মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ পদক্ষেপ

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২১ | ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২১ | ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 173 বার দেখা হয়েছে

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ পদক্ষেপ

চৈতন্য চরণ দাস

যখন প্রভুপাদ আমেরিকা গমনের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন ভারতে তার যৎসামান্যই সফলতা ছিল। তিনি বিবিধ উপায়ে প্রচেষ্টা করেছিলেন, তিনি নিজে ব্যবসা শুরু করেছিলেন যাতে তাঁর গুরুদেবের মিশনে আর্থিক অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু সে ব্যাবসাগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ল। তিনি ‘লীগ অব ডেবোটিস’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছিলেন কিন্তু সেটিও থমকে গিয়েছিল। তিনি ব্যাক টু গডহেড পত্রিকা প্রচার শুরু করেছিলেন। এই পত্রিকা প্রচারের সময় পথে ষাঁড়ের আক্রমনে আহতও হয়েছিলেন। কাঠফাটা রোদের প্রখরতা সহ্য করতে না পেরে একদিন তিনি রাস্তায় বেহুশ হয়ে পড়েও যান। পর্যায়ক্রমে এটিও সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। তিনি তাঁর গুরুভ্রাতাদের সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মিশনের প্রচার প্রসারের দূরদর্শিতা ছিল না। তিনি কিছু পারমার্থিক গ্রন্থ রচনা করে তাতেও সফল হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সাধারণ লোকেরা সেগুলোকে হৃদয় পরিবর্তনের জন্য একনিষ্ঠভাবে প্রয়োগ সাধনের গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করার পরিবর্তে তথাকথিত ধর্মীয় আবেগপ্রবণ গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে ভারতে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি প্রথমদিকে অসফল হয়েছিলেন। সাধারণ লোকেদের ক্ষেত্রে যখন কেউ ক্রমাগত শুধু ব্যর্থ হতে থাকে তখন তা সেই ব্যক্তির মন ভেঙে দেয়। যখন তারা হয়ত আমেরিকার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হতে চায়। তখন কোনো এক ভারতীয় ভাবে, যাক হয়তো আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারিনি, তবে আমি ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে চেষ্টা করব। যখন সেটিও অসফল হয় তখন ভাবে, “ও আচ্ছা তাহলে আমি আমার কোম্পানির সিও হবো।” তখন সে তার ক্যারিয়ার নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। সে দেখে জীবন কতটা জটিল প্রকৃতির। জীবনে শান্তি লাভ করাটা কত কঠিন। সে সময় যখন সে তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তখন অবশেষে তার চিন্তাধারা হয়, অন্তত একটি চাকুরি পেলেই আমি সুখী হবো। আসলে আমাদের জীবনের কাঠামোটিতে তিক্ততা পেতে পেতে আমাদের লক্ষ্যগুলোও ধীরে ধীরে উল্টো দিকে নিচে নামতে নামতে একসময় ক্ষুদ্র হয়ে যায়। কিন্তু এখানে শ্রীল প্রভুপাদের জীবনের প্রতিকূলতা তাকে অনেক বার প্রহার করতে করতে তিনি জীবনের অস্তমিত সূর্যের বছরে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর বয়স তখন ৬৯ বছর এবং তাঁর কোনো কিছুই ছিল না। ছিল না ব্যবসা, ছিল না পরিকর, এমনকি একজন সন্ন্যাসী হিসেবেও তার সেসময় কোনো অনুসারী ছিল না, ছিল না কোনো অর্থ। সেরকম একটি সময়ে পুনঃ পুনঃ তার সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পরও তাঁর লক্ষ্য সংকুচিত হওয়ার পরিবর্তে, প্রভুপাদ তাঁর লক্ষ্যকে আরো অধিক প্রসারিত করেছিলেন।
তিনি এভাবে ভাবছিলেন না, “ও আমি ভারতেই সফল হইনি, তবে আমেরিকায় কিভাবে সফল হব?” কিন্তু প্রভুপাদ ভেবেছিলেন যে, ‘যদি আমি ভারতে সফল হতে না পারি তো আমেরিকায় সফল হবো।” তার চিন্তা-ভাবনা এতটা ইতিবাচক ছিল। তার সেই ইতিবাচক আকাঙ্খাময় মিশন তিনি শুরু করেছিলেন এবং পরিশেষে তার ফলাফলটি হয়েছিল অনুপ্রেরণাদায়ক।
