রাশিয়ায় ‘ভগবদগীতা যথাযথ’ এর বিজয়

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০১৮ | ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০১৮ | ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 1393 বার দেখা হয়েছে

রাশিয়ায় ‘ভগবদগীতা যথাযথ’ এর বিজয়

ইস্‌কন নন্দনকানন চট্টগ্রাম চৈতন্য সন্দেশ ডেস্ক: উৎকণ্ঠা দিয়ে শুরু উল্লাস দিয়ে শেষ। শ্রীমদ্ভগবদগীতার রাশিয়া বিজয়ের ইতিবৃত্ত এটিই বলা যেতে পারে। তবে এর বাইরেও আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা রয়েই যায়। যেটি এ প্রতিবেদনের শেষে উল্লেখ করা হবে। তবে তার আগে ঘটনার ইতিবৃত্ত পাঠকদের উদ্দেশ্যে পর্যায়ক্রমিকভাবে তুলে ধরা হল।

সূত্রপাত: গত জুন মাসে রাশিয়ান তমস্ক নগরে ঘটনার সূত্রপাত। রাশিয়ান একটি অর্থডক্স চার্চ ইস্‌কন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল এ. সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক তাৎপর্যকৃত ‘‘শ্রীমদ্ভবদগীতা আ্যজ ইট ইস্’’ এর রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদকৃত গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করার জন্য সাইবেরিয়ায় তমস্ক আদালতে আপিল করে। তাদের অজুহাত ছিল শ্রীমদ্ভবদ্গীতা রাশিয়াতে ‘সামাজিক বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করেছে। সত্যিকার অর্থে বিশৃঙ্খলা শব্দটির অর্থ আমাদের জানা নেই। দ্যুতক্রীড়া, আমিষাহার, জুয়া, অবৈধ যৌন সঙ্গ ইত্যাদি পরিত্যাগের বাণী প্রচার করে সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশের সরকার, মেয়র, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়া থেকে পুরস্কৃত হল যে ভগবদ্গীতা সময়ের পরিহাসে কতিপয় দুস্কৃতকারী হঠাৎ পাগলের মত বলছে এটিই নাকি সামাজিক বিশৃঙ্খলা। তবে বিশৃঙ্খলা মানে কি? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। ইস্কন রাশিয়ার একজন মুখপাত্র জুরি প্লেসকব বলেন, ‘‘রাশিয়ায় ভগবদ্গীতা যথাযথ ২৫ বছর পর্যন্ত প্রচারিত হচ্ছে, কিন্তু কখনো এর জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির রেকর্ড নেই’’।

