এই পোস্টটি 2057 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমতি দেবকী দেবী দাসী:চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে লন্ডনে ইস্কনের প্রথম মন্দির শ্রীশ্রী রাধা-লন্ডনেশ্বর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি।
শ্রীমৎ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের নির্দেশনার বাস্তবায়ন
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের আকাক্সক্ষা ছিল, কখন কৃষ্ণভাবনামৃত পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রচার হবে এবং তাঁর পুত্র ও শ্রীল প্রভুপাদের গুরুদেব, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরও একই অভিলাষ পোষণ করতেন, যার মধ্যে লন্ডন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ৩০ এর দশকে তাঁর তিন জন বরিষ্ট শিষ্যকে লন্ডনে পাঠান, যাদের মধ্যে ২ জন সন্ন্যাসী ছিলেন। ১৯৩৩ সালে তারা “গৌড়ীয় মিশন সোসাইটি” নামে একটি কেন্দ্র স্থাপন করেন যেটি সামান্যই সফলতা পেয়েছিল।
তিন দশক পরে শ্রীল প্রভুপাদ, যিনি তাঁর গুরুদেবের মনোভিলাষ পূরণে গভীর উৎসাহী ছিলেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে নিশ্চিতভাবে তাঁর শিষ্যরা ইউরোপে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। যেমনটি তারা উত্তর আমেরিকায় করেছে। লন্ডনে একটি মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে তিনি কাজ শুরু করেন।
১৯৬৮ সালে তিন আমেরিকান দম্পতি-গুরুদাস ও যমুনা দেবী দাসী, শ্যামসুন্দর দাস ও মালতী দেবী দাসী (সাথে তাদের ছোট কন্যা সরস্বতী) এবং মুকুন্দ দাস ও জানকী দেবী দাসী-তাদের পারমার্থিক গুরুদেব শ্রীল প্রভুপাদের আদেশে লন্ডনে মন্দির স্থাপনের উদ্দেশ্যে সানফ্রান্সিসকো ত্যাগ করেন। তারা সানফ্রান্সিসকোতে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রভুপাদের ঘনিষ্ট সঙ্গ লাভ করেছিলেন। তাদের গুরুদেব শ্রীল প্রভুপাদের সন্তুষ্টির জন্য লন্ডনে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে আগ্রহী হয়ে তারা লন্ডনের প্রচার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে মন্ট্রিলে শ্রীল প্রভুপাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তাঁর কৃপা প্রার্থনা করেন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে কীর্তন অনুশীলন করেন। লন্ডনে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে কীর্তন হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ণ দৃঢ়তা
লন্ডনের পৌঁছার পর তিন দম্পতি কোন আর্থিক সহায়তা ছাড়াই তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যান। কিন্তু প্রভুপাদের আশীর্বাদের প্রতি তাদের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। যদিও তাদেরকে আলাদা শহরে থাকতে হচ্ছিল, তারপরও তারা কৃষ্ণভাবনামৃতে উৎসাহ বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। প্রায় প্রতিদিন তারা একত্রিত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন অথবা কোন মিডিয়া অফিস বা রক সেন্টারে যেতেন তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
১৯৬৯ মালের ২৭ জুলাই তাঁরা লন্ডনে প্রথম রথযাত্রার আয়োজন করেন। শোভাযাত্রটি মার্বেল গেইট থেকে শুরু হয়ে ট্রাফালগার স্কয়ারের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। শ্যামসুন্দর দাস, পেশাগতভাবে যিনি ছিলেন সুত্রধর। তিনি জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা মহারাণীর জন্য রথটি নির্মাণ করেন। সেই বিগ্রহগুলো খুব সুন্দরভাবে তৈরি করে, যাতে সবাই তাঁদের প্রতি আকর্ষিত হয়। যুক্তরাজ্যে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে সহায়তা করার একটি উপায় হিসেবে শ্যামসুন্দর দাস বিটল্সের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চাইলেন।
বিটলসের সাথে সাক্ষাৎ
মানসিক সুখ ও শান্তির অন্বেষণে বিটল্স ১৯৬৭ সালে ঋষিকেশ ভ্রমণ করে। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন মাত্রার স্বাদ নিয়ে তারা লন্ডনে ফিরে আসেন। তাঁদের মধ্যে জর্জ হ্যারিসন সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ১৯৬৯ সালে বিটল্সের মনোযোগ পাওয়ার জন্য ভক্তরা বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা করেন। অ্যাপল রেকর্ডসের একটি বড়দিনের পার্টিতে জর্জ হ্যারিসনের আমন্ত্রণে তার বাড়ীতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করার মাধ্যমে শ্যামসুন্দরের দীর্ঘলালিত স্বপ্ন অবশেষে পূর্ণ হয়। হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন ও বিটল্সের সাথে বন্ধুত্ব করে হরেকৃষ্ণ ভক্তরা সবার মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠে।
