এই পোস্টটি 106 বার দেখা হয়েছে
বালি শিল্প
বর্তমানে বালি শিল্প সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। যখন কোন ব্যক্তি বিশ্বে খুব জনপ্রিয় হয় তখন তাদের অবয়ব বালি দিয়ে তৈরি এটি খুবই সাধারণ দৃশ্য। বিশেষত এ ধরনের অবয়ব প্রদর্শিত হয় পুরীর সমুদ্র সৈকতে। এ থেকে বাদ পড়ে না কোন বিশেষ দালানকোটা সমূহ। বর্তমানে বালিশিল্প সারা বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃত লাভ করেছে, কিন্তু এর প্রাচীন উৎস হল জগন্নাথ পুরী। দণ্ডি রামায়নে বালি শিল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভগবান শ্রী জগন্নাথদেবের রথে আরোহন করতে, যখন দন্ডি রামায়নের লেখন বলরাম দাসকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তখন তিনি খুবই বিষন্ন অনুভব করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি চেয়েছিলেন ভগবান শ্রী জগন্নাথ দেবের রথের উপর উঠে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা নিবেদন করতে। তিনি পুরীর সমুদ্র সৈকতে গমন করলেন এবং সেখানে গিয়ে বালি দিয়ে শ্রীজগন্নাথ দেবের মূর্তি তৈরি করে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা নিবেদন করেন। তাঁর প্রার্থনার মধ্যে এমন গভীর অভিপ্রায় ছিল যে, রথের উপর উপবিষ্ট মূল শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ অদৃশ্য হয়ে গেল এবং সেই সমুদ্র সৈকতে শ্রী জগন্নাথদেব বলরাম দাসের সামনে আবির্ভূত হলেন। মূলত পুরীর এই প্রাচীন শিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে সুদর্শন পথনায়ক সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভ্রমনার্থীরা রথযাত্রার সময় পুরীর সমুদ্র সৈকতে জড়ো হয় স্বর্ণ রঙের বালি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন মূর্তি দর্শন করার জন্য। এভাবে পুরীতে পাথর খোঁদাই শিল্প, কাঠ খোদাই শিল্প, সিলভার, কাগজ ইত্যাদি নানা ধরনের প্রাচীন শিল্প ঐতিহ্য পুরী থেকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর রথযাত্রা সহ বিভিন্ন উৎসবে পুরীর পান্ডা নামে খ্যাত একদল জনগোষ্ঠিরা এ শিল্প ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। উল্লেখ্য বলা হয় যে, পুরীর পাণ্ডারা কোন সাধারণ জীব নয় এদেরকে ভগবান বিষ্ণুর একেকজন সেনাপতি হিসেবেও অভিহিত করা হয় যা সাধারণের দৃষ্টির অগোচরে হরে কৃষ্ণ।
ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর
গুণ্ডিচা মন্দিরের পাশেই এ সরোবর অবস্থিত। এই স্থানে ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা প্রথম এসেছিলেন এবং এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ এ সম্পাদন করেন। তিনি এখানে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার গাভী দান করেন। সেই গাভীগুলো এই স্থানে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের পায়ের খুঁড় দিয়ে ভূমিতে আঘাতের ফলে যে গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল এবং একটি বিশাল সরোবরে পরিণত হয়। এই সরোবর গাভীর মূত্র এবং জলে পরিপূর্ণ যেখানে ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা ‘সঙ্কল্প’ নামক একটি অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করত। এভাবে এটি একটি তীর্থে পরিণত হয়েছিল এবং কথিত আছে, এই সরোবরে সমস্ত তীর্থ অবস্থান করেন। যদি কেউ এই সরোবরের জলে স্নান করে তবে সে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়। এই স্থানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জল ক্রীড়া করতেন। শ্রীগুণ্ডিচামন্দিরের অনতিদূরে উত্তরদিকে এই মর্মর মণ্ডিত সুবৃহৎ সরোবর অবস্থিত। মহাভারতীয় আরণ্যকপর্বান্তর্গত মার্কণ্ডেয়-সমস্যা প্রসঙ্গে ইহার উল্লেখ আছে। শ্রী ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরের তীরে শ্রীনীলকন্ঠেরশ্বর মহাদেবের মন্দির আছে। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের মধ্য চতুর্দশ পরিচ্ছেদে শ্রীইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে সপার্ষদ শ্রীগৌরসুন্দরের বিবিধ জলকেলি-লীলা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে।
পহণ্ডি বিজয়
রথারোহণার্থ শ্রীমন্দির হতে শ্রীমূর্তিত্রয়ের বিজয়কে ‘পহণ্ডি’ বা পাণ্ডু-বিজয়’ বলে। (চৈ চ ম ১৩ ৫-১৩)
কেউ কেউ বলেন, শ্রীরথযাত্রা প্রথমে মলয়াচল-পাণ্ডা কাঞ্চনমালা প্রবর্তন করিয়েছিলেন বলে এই বিজয়র নাম ‘পাণ্ড্যবিজয়’ ও ডোরীর নাম “কাঞ্চনমালা’ হয়েছে। পরে এটি ‘পহন্ডি-বিজয়’ বলে কথিত হচ্ছে।
সুদর্শনং পুরস্কৃত্য বলভদ্রং ততঃ পরম্।
সুভদ্রা চ ততো নীতা জগদীশং সুরেশ্বরম্ ॥
এই নিয়মে সর্বাগ্রে শ্রীসুদর্শন শ্রীসুভদ্রদেবের রথে বিজয় করেন, তারপর যথাক্রমে শ্রীবলদেবের, শ্রীসুভদ্রার ও সর্বশেষ শ্রীজগন্নাথের ‘পহণ্ডি-বিজয়’ হয়। শ্রীসুভদ্রাদেবী দয়িতাগণের স্কন্ধাবলম্বনে রথারোহণ করেন। শ্রীজগন্নাথ ও শ্রীবলরামকে দয়িতাগণ হস্ত, বাহু, স্কন্ধ ও রজ্জুদ্বারা আকর্ষণ করে তার কৃপায় ও ইচ্ছায় এক তুলি হতে অন্য তুলিতে শ্রীপদবিন্যাস লীলাক্রমে রথে উত্তোলন করেন। এদেরকে ‘কালবেড়িয়া’ বলা হয়। এরা যাত্রীদের সঙ্গে রথ টানেন। পূর্বে নীলাচলপতি শ্রীজগন্নাথদেবের রথে চৌদ্দশত, শ্রীবলরামের রথে বারশত ও শ্রীসুভদ্রাদেবীর রথে বারশত ‘বেঠিয়া‘ নিযুক্ত হইত। বিগ্রহ রথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাচীন রীতি অনুসারে উড়িষ্যার গজপতি মহারাজগণ স্বর্ণমার্জনী দ্বারা রথ পরিস্কার করেন-এই সেবাকে ‘ছেরাপহরা’ বলে। রথমার্জনের পর বিগ্রহগণকে বিবিধ বস্ত্রালঙ্কারাদি দ্বারা ভূষিত করে সমৃদ্ধির সাথে বিবিধ উপচারে পূজা করা হয়। পূজান্তে যথাক্রমে শ্রীবলভদ্র, শ্রীসুভদ্রা ও শ্রীজগন্নাথের রথ টানা হয়। স্থানীয় পুলিশ রথের চতুর্দিকে রজ্জুদ্বারা বেষ্টন করে রথ রক্ষা করে। রথাগ্রে বিশেষ বিশেষ সংকীর্তনমণ্ডলী নৃত্যকীর্তন করেন। এই প্রকারে রথ চলিতে চলিতে যখন শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীমন্দির ও প্রায় গুণ্ডিচার মধ্যবর্তিস্থলে বর্তমান ‘বলগণ্ডি’ নামক স্থানে উপস্থিত হয়, তখন মধ্যাহ্নকালীন প্রখর রৌদ্রে ক্লান্তি অনুভব করে শ্রীজগন্নাথদেব ও সেবকবৃন্দ বিশ্রামের জন্য সেখানে কিছুকাল অবস্থান করেন। বলগণ্ডির একদিকে বহু ব্রাহ্মণের বসতি ও নারিকেল বন, অন্যদিকে মনোরম পুস্পদ্যান। ঐসময় শ্রীবিগ্রহ ত্রয়ের সন্তাপশান্তির নিমিত্ত পঞ্চামৃত এবং