যখন তিনি আমেরিকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তাঁর কিছুই ছিল না। আমেরিকার কোনো ফোন নাম্বার ছিল না, কোনো সংস্থার সহায়তা ছিল। না, ছিল মাত্র ৪০টি রুপি। ঐ সময় আমেরিকায় মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন ভারতীয় ছিল। অভিবাসী আইনও ছিল খুব কঠোর। তাই ভারতীয় রুপির পরিবর্তে আমেরিকান ডলার পাওয়াটাও সহজ ছিল না। ৪০ রুপি অর্থ বাস্তবিক পক্ষে মূল্যহীন ছিল। এমনকি যদি এর কোনো মূল্যও থাকত তবে সেটি মাত্র আমেরিকায় কয়েক ঘণ্টা চলার মতো অর্থ ।
প্রকৃতপক্ষে শুদ্ধভক্ত যাই করেন, সবকিছুই সফল কেননা সেগুলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রসন্ন করে । যা হোক এরকম এক ব্যর্থ ইতিহাসের পরও, দৃশ্যত হয়তো সফলতা তৎক্ষণাৎ প্রকাশিত হয়নি। ঐ সময় শ্রীল প্রভুপাদের সফলতা পাওয়ার জন্য তার কোনো অর্থও ছিল না, কোনো সংস্থার সহায়তা ছিল না, ছিল না কোনো অনুসারী। আমেরিকাতে বিশ্বস্ত কোনো নাম্বারও ছিল না। এরকম একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া, তাও আবার একাকি ৬৯ বছর বয়সে, যে বয়সে সাধারণ লোকেরা সাগর পাড়ি তো দূরের কথা রাস্তা পাড়ি দিতেও চিন্তা করে। সে বয়সে লাগাতার ত্রিশ-চল্লিশ দিন সময় জুড়ে উত্তাল মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অকল্পনীয় সাহসী পদক্ষেপ। তাঁর কোনো নিরাপত্তা ছিল না, সামনে কি হতে চলেছে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না, তিনি এমনকি জানতেন না আমেরিকাতে তিনি সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার খেতে পারবেন কি না? সন্ন্যাসী হিসেবে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো পন্থাও নেই। এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেই সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল। প্রভুপাদের জলদূত পদক্ষেপের ঘটনাটি মনের ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী কোনো পদক্ষেপ ছিল ।
নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন যে, “চাঁদে অবতরণ মানবের জন্য একটি বিশাল পদক্ষেপ” তার সেই উক্তিটি মহাকাশ বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদ যেটি করেছিলেন, “জলদূত জাহাজে তার এক পদক্ষেপ ছিল সমগ্র মানবতার জন্য এক বিশাল পদক্ষেপ।” কেননা তাঁর সেই সাহসিক কার্য, পুনঃ পুনঃ ব্যর্থতা ও অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও অধ্যবসায় বজায় রাখা, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বিশ্বাসপূর্ণ কার্য, তাঁর গুরুদেবের মিশনকে সফল করার জন্য নিবেদিত কার্য। এ সবকিছু ঘটেছে মাত্র কিছু বছরের মধ্যে। মাত্র এক দশকের মধ্যেই তিনি ভক্তির তরঙ্গ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ১০৮টি মন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, ৭০টি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে, মিলিয়ন মিলিয়ন লোককে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার লোক নিজেদের পারমার্থিক পথে উৎসর্গ করে। এভাবে এ সবকিছু মানবের মানবতাকে পারমার্থিক বিবর্তনের পথে খুব দ্রুততরভাবে সম্মুখ দিকে পরিচালিত করে।
অতএব, শ্রীল প্রভুপাদের সেই পদক্ষেপটি ছিল প্রকৃতপক্ষে মানবতার পারমার্থিক বিবর্তনের পথে বিশাল একটি পদক্ষেপ। সেই বিবর্তন এখনও অবধি বহমান যে বিবর্তনে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি এবং সম্মুখ দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
অতএব, জলদূত মিশন যাত্রা করার যে সাহসী পদক্ষেপ শ্রীল প্রভুপাদ গ্রহণ করেছিলেন, তা কৃতজ্ঞতার সহিত ধ্যান করার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভক্তিকে বিকশিত করার পথে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি। ব্যর্থতা হৃদয় ভেঙে যাওয়া এ সবকিছু পরিত্যাগ করে আমাদের পরিধিতে সে ভক্তিকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য আমরা যা যা প্রয়োজন তা করতে পারি। যখন আমরা দর্শন করব যে, শ্রীল প্রভুপাদ যা করেছেন তা শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের জীবনে প্রদান করার উদ্দেশ্যে। আমরা যদি তার ন্যূনতমও করতে পারি তবে আমরা কৃষ্ণকে গ্রহণ করতে পারব এবং অন্যদের মাঝে কৃষ্ণকে প্রদান করতে পারব।


 

অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।