এই পোস্টটি 401 বার দেখা হয়েছে
মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রী রামচন্দ্র ও তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তবৃন্দ ত্রেতাযুগে আবির্ভূত হয়ে লোকশিক্ষার্থে অপূর্ব সব লীলা প্রকাশ করেন।
গিরিরাজ স্বামী
পরমেশ্বর ভগবান হলেন কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণ, এবং তিনি বিভিন্ন রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। কৃষ্ণের এক প্রকাশরূপ হলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র। যখন কৃষ্ণ স্বরূপে স্বয়ং প্রকটিত হন তখন তিনি পরমেশ্বর ভগবান রূপে আচরণ করেন, কিন্তু যখন তিনি শ্রীরাম রূপে আবির্ভূত হন তখন তিনি একজন আদর্শ রাজা রূপে আচরণ করেন। বাস্তবে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের লীলাবিলাসসমূহ বহুরূপে আদর্শকে ফুটিয়ে তোলে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাজা দশরথের পুত্ররূপে আবির্ভূত হন এবং দশরথ একজন আদর্শ পিতা এবং আদর্শ রাজা ছিলেন। রামের সহোদর লক্ষ্মণ একজন আদর্শ ভ্রাতারূপে এবং রামের পত্নী সীতাদেবী একজন আদর্শ পত্নীরূপে আচরণ করেন। যেহেতু ভগবান শ্রীরাম একজন আদর্শ মানুষরূপে আচরণ করেন তাই তাকে বলা হয় মর্যাদা পুরুষোত্তম। একজন মানুষ হিসেবে আমাদের যে সকল নিয়ম নীতি পালন করা উচিত ভগবান ঠিক তা পালন করেছিলেন। অন্যদিকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোনরূপ নিয়ম নীতি অনুসরণ করেন নি, তাছাড়া ভগবান কোনো নিয়ম পালনে বাধ্যও নন। তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন পরম উপভোক্তারূপে এবং আমরা কিভাবে ভগবানের সাথে আনন্দময় লীলাবিলাস উপভোগ করতে পারি সেই পথ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাই কৃষ্ণকে বলা হয় লীলা পুরুষোত্তম।
রামায়ণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের লীলাবিলাস বিস্তৃতরূপে বর্ণিত হয়েছে। সমস্ত পণ্ডিত এবং বৈদিক পরম্পরা মতে রামায়ণাদি গ্রন্থসমূহের মধ্যে গ্রন্থরাজ শ্রীমদ্ভাগবত্ েরয়েছে বৈদিক সাহিত্যের পরম জ্ঞান। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে কৃষ্ণের বিভিন্ন অবতারের লীলাবিলাসের কথা, এমনকি শ্রীরামচন্দ্রেরও। তাই শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা অনুসারে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লীলাবিলাস সম্পর্কে আমরা শ্রবণ করতে পারি।
অস্মৎ প্রসাদসুমুখঃ কলয়া কলেশ
ইক্ষ্বাকুবংশ অবতীর্য গুরোনির্দেশে।
তিষ্ঠন্ বনং সদয়িতানুজ আবিবেশ
যস্মিন্ বিরুধ্য দশকন্ধর আতিমাচ্ছৎ ৷।
অনুবাদ : এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জীবের প্রতি অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে ভগবান তাঁর অংশসহ মহারাজ ইক্ষ্বাকুর বংশে অন্তরঙ্গা-শক্তি সীতাদেবীর পতিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর পিতা মহারাজ দশরথের আজ্ঞানুসারে তিনি তাঁর পত্নী এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতাসহ বনে গমন করেছিলেন এবং দীর্ঘকাল সেখানে বসবাস করেছিলেন। অত্যন্ত শক্তিশালী দশমুণ্ড রাবণ তাঁর প্রতি মহা অপরাধ করেছিল এবং তার ফলে চরমে সে বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিল। (ভা.-২/৭/২৩)
