এই পোস্টটি 669 বার দেখা হয়েছে
আগামী ২৬-৩০ নভেম্বর ২০২০
শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী
ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কি?
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অভিন্ন প্রকাশ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদপ্রবর ও গৌড়ীয় আচার্যবর্গের অন্যতম শ্রীল সনাতন গোস্বামীপাদ শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে (১৬/৪৩৪) লিখেছেন-“কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী হতে আরম্ভ করে (পূর্ণিমা পর্যন্ত) পাঁচদিন শ্রীভগবানের প্রীতির জন্য যদি সমর্থ হয়, ‘ভীষ্মপঞ্চক’ ব্রত আচরণ করবেন।”
চাতুর্মাস্যের শেষ মাসে অর্থাৎ কার্তিক তথা দামোদর মাসের এই ব্রতে বিশেষ খাদ্যতালিকা থাকে, যে অনুযায়ী কেউ পঞ্চগব্য অথবা ফলমূল অথবা হবিষ্যান্ন গ্রহণ করতে পারেন। এই ব্রত অনুষ্ঠানকারী ব্যক্তিকে ভগবৎপ্রেম প্রদান করে-সর্বপাপবিনির্মুক্তঃ প্রাপ্তকামো হরিং ব্রজেৎ ॥ (গরুড়পুরাণ, পূর্বখণ্ড ১২৩/২)। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুর প্রীতিপ্রদ বলে একে বিষ্ণুপঞ্চকও বলা হয়। সর্ববিধ বার্ষিক ব্রতের মধ্যে চাতুর্মাস্য ব্রত প্রধান, আর চাতুর্মাস্য ব্রত অপেক্ষা ভীষ্মপঞ্চক ব্রত সর্বপ্রধান।
পত্র-পুষ্প অর্পণ বিধি
ব্রতকালে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ বা ভগবানের অন্য যেকোনো রূপের শ্রীবিগ্রহকে ঘৃত প্রদীপ ও পুষ্প নিবেদন করা উচিত। ভগবানের শ্রীবিগ্রহে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন পুষ্প নিবেদনের নিয়ম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গরুড়পুরাণ পূর্বখণ্ড ১২৩ অধ্যায়ে (৮-৯) বলা হয়েছে-
১ম দিন: পদ্মফুল-চরণকমলে
২য় দিন: বিল্বপত্র-জানুতে
৩য় দিন: গন্ধদ্রব্য-নাভিকমলে
৪র্থ দিন-বিল্বপত্র ও জবাফুল-স্কন্ধদেশে
৫ম দিন: মালতীফুল-শিরোদেশে
যদি কখনো দুটো তিথি একদিনে পড়ে, তবে ঐদিন দু’দিনের উদ্দিষ্ট ফুলগুলো একই দিনে নিবেদন করতে পারেন। আর যদি কারো নিকট ফুলগুলো না থাকে, তবে ভগবানের নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত ফুলগুলো কেউ মানসিকভাবে নিবেদন করতে পারেন।
আহার বিধি
ব্রতকারী কতবার আহার গ্রহণ করতে পারে সে ব্যাপারে নির্ধারিত কোনোকিছু উল্লেখ নেই। ভীষ্মপঞ্চক ব্রত ব্যক্তির সামর্থ্য অনুসারে বিভিন্ন স্তরে উদ্যাপন করা যায়- একথা পদ্মপুরাণে (স্বর্গখণ্ড ৪৮/১৫) বলা হয়েছে। সাধারণত একাদশীতে সম্পূর্ণ উপবাস এবং তার পরবর্তী চারদিন ফলমূল গ্রহণ করতে বলা হয় অথবা কেউ পাঁচদিনই ফলমূল গ্রহণ করতে পারেন। ভক্তরা তাদের সুবিধামতো নিন্মোক্ত স্তরগুলোর যেকোনোটি অনুসরণ করতে পারেন, যেন তাদের সাধারণ ভক্তিমূলক সেবা ও দৈনন্দিন সাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।
১ম স্তর- পঞ্চগব্য গ্রহণ
পঞ্চগব্যের একেকটি একেক দিনে গ্রহণ করা যেতে পারে (গ.পু. পূর্ব ১২৩/১০; প.পু স্বর্গ ৪৮/১১-১৪; স্কন্দ.পু.কাতির্কমাসমাহাত্ম্য ৩২.৪৬.৪৭.৫০)।
১ম দিন-গোময়
২য় দিন-গোমূত্র
৩য় দিন-দুধ
৪র্থ দিন-দধি
৫ম দিন-গোময়, গোমূত্র, দুগ্ধ, দধি ও ঘিয়ের মিশ্রণে তৈরি পঞ্চগব্য।
২য় স্তর-ফলমূল গ্রহণ
