এই পোস্টটি 1331 বার দেখা হয়েছে
ভূত কত প্রকার ও কি কি?
জয়তীর্থচরণ দাস: বিভিন্ন প্রকারে ভূত রয়েছে যদিও তার আমাদের মতই জড়দেহহীন জীব যাদের আত্মা সূক্ষ্মদেহে অবস্থান করে। যাদের মধ্যে কাউকে হয়তোবা অবচেতন, চেতন বা অন্য কোন না কোন অবস্থায় আপনাদের অভিজ্ঞতা শিকার হয়েছেন। মানুষ তাদের অপমৃত্যুকালীন সময়ে যে যে ভাবনায় নিযুক্ত হয় সে সেই ধরনের ভূতের দেহ লাভ করে থাকে। বৈদিক শাস্ত্র মতে বহু ধরনের ভূতের প্রকার রয়েছে। ঠিক যেরকম বিভিন্ন প্রকারের জড় দেহ রয়েছে ঠিক তেমনি বিভিন্ন প্রকারের জড় দেহ রয়েছে ঠিক তেমনি বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্মদেহ রয়েছে। তাদের মধ্যে একপ্রকার হচ্ছে ব্রহ্মরাক্ষস (খুবই রাগান্বিত ব্রাহ্মণ যাদের রক্তরাঙ্গা চোখ রয়েছে, যাদের অপমৃত্যু হয়েছে এবং যেসমস্ত তান্ত্রিক তাদের পাপকর্মের জন্য মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে তারা পরবর্তীতে ব্রহ্মরাক্ষসে পরিণত হয়) অন্য এক প্রকারের ভূত রয়েছে যাদের প্রমথা বলা হয় তারা মানুষের তেমন কোন ক্ষতি করে না কিন্তু বেতাল ভূতেরা শ্মশানে আক্রমণ করে এবং মৃতদেহ ভক্ষণ করে। মানুষ যেখানেই যায় না কেন এরা ভয়ের সৃষ্টি করে। এছাড়াও শাকিনি এবং ডাকিনি নামক প্রেত্মী (স্ত্রী ভূত) রয়েছে যাদের উগ্র কণ্ঠ রয়েছে, এসমস্ত প্রেত্নীর কান্না বাড়ির কারো মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে (স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের প্রচলিত ধারণা মতে) এরা আবার বিভিন্ন বাড়ি ঘরের প্রেতদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের আত্মীয় স্বজনদের ভয় দেখায়, বাড়ির ছাদে নৃত্য করতে থাকে, খেলা করে, ভয় দেখায় কেননা তারা মৃত্যুর পর বিষ্ণু প্রসাদ লাভ করতে পারেনি বলেই প্রেত শরীর লাভ করে। আর গুয়াখা ভূতের কথা আর কি বলার আছে। আমরা অনেক সময় দেখি যে আমাদের ঘর কিংবা অফিসে কোন জিনিস হারিয়ে যায় কিন্তু পরে সেই বস্তুটিকে অন্য কোন স্থানে পাওয়া যায়। এমনকি একই স্থানে আমরা বার বার দেখার পরও সেই জিনিস আর পাই না। এটি গুয়াখা ভূতের কর্ম। যদিও তারা তাদের সূক্ষ্মদেহে জিনিসগুলো রাখতে পারে না তাই তারা জিনিসগুলো অন্যকোন স্থানে রেখে দেয় এবং লুকিয়ে রাখে, সেই পুরনো অভ্যাস তারা ত্যাগ করতে পারে না। কিছু অদ্ভুত ভূত রয়েছে যাদের কোন ঘর নেই যদি না আপনি ভয় পেয়ে তাদের ঘরে জায়গা না দেন অর্থাৎ দুর্মন ভূত যারা রাতে বিলাপ এবং ক্রন্দন করতে থাকে। এছাড়াও বিনায়ক, মূলন, যতাধানী, মলানয়া ইত্যাদি যারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র বা অন্য কোন বর্ণ থেকে ভূতের দেহ লাভ করে। তাদের বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড এবং প্রভাব রয়েছে মানুষের উপর।
ইংল্যান্ড এবং মধ্য ইউরোপ এমন এক ধরনের ভূত রয়েছে যাকে বলা হয় হাগ। এই ভুতেরা ঘুমন্ত মানুষদের আক্রমণ করে। এরা মুখমণ্ডল দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। ভূতের শিকার সেই ব্যক্তিটি সাধারণ স্বপ্ন দেখেন যেখানে দেখা যায় যে, কেউ তাকে হত্যা করছে এবং তারা অনেক সময় বুকের উপর বসে শরীরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই সময় সেই ব্যক্তির সমগ্র দেহটি পক্ষঘাতগ্রস্থ হয় (প্যারালাইড)। এই ভূতেরা পুরুষ দেহে প্রবেশ করে তাদের পৌরুষত্ব চুরি করতে চায় যাতে তারা আরো শক্তিশালী হয় কিন্তু সেই সময় যে সমস্ত ভক্ত ভগবানের পবিত্র নাম স্বরণ করতে পারে তারাই কেবল এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারে। পক্ষঘাতগ্রস্থ অবস্থায় যে সময় সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের মনে ভগবানের চিন্তা আসে বা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করব চেষ্টা করেন, তাদের এই শক্তিশালী মহামন্ত্রের প্রভাবে ভূতগুলো বহু দূরে ছুড়ে পড়ে। মাত্র ১০ সেকেন্ডের প্রার্থনা ভূতগুলোকে আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে ছুড়ে ফেলতে বা রাখতে সক্ষম।