শ্রীল প্রভুপাদ এ শ্লোকের তাৎপর্যে উল্লেখ করেছেন, “শ্রীরামচন্দ্র হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, এবং তাঁর ভাই ভরত, লক্ষ্মণ এবং শত্রুঘ্ন হচ্ছেন তাঁর অংশ। এই চার ভাই হচ্ছেন বিষ্ণু তত্ত্ব এবং তাঁরা কোনো অবস্থাতেই সাধারণ মানুষ নন। রামায়ণের বহু অসৎ এবং অল্পজ্ঞানী টীকাকার ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সাধারণ জীবাত্মা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ভগবত্তত্ত্ব-বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় সবচাইতে প্রামাণিত শাস্ত্র শ্রীমদ্ভাগবতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর ভাইয়েরা হচ্ছেন তাঁর অংশ-প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে শ্রীরামচন্দ্র হচ্ছেন বাসুদেবের অবতার, লক্ষ্মণ সঙ্কর্ষণের অবতার, ভরত প্রদ্যুম্নের অবতার এবং শত্রুঘ্ন অনিরুদ্ধের অবতার। এইভাবে তাঁরা সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের অংশ-প্রকাশ। লক্ষ্মী সীতাদেবী ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি। তিনি কোনো সাধারণ রমনী নন অথবা দুর্গার অবতার নন। দুর্গা হচ্ছেন ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি এবং তিনি শিবের সঙ্গিনী।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৪/৭) উল্লেখ করা হয়েছে যে, যখন ধর্মের গ্লানি হয় তখন ভগবান অবতরণ করেন, তেমনই এক পরিস্থিতিতে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির প্রকাশ, ভ্রাতাদের এবং লক্ষ্মীদেবী সীতাদেবীকে নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পিতা দশরথ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁকে গৃহত্যাগ করে বনে যেতে আদেশ দিয়েছিলেন এবং ভগবান তাঁর পিতার আদর্শ পুত্ররূপে, অযোধ্যার যুবরাজপদে অভিষিক্ত হওয়ার ঠিক পরেই তাঁর সেই আজ্ঞা পালন করেছিলেন। তাঁর এক কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণ এবং তাঁর নিত্য সঙ্গিনী সীতাদেবী তাঁর সাথে বনবাসী হতে বাসনা করেছিলেন। ভগবান তাঁদের উভয়েরই ইচ্ছার সমর্থন করেছিলেন এবং তাদের নিয়ে। দণ্ডকারণ্যে চৌদ্দ বছর বনবাসী হয়েছিলেন। বনে বাস করার সময় রামচন্দ্রের সঙ্গে রাবণের কলহ হয় এবং তার ফলে রাবণ তার রাজ্য এবং পরিবারসহ বিনষ্ট হয় এবং এইভাবে সেই কলহের সমাপ্তি হয়।
সীতাদেবী হচ্ছেন সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবী এবং কোনো অবস্থাতেই তিনি কোনো জীবের ভোক্তা নন। জীবের কর্তব্য হচ্ছে তাঁর পতি শ্রীরামচন্দ্রসহ তাঁর পূজা করা। রাবণের মতো জড়বাদী মানুষেরা এই মহান সত্য বুঝতে পারে না। পক্ষান্তরে তারা রামচন্দ্রের কাছ থেকে সীতাদেবীকে হরণ করার বাসনা করে মহা অপরাধ করে এবং তার ফলে গভীর দুঃখকষ্ট ভোগ করে। যে সমস্ত জড়বাদীরা জড় ঐশ্বর্য ও জড় সমৃদ্ধি লাভ করতে চায়, তাদের রামায়ণ থেকে এই শিক্ষা লাভ করা উচিত যে, পরমেশ্বর ভগবানের পরম পদ অস্বীকার করে তাঁর প্রকৃতিকে শোষণ করার পন্থা হচ্ছে রাবণের পন্থা। জাগতিক বিচারে রাবণ এতই উন্নত ছিল যে সে তার রাজধানী লঙ্কাকে সোনা দিয়ে বানিয়েছিলেন। কিন্তু সে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পরমেশ্বরত্ব স্বীকার না করে তাঁকে অবমাননা করে তাঁর সতীসাধ্বী পত্নী সীতাদেবীকে হরণ করেছিল এবং তার ফলে রাবণ ভগবানের হস্তে নিহত হয়। এবং তার সমস্ত ঐশ্বর্য এবং পরাক্রম ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র হচ্ছেন ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ ভগবানের পূর্ণ-অবতার, এবং তাই এই শ্লোকে তাঁকে কলেশঃ বা সমস্ত ঐশ্বর্যের ঈশ্বর বলে বর্ণনা করা হয়েছে।”