যদি কেউ ১ম স্তর অনুসরণ করতে না পারেন, তবে ফলমূল গ্রহণ করা যেতে পরে। অধিকাংশ ব্যক্তি ফলমূল গ্রহণ করেন। তাই আলু, মূল এবং ফল যেমন কলা, আপেল, কূল, পানিফল, বাদাম, আখরোট, হেলেনটস, কাজুবাদাম, কিসমিস ও খেজুর খাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ফলের মতো এগুলোও ফল হিসেবে বিবেচিত হয়। আখের রস এবং ইক্ষুদ্রব্য যেমন মিছরি গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু গুড় এবং মোলাসেস অনুমোদিত নয়। আলু, কাঁচকলা বা মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বাদের জন্য সৈন্ধব লবণ ব্যবহার অনুমোদিত। নারকেল ও নারকেলের জল গ্রহণ করা যাবে। তবে দুধ বা দুগ্ধজাত কোনো দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে না।
৩য় স্তর-হবিষ্যান্ন গ্রহণ
যদি কেউ ২য় স্তরও পালনে অসমর্থ হন, তবে ‘হবিষ্যান্ন’ গ্রহণ করতে পারেন। শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১৩/১০-১৩ নং শ্লোকে হবিষ্যান্নের উপাদান উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নোক্ত উপাদনগুলো হবিষ্যান্ন তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে।
হবিষ্য সাধারণত আতপ চাল এবং মুগ ডাল দিয়ে তৈরি করা হয়। যারা একাদশী থেকে একাদশী পর্যন্ত চাতুর্মাস্য পালন করছেন, নিয়মানুযায়ী তাদের কার্তিক মাস একাদশী পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে, তাই তারা তাদের হবিষ্যে মুগ ডাল গ্রহণ করতে পারেন। তবে, অধিকাংশ ভক্তগণ পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করেন, তাই ভীষ্পপঞ্চকের হবিষ্যে মুগ ডাল অনুমোদিত হবে না এবং সকল প্রকার তেল পরিত্যাজ্য।
– আতপ চাল, ঘি, সৈন্ধব লবণ, পাকা কলা, কাল শাক, গম, বার্লি-এই উপাদানগুলোও গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া নিন্মোক্ত ফলসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।
– ফল (স্কন্দপুরাণের নাগরখণ্ডে অবশ্যই একটি ছোট বীজের অথবা কম বীজপূর্ণ ফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে)
আম, কাঁঠাল, লাবালী ফল, কেয়া ব্যতীত সকল মূল, পিপলী, হরিতকি, আমলকি, নারঙ্গ, ইক্ষুদ্রব্য (গুড় ব্যতীত) এবং ননীপূর্ণ গোদুগ্ধ।
হবিষ্যান্নে বর্জনীয় দ্রব্যসমূহ
নিম্নবর্ণিত দ্রব্যগুলো হবিষ্যান্নের অন্তর্ভুক্ত হলেও তা কার্তিক মাসে বর্জন করতে বলা হয়েছে। যথাÑ তিলের তেল, বেতো শাক, সাত্ত্বিক শাক, মূলা, জিরা ও তেঁতুল।
তর্পণবিধি ও মন্ত্রাবলি
এছাড়া প্রতিদিন গঙ্গার মতো পবিত্র নদীতে স্নান ও তর্পণ করা উচিত। তর্পণ করার সময় উপবীতকে পেছনদিকে নিয়ে (যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং উভয় হাতে জল নিতে হয়; মন্ত্র উচ্চারণ করা হয় এবং দুই হাত ডানদিকে ও নিচে কাত করে নিবেদন করা হয়, যাতে জল ডান বৃদ্ধাঙ্গুলির নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিবেদনের একটি উপায়। তবে ভীষ্মপঞ্চকে তা ভীষ্মদেবের উদ্দেশ্যে করা হয়, যা স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে, কার্তিকমাসমাহাত্ম্যে (৩২/৯) বলা হয়েছে-
ভীষ্মায়ৈতদ্দাদাম্যর্ঘ্যমাজন্মব্রহ্মচারিণে।
এই তর্পণে সকল বর্ণেরই সমান অধিকার-তর্পণং সার্ববর্ণিকম্॥ (৩২/১০)।
তর্পণ মন্ত্র
ওঁ বৈয়াগ্রপদ্য গোত্রায় সংস্কৃতি প্রবরায় চ।
অপুত্রায় দদাম্যেতৎ সলিলং ভীষ্মবর্মণে ॥
অর্ঘ্য
বসুনামাবতারায় শান্তনোরাত্মজায়চ।
অর্ঘ্যং দদামি ভীষ্মায় আজন্ম ব্রহ্মচারিণে ॥
