এই পোস্টটি 118 বার দেখা হয়েছে
অনেকে বলে যে, ‘পৃথিবীতে ভগবান বলতে কিছুই নেই।’আবার অনেকে বলে, ‘ভগবানকে কেউ দেখেছে নাকি? বর্তমানের বিজ্ঞানের যুগে ভগবান মানে সেকেলের কাল্পনিক ধারণা মাত্র , যা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয় । ’এ্ই সমস্ত প্রচলিত উক্তি আমাদের সমাজে অনেকেই করে থাকে। তাদের জন্য “ মঙ্গলাগিরি’’ এক বাস্তব প্রমাণ।
পারমার্থিক জগতে ভক্ত এবং ভগবানের মধ্যে অপ্রাকৃত লীলা দর্শনের মাধ্যমে আমাদের ভক্তি কিংবা বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। ভক্তগণ পারমার্থিক জ্ঞান দ্বারা এবং পূর্বতন আচার্যদের গুণাবলী কিংবা লীলা দর্শন করে ভগবানের প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করে। আমরা অনেকেই হয়তো সরাসরিভাবে ভগবানের লীলা উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু অপ্রাকৃত ধাম “মঙ্গলাগিরি” তে এলে যে কেউ ভক্ত এবং ভগবানের মধ্যে সাক্ষাৎ লীলা দর্শন করতে পারেন।
এতে ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রেমভক্তি বৃদ্ধি পায়। অর্ধসিংহ ও অর্ধ নর রুপি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার ভগবান নৃসিংহদেব, যিনি সত্যযুগে ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ভগবান নৃসিংহদেবের আবির্ভাব স্থান ”অহোভিলাম “থেকে কিছু দূরে। দক্ষিণ ভারতে মঙ্গলাগিরি ধাম অবস্থিত। এই ধামের চতুর্দিক হাতি সদৃশ। এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় “স্থল পুরাণ” হতে। একবার বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধক অবস্থায় জন্ম নেয় এক বালক ঋষ্যশৃঙ্গি। ঋষ্যশৃঙ্গি যখন বুঝতে সক্ষম হলেন যে তার পিতা পরিযাত্র তার প্রতিবন্ধী শরীরে জন্মগ্রহণে অসন্তুষ্ঠ, তখন তিনি পিতৃ আবাস ত্যাগ করলেন। তীর্থ পরিক্রমা কালে তিনি কৃষ্ণ নদীর দক্ষিণ পার্শ্বে এসে পদিত আশ্রমে আশ্রয় নেন। তিনি যখন শুনলেন যে তার পিতা সেখানে আসছেন, তখন তিনি সেখানের লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহের কাছে প্রার্থনা করলেন তারা যাতে লক্ষ্মীনৃসিংহ রূপে অবতীর্ণ হয়ে পাহাড়ে নিত্য অবস্থান করেন। ঋষ্যশৃঙ্গির কঠোর তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনে সন্তুস্ট হয়ে ভগবান নৃসিংহদেব এই স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কলের ঋষ্যশৃঙ্গির স্তোত্র পাঠের উক্তি কারণে উক্ত পাহাড়কে ‘স্তোত্রাদ্রি’ মাণ বলা হয়।স্তোত্রাদ্রি পাহাড়ের উপর ৬০০টি সিঁড়ি পার হয়ে উঠলে লক্ষ্মীনৃসিংহ মন্দির দর্শন করা যায়। ৬০০ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই প্রচণ্ড ক্লান্তি আপনাকে অবসন্ন করতে পারে। তবে চিন্তা নেই, আপনার ক্লান্তি নিমিষেই চলে যাবে যখন আপনি এখানের এক বিশেষ প্রসাদ গ্রহণ করবেন। আখের রস, কপুর, এলাচ ও কালো মরিচের সমন্বয়ে তৈরি এক অপূর্ব শরবত বা পঙ্কম (তামিল ভাষায়) এখানে নৃসিংহদেবকে নিবেদন করা হয়। যে কারো নিবেদিত এই শরবত ভগবান গ্রহণ করে থাকেন