ভগবান রামচন্দ্র ছিলেন মহারাজ দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং রাজ্যের প্রজারা তাঁকে খুবই ভালবাসতেন। বৈদিক প্রথা অনুযায়ী যে কেউ একটি নির্দিষ্ট বয়সে পৌছালে তারা সকল দায়িত্ব কর্তব্য পরিহার করে শুধুমাত্র ঈশ্বরভাবনা তথা কৃষ্ণভাবনায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেন। মহারাজ দশরথও রাজা পদ থেকে নিবৃত্ত হয়ে তার পুত্র রামচন্দ্রকে সেই পদে অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রামের রাজ্য অভিষেকের সময় রাণী কৈকেয়ীর কাছে কৃত পূর্ব প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে রাজা দশরথ রামকে বনে যাওয়ার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। যেহেতু রাজা রামচন্দ্র ছিলেন একজন আদর্শ পুত্র, তাই তিনি তৎক্ষণাৎ কোনো প্রকার ইতস্তত না করে পিতার আদেশ শিরোধার্য বলে গ্রহণ করলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রজাগণ রামকে এতই ভালোবাসতো যে তারা সকলেই তার সাথে বনে গমনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ভগবান রাম বললেন, “না, আপনারা যদি সকলে আমার সাথে বনে গমন করেন তবে রাজ্যের কি হবে? আপনাদের সকলকে অবশ্যই অযোধ্যায় থাকতে হবে।” রামের ভাই লক্ষ্মণ এতই বেশি আসক্ত ছিলেন যে, তিনি তার বিচ্ছেদ বিরহ সহ্য করতে পারলেন না এবং শ্রীরাম তাকে বনে সাথে নিয়ে যাওয়ার সম্মত হলেন। একইভাবে সীতাদেবীও একজন আদর্শ সহধর্মিনীরূপে পতির সাথে বনে যাওয়ার জন্য এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে পতির সেবা করার জন্য উন্মুখ হলেন। বনে বসবাস করা অবস্থায় একজন শক্তিশালী অসুর রাবণ সীতাদেবীকে হরণ করে এবং তার রাজ্য লঙ্কায় নিয়ে যান।
যখন আমরা এই প্রকারের গল্প শুনি তখন হয়তোবা আমরা ভেবে অবাক হই যে, এইসকল কাহিনিগুলো কি বাস্তবিক নাকি শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনি? এই কাহিনিগুলো কি শুধুমাত্র মানুষকে বিনোদিত করার জন্য রচিত? এটি কি শুধুমাত্র নীতি আদর্শ শিক্ষা দান করছে নাকি মানুষকে কিছু নিয়ম নীতির জালে আবদ্ধ করে আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য প্ররোচিত করছে।” আমরা রামায়ণ কিংবা শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত ঘটনাসমূহকে সত্য বলে স্বীকার করি। আমরা জানতে পারি যে, রাবণের দশ মুণ্ড রয়েছে। কেউ হয়তোবা বলতে পারে, “কিভাবে কারো দশ মাথা থাকতে পারে? কিভাবে আপনারা আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন যে কোনো মানুষের দশ মাথা হতে পারে? এটি অবশ্যই কোন পৌরাণিক কাহিনি কিংবা কোন শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত রূপক গল্প হবে, এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।” কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে আমাদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি খুবই সীমাবদ্ধ এবং আমরা নিজেদের এই সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সব কিছু বিচার করতে পারি না। প্রাচীনকালের মানুষের তুলনায় বর্তমান মানুষের শারীরিক সক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা প্রতিনিয়ত লোপ পাচ্ছে। সুতরাং আমাদের এই সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কোনটি সম্ভব আর কোনটি সম্ভব নয় সেটি বিচার করা খুবই দুরূহ। কিন্তু পৌরাণিক যুগের লোকেরা অত্যন্ত শক্তিশালী ও উন্নত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। আমাদের মধ্যে হয়তোবা অনেকেই শুনেছি যে ভারতীয় যোগীরা রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী। এই ধরনের ক্ষমতার প্রদর্শন এখন তেমন একটা দেখা যায় না। কিন্তু পৌরাণিক যুগে এই ধরনের ক্ষমতার প্রদর্শন সর্বদাই দৃশ্যমান হত। শ্রীল প্রভুপাদ গত শতাব্দীর এমন এক যোগী সম্পর্কে আমাদের বলেছিলেন, তখন ভারতে ব্রিটিশ শাসন চলছিল। যোগীটি সাধারণ জনগণ এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিবস্ত্র অবস্থায় ধ্যান করতেন।