প্রণাম
ওঁ ভীষ্ম শান্তনবো বীরঃ সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়ঃ।
অভিরদ্ভিরবাপ্নোতু পুত্রপৌত্রচিতাং ক্রিয়াম্ ॥
কারো প্রশ্ন হতে পারে যে, যাদের পিতা জীবিত, তারা কি তর্পণ করতে পারবে? এক্ষেত্রে বুঝতে হবে, যেহেতু এই ব্রতের তর্পণ ভীষ্মদেবের উদ্দেশ্যে করা হয়, কারো পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নয়; সুতরাং, যে কেউ তর্পণ করতে পারেন। আর যদি কেউ গঙ্গায় স্নান ও তর্পণ করতে যেতে না পারেন, অর্থাৎ, যদি কারো কাছাকাছি কোনো পবিত্র নদী না থাকে, তবে তিনি “গঙ্গা, গঙ্গা, গঙ্গা” উচ্চারণ করে তথা গঙ্গনাম স্মরণ করে এই পবিত্র নদীতে স্নান করার সুফল লাভ করতে পারেন, যা যেকোনো স্থানেই করা সম্ভব (পদ্মপুরাণ, ক্রিয়াযোগসার, ৬/১১)
এছাড়া ভগবানের শ্রীবিগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন প্রদীপও নিবেদন করা উচিত। ভীষ্মপঞ্চক গোবিন্দের নিকট বিশেষ প্রিয় এবং এর ফলে কেউ অতি সহজেই কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারেন।
পূর্ণিমার দিন তথা ব্রতের শেষদিন সূর্যাস্তের পর এবং চন্দ্রোদয়ের সময় ব্রতের পারণ করতে হবে। সেদিন বিকেলের প্রসাদ না পেলেই ভালো; কেননা কিছুক্ষণ পরেই ব্রত শেষ হবে এবং তখন মহাভোজ হবে। ব্রতকারী প্রথমে পঞ্চগব্য পান করে তারপর অহার করবে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ভীষ্মপঞ্চক ব্রতকালে একাদশীর দিন উপবাস করার পরদিন কি খেযে পারণ করা উচিত? উত্তরে বলা যায় যে, আমরা একটি সংকল্প করি আমরা ভীষ্মপঞ্চক পালন করছি। সংকল্প করার মাধ্যমে এই একাদশী পালনের দিনটিও স্বাভাবিকভাবেই ভীষ্মপঞ্চক ব্রতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কেউ যদি হবিষ্যান্ন গ্রহণ করে ব্রতপালন করেন, তবে একাদশীর পারণ হিসেবে দ্বিতীয় দিন দানা গ্রহণ করতে পারেন। ১ম ও ২য় স্তরের ক্ষেত্রে যেহেতু পাঁচ দিন দানা গ্রহণ নিষিদ্ধ, সেক্ষেত্রে ৫ম দিন ব্রতের পারণ করবেন। তবে কেউ যদি সত্যিই এ ব্যাপারে চিন্তিত হন, তবে তিনি একাদশীতে নির্জলা উপবাস থাকতে পারেন এবং জল গ্রহণ করে পারণ করতে পারেন।
ভীষ্মপঞ্চক ব্রতের উদ্দেশ্য
যেহেতু উদ্দেশ্যটি হলো আমাদের নিয়েমিত ভগবদ্ভক্তি চালিয়ে যাওয়া, এমন নয় যে, আমি উপবাস করছি, তাই আমি কিছু করব না। যাদের ডায়াবেটিস আছে অথবা যারা সম্পূর্ণ উপবাস করতে পারবেন না, তারা হবিষ্যান্ন পেতে পারেন। যে ব্যাপারটি চিত্তাকর্ষক তা হলো, ভীষ্মদেব তাঁর পিতার কারণে বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞা করেছেন্ এর পেছনে এক বৃহৎ কাহিনি রয়েছে।
প্রার্থনায় আছে ‘আজন্ম ব্রহ্মচারিণে’, আমরা তাঁর জন্য তর্পণ করছি। তাঁর কোনা সন্তান নেই, তিনি কখনো বিবাহ করেননি। তাই এটি আশ্চর্যজনক যে, কীভাবে সারা ভারত এবং সারা বিশে^র লক্ষ লক্ষ মানুষ ভীষ্মদেবের জন্য ভীষ্মপঞ্চক করছেন এবং তারা তর্পণ কছেন; কিন্তু তাঁর কোনো সন্তান নেই এবং তিনি গঙ্গামাতার সন্তান। তাই যখন ভক্তরা গঙ্গায় যান, গঙ্গাদেবী প্রসন্ন হন যে, তাঁর পুত্র সম্মানপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এভাবে এই ব্রতের ফলে মাতাগঙ্গা, মহাত্মা ভীষ্মদেব এবং সর্বোপরি পরমেশ্বর ভগবান প্রসন্ন হন। আর তাঁকে প্রসন্ন করাই সমস্ত যজ্ঞ, দান, ব্রত বা তপস্যার মুখ্য উদ্দেশ্য।