ভারতের নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার কাদাকিন এক মন্তব্যে যেটিকে আপিলকারীদের পাগলামো বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, রাশিয়ান হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তায় ঈর্ষানিত হয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের শুরু থেকেই এর বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। আর তাই ‘ভগবদ্গীতা নিষিদ্ধ’ হওয়ার বিষয়টিও এরই ধারাবাহিকতা।
রাশিয়ায় আন্দোলন: এরপরে রাশিয়ায় শুরু হল আন্দোলন। যেখানে ইস্‌কন ভক্তসহ সর্বস্তরের জনগণ এ আন্দোলনে অশংগ্রহণ করে। ধারনা করা হচ্ছিল গত ১৯ ডিসেম্বর ‘ভগবদগীতা যথাযথ’ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হতে পরে আর এ জন্যে আন্দোলন আরো দুর্বার হয়ে উঠে। রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে এই রায়ের সপক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে।
রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ ব্যানার, প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদ বাক্য লিখে ইস্‌কন ভক্তদের সাথে হরিনাম কীর্তনে অংশগ্রহণ করে। তারা নানাভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে। সৌভাগ্যক্রমে ভারতের প্রধান মনমোহন সিং এর রাশিয়ায় সফর ঘটে। রাশিয়ায় ইস্‌কন ভক্তরা একটি লিখিত চিঠিতে মনমোহন সিংকে অবহিত করে। নিজেদের অধিকার আদায়কে সামনে থেকে এর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব ইস্‌কন ভক্ত সাধুপ্রিয় দাস। এজন্যে তিনি হিন্দু কাউন্সিল অব রাশিয়া নামে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেন। একজোট হয়ে ভারত, বাংলাদেশ, মরিশাস, নেপাল সহ বেশ কয়েকটি দেশ মিলে এ কমিটি গঠিত হয়।
ভারত জুড়ে আন্দোলন: রাশিয়া থেকে এ আন্দোলন মিডিয়ার মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারতে। ধীরে ধীরে এ আন্দোলন দানা বাধেঁ। ১৯ ডিসেম্বর যতই ঘনিয়ে আসছে চূড়ান্ত আন্দোলন দুর্বারভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারত জুড়ে। ভারতীয় মিডিয়াতে বার বার ইস্‌কন, প্রভুপাদ ও প্রতিবেদন ফলাও করে প্রচার করে এবং ভারতীয় সরকারের ধীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
সমাজবাদী, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, ধর্মীয় প্রধান ব্যাক্তি থেকে শুরু করে বলিউডের নায়ক নায়িকা পর্যন্ত সকলেই ফেসবুক, টুইটার সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে গীতা নিষিদ্ধের ব্যাপারে তীব্র নিন্দা জানান। এদিকে এই বিষয়ে সরকারি পক্ষ থেকে আগাম কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় মন্ত্রীদের আন্দোলনের মুখে ভারতীয় লোকসভা দুই দিন তার কার্যক্রম চালাতে পারে নি। ভারতে কলকাতার সংবাদপত্র ‘বর্তমান’-এ (২০ ডিসেম্বর) লেখা হয়, ‘‘লোকসভায় প্রায় সবদলের এম পি’রাই উদ্বেগ জানিয়ে দবি করেন, রাশিয়ায় বসবাসকারী সনাতন ধর্মালম্বী মানুষের কাছে আশ্বাসের বার্তা পৌঁছানো জরুরী। এছাড়া লোকসভায় দফায় দফায় হট্টগোল হয় এবং লোকসভা জয় কৃষ্ণ ভগবান কি জয় ধ্বনিতে মুখরিত হয়।…..লোকসভায় ইস্যুটি প্রথম উপস্থাপন করেন বিজু জনতা পার্টির এম পি ভর্তৃহরি মহতাব। তিনিই প্রথম বলেন, এ ঘটনার জেরে ইস্কনের পক্ষ থেকে ভারত সরকারকে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। মহতাবের বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব দলই (কংগ্রেস, শিবসেনা, বিজেপি, আরজিডি, বিএসপি, এসপি সহ) তাঁকে সমর্থন করে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগী হতে বলে। এরপর এ নিয়ে লালু প্রসাদ যাদব, হুকুম সিং দের যাদব, শারদ যাদবরা বক্তব্য পেশ করেন।’’
এছাড়া ভারতে নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার কাদাকিন বলেন, ‘‘ভারত এবং রাশিয়া দুই দেশেরই এই ঘটনা ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। গীতা হচ্ছে পুর্নজ্ঞান এবং অনুপ্রেরণার উৎস যা শুধুমাত্র ভারতীয়দের জন্য নয়, তা রাশিয়ান জনগণ এবং সমগ্রবিশ্বের জন্যও আবশ্যিক পঠিত গ্রন্থ।’’ এছাড়াও কাদাকিন গীতা নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য আপিলকারীদেরকে পাগল ব্যক্তি রূপে সম্বোধন করেন। কাদাকিনের বক্তব্য বিশ্বজুড়ে ভগবদগীতার প্রতি আস্থা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, আপিলকারীগণ ভগবদ্গীতা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক এবং পরিপূর্ণ কোন যুক্তি দেখাতে পারেনি। গীতা হচ্ছে সদ্জ্ঞানের ভান্ডার যা মহাত্মা গান্ধিও অনুসরণ করতেন। এছাড়াও টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রকাশিত এক সংবাদে রিপোর্টার এবং যামাইয়া মিলা ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক ফরিদা খানম বলেন যে, ‘‘আমি ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করছি কিন্তু আমার লাইব্রেরীতে হিন্দি, উর্দু এবং ইংরেজি ভাষার গীতা রয়েছে। কিন্তু তা পাঠ করে আমার কাছে কোন বিপদজনক কিছু মনে হয়নি বরং তা এক অনন্য জ্ঞানের আধার বলে মনে হয়েছে। এই ধরনের আপিল সত্যিই অদ্ভুদ।’’ (টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৫ডিসেম্বর)