অগণিত বানর সৈন্য ভগবান রামচন্দ্রের সেবায় এগিয় এসেছিল। যেটির প্রকৃত সংখ্যা রামায়নে উল্লেখ আছে, যার মাধ্যমে রামায়নের মাধ্যমে বৃহৎ গণনার সর্বাধুনিক পদ্ধতি আমরা পেয়ে থাকি।
১ লক্ষ কোটি (১ ট্রিলিয়ন) কে বলা হয় ১ সংখু
১ লক্ষ কোটি সংখু কে বলা হয় ১ মহাসংখু
১ লক্ষ কোটি মহাসংখু কে বলা হয় ১ টি বৃন্দ
১ লক্ষ কোটি বৃন্দ কে বলা হয় ১ টি পদ্ম
১ লক্ষ কোটি পদ্ম কে বলা হয় ১ টি মহাপদ্ম
১ লক্ষ কোটি মহাপদ্ম কে বলা হয় ১টি খর্ব
১ লক্ষ কোটি খর্ব কে বলা হয় ১ মহাখব
১ লক্ষ কোটি মহাখব কে বলা হয় ১টি সমুদ্র
১ লক্ষ কোটি মহাসমুদ্র কে বলা হয় ১টি ওগ
১ লক্ষ কোটি ওগ কে বলা হয় ১ মহাওগ
এবং রামচন্দ্রের সেই বানর সেনাদের সংখ্যা ছিল। এরকম ১ লক্ষ কোটি মহাওগ পদাতিক বানর সেনা। ভগবান রামচন্দ্র এরকম বিশাল বানরবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। যা তাঁর ভগবত্তার আর একটি প্রকাশ।
ব্রিটিশ সরকার তাকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু তিনি তার যোগবলে নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করে তালার ছিদ্রের (keyhole) মধ্যে দিয়ে বের হয়ে পুনরায় রাস্তায় বিবস্ত্র অবস্থায় ধ্যান করতে শুরু করলেন। এরকম ঘটনা আরো তিন চার বার পুনরাবৃত্তি হলে ব্রিটিশ সরকার তাকে পুনঃপুনঃ গ্রেফতার করার প্রচেষ্ঠা থেকে বিরত হলেন। তারা বুঝতে পারেন যে তাকে বেঁধে রাখার প্রচেষ্ঠা একটি ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। এমনকি আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটও ভারত বিজয়ের সময় দেখেছিলেন এক যোগী প্রচণ্ড খর রৌদ্র তাপের মধ্যে অত্যন্ত শান্ত চিত্তে ধ্যান করছিলেন। এবং আলেকজান্ডার খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। তিনি যোগীকে বললেন, “আমি হলাম মহান আলেকজান্ডার এবং বিশ্বের রাজা। আমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী সবই দিতে রাজি আছি। তোমার যা ইচ্ছা তুমি আমার কাছে চাইতে পার। যোগীটি সরলভাবে উত্তর দিল- আপনি কি একটু সরে দাঁড়াতে পারেন। আপনার কারণে সূর্যের আলো ঠিকমত আসছে না।” পরবর্তীতে আলেকজান্ডার তার লোকেদের কাছে এই বার্তা পাঠালেন যে, এই ধরনের সন্তরা সাধারণ কেউ নন, তাদের সাথে রূঢ় আচরণ কোরো না। সুতরাং পূর্বতন লোকদের মন এবং ইন্দ্রিয়ের ওপর অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল। তাদের ছিল অলৌকিক শক্তি। এই ক্ষমতা বলতে সাধারণ পারমার্থিক ক্ষমতাকে বোঝায় কিন্তু মাঝে মাঝে স্বার্থপর কিছু অসাধু ব্যক্তি এই ধরনের ক্ষমতা অর্জন করে তাদের নিজেদের পাশবিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করে থাকে। অবশ্যই এখনকার লোকেরা অতটা ধার্মিক না। কিন্তু আমরা এই নীতির প্রায়োগিক ব্যবহার দেখতে পারি, যেমন একজন ধনী ব্যক্তির উচিত তার অর্থ অন্যের ভালোর জন্য ব্যয় করা অথবা কোনো দাতব্য উদ্দেশ্যে খরচ করা। তথাপিও অনেক ধনী ব্যক্তি তার অর্থ অসদ্ উদ্দেশ্যে ব্যয় করে থাকে। একইভাবে রহস্যময় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরাও তাদের ক্ষমতা অন্যের ভালোর জন্য বা অন্যের জন্য ব্যয় করতে পারেন। রাবণ তার ক্ষমতা অসদ্ উদ্দেশ্য ব্যবহার করেছিলেন এবং পরিশেষে ভগবান রামচন্দ্রের হাতে তাকে স্ববংশে নিশ্চিহ্ন হতে হয়েছে। রামায়ণের এই পৌরাণিক ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, আমরা জাগতিকভাবে অনেক ক্ষমতাধর