যুক্তরাজ্যে ইস্কনের প্রথম মন্দির
শ্রীল প্রভুপাদ লন্ডনে থাকা তাঁর শিষ্যদের নিকট থেকে নিয়মিত খবরাখবর পাচ্ছিলেন। ১৯৬৯ সালে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে তিনি যুক্তরাজ্যে যাওয়ার দিন নির্ধারণ করেন। লন্ডনের মন্দির স্থাপনের জন্য জমি পাওয়ার অব্যাহত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গুরুদাস একজন জমি ক্রয়-বিক্রয়ের দালানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন যার বিট্রিশ জাদুঘরের নিকটে সেন্ট্রাল লন্ডনের কবরস্থানে পাঁচ তলা একটি বাড়ি ছিল। ‘হরেকৃষ্ণ মন্ত্র’ রেকর্ড বিভিন্ন অর্থের দ্বারা তারা সেই বাড়িটি ভাড়া করতে সক্ষম হলেন এবং সেটিকে তারা মন্দিরে রূপান্তরিত করলেন। জর্জ হ্যারিসন কথা দিলেন যে ভক্তরা ভাড়া পরিশোধে অক্ষম হলে, অ্যাপল রেকর্ডস তা প্রদান করবেন।
১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীল প্রভুপাদ প্রথম বার যুক্তরাজ্যে গেলে, জর্জ হ্যারিসন ও জন লেনন তাঁর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বোরি প্রাসাদের সংস্কার কাজ সম্পন্ন না হওয়ার পর্যন্ত জন শ্রীল প্রভুপাদ ও তাঁর শিষ্যদের তার বাড়ীতে থাকার আমন্ত্রণ জানান, যদিও তা ছিল এই শর্ত সাপেক্ষে যে, প্রভুপাদের শিষ্যরা তার সম্পত্তির সংস্কার কাজে সহায়তা করবে। তারা সেই শর্তে রাজী হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৬৯ এর অক্টোবরের শেষের দিকে কিছু ভক্ত বোরি প্রাসাদে চলে গেলেন এবং সংস্কার কাজের কোলাহল সত্ত্বেও শ্রীল প্রভুপাদ তাদের সাথে সেখানে গিয়ে উঠলেন। শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্যরা তাদের পারমার্থিক গুরুদেবকে সন্তুষ্ট করতে, যে কোন কিছু করার প্রচেষ্টা করেন এবং শ্রীশ্রী রাধা কৃষ্ণের মন্দির প্রস্তুত করতে কঠোর পরিশ্রম করেন। মন্দির উদ্বোধনের জন্য শ্রীল প্রভুপাদ তাদেরকে শ্রীশ্রী রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহ ক্রয় করতে বললেন এবং ঐ সময় লন্ডনে পরিদর্শনরত তাঁর এক শিষ্য, তমাল কৃষ্ণ দাসকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ পত্র বিলি করতে বলেন। যেই তারিখটি শ্রীল প্রভুপাদ বিগ্রহ ক্রয় করার আগেই নির্ধারণ করেছিলেন। এমনকি নতুন মন্দিরে প্রথম সপ্তাহে প্রতি সন্ধ্যায় কি কি প্রসাদ পরিবেশন করা হবে সেই বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ তমাল কৃষ্ণ প্রভুকে উপদেশ দিয়েছিলেন। অনেক প্রচেষ্টার পর, অবশেষে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সালে বোরি প্রাসাদে শ্রীশ্রী রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হল। প্রভুপাদ বিগ্রহগণের নামকরণ করলেন শ্রীশ্রী রাধা-লন্ডনেশ্বর অর্থাৎ লন্ডনের নিয়ন্তা রাধাকৃষ্ণ। ইস্কনের ইতিহাসে শ্রীশ্রী রাধা-লন্ডনেশ্বর বিগ্রহের বিশেষ স্থান রয়েছে এই বিগ্রহের অনন্যতার কারণে। যদিও ভগবান স্বয়ং প্রকাশিত হন, তবুও ভক্তদের আনন্দ প্রদান করতে তাঁর প্রিয় ভক্ত দ্বারা আবির্ভূত হন। এটি জনৈক ভারতীয় ভদ্রলোক গোয়েল কর্তৃক দানকৃত, যিনি পূর্বলন্ডনের একটি হিন্দু কেন্দ্রের জন্য নিজেই বিগ্রহ খুঁজছিলেন। বিবিসি কর্তৃক ধারণকৃত সেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উৎসব শ্রীল প্রভুপাদ তত্ত্বাবধান করেছিলেন। শ্রীশ্রী রাধা-লন্ডনেশ্বর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রীল প্রভুপাদ পূর্বতন আচার্যদের দীর্ঘলালিত একটি আকাক্সক্ষা পূরণ করেন।
লন্ডন ইস্কন মন্দিরের প্রধান পূজারী মুরালী মনোহর দাস বলেন, “শ্রীল প্রভুপাদের দৃঢ় বাসনার প্রত্যক্ষ প্রকাশ হল শ্রীশ্রী রাধা-লন্ডনেশ্বর। সেই দিক থেকে আপনি চাইলে তাদের স্ব-প্রকাশিত বিগ্রহও বলতে পারেন। শ্রীল প্রভুপাদের সাথে লীলাস্বরূপ তাঁরা স্বয়ং লন্ডনে আবির্ভূত হয়েছিলেন।”
লন্ডনে ইস্কনের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শ্রীমৎ তমাল কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, “শ্রীশ্রী রাধা-লন্ডনেশ্বর বিগ্রহ পশ্চিমা বিশ্বে পূজিত প্রথম কোন রাধা-কৃষ্ণ বিগ্রহ এবং এগুলো সবচেয়ে ব্যতিক্রম সুন্দর বিগ্রহ; যাঁদের প্রতি শ্রীল প্রভুপাদের প্রবল আকর্ষণ ছিল।” হরেকৃষ্ণ!