এই পোস্টটি 380 বার দেখা হয়েছে
ব্রজবাসীরা কুরুক্ষেত্রে গেলেন কৃষ্ণকে দেখতে। যখনই তাঁরা সুযোগ পেতেন, তাঁরা কৃষ্ণকে দেখতে চাইতেন। ঠিক যেমন এইসব গোপবালকেরা যখন দিল্লীর কাছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল…. বৃন্দাবন দিল্লী হতে বেশি দূরে নয়। এটি প্রায় নব্বই মাইল। সেজন্য তাঁরা, যুদ্ধক্ষেত্রে সারথির বেশে কৃষ্ণকে দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁরা কৃষ্ণকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা ভাবতে লাগলেন, “কৃষ্ণ আমাদের সখা, গোপবালক। কেমন করে এটা সম্ভব হতে পারে যে, সে এখন রথে চেপে যুদ্ধ করছে?” এজন্য তারা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
সুতরাং এই হচ্ছে বৃন্দাবন লীলা। সেজন্য তেমনিভাবে, যখন ব্রজবাসীগণ ভগবান কৃষ্ণকে জগন্নাথকে দেখতে গেলেন…..। কৃষ্ণ অর্থ জগন্নাথ । জগৎ…..জগতের নাথ, প্রভু। কৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলেন, “ভোক্তারং যজ্ঞ তপসাং সর্বলোক মহেশ্বরম্ (ভ. গী. ৫/২৯)– “আমি সকল গ্রহলোক সমূহের ভোক্তা।”
সেজন্য তিনি হচ্ছেন জগন্নাথ। জগন্নাথ অর্থ সমগ্র জগৎ, সকল গ্রহলোক সমূহের অধীশ্বর। সুতরাং বৃন্দাবনের অধিবাসীগণ কৃষ্ণকে দেখতে গিয়েছিলেন কেননা কৃষ্ণ ছিল তাঁদের জীবন। তাঁরা কৃষ্ণ ছাড়া কিছু জানতেন না। অতএব সেটা ছিল একটি সুযোগ। সেজন্য এটা ছিল কৃষ্ণের কাছে রাধারাণীর অনুরোধ, “প্রিয় কৃষ্ণ! তুমি সেই একই কৃষ্ণ; আমিও সেই একই কৃষ্ণ; আমি সেই একই রাধারাণী। আমরা পরস্পর সাক্ষাৎ করছি, কিন্তু আমরা একই স্থানে সাক্ষাৎ করছি না। এখানে তুমি একজন রাজা, তোমার কত রথ, সৈন্য-সামন্ত, মন্ত্রি, সচিবেরা রয়েছে। আর ওখানে বৃন্দাবনে তুমি ছিলে একজন গোপবালক, আর বনে নানা কুঞ্জবীথিতে আমাদের সাক্ষাত হত। অতএব আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে চাই। তাহলে আমি খুব খুশি হব।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এমন ভাবই প্রকাশ করেছিলেন, কেননা তিনি রাধারাণীর ভাব অবলম্বন করে ভগবৎ-আরাধনা করতেন। রাধাকৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতিহ্লাদিনী শক্তিরস্মাদেকাত্মানাবপিভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ (চৈ.চ. ১/৫) এই দর্শন হচ্ছে কৃষ্ণ…..রাধা কৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতির। রাধা-কৃষ্ণের সেই প্রণয় ব্যাপার, সেই প্রেম কি? এটা কি একটি তরুণ ছেলে ও তরুণী মেয়ের খেলার মতো? নিশ্চয়ই। এটা ঠিক ওই রকমই। এটা ওইরকম মনে হয়, আর প্রকতৃপক্ষেও ওটা ওইরকম। কিন্তু এটা এই জড় জগতের তরুণ তরুণীর প্রেমের খেলার মতো নয়। না। এটি তাঁর আহ্লাদিনী শক্তির সাথে পরম পুরুষ ভগবানের লীলাবিলাস। রাধাকৃষ্ণ প্রণয়বিকৃতিহ্লাদিনীশক্তির। ঠিক যেমন এই জড় জগতে জড় গুণগুলি রয়েছে; সত্ত্বগুণ, রজোগুণ, তমোগুণ। ঠিক তেমনি, চিন্ময় জগতে তিনটি শক্তি-সম্বিৎ, সন্ধিনী এবং আহ্লাদিনী । সেই আহ্লাদিনী শক্তি হচ্ছেন কৃষ্ণ।
এসব বিষয়ে শ্রীল জীব গোস্বামী এই বিষয়টি আরো পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে কৃষ্ণ হচ্ছেন পরম ব্রহ্ম। ভগবদ্গীতায় অর্জুন তা স্বীকার করেছেন। পরমব্রহ্ম পরম ধাম পবিত্রয় পরমং ভবান। পরম ব্রহ্ম, অর্থাৎ পরম সত্য। এখন, এই জড়জগতে বিভিন্ন ধরনের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি। গোপিকাদের সাথে কৃষ্ণের প্রণয়লীলাও কি একই রকম? না। সেটাই হচ্ছে তাঁর দার্শনিক উপস্থাপনা। তিনি এই যুক্তি দেন যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন পরম ব্রহ্ম, কিন্তু এখানে এই জড় জগতে আমরা দেখি যে, পরম ব্রহ্মে আসক্ত হতে বা পরমব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি, এই জড় জগতের সবকিছুই পরিত্যাগ করে। সেটাই হচ্ছে শঙ্করাচার্যের মতবাদ। তিনিই বলে গেছেন ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।