ভূতের অবস্থান
অনেকেই আছেন যারা ভূতের যে অস্তিত্ব আছে তা বিশ্বাস করতে চান না (গরুড় পুরাণের ২০ অধ্যায়ের ৩১ ও ৩২ শ্লোকে) বর্ণিত আছে যে, ভূতেরা বর্ণনা করছেন, “আমরা সেখানেই থাকি যেখানে মানুষ বেদকে অনুসরণ করে না, যেখানে কোন লজ্জা নেই, ধর্মে বিশ্বাস নেই, কোন নিয়মানুবর্তিতা নেই, ক্ষমা নেই, ধৈর্য এবং জ্ঞান নেই।” জন লেলনের আবাসস্থল সম্পর্কে একবার শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, “আমি সেখানে একজন অতিথি হিসেবে ছিলাম। সেখানে ছিল একজন ভূত…মায়ার দ্বারা আবদ্ধ। শুধুমাত্র মায়ার দাসত্ব করা চাকর।” এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার সন্ধান লাভ করা যায় যে ভূতেরা ঘটনা কোন কল্পনা নয়, এগুলো বাস্তবিক আয়ুর্বেদে একটি মানসিক রোগের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যার নাম ভূতগ্রহ, যা মূলত অবিবাহিত নারী এবং সেই সমস্ত ব্রহ্মচারীদের হয়ে থাকে যাদের কোন নির্দিষ্ট প্রতিজ্ঞা থাকে না, শুধুমাত্র বাহ্যিক জড়রূপে আশ্রম পালন করছে। আয়ুর্বেদে ঔষধিকে ৮টি বিভাগে ভাগ করছেন এর জনক ভগবান ধনন্ত¡রী এবং প্রজাপতি ব্রহ্মা, প্রজাপতি দক্ষ, অশ্বিনী কুমারগণ, শুশ্রুত মুনি, মহারাজ নিমি (যিনি নিমি তন্ত্র লিখেছেন), যারা সকলেই বিভিন্ন প্রকারের রোগ দূর্ঘটনা দেহের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। ৮ প্রকারের কায় চিকিৎসার মধ্যে (ভূত) গ্রহ বিভাগ রয়েছে যা অদেখা আত্মা, মানসিক সমস্যা, মানসিক রোগ নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
আয়ুর্বেদের বৈদিক ঔষধির ৮টি বিভাগের মধ্যে ৭ টি ইতোমধ্যে সারাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই জ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিন্তু বাকি ১টি ভূত বা গ্রহবিভাগ এখনো বর্তমান পাশ্চাত্য চিকিৎসা ব্যবস্থা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। যেহেতু বিভিন্ন পশ্চিমা মিশনারী সংস্থাগুলো ভাবতে তাদের প্রভাব বিস্তার করে এবং বৈদিক শাস্ত্রগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে। এই কারণে অধিকাংশ বৈদিক উন্নততর জ্ঞান মানুষ হয় ভুলে গেছে নয়তো সেখানে পাশ্চাত্য দর্শন মিশ্রিত হয়ে সেগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে। বর্তমান আধুনিক স্কুল, শিক্ষার বিষয়, তত্ত্বসমূহ কেবল পরিবর্তিত হচ্ছে তবে এবার হয়তোবা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের উৎসস্থলের দিকে উল্টেপাথে হাঁটতে শুরু করেছে। আর তাইতো চিকিৎসা জগতে অ্যারোমা থেরাপী, কালার থেরাপী, ম্যাসাজ আকুপ্রেসার, নিরামিশাষী হওয়া সহ বিভিন্ন বিষয়গুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রকারের যোগ পন্থা, মন্ত্র, জপ এবং ভক্তিযোগ ফিরে এসেছে।