হতে পারি, কিন্তু যদি আমরা নিজেদের সেই ক্ষমতাকে ভগবানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করি তবে পরিশেষে আমাদেরও স্ববংশে বিনাশ হতে হবে। কেউ হয়তো এই তর্কে লিপ্ত হতে পারে সবাইকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে, সকলেরই বিনাশ হবে। সেটি সত্য, এই জড় জগতের প্রত্যেককে মৃত্যুবরণ করতে হবে কিন্তু তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যখন ভক্ত দেহত্যাগ করে সে এক পারমার্থিক আনন্দে উপনীত হয় কিন্তু যখনই একজন দানব কিংবা পাশবিক হৃদয়ের মানুষ দেহ ত্যাগ করে তাকে একজন দাগী অপরাধীর মতো নারকীয় অবস্থার মধ্যে যেতে হয়। একজন ভক্ত তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে আনন্দময় বার্তা বয়ে নিয়ে আসে আর একজন অসুরিক ব্যক্তি অবক্ষয় নিয়ে আসে। যেমন রাবণ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এবং মাতা সীতাদেবীর চরণে অপরাধ করায় তার রাজত্ব ও পরিবার পরিজনদেরও বিনাশ প্রাপ্ত হতে হয়েছিল। অতএব আমাদের রামভক্তদের চরণে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং খুবই সতর্ক থাকতে হবে। যদিও রাবণ প্রত্যক্ষভাবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের চরণে অপরাধ করেননি, কিন্তু তিনি সীতাদেবীর চরণে প্রত্যক্ষভাবে অপরাধ করেছিলেন। তিনি সীতাদেবীকে অপহরণ করেছিলেন। যেহেতু সীতাদেবী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তাই ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাবণের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কেননা ভগবান তাঁর ভক্তদেরকে তার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। অতএব ভক্তদের চরণে অপরাধ হলো ভগবানের নিকট অপরাধ করা থেকেও বেশি মারাত্মক।
আরেকটি শিক্ষা হলো এই ভগবানের প্রদত্ত শক্তি ভগবানের সেবাকাজে ব্যবহার করা উচিত। যদি আমরা ভগবানের শক্তিকে নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি তাহলে পরিশেষে আমাদেরকে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হবে। অবশ্যই বর্তমান প্রযুক্তিবিজ্ঞান ভগবান এবং ভগবানের শক্তিকে আলাদাভাবে বিবেচনা করে থাকে। ভগবানের শক্তি উৎসগত ভাবে পারমার্থিক এটি যতক্ষণ ভগবানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকে ততক্ষণই এটি পারমার্থিক থাকে, কিন্তু যখনই ভগবানের শক্তিকে ভগবানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ভগবানের সেবা থেকে বিরত রেখে ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য সেই শক্তিকে অপব্যবহার করা হয় তখন এটি জাগতিক শক্তি হয়ে পড়ে অথবা বিচ্ছিন্ন শক্তি হয়ে পড়ে। সুতরাং আমার যা দেখছি এই জড় জগতের মৌলিক উপাদানগুলো যেমন মাটি, তরল, বায়ু সব কিছুই ভগবান হতে বিচ্যুত শক্তি। এইভাবে ভগবানের সকল সম্পত্তি ভগবানের উদ্দেশ্য ব্যয় হওয়া উচিত। যদি আমরা ভগবানের সম্পদকে কেড়ে নিয়ে ভগবানের সেবাভিন্ন নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যয় করি তবে আমরা ভগবানের চরণে অপরাধী হব এবং পরিসমাপ্তিতে এর চরম ফল প্রাপ্ত হব।