এবং এজন্য আপনাকে টিকেট সংগ্রহ করতে হবে। পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত এই মন্দিরের বিগ্রহের নাম পঙ্কল নৃসিংহ। এই পঙ্কল নৃসিংহ কি হচ্ছেন স্বপ্রকাশিত বিগ্রহ যার রয়েছে বড় মুখ যা ছয়ইঞ্চি গভীর। চর্তুহস্তে এবং বিশাল মুখে তিনি সরাসরি ভোগদ্রব্য গ্রহন করে থাকেন। একটি শরবতের পূর্ণ জগ নিয়ে যদি আপনি ভগবানকে নিবেদন করেন তখন এই পূজারী সেই শরবত ভোগ সরাসরি শঙ্কের সাহায্যে পঙ্কল নৃসিংহদেবের মুখে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ঠিক তখন খল খল শব্দ হয় এবং ভগবান যে স্বয়ং সেই নিবেদিত জল গ্রহন করছেন তা বোঝা যায়। কিন্তু এক সময় ঐ শব্দ আর শোনা যায় না। তখন পূজারী পঙ্কম পান করানো থেকে বিরত থাকেন।
তবে এখানে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভগবান কখনো সম্পূর্ণ পাত্রপূর্ণ শরবত গ্রহণ করেন না। তিনি ঠিক অর্ধেক গ্রহণ করেন এবং প্রত্যক্ষভাবেই দেখা যায় যে, প্রতিবারই যখনই ভগবানকে ভোগ নিবেদন করা হয় তখন কেবল অর্ধেক গ্রহন করেন। স্থল পুরাণ অনুসারে এই রহস্যের সমাধান পাওয়া যায়। প্রজাপতী কশ্যপের নামুচি নামক এক দৈত্য পুত্র ছিল। নামুচি ছিলেন খুবই নিষ্ঠুর স্বভাবের। অসীম শক্তিমত্তা লাভের আশায় নামুচি বিভিন্ন তপস্যার পথ বেছে নিলেন। তপস্যার কারণে নামুচির শিখা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার উষ্ণতা সহ্য করতে না পেরে দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন।
ব্রহ্মা তখন নামুচির সন্নিকটে এসে তাকে বর চাইতে বললে নামুচি প্রার্থনা করলেন এমন বর যে তাকে ভেজা বা শুস্ক কোন অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না। প্রত্যাশিত বর লাভ করে শক্তিশালী নামুচি দেবতাদের স্বর্গচ্যুত করেন। ব্রহ্মাসহ দেবতারা তখন ভগবান বিষ্ণুর নিকট শরণাগত হলে তখন ভগবান তাদের আশ্বস্থ করেছিলেন যে উপযুক্ত সময়ে তিনি অবশ্যই নামুচিকে নিধন করবেন। পরবর্তীতে যুদ্ধক্ষেত্রে ভগবান বিষ্ণু জল উদ্বুত বাষ্পীয় পরিবেশে সুদর্শন চক্র নিক্ষেপ করেন। বাস্প মূলত শুষ্কও নয় আবার ভেজাও নয়। সুদর্শনের ভয়ে নামুচি তখন মঙ্গলাগিরির গুহায় আত্মগোপন করেন। সুদর্শন তাকে খুঁজে বের করেন এবং হত্যা করেন। নামুচির দেহ নিগৃত রক্ত থেকে ‘রক্ত কল্য’ নামক নদীর উদ্ভব হয়।
এমনকি এখনও মন্দিরের চারপাশে লাল মাটি দেখা যায়। সুদর্শন ছাড়ার মুহূর্তে ভগবান বিষ্ণু ভগবান নৃসিংহ রূপ ধারণ করেন, যে রূপ দেবতাদের পর্যন্ত ভয়ের কারণ।দেবতারা তখন স্তব স্তুতি পাঠ করে ভগবান নৃসিংহদেবকে শান্ত করেন। দেবতারা ভগবানকে অমৃত পান করতে দিলে ভগবান অর্ধেক অমৃত পান করেছিলেন। তখন ভগবান বলেছিলেন যে, সত্যযুগে তিনি তাকে নিবেদিত অমৃতের অর্ধেক গ্রহন করবেন। তারপর ত্রেতাযুগে তিনি অর্ধেক ঘি, দ্বাপরে কামধেনু গাভী থেকে পাওয়া অর্ধেক দুধ এবং কলিযুগে তিনি অর্ধেক শরবত (jaggery water) গ্রহণ করবেন। পঙ্কল নৃসিংহ মূলত স্বপ্রকাশিত পাথরের বিগ্রহ’যার ডানে রয়েছে শঙ্খ এবং বামে সুদর্শন চক্রের