আমরা এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব যা ভূতগ্রহ বিভাগের অন্তর্গত যাকে বলা হয় যশ পাশমারা। এটি কিছুটা মৃগীরোগীর মত যা যুবতী রমনীর মধ্যে দেখা যায়। যদিও এটি অনেকটা মানসিক সমস্যা। সাধারণত কেউ যদি ভূতে আক্রান্ত হয় তবে তার মনে সীমাহীন বাসনার সৃষ্টি হয়। মনের গহীন কোণে স্বামী, সন্তান এবং যথেষ্ট সুরক্ষা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। কিন্তু সামাজিকভাবে বিভিন্ন চাপ, বিশেষত পরিবারের চাপে এবং নিজের দেহের পরিবর্তন বিশেষত যখন কেউ বালিকা থেকে শারীরিকভাবে নারীতে রূপান্তরিত হয়, তখন প্রচণ্ড মানসিক হতাশা, তর্ক করার ইচ্ছা, ঘুমের উপদ্রব, শ্বাসকষ্টে ভোগে এবং নিজেদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে চায়, নতুন বন্ধুত্বের সাহচর্য পেতে চায়, সর্বদা যৌন নির্যাতনের ভয়ে থাকে বা ভান করে, অস্বাভাবিক আচরণ করে। বিজ্ঞানী ফ্রয়েড বলেছেন যে, এই ধরনের অবস্থায় তাদের যে রক্তের অস্বাভাবিক গতি তা কোন ইহজাগতিক ব্যাপার নয়। সামাজিকতার দায়ে বাহ্যিকভাবে নৈতিক আচরণ কিন্তু অভ্যন্তরে ভূতগ্রহের প্রভাবে অতিকামনার উদ্রেক হয়। এই অবস্থার নৈতিকতা এবং অভ্যন্তরের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির মধ্যে ঘটে। এই দ্বন্দের কারণে বাহ্যিকভাবে শারীরিক সমস্যা ঘটে থাকে যেমনঃ মেয়েদের ঋতুকালীন সমস্যা, অসংলগ্ন কথা বলা ইত্যাদি।
পুরুষ-নারী নির্বিশেষ সকলেই তাদের কামুক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য এতই নিমগ্ন থাকে যে তারা জাগতিক চাহিদার মধ্য দিয়েও অতিবাসনা পূরণ করতে চায়। পুরুষরা তাদের অদ্ভূদ পৌরুষত্ব দেখাতে চায়। এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে, কেন যুবক যুবতীরা কাম বাসনা উদ্রেককারী পোশাক পরিধান করে? তারা হয়তো বলতে পারে স্বামী বা স্ত্রীর জন্য। কিন্তু তারাতো এখনো বিয়ে করেনি। সুতরাং তারা কি করছে? তারা কি চায়? এর উত্তরে মিলবে যে, আধুনিক মিডিয়া তাদের বাধ্য করছে। তাহলে ফ্যাশনের নামে উভয় লিঙ্গই অনবরত নিজেদের শোষণ করে চলেছে এবং কামনাবাসনার পাহাড় গড়ে তুলছে, যা পুরণ করা অসম্ভব। তাই ভূতগ্রহের প্রভাব বিশেষত যুবক-যবতীদের মধ্যে বেশি থাকে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথ আমাদের দিয়েছেন। ভগবদ্গীতার ২য় অধ্যায়ের ৫৯ নং শ্লোকে উল্লেখিত আছে-
বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্টা নিবর্ততে॥
দেহবিশিষ্ট জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু উচ্চতর স্বাদ আস্বাদন করা ফলে তিনি সেই বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত হন।
অতএব, ভগবানের বর্ণনা মতে কেউ যদি উচ্চতর স্বাদ না পায় তবে সে নিম্নতর কুরুচি সম্পন্ন বিষয়াবলী ত্যাগ করতে পারে না। আমরা যখন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণে সেবায় যুক্ত হব, তার মহিমান্বিত নাম জপ করব, ভগবদ্ প্রসাদ গ্রহণ করব এবং অসৎ কার্যাবলী পরিত্যাগ করব তখন আমরা সেই উচ্চতর স্বাদ পাব যা পেলে এই নিম্নতর বাসনার প্রতি কোন আগ্রহ থাকবে না। ভূতগ্রহের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র পন্থা যা বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশিত হয়েছে তা হল ভগবানের পবিত্র নাম জপ করে আমাদের হৃদয় পরিবর্তন করা।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥
এই মহামন্ত্র জপ করলে ভূতের কোন ভয় থাকে না এবং এটি মহাশক্তিশালী। আগামী সংখ্যায় ভূতের আক্রমনের কিছু প্রত্যক্ষ ঘটনা উল্লেখ করা হবে এবং এর থেকে মুক্তির উপায় বর্ণনা করা হবে। (চলবে…) হরেকৃষ্ণ!
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ পত্রিকা জুলাই ২০১২ প্রকাশিত)
এরকম চমৎকার ও শিক্ষণীয় প্রবন্ধ পড়তে চোখ রাখুন ‘চৈতন্য সন্দেশ’ ও ‘ব্যাক টু গডহেড’ এ
যোগাযোগ: ০১৮৩৮-১৪৪৬৯৯