সুবাসিত সুশীতল জলদ্বারা দর্পণে অভিষেক; সুগন্ধিচন্দন-কর্পরাদিদ্বারা সর্বাঙ্গ-লেপন; সুশোবন চামর ও সুশীতল ব্যঞ্জনাদি-দ্বারা বীজন; এবং সুমধুর পেয় দ্রব্য, খণ্ডবিকারজাত মিষ্টান্ন, খজুল, নারিকেল, নানাবিধ রম্ভা, তালপনসাদি সুস্বাধু এবং প্রিয় ফল, ইক্ষু, ক্ষীরোৎপন্ন বহুপ্রকার দ্রব্য, সুবাসিত সুশীতল জল কর্পূর লঙ্গাদি সুবাসিত তাম্বুলাদি অনন্ত উপকরণ দবারা পূজা হয়। একে ‘বলগণ্ডি-ভোগ’ বলে। তারপর অপরাহ্নে রথ ধীরে ধীরে চলতে চলতে সন্ধ্যার সময় গুণ্ডিচামন্দিরের দ্বারে উপস্থিত হয় এবং রাত্রিকালে বিগ্রহগণের রথেই অবস্থানও ভোগারতি হয়। পরদিন সন্ধ্যায় শ্রীবিগ্রহগণ গুণ্ডিচামণ্ডপের যজ্ঞবেদীতে পহন্ডি বিজয় করেন এবং তথায় ভোগরাগাদি চলতে থাকে। রথযাত্রার (চতুর্থ দিনে) পঞ্চমী তিথিকে ‘হেরাপঞ্চমী‘ বলে। ঐ দিন শ্রীলক্ষ্মীদেবী শ্রীজগন্নাথদেবের দর্শনার্থ গুণ্ডিচায় বিজয়পূর্বক রথভঙ্গোৎসব করে আসেন। সপ্তম দিবসে সন্ধ্যা আরাত্রিকের পর ‘সন্ধ্যাদর্শন’ নামে উৎসব হয়। অষ্টম দিনে রথত্রয়কে পুনরায় দক্ষিণাভিমুখে সুসজ্জিত করে রাখা হয়। পুনযাত্রার দিন অর্থাৎ নবম দিবসে প্রাতঃকালে মহাসমারোহে শ্রীবিগ্রহ ত্রয়কে পূর্বের রথে অধিষ্ঠিত করে গুণ্ডিচামণ্ডপ হতে শ্রীমন্দিরাভিমুখে রথত্রয়কে আকর্ষণ করা হয়। রথ ‘শ্রদ্ধাবালি‘র উপর দিয়ে অর্ধাসনীদেবী বা মাসীমার নিকট উপস্থিত হলে তথায় ‘পোড়াপিঠা’ ভোগ হয়। কথিত হয়, নরসিংদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আঠার-নালা (শঙ্খুআ) সেতু বেঁধেছিলেন। তাঁর মহিষীর নাম ছিল-শ্রদ্ধাদেবী। সেই ‘শঙ্খআ’ নদীর একটি ধারার নাম-‘মালিনী’। এটি বড়দাও ও গুণ্ডিচামণ্ডপকে পৃথক করে ছিল, বর্তমানে ঐটির অস্তিত্ব নাই। সেজন্য পূর্বে ৬টি রথ প্রস্তুত হত এবং উত্তর দিকে ৩টি ও দক্ষিণ দিকে ৩টি রথে রথযাত্রা হত। শ্রদ্ধাদেবী ‘মালিনী’ নদীর উপর সেতু নির্মাণপূর্বক গুণ্ডিচামণ্ডপের নিকটস্থ ভূমি রথচালনের উপযোগী করেছিলেন বলে উক্ত নদীর সেকত ‘শ্রদ্ধাবালি’ নামে খ্যাত। রথ মাসীমার নিকট হতে মর্চিকাদেবীর নিকট পৌঁছে। শ্রীলক্ষ্মীদেবী শ্রীজগন্নাথদেবের আগমন জেনে শ্রীমন্দির হতে রাজার সঙ্গে শ্রীজগন্নাথ দর্শনে আসেন। একে ‘লক্ষ্মীনারায়ণ-ভেট’ বলে। এরপর রথ সিংহদ্বারে উপস্থিত হলে সেখানে ‘অধরপণা‘ ভোগ হয় এবং বিপুল হরিসংকীর্তনের মধ্য রথোৎসব সমাপ্ত হয়। একাদশীর দিন লীলাপুরুষোত্তম শ্রীজগন্নাথের স্বর্ণালঙ্কারের দ্বারা ‘রাজবেশ’ হয়। দ্বাদশীর দিন শ্রীজগন্নাথের ‘নীলাদ্রি-উৎসব অর্থাৎ শ্রীমন্দিরে বিজয়োৎসব হয়। সেই সময় শ্রীলক্ষ্মীদেবী শ্রীজগন্নাথের উপর অভিমান করে শ্রীমন্দিরের দ্বার বন্ধ করেন। শ্রীলক্ষ্মীর প্রতিনিধিরূপে ‘মাহারী’ দেবদাসীর সাথে শ্রীজগন্নাথের প্রতিনিধি দয়িতাপতির কিছুক্ষণ ঝগড়া হয়। শ্রীজগন্নাথ ঝগড়ায় পরাজিত হলে দ্বার খোলা হয় এবং ‘বন্দাপনা’ হয়ে শ্রীজগন্নাথ রত্নাসিংহাসনে বিজয় করেন। ব্রজগোপীদের দাস্যাভিলাষী শ্রীগৌড়ীয়বৈষ্ণবগণ শ্রীব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীজগন্নাথকে শ্রীকুরুক্ষেত্র- শ্রীনীলাচল হতে শ্রীসুন্দরাচল শ্রীবৃন্দাবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগ্রহবিশিষ্ট হন; পুনর্যাত্রায় তাঁদের আগ্রহ নাই।