ভোট গ্রহন ও চুড়ান্ত রায়ের নাটক :www.petions24.com/gita ‘ভদগবদ্গীতা যথাযথ’ গ্রন্থটি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে ভোটগ্রহণ শুরু হতে থাকে। এ ভোট গ্রহণ ১৯ ডিসেম্বর রায় ঘোষনার পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে। যদিও ঐদিনই চূড়ান্ত রায় ঘোষনার কথা ছিল কিন্তু ঐদিন রায় মুলতবি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এবং চূড়ান্ত রায়ের তারিখ নির্ধারণ হয় ২৮ তারিখ। সারাবিশ্বে অর্ধলক্ষাধিক লোক এ রায়ের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এতে বাংলাদেশও অনবদ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষত চট্টগ্রাম সারা বিশ্বে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ষষ্ঠ স্থান লাভ করে। তখন সারাবিশ্বের মানুষ ভোট প্রদানের জন্য আরো সোচ্চার হয়ে উঠে। ফেইস্বুক, টুইটার সহ এ বিষয়ে বার্তা প্রচার হতে থাকে তাতে এর বিরুদ্ধে জনশক্তি আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফাঁকে রাশিয়ার এ্কদল গবেষক ভগবদগীতা যথাযথ গ্রন্থটির সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তা ও এর দর্শন ইত্যাদি গবেষণা করতে থাকে। গবেষনায় উঠে আসে। সারাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ লোকের কছে এ গ্রন্থটি কতটা জনপ্রিয় ও সমাদৃত। সারাবিশ্বে এ গ্রন্থটির কল্যানে কতটা শান্তি বয়ে এনেছে। এক পর্যায়ে তারা গ্রন্থটির ইতিবাচকতা স্কীকার করতে বাধ্য হয়। এভাবে অনেক কর্মসূচির পর আসে কাঙ্খিত সেই দিন যেই দিনে চূড়ান্ত ঘোষণা ঘোষিত হবে।
চূড়ান্ত বিজয়: ২৮ ডিসেম্বর চূড়ান্ত রায়ের দিন। সকাল থেকে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল কি হবে? সারাবিশ্বের ইস্‌কন ভক্তদের কৃষ্ণের কাছে একটিই প্রার্থনা ছিল ‘‘কৃষ্ণ অনুগ্রহ করে ভগবদ্গীতাকে রক্ষা করুন।’’ আদালত রায় দিল, শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এর উপর আনা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যেই নিষেধজ্ঞা সেটিই তুলে নেয়া হল। আর এভাবে এর মাধ্যমে ইসকনের বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ’ রাশিয়ায় বিজয় হল। সারাবিশ্বে শুরু হল বিজয় উল্লাস। এভাবে পরিসমাপ্তি ঘটল ভগবদগীতা যথাযথ প্রিয় ভক্তগণের সুদীর্ঘ ছয় মাসের সংগ্রাম।
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে একটি তথ্য সর্বশেষ আমরা উপস্থাপন করতে চাই তা হল, এই ডিসেম্বর মাস ছিল শ্রীমদ্ভগবদগীতার আবির্ভাব মাস। আর এই মাসে ইসকন গীতা ম্যারাথন হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছরটিকে অন্যান্য বছর থেকে একটু ব্যতিক্রম বলতে হবে। কেননা এ মাসে কৃষ্ণ স্বয়ং সারা বিশ্বে গীতা ম্যারাথন করলেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আর কি হতে পারে? প্রমাণ? এ মাসে সারা বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ বিক্রিই হল তার প্রমাণ। তাই এ মাসটিকে কৃষ্ণের গীতা ম্যারাথন বলাটা কি সমীচিন নয়? কৃষ্ণের পরিকল্পনা বলে কথা। এটিই সেই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। সেসাথে সারাবিশ্বের মানুষ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থকে ভালবেসে একত্রিত হয়ে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছে তা বিশ্বে স্থাপন করেছে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। হরে কৃষ্ণ।
তথ্যসূত্র: দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস, উইকিপিডিয়া, টাইমস্ অব ইন্ডিয়া, ড্যালিভাস্কর, সি.এন.এন., বিবিসি, রয়টার্স, ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস, TV9, NDTV, Zee News IAN LIVE সহ বিশ্ব মিডিয়াসমূহ।

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ জানুয়ারি ২০১২ সালে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।