রামায়ণ (পর্ব-১)

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২০ | ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২০ | ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 730 বার দেখা হয়েছে

রামায়ণ (পর্ব-১)

বিশ্বজুড়ে আদৌ কি বৈদিক সংস্কৃতি ছিল?

অমরেন্দ্র দাস (ভাষান্তর: এলবিন দাস)

অনেকেরই মতে, প্রাচীন রামায়ণ শুধুমাত্র ভারতীয় সংস্কৃতির একটি মহাকাব্য রূপেই পরিচিত। কিন্তু অজানা বিষয়টি হলো, সমগ্র পৃথিবীতে রামায়ণের প্রায় ৩০০টিরও অধিক সংস্করণের প্রচলন দেখা যায়। তাই বলা চলে, রামায়ণ শুধুমাত্র ভারতীয় একটি সংস্কৃতিই নয় বরং তা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত একটি সভ্যতা।  


আমরা প্রত্যেকেই অবগত, রামায়ণ এবং মহাভারত আমাদের সংস্কৃতির একটি অনবদ্য অংশ। এই ভারতীয় বৈদিক পাঠ্য রামায়ণ এবং মহাভারত শুধুমাত্র পৌরাণিক শাস্ত্র হিসেবেই নয়, বরং তা প্রাচীন ইতিহাস রূপেও বিবেচিত। যা খুবই অপ্রাকৃত। কেবল ভারতবর্ষে না, সমগ্র পৃথিবী জুড়েই রামায়ণের একটি বৃহৎ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এশিয়া এবং ইউরোপীয় দেশ যথা: তিব্বত, বার্মা, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, চীন, মঙ্গোলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে রামায়ণ জড়িয়ে রয়েছে। চলুন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সমূহে রামায়ণের প্রভাব সম্পর্কে তত্ত্বানুসন্ধান করা যাক :

থাইল্যান্ডে রামায়ণ

থাইল্যান্ডের চলমান বিভিন্ন সংস্কৃতিতে রামায়ণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সেখানে স্থানীয়ভাবে যে রামায়ণটি প্রচলিত তাকে স্থানীয় থাইভাষায় “Ramakien” বা রামা-কিয়ান বলা হয়। যদিও এটি ভারতবর্ষে রামায়ণ নামে পরিচিত, কিন্তু থাইল্যান্ডে একই রামায়ণ “রামা-কিয়ান” হিসেবে খ্যাত। এটি থাইল্যান্ডের একটি জাতীয় গ্রন্থও বটে। এর কাহিনী সূত্রে বর্ণিত রয়েছে, পুরাকালে শ্রীরাম নামক একজন মহৎ রাজা ছিলেন। যার সীতা নামে একজন পত্নী ছিলেন। থাইল্যান্ডীয় সংস্কৃতি মনে হলেও মূল রামায়ণের সাথে এটি বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। শুধু রামা-কিয়ানই নয়, প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে থাইল্যান্ডের রাজধানীতে অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর “Ayuthaya” বা “আইয়ুধ্যা” হিসেবে পরিচিত ছিল। যা ভারতের রামরাজ্য অয্যোধ্যা শব্দটির সাথে অনেকটাই মিলে যায়।

সারা বিশ্বে রামায়ণের সংস্করণ


১. শ্রীলঙ্কায় রামায়ণ গ্রন্থটির নাম “Janakiharan” হিসেবে বিখ্যাত।
২. মালেশিয়ায় মালয় ভাষায় রচিত রামায়ণটির নাম “Hikayat Seri Rama”
৩. স্থানীয় থাইভাষায় “Ramakien” বা রামা-কিয়ান বলা হয়।
৪. বার্মায় রামায়ণের নাম (Yamayana) বা “ইয়ামায়ান”।
৫. লাউসে প্রচলিত রামায়ণটির নাম “Phra Lak Phra Ram” যা বাল্মীকি রামায়ণ মতে রচিত।
৬. ইরানে যে রামায়ণটি প্রচলিত তার নাম “Dastan-e-Ram O Sita।”
৭. দক্ষিণ এশিয় দেশ নেপালে দুটি পৃথক ভাষায় রামায়ণ রচিত। একটি হল প্রধান নেপালি ভাষায়, যার নাম “Bhanubhaktako Ramayan” এবং অন্যটি হল “খাস” ভাষায় যা “Bhanubhaktako Ramayan” নামে পরিচিত।
৮. কম্বোডিয়ার প্রচলিত রামায়ণ Ramakerti (রামকীর্তি) নামে পরিচিত।
৯. চীনে রামায়ণ “Liudu-ji-Jing”
১০. ফিলিপাইনে সংস্করণকৃত রামায়ণটির নাম “Maharadia Lawana”

থাইল্যান্ডের অন্য একটি প্রাচীন শহর “লবপুরী” যা রামের পুত্র লবের নামে নামকরণ করা হয়। বিগত ২০০ বছরের মধ্যে থাইল্যান্ডে প্রায় নয় জনেরও অধিক রাজার রাজত্বকালে ছিল, যাদের শ্রীরামের উত্তরাধিকারীরূপেই বিবেচনা করা হয়। পূর্ব শতাব্দীতে, এসমস্ত রাজাদের নামের পূর্বে “রাম” শব্দটি সংযোজন করা হত। থাইল্যান্ডে “রামা কিয়ান” নামক রামায়ণটি বেশ জনপ্রিয় এবং থাইল্যান্ডের বিভিন্ন নাটক ও নৃত্যকলায় এর বিভিন্ন প্রভাব দর্শন করা যায়। এছাড়াও থাইল্যান্ডের বহুল পরিচিত ঐতিহাসিক থাই বক্সিং প্রাচীন রামায়ণের ঐতিহ্য মতেই প্রচলিত হয়ে আসছে। থাই বক্সিং এর কিছু ধাপ যেমন: হনুমান কিক্ (Hanuman kick), হনুমান হোল্ড (Hanuman Hold), অঙ্গদ ফ্লাইট (Anggad flight) নামে পরিচিত, যা রামায়ণ থেকেই আসা। এভাবে, রামায়ণের অনেক ঐতিহ্যই বর্তমানে থাইল্যান্ডের সংস্কৃতিতে স্থান পেয়েছে।