চিহ্ন। ভক্তের প্রীতিবিধানের উদ্দেশ্য এবং নিবেদিত ভোগ্য সরাসরি গ্রহন করার জন্য খোলা মুখমণ্ডল। যদিও প্রতিদিন এখানে প্রচুর পরিমাণে সুমিষ্ট পানীয় নিবেদিত হয় তবুও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এখানে কোন পিঁপড়া নেই। এছাড়া এত গ্যালন গ্যালন পানীয় যে কোথায় যায় তা এখনো পর্যন্ত কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। সত্যিই আশ্চর্যকর ভগবান নৃসিংহদেবের মহিমা।
মন্দিরের ইতিহাস:
স্কন্ধ পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মঙ্গলাগিরি ধামের বর্ণনা উল্লেখিত আছে। এই দুই পুরাণ মতে, অন্যতম ৮টি তীর্থ স্থান হল-শ্রীরঙ্গাম, শ্রীমুসনাম, নৈমিষারণ্য, পুস্কর, শালগ্রাম, বদ্রিনাথ, ভেঙ্কটাদ্রি এবং মঙ্গলাগিরি, এই সকল তীর্থস্থানে দেবতারা বিশেষ বিশেষ সময়ে ভগবানের আরাধনা করতে আসেন।দেবতাদের উপস্থিতি মঙ্গলাগিরিতে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। যেমন- উক্ত মন্দির, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বন্ধ করে দেয়া হয় কেননা দেবতারা তখন উচ্চলোকে থেকে এখানে এসে নৃসিংহদেবের পূজার্চনা করে থাকেন। দেবতাদের উপস্থিতির একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় ভোরে মন্দিরের প্রবেশ দ্বার খুললে, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুল এবং সুগন্ধি পড়ে থাকতে দেখা যায়। মঙ্গলাগিরির এই স্থানে হরিদাস এবং বিষ্ণুদাস নামে দুইজন ভক্ত বাস করতেন। তারা বৈকণ্ঠের দ্বারপাল হওয়ার আকাঙ্খায় ভগবানের কাছে প্রার্থনা নিবেদন করেন।
হরিদাস, যিনি ছিলেন একজন ক্ষত্রিয়, তিনি মূল্যবান রত্নপাথর নিবেদনের মাধ্যমে ভগবানের আরাধনা করেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ বিষ্ণুদাস সজীব তুলসী পাতা নিবেদনের মাধ্যমে ভগবানের আরাধনা করেন। একদিন ভগবান নৃসিংহদেব এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে তাদের নিকট গমন করেন। ব্রাহ্মণরূপি ভগবানকে দর্শন করে হরিদাস জানতে চাইলেন যে, তাদের সেবিত বিগ্রহ বিন্দু মাধব কে কোনটি নিবেদন করা সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যবান পাথর না তুলসী। সরাসরি উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে ভগবান তাঁদের কাছে জানতে চাইলন যে, তারা কিসের অভিলাষে ভগবানের আরাধনা করছেন।
তখন হরিদাস ও বিষ্ণুদাস তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে, ভগবান তাদেরকে মঙ্গলাগিরিতে গমন করতে উপদেশ দিলেন। তিনি আরো বলেন যে, এই ধামে ভগবান নৃসিংহদেব খুব দ্রুত ভক্ত অভিলাষ পূরণ করে থাকেন। তারা উভয়েই ভগবানের উপদেশ মোতাবেক মঙ্গলাগিরিতে ভজন করেন। পরবর্তী জন্মে তারা উভয়েই বৈকুন্ঠে দ্বারপালের সেবা লাভ করলেন। হরিদাস হলেন জয় এবং বিষ্ণুদাস হলেন বিজয়। মন্দিরের উপরিভাগে লক্ষ্মীদেবী এবং ভেঙ্কটেশ্বর গুহা এবং হনুমান প্রজা বর্তমান। মন্দিরের চতুর্দিকে ধাম রক্ষক এবং দ্বারপাল হিসেবে চারজন হনুমান সর্বদা অবস্থান করেন।