কিন্তু আমাদের ভগবানের সম্পত্তি চুরি করা ও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার অভ্যাস রয়েছে। বৈদিক সাহিত্য অনুসারে আমরা পরম পূর্ণ পুরুষের চিন্ময় অংশ কিন্তু আমরা অনাদিকাল আগে সেই পূর্ণ পুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক দেহ থেকে আরেক দেহ ভ্রমণ করছি। এই দেহান্তর প্রক্রিয়া ঘটছে এই জড় জগতে। আমরা ইন্দ্রিয় তৃপ্তির প্রচেষ্টাকে আরো উন্নত থেকে উন্নততর করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি তাই আমাদেরকে এই জড় জগতের এক দেহ থেকে অন্য দেহ অনন্তকাল ধরে পরিভ্রমণ করতে হবে। আর এভাবেই আমরা জন্ম মৃত্যুর চক্রে বন্দি হয়ে পড়ব। এই দুর্ভোগ শুধু জন্ম মৃত্যুর নয়, সাথে সাথে আরো বহু প্রকারের দুঃখ কষ্টও রয়েছে। এই জন্ম-মৃত্যুর দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হওয়ার একটি উপায় হচ্ছে ভগবানের প্রতি সেবাভাবে উপনিত হয়ে তার ধামে ফিরে যাওয়া। তার প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন না হয়ে সেবাভাব বজায় রাখা উচিত। যেহেতু আমরা এই জড় জগতের বদ্ধ জীব আমাদের মধ্যে নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জড় মানসিকতার প্রবৃত্তিটি হৃদয়ে অত্যন্ত গভীরভাবে রোপিত হয়েছে। মানসিকভাবে কামাসক্তি অথবা এই ধরনের বদ অভ্যাসগুলো শুধুমাত্র হরিনাম জপ করার মাধ্যমে পরিশোধিত হতে পারে। বিশেষ করে আমরা এই রাম নবমীর দিনে যা করছি “ভগবানের পবিত্র নাম জপ।” এই কলিযুগে ভগবানের পবিত্র নাম জপ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সেই নাম হচ্ছে- হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। সেই একই নাম যা আমরা জপ করছি।
কৃষ্ণভাবনামৃত কোনো সাম্প্রদায়িকতা নয়। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভগবানের অনেক নাম রয়েছে। ভগবানের সকল নামই অনন্য। একইভাবে ভগবানের সকল রূপ অনুপম। সুতরাং যদি কেউ মুসলিম বা বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান হয় তবে সে তার ধর্মের নির্ধারিত নাম জপ করতে পারে। তবে কেউ যদি হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করে তবে তার হৃদয় থেকে জড় আসক্তির বিনাশ ঘটে এবং কৃষ্ণের প্রতি বিশুদ্ধ প্রেমের উদয় হয়। আমরা যখন বিশুদ্ধ প্রেমের স্তরে উপনিত হই তখন আমাদের হৃদয়ে পরমেশ্বর ভগবানের আবির্ভাব ঘটে আর তখন আমরা ভগবানের সেবা মনোবৃত্তি নিয়ে সকল কর্ম সম্পাদন করতে পারি। শ্রীরামচন্দ্রের লীলা থেকে আমরা উপরোক্ত শিক্ষাসমূহ প্রাপ্ত হই।
উক্ত প্রবচনের ওপর ভিত্তি করে শ্রোতামণ্ডলীর
কিছু প্রশ্নের উত্তর:
ভক্ত : আমার দুটি প্রশ্ন আছে। রামায়ণের পৌরাণিক ঘটনাসমূহ বাস্তবিক বলে বিবেচনা করতে হবে কিন্তু সেই চরিত্রগুলোর মাঝে যে প্রতিকীরূপ রয়েছে তা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? দ্বিতীয়ত রাবণের প্রকৃত পরিচয় কী? যেহেতু তিনি বহু শুদ্ধ আত্মার সংস্পর্শে এসেছিলেন, বিশেষত ভগবান অন্তরঙ্গা শক্তি সীতা এবং ভগবান শ্রীরাম। তাই হয়তোবা তিনি সাধারণ কোনো অসুর ছিলেন না।
গিরিরাজ স্বামী : প্রথম প্রশ্ন মতে আমরা রামায়ণের যে ইতিহাস দেখছি সেটি মূলত বাস্তবিক এবং এটির বিভিন্ন চরিত্র বিভিন্ন প্রতীক নির্দেশ করছে। কেউ হয়তো বলতে পারে রাবণ হল অসুরের প্রতীক এবং রাম হল দেব তথা ধর্মের প্রতিক এবং রামায়ণ পাঠের মাধ্যমে আমরা দেখি যে দুষ্টের দমন হয় এবং সত্যের জয় হয়। কিন্তু এই ধরনের পদ্ধতিগত শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে আমরা পরমেশ্বর ভগবান হিসেবে শ্রীরামচন্দ্রের মহিমাকে ম্লান করি এমনকি রাবণকেও কেবলমাত্র একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলে মনে করি। তাই আমাদের বলা উচিত নয় যে এই শাস্ত্রসমূহ প্রতিকী যা কিছু শিক্ষা দেয় মাত্র। বরং আমরা বলতে পারি যে এই শাস্ত্রসমূহে বর্ণিত ঘটনাসমূহ হল বাস্তবিক এবং এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিক আলোচিত হয়েছে যা শ্রবণ, পঠন কিংবা আলোচনার মাধ্যমে আমরা উপকৃত হতে পারি।