বার্মায় রামায়ণ

বার্মায় প্রচলিত রামায়ণটির নাম (Yamayana) বা “ইয়ামায়ান”, যা বার্মার একটি জাতীয় মহাকাব্য। এটিকে (Yama-zatdaw) “ইয়ামা-জাটদাও” নামেও বলা হয়। বার্মার রামকে “ইয়ামা” বা (Yama) এবং সীতাকে “মি-থিডা” বা (Me-Thida) বলা হয়।

ইথিওপিয়ায় রামায়ণ

ইথিওপিয়ার ইতিহাসে এই সূত্রে একটি কাহিনি রয়েছে, একবার ভারতবর্ষ হতে এক সাধু ইথিওপিয়ার তৎকালীন রাজা “হাইলি সেলাসি”কে (১৮৯২-১৯৭৫) রামায়ণের একটি খণ্ড উপহার দিয়েছিলেন। রাজা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, গ্রন্থটি সম্পর্কে? সাধু তখন রাজাকে জানালেন, গ্রন্থটি শ্রীরাম নামক এক মহৎ রাজার সম্পর্কে, যিনি যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার একদিন পরই বনবাসে গমন করেন। সেখানে ভয়ঙ্কর রাক্ষস রাবণ তাঁর পত্নী সীতাকে হরণ করেন। ইথিওপিয়ার রাজা এটি শুনে প্রত্যুত্তরে বলেন, তিনি এই কাহিনিটি সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই জানেন। কারণ, তারা “কুশাইট” বংশ হতে আগত। তখন সাধু রাজাকে “কুশাইট” শব্দটির অর্থ জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু, রাজার নিকট এর কোন উত্তর ছিল না। পরবর্তীতে সেই বৈষ্ণব সাধু তার নিজ দেশে ফিরে আসেন এবং হাল না ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভৌগোলিক গঠন চিত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ইতিহাসের এক পর্যায়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, ত্রেতাযুগে শ্রীরাম তাঁর রাজত্বের শেষ সময়ে সমগ্র পৃথিবীকে দুটি অংশে ভাগ করেন। একটি অংশ ছিল তাঁর পুত্র লব এবং অন্য অংশটি ছিল পুত্র কুশের। কুশের অংশে একটি শোভনীয় দ্বীপ ছিল। যার নাম পরবর্তীতে “কুশক্ দ্বীপ” রাখা হয়। কুশকদ্বীপ হতেই “কুশাইট” বংশটির আবির্ভাব ঘটে এবং বর্তমান ইথিওপিয়া সেই কুশক্ দ্বীপের উপরি-ভাগেই অবস্থিত। তাই, রাজা নিজেকে “কুশাইট” বংশীয় রূপে পরিচিতি দেন।

মরিশাসে রামায়ণ

রামায়ণ কাহিনিতে দেখা যায়, ভগবান রাম কর্তৃক তাড়কা রাক্ষসী বধের পর তাঁর পুত্র অসুর মারীচ শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন। কিন্তু, ভগবান তাকে হত্যা করেননি বরং তিনি শুধু তার বক্ষে একটি বাণ নিক্ষেপ করেন। যার ফলে মারীচ শতযোজন দূরে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়।
রামায়ণে আদিকাণ্ড একত্রিংশ সর্গে (৩১) এর উল্লেখ রয়েছে –

ইত্যুক্ত্বা বচনং রামশ্চাপে সন্ধায় বেগবান্॥ ১৬
মানবং পরমোদারমস্ত্রং পরমভাস্বরম্।
নিক্ষেপ পরমক্রুদ্ধো মারীচোরসি রাঘবঃ ॥ ১৭

‘এই কথা বলে রঘুকুলতিলক শ্রীরামচন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শক্তিশালী ও তেজস্বী মানব নামক অস্ত্রটি ধনুকে যোজনা করে মারীচের বক্ষে নিক্ষেপ করলেন।

স তেন পরমাস্ত্রেণ মানবেন সমাহতঃ।
সম্পূর্ণং যোজনশতং ক্ষিপ্তঃ সাগরসংপ্লবে ॥ ১৮

‘সেই ভয়ানক মানবাস্ত্রের প্রহারে আহত হয়ে মারীচ শতযোজন দূরে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষিপ্ত হল।
তখন মারীচ উপলব্ধি করতে পারলেন, রামের একটি বাণই কত ভয়ানক! তাই সে আর যুদ্ধ করতে চাইল না এবং যেখানে সে পতিত হল সেই দ্বীপেই সে পারমার্থিক জীবন অনুশীলন করা শুরু করল এবং একজন সাধুতে পরিণত হল। সেই দ্বীপটিতে মারীচের পরিবার “মৌরিচাস” নামে খ্যাত ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী সেই দ্বীপটিই বর্তমানে “মরিশাস”।

সূত্র: ব্যাক টু গডহেড ( এপ্রিল – জুন) ২০২০ সালে প্রকাশিত।

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ও ব্যাক টু গডহেড এর ।। গ্রাহক ও এজেন্ট হতে পারেন

প্রয়োজনে : 01820-133161, 01758-878816, 01838-144699

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।