কথিত আছে যে, ভগবান রামচন্দ্র চিন্ময় ধাম প্রত্যাবর্তনের সময় হনুমানকে এই স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে নৃসিংহদেবের আরাধনা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভগবান পঙ্কল নৃসিংহদেবের চোখের দৃষ্টির তীব্রতা এতই বেশি যে, সেই তীব্রতা হতে নিকটবর্তী গ্রামগুলোকে রক্ষার জন্য ভগবানের চোখের সন্নিকটে হনুমান বিগ্রহ মন্দির প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই হনুমান মন্দিরটি সবসময় বন্ধ রাখা হয়। মন্দিরের চারপাশে দেবতাদের নির্মিত বিভিন্ন পবিত্র সরোবর রয়েছে। কথিত আছে যে, সকল তীর্থ জল দ্বারা উক্ত সরোবর পূর্ণ কেননা মহালক্ষ্মী ক্ষীর সাগর থেকে এখানে আসার পর উক্ত জলে স্নান করেন এবং ভগবান নৃসিংহদেবের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।মঙ্গলাগিরি ধামে তিনটি নৃসিংহ মন্দির রয়েছে।
একেবারে পাহারে উপরে পঙ্কল নৃসিংহদেব মন্দির। তার নীচেই রয়েছে লক্ষ্মীনৃসিংহ স্বামী মন্দির এবং পাহারে একেবারে উপরে গন্ডল নরসিংহ স্বামী মন্দির। লক্ষ্মীনৃসিংহ স্বামী মন্দিরের অনেক মাহাত্ম্য রয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবের একজন ভ্রাতা স্বয়ং যুধিষ্ঠির মহারাজ এই বিগ্রহ স্থাপন করেন। বামে লক্ষ্মীদেবীর সাথে নরসিংহদেব অবস্থান করছেন এবং ভগবানের গলার মালা ১০৮টি শালগ্রাম দিয়ে তৈরি। এছাড়া এই মন্দিরের একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে, ‘দক্ষনভ্রত শঙ্খ‘। কথিত আছে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই শঙ্খ ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়া এখানে মহাভারত ও রামায়নের সাক্ষী এক স্বর্ণালংকার ভূষিত কাঠের রথ বিদ্যমান। এরপর একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় একটি ছোট বেদী রয়েছে। তাকে গন্ডলা নৃসিংহ স্বামী বলে। এখানে একটি দীপ রয়েছে যা সবসময় প্রজ্বলিত থাকে। এখানে দীপ জ্বালালে ভক্তগণের দুঃখদুর্দশা দ্রুত লাঘব হয়। এখানে নৃসিংহদেবের উদ্দেশ্য বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তবে ফাল্গুন শুদ্ধ সপ্তমীতে (ফেব্রুয়ারি মার্চের দিকে) ১১দিন ধরে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে যে, স্বয়ং
ধর্মরাজ এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিলেন। এছাড়া এই ধামে একটি ক্ষীর বৃক্ষ রয়েছে যেটি নারদ মুনির প্রকাশ এবং ভক্তদের সর্বদা কৃপা করে থাকেন।আগামী ২৭মে নৃসিংহ চতুর্দশী।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্জলা উপবাস পালনের মাধ্যমে যেকেউ ভগবান নৃসিংহদেবের কৃপা লাভ করতে পারেন। এতে ভগবানের প্রতি জন্মাবে এই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। ইস্কন তীর্থ দর্শন সেবা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আপনারাও দিব্যধাম মঙ্গলাগিরি দর্শন করে আসতে পারেন। উল্লেখ্য যে, নৃসিংহ চতুর্দশী উপলক্ষে ইসকনের সমস্ত মন্দিরে মহাসমারোহে এই তিথি উদযাপিত হবে। হরেকৃষ্ণ।
ReplyForward |