সুতরাং পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তোেল।
শঙ্করাচার্যের ত্যাগ-বৈরাগ্য, তপশ্চর্যা খুবই কঠোর। প্রথমে সন্ন্যাস গ্রহণ কর তারপর পরম ব্রহ্মের কথা বল। সেটাই হচ্ছে শঙ্কর সম্প্রদায়। আমাদের বৈষ্ণব সম্প্রদায়, চৈতন্য মহাপ্রভুর সম্প্রদায় একটু ভিন্ন। আমরা এই জড়জগতের সবকিছুর সর্বোত্তম উপযোগ করতে পারি। সেটিই হচ্ছে শঙ্কর দর্শন ও বৈষ্ণব দর্শনের মধ্যে প্রভেদ। জগৎ মিথ্যা নয়, কেননা এটি পরম সত্যবস্তু হতে উদ্গত হয়েছে। যে এটির সদ্ব্যবহার জানে না তার কাছে এটি মিথ্যা। তারা মিথ্যার পেছনে ছুটছে। জগতের সবকিছুরই পরমেশ্বর ভগবানের সাথে সম্বন্ধ রয়েছে। ঈশাবাস্যমিদং সর্বং। সব পদার্থ যেমন-লোহা, কাঠ, ধাতু এসবই কৃষ্ণের শক্তিপ্রসূত। যেহেতু শক্তি শক্তিমানের জন্য ব্যবহৃত হয়, ঠিক তেমনি কৃষ্ণের শক্তি হতে যা কিছু উৎপন্ন হয়েছে সবই তাঁর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। সেটাই হচ্ছে আমাদের দর্শন। কোন কিছুই আমরা ইন্ড্রিয়তৃপ্তির জন্য গ্রহণ করি না। সেটাই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত। শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেন,
অনাসক্তস্য বিষয়ান যথাহমুপযুঞ্জতঃ ।
নিবন্ধ কৃষ্ণসম্বন্ধে যুক্তং বৈরাগ্যমুচ্যতে ॥
কৃষ্ণের সম্পত্তিতে তোমার আসক্ত হওয়া উচিত নয়। কর্মীরা কৃষ্ণের সম্পত্তিতে আসক্ত। তারা কৃষ্ণের সম্পত্তি চুরি করে, বে-আইনিভাবে ভোগ করার চেষ্টা করছে। আর তথাকথিত জ্ঞানীরা কৃষ্ণের সম্পত্তি ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। জ্ঞানীরা এই ভেবে গর্বিত যে, তাঁরা জ্ঞানে খুব উন্নত এবং ত্যাগী, বৈরাগ্যবান। কিন্তু কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, “মশাই, আপনি কি ত্যাগ করছেন?” “এই জগৎ।”
আচ্ছা বেশ। এই জগৎটি কখন আপনার সম্পত্তি ছিল যে, আপনি এখন তা ত্যাগ করছেন? আপনি কোন কিছু তখনই ত্যাগ করতে পারেন যখন আপনি সেটির মালিক থাকেন। কিন্তু যদি কোন কিছুই আপনার অধিকারভুক্ত না থাকে, তাহলে বিষয় ত্যাগের অর্থ কি? আপনি এখানে খালি হাতে এসেছিলেন, এখানে কিছুকাল বেঁচে রয়েছেন, তারপর চলে যাবেন। সুতরাং শুরুতে আপনি কিছুর মালিক নন, যখন আপনি চলে যাবেন তখনও আপনি কিছুর মালিক নন। তাহলে আপনার ত্যাগের মানেটা কি? এটাই হচ্ছে তাঁদের ত্রুটি ।
সুতরাং আমরা কিছু ত্যাগ করি না। আমরা চিন্তা করি, যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি তা সবই আমাদের কাছে কৃষ্ণের দান। তেন ত্যজেন ভুঞ্জীথা। কোন কিছুই আমার নয়, সবকিছুই কৃষ্ণের সম্পত্তি। আমার শরীর, মন, ভাবনা, কথাবার্তা আমি যা কিছু সৃষ্টি করি সবই কৃষ্ণের। এই হচ্ছে কৃষ্ণ দর্শন এবং এটিই বাস্তব সত্য।
এই জগন্নাথ রথযাত্রা কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের অংশ কেননা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন নতুন কিছু নয়। ভগবদ্গীতা থেকে আমরা জানতে পারি এটি পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন এবং ভগবদ্গীতায় এই আন্দোলনের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পারি যে, এটি প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বছরের প্রাচীন। আধুনিক যুগে এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন, হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের সূচনা করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, আর এই রথযাত্রা সেই আন্দোলনের অংশ। ।। হরেকৃষ্ণ ।।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, জুন-২০১২ ইং সংখ্যায় প্রকাশিত