যেমন, একজন ছোট্ট শিশু হয়তোবা আগুনে হাত দিতে পারে এবং এতে তার হাত ঝলসে যেতে পারে। কিন্তু এই ঘটনা শ্রবণ করে আমরা বলতে পারি না যে শিশু এবং আগুন হল প্রতিকী রূপ মাত্র, কেননা এটি হল বাস্তবিক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করতে পারি যে কখনো আগুনে হাত দেওয়া উচিত নয়।
একইভাবে রাবণের উদাহরণ থেকে আমরা শিক্ষা প্রাপ্ত হতে পারি যে ভগবানের বিরুদ্ধাচরণ করা উচিত নয়। এছাড়াও ভগবানের ভক্ত এবং দৈত্য অসুরদের বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা আরো বিভিন্ন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
বৈদিক শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে বৈদিক জ্ঞান পরম্পরা ধারায় অধিষ্ঠিত একজন সদগুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত হতে হয়। আমাদের ক্ষেত্রে, আমরা শ্রীল প্রভুপাদের অধ্যক্ষতায় বৈদিক জ্ঞান আহরণ করি এবং তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের ৪র্থ স্কন্ধে বলেছেন যে, শ্রীমদ্ভাগবত হল রূপক শিক্ষা কিন্তু সেখানের সকল ইতিহাস বা ঘটনা বাস্তবিক ।
ভক্ত : আমি শুনেছি যে শ্রীমদ্ভাগবত অনুসারে কৃষ্ণ যে বিবিধ অসুরদের সংহার করছিলেন তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন প্রতিক বহন করে যেমন অনর্থ, কাম ইত্যাদি।
গিরিরাজ স্বামী : একজন উন্নত ভক্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গকে একটি বিশেষ গোত্র বা একটি বিশেষ আদর্শের প্রতিনিধিরূপে গণ্য করে। আমার একজন ইহুদী বন্ধুর সাথে কথা হয়। তাদের একটি অনুষ্ঠান রয়েছে ‘ফেস্টিভ্যাল অব পাসওভার’ নামে। এই বিশেষ সময়ে তারা গৃহের সমস্ত শস্যদানা ঘরের বাইরে নিয়ে আসে এবং গৃহকে সমস্ত পাপ এবং অসদ গুণ থেকে মুক্ত করে। তাদের মধ্যে একটি অসদ গুণ হল গর্ব করা এবং বাইবেলের একটি ভাষ্য মতে, ফেরোদের গর্বের প্রতিকরূপে গণ্য করা হয় এবং যখন মূসা ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে ফেরোদের সম্মুখে এলেন তখন ফেরোরা বললেন যে, “কে সেই ঈশ্বর যার কথা আমাকে শুনতে হবে? আমি কারো কথা মেনে চলি না। সকলে আমার কথা শুনে।” এরপর ভাষ্য মতে, ফেরোদের কাছে দশবিধ ঈশ্বর প্রদত্ত সত্তাপ বা প্লেগ পাঠানো হয়। এই প্রত্যেকটি প্লেগ ভিন্ন ভিন্ন শয়তান কিংবা রোগের প্রতিকীরূপে কাজ করে। আমাদের মতে যে কোনো এক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন একাগ্রচিত্ত ব্যক্তি এমন এক পারমার্থিক চেতনার স্তরে পৌছাতে পারেন তখন তিনি যেকোনো বিষয়ের গভীরতম অর্থ দর্শন করতে সক্ষম হন। তখন পারমার্থিক শাস্ত্রের জ্ঞানে পরিপূর্ণ সত্তাগণ যেকোনো শাস্ত্রের বিভিন্ন ঘটনার গভীরতম অর্থ বিস্তৃতভাবে এবং সঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন।
শ্রীমদ্ভাগবত অনুসারে রাবণ কোনো সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ভগবানের একজন সেবক, কিন্তু অভিশাপগ্রস্থ হওয়ার কারণে তিনি এমন শক্তিশালী অসুরে পরিণত হন যাকে হত্যার জন্য স্বয়ং ভগবান পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন। সৃষ্টির মধ্যে স্বয়ং সৃষ্ট জীবের প্রতি ভগবানের করুণা রয়েছে। তাই কখনো কখনো ভগবান আনন্দ লাভের জন্য মল্লযুদ্ধ করে থাকেন। কিন্তু ভগবানের সাথে কে যুদ্ধ করতে পারে? নিঃশ্চয়ই প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ শক্তিশালী কেউ সেই ক্ষমতা লাভ করতে পারে। তাই ভগবানের ইচ্ছাতেই একজন মহান ভক্ত রাবণরূপে এসে ভগবানের সাথে যুদ্ধ করলেন। রাবণের সীতাহরণ সম্পর্কে বলতে গেলে শাস্ত্রানুসারে যেহেতু গদেবা সম্পূর্ণরূপে চিন্ময় শক্তি, তাই তিনি কখনোই অসুর দ্বারা স্পর্শিত হতে পারেন না। এমনকি কোনো অসুর তাকে দর্শন পর্যন্ত করতে পারে না। তাই রাবণ যে সীতাকে হরণ করেছিল তা ছিল মূলত মায়া সীতা, প্রকৃত সীতাদেবী ছিলেন লুকায়িত। যখন রাবণ নিহত হয় এবং সীতা মুক্ত হন তখন প্রকৃত সীতা পুনরায় ফিরে আসেন।
শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখা করেছেন যে কেউ যদি শুধুমাত্র হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করে, সে শুধুমাত্র এই জপের মাধ্যমে প্রকৃত উৎকর্ষ লাভ করতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান লাভ করতে চায় তবে তার জন্য রয়েছে বহু গ্রন্থ। এই ধরনের জিজ্ঞাসু ব্যক্তিগণের বুদ্ধিমত্তা থাকলে তারা গ্রন্থের গভীর থেকে গভীরতম প্রদেশের উপলব্ধিতে পৌছাতে পারে। বৈদিক শাস্ত্রাদি থেকে আহরিত পরমেশ্বর ভগবান সম্পর্কিত জ্ঞানসমূহ হচ্ছে অসীম সমুদ্রের মতো।
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ আমাদের হৃদয়কে সকল জাগতিক কলুষতা থেকে নিবৃত্ত করে। শ্রীল প্রভুপাদ বলেন আমরা যদি একটি বৃক্ষের সম্মুখ দিয়ে যায় এবং যদি সেখানে কোন কালো পাখি। বসে থাকে, তবে আমাদের হাতের তালির শব্দের মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা সেই পাখিগুলোকে তাড়াতে পারি। ঠিক একইভাবে শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন যে, হরে কৃষ্ণ জপ করার মাধ্যমে আমাদের হৃদয় অবস্থিত কালো পাখিরূপ কাম, লোভ এবং অহংকারকে আমরা তাড়াতে পারব। আমরা যতই ধ্যান হিসেবে জপের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করব ততই ভগবানের প্রতি আমাদের প্রার্থনা আমাদের হৃদয়কে নির্মল করবে এবং পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং ভক্তি হবে শিশুর মতো- যত বেশি আমরা সেই ভাবে প্রবেশ করব তত বেশি এটি আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তাই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ বাস্তবিকপক্ষে আমাদের খুবই প্রয়োজন। এটি একটি পরিপূর্ণ পন্থা। সেই সাথে সাথে কৃষ্ণভাবনার দর্শন সম্পর্কে উপলব্ধি করাও গুরুত্বপূর্ণ কেননা এর মাধ্যমে আমাদের অন্যদের শিক্ষা প্রদান এবং অন্যের সাথে ভাবের আদান প্রদান করা সহজতর হয়। হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ আমাদের জীবনে গভীর আনন্দ নিয়ে আসে কেননা এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের স্বরূপ জানতে পারি। আমরা অবগত হই যে আমরা হলাম চিন্ময় আত্মা এবং আমরা এই বিভিন্ন জড় শরীরে আবদ্ধ আছি, ঠিক যেমন আমাদের দেহ বিভিন্ন পোশাকে আবৃত থাকে। হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ আমাদের প্রকৃত আনন্দ ও আশীর্বাদ জাগিয়ে তোলে এবং আমরা নিজেদের প্রকৃত সত্ত্বা তথা পারমার্থিক প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হই।
শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী শিকাগোর এক সম্মানিত বিচারকের একমাত্র পুত্র। ১৯৬৯ সালে বোস্টনের ব্রান্ডিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় শ্রীল প্রভুপাদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। পরবর্তীতে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর শ্রীল প্রভুপাদ থেকে দীক্ষা নেওয়ার পর নাম হয় গিরিরাজ দাস। তিনি বৃন্দাবনের গোবর্ধনে ভক্তিবেদান্ত আশ্রম, নারীদের জন্য কীর্তন আশ্রম, ভক্তিবেদান্ত হসপিস এবং বৃন্দাবন ইনস্টিটিউট উন্নয়নের জন্য সেবা করে গেছেন। বর্তমানে তিনি বিশেষভাবে গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছেন।
অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড