লক্ষ্য

প্রকাশ: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ | ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 1126 বার দেখা হয়েছে

লক্ষ্য

লক্ষ্য, ছোটবেলায় একটা রচনার সঙ্গে বেশ পরিচিত জীবনের লক্ষ্য বা ইংরেজিতে aim in life। এখনো পর্যন্ত পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের সেই রচনার বিষয়বস্তু হিসেবে লেখেন, “আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি হতে চাই” ইত্যাদি। জীবনে চলার পথে একটি লক্ষ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ লক্ষ্যবিহীন কোনো জীবন নিতান্তই এলোমেলো। লক্ষ্যই আমাদের জীবনকে সুন্দর করে। তাই তো মা-বাবা থেকে শুরু করে এমনকি শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি লক্ষ্য থাকেই। শুধু তাই নয় সমাজে সর্বস্তরের ব্যক্তিদের জন্য কোনো না কোনো লক্ষ্য খুবই সাধারণ। এক কথায় বললে সবারই সাধারণ একটি লক্ষ্য হল, “বড় হতে হবে আর অর্থ আয় করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।”
একটি কথোপকথন
কোনো একজন ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি পড়াশোনা করছ কেন?”
উত্তর হতে পারে,”ডাক্তার হব বলে।”
আচ্ছা বেশ, “তো ডাক্তার হবে কেন?”
“প্রতিষ্ঠা, সম্মাান ও ভাল অর্থ আয়ের আশায়।”
“অর্থ কেনো প্রয়োজন?”
“জীবনের চাহিদা মেটাবো বলে।”
“তোমার তো সেরকম চাহিদা নেই, মা-বাবা আর তুমি, এইতো।”
“একদিন আমারও সংসার হবে, স্ত্রী সন্তানতো আমারও থাকবে। তাদের ভরণ পোষণ করতে হবে না?”
“এরপর?” “এরপর আর কি, সময়ে যা হয় আর কি, দায়িত্ব আর থাকবে না। তখন কোনোভাবে ভগবান ভগবান করে শান্তিতে মরতে পারলেই হয়।”
ইন্দ্রিয় তৃপ্তি
ওপরের কথোপকথন থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, জীবনের লক্ষ্যই হল ইন্দ্রিয় তৃপ্তি। আমাদের মনসহ মোট ১১টি ইন্দ্রিয় রয়েছে। সেগুলো হলঃ পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। আর পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়- বাক্, পানি, পায়ু, উদর ও উপস্থ এবং অন্তরেন্দ্রিয়- মন।
অর্থোপার্জন, সংসার বন্ধন, প্রতিষ্ঠা, সম্মান এ সবই এ সমস্ত পৃথক পৃথক বা সমস্ত ইন্দ্রিয়সমূহের তৃপ্তিসাধন বা সন্তুষ্টিবিধান। আরো বিশেষভাবে ব্যক্ত করলে শুধুমাত্র চারটি বিষয়ের জন্য এত কিছুঃ আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন। আমাদের এত খাটুনির একটাই লক্ষ্য হল ওপরের এই চারটি বিষয় বা ইন্দ্রিয়সমূহের তৃপ্তি সাধন। প্রশ্ন হল আমার তো এই হাত, পা কিংবা আরো সুক্ষ্মভাবে বলতে গেলে এই ‘মন’ নই। আমারা প্রকৃতপক্ষে কে? আর আমিই কি আসলে সন্তুষ্ট? নাকি বাহ্যিকভাবে বা কৃত্রিমভাবে বা গড্ডালিকা স্রোতের প্রবাহে মনে করছি, “হ্যাঁ, আমি সুখিই তো, বা সন্তুষ্ট।”
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, প্রাচীকালে রাজারা অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করতেন পানিতে ডুবিয়ে, যখন অপরাধীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন ওপরে খানিকটা শ্বাস নেওয়ার জন্য তুলে আবার ডুবানো হয়। সুখ হচ্ছে এরকমই। এ জড়জগতে ক্ষণিকের জন্য আপনি সুখি হতে পারেন। কিন্তু চিরস্থায়ী সুখ কখনো আশা করা যায় না। আপনি অনেক অনেক পরিশ্রম করে সামান্য একটু ইন্দ্রিয়তৃপ্তিমূলক সুখ উপলব্ধি করতে পারেন।
ইন্দ্রিয় তৃপ্তির উর্ধ্বে
কিন্তু সেই ইন্দ্রিয় তৃপ্তি জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা বোকামির পরিচয়। যে ইন্দ্রিয় তৃপ্তি আমাকে বিনিময়ে মাত্র ভগ্নাংশ পরিমাণে সুখ দিচ্ছে আমি জীবনের লক্ষ্য হিসেবে কেন নির্ধারণ করতে পারি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উর্ধ্বে কোনো জ্ঞান সরবরাহ করতে পারে না। পৃথিবীতে যত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে শুধুমাত্র এই শিক্ষা বা জ্ঞান প্রদানের জন্য যে ইন্দ্রিয়তৃপ্তিমূলক সুখ কিভাবে বা কত রকম পন্থায় লাভ করা যায়। এসব শিক্ষা এ পৃথিবীর সীমিত পরিধির মধ্যেই বা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সম্প্রতি WITS বিশ্ববিদ্যালয় শ্রীমৎ জয়দ্বৈত স্বামী এক প্রবচন দেন, সেই প্রবচনে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার ফলাফল বিষয়ে বক্তৃতা দেন। নিম্নে সেই বক্তৃতার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হয় যা উপরোক্ত আলোচনার সঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
“বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে, শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত চারটি উদ্দেশ্য সফলভাবে অর্জন আমাদেরকে সমর্থ করে : ধর্ম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আমাদের প্রয়োজন ও চাওয়াগুলো অর্জন এবং অবশেষে মুক্তি। এই মুক্তি রাজনৈতিক মুক্তি নয়, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যখন আমরা প্রথম উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলি। সেটি হল ধর্ম এবং সেটি কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মমত বা ধর্মবিশ্বাস নয়। সংস্কৃত শব্দ ধর্ম এখানে আরো বৃহত্তর ও গভীর। দর্শন হল, সর্বোপরি একটি প্রয়োজনীয় সহজাত গুণ, যেটি এমন একটি জিনিষ বা এমন কেউ যাকে সহজাতভাবেই করতে হয়। জলের ধর্ম তরলতা, মরিচের ধর্ম কটুতা, চিনির ধর্ম মিষ্টতা এবং জীবের ধর্ম হল সেবা করা।
দোকানদার ক্রেতাকে, শ্রমিক মালিককে, ডাক্তার রোগীকে, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের, রাজনীতিবিদ জাতির সেবা করে। এছাড়াও, সর্বোপরি আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয়সমূহের সেবা করি। আমরা জিহ্বা, কান, চোখ ও আরো অন্যান্য কিছুর দাবি পূরণের সেবা করি এবং আমাদের সহজাত ধর্ম হল ভগবানের সেবা। দেহের অংশ হাত, হাতের কাজ হল সমগ্র দেহের সেবা করা। ঠিক তেমনি আমরা সবাই ভগবানের অংশ হওয়ায় আমাদের কর্তব্য ভগবানের সেবা করা।
আমরা সবাই কোনো না কোনো বিশেষ পেশায় নিযুক্ত হয়ে সেবা করে থাকি এবং সেটি ধর্মের আরেকটি অর্থ। আমাদের স্বাভাবিক শিক্ষা ও দক্ষতা অনুসারে, আমরা হয়তো শিক্ষক, মিলিটারি বা রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী অথবা কৃষক, শ্রমিক ও প্রকৌশলী হিসেবে সেবা করতে পারি। যে বিশেষ সেবা আমরা করি সেটিও ধর্মের আরেকটি দৃষ্টিকোণ।
এভাবে আমাদের যার যার পেশার পরিপ্রেক্ষিতে সেবা করার মাধ্যমে। আমরা স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করতে পারি। এভাবে আমরা তৃতীয় উদ্দেশ্য, আমাদের প্রয়োজন ও। বাসনাগুলোর সন্তুষ্টি বিধানও করতে পারি। অবশেষে ৪র্থ লক্ষ্য হল ‘মুক্তি’। উল্লেখ্য, এটি রাজনৈতিক কোনো মুক্তি নয়। বরং এটি পারমার্থিক মুক্তিকে উল্লেখ করে, যেটি জাগতিক বদ্ধ অবস্থা থেকে আত্মার মুক্তি।
এটি এমন এক বিষয়, যেটি নিয়ে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা কোনো কিছুই করতে চায় না। সেটি ধর্মের অধীন। সবাই দেহগত চিন্তাধারায়য় জীবনযাপন করছে এবং সেটি হল অজ্ঞতার জীবন অনুসরণ করে তারা নিম্নগামী হয়, অন্ধকারে নিপতিত হয় এবং যারা এসমস্ত জ্ঞানচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করে তারা আরো অন্ধকারে নিপতিত হয়।
অন্যকথায়, ভুল পথে পরিচালিত জ্ঞান, শিক্ষা না থাকার চেয়ে থাকাটা আরো বেশি খারাপ। তার অর্থ এই নয় যে, শিক্ষিত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু সেই শিক্ষার উচিত একজন ব্যক্তিকে সৎ হিসেবে গড়ে তোলা।
অতএব, ইন্দ্রিয় তৃপ্তিই যদি আমাদের লক্ষ্য থাকে তবে সেটি আমাদের নরকগামী করবে। আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত ভগবদ্ধামে প্রত্যাগমন করার। কেননা সেটিঈ হল কৃষ্ণের আলয় যা আমাদের নিত্য আলয়। আর এর জন্য যথাযথ শিক্ষা অনুশীলন করা উচিত। শ্রীল প্রভুপাদ সেই শিক্ষা সারা বিশ্বকে প্রদান করেছেন। আপনার উচিত সেটিকে সাদরে গ্রহণ করা। তবেই নিজের প্রকৃত লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হয়ে সেটি সার্থক করার প্রচেষ্টা করবেন। আর এটিই হল জীবনের স্বার্থকতা। হরে কৃষ্ণ (মাসিক চৈতন্য সন্দেশ জুন ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ)

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।