরূপ। অতি দৈন্যভরে সেই শ্রীশালগ্রাম মূর্তি শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামী পাদের শ্রীকরকমলে অর্পণ করে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীপাদ পরমানন্দে সেই শ্রীশালগ্রামকে মস্তকে ও হৃদয়ে ধারণ করে সেই দিন হতেই সেবা করতে লাগলেন। সেই শ্রীশালগ্রাম হতেই পরম মনোহর শ্রীশ্রীরাধারমণ দেব বিগ্রহ প্রকট হয়েছেন। এই ইতিহাস অবলম্বন করে অদাপিও শ্রীগোকুলের গোস্বামী গণের পরিক্রমা শ্রীবৃন্দাবনে আসলে সম্প্রদায়ের মহান্ত বা আচার্য ভেট সামগ্রী নিয়ে শ্রীরাধারমণের দর্শনে আসার প্রথা অক্ষুন্ন রেখেছেন। তাঁদের নিকট শ্রীরাধারমণের একনাম “বটুয়াকী ঠাকুর” বলে প্রসিদ্ধ আছে।
নিধুবনের পাশ্বের শ্রীরাধারমণ জীউর মন্দির অবস্থিত। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষ পবিত্রতার সহিত প্রতি বৎসর শ্রীগোপীনাথ পূজারী গোস্বামী মহারাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীদামোদর গোস্বামী মহাশয়ের বংশধর গোস্বামী সন্তানগণ শ্রীশ্রীরাধারমণের মহা অভিষেক সেবা আজ পর্যন্ত করে এসেছেন। এই শ্রীবিগ্রহ প্রকট কাল হতেই শ্রীবৃন্দাবনে অবস্থান করছেন, কোথাও স্থানান্তরিত করা হয় নাই। শ্রীরাধারমণ জীউ বিগ্রহের বামপাশ্বের শ্রীমতী রাধারাণীর বিগ্রহ নেই। সিংহাসনের বামপাশ্বের একটি রৌপ্য মুকুট শ্রীমতী রাধারাণীর প্রতিভূরূপে রাখা হয়েছে। অদ্যাপিও শ্রীরাধারমণ জীউর পৃষ্ঠদেশে শালগ্রাম চিহ্ন বিরাজিত আছেন। এই বিগ্রহ দর্শন মাত্রেই প্রেমভক্তির উদয় হয়।