এই পোস্টটি 955 বার দেখা হয়েছে
চৈতন্য সন্দেশ ডেষ্ক: ইনডোর গেইমের মধ্যে যে গেইমটি এখনও খুব জনপ্রিয় তা হল লুডু। বিশেষত গ্রামে- গঞ্জে এই খেলার প্রচলন দেখা যায়। এমনকি শহরেও খানিকটা এর প্রচলন রয়েছে। শুধুমাত্র একটি বোর্ড, ছক্কা দানা আর কিছু গুটি দিয়ে খুব সহজেই এই খেলা হয়। কিন্তু কেউ হয়ত জানেনা মজার খেলার উৎপত্তি কোত্থেকে। শুনে অবাক হবেন পৃথিবীর অনেক প্রাচীন খেলার মধ্যে এই খেলাটিও অন্যতম। বিশেষ করে বলতে গেলে সাপ খেলার জনপ্রিয়তা একসময় খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। ধারণা করা হয় খ্রীষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকেই এর প্রচলন শুরু হয়। ভারতীয়রা এখন এটিকে বলে ‘সর্প’ এবং ‘মই’ খেলা। অবশ্য এই নামটি ব্রিটিশরাই দেয়। কেননা ভারত খেকে পরবর্তীতে ব্রিটিশরা তাদের দেশে এ খেলার প্রচলন শুরু করে এবং এই নাম দেয়। যিনি এ খেলার উৎপত্তি ঘটান তিনি হলেন একজন বিখ্যাত কবি সাধু জ্ঞানদেব। তবে খেলাটির প্রাচীন নাম হল মোক্ষ পতং বা পরম পদং বা মোক্ষপথ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে খেলাটি আমরা এখন নিছক বিনোদনের খোরাক হিসেবেই খেলি। তা কিন্তু ব্যবহার হত শুধু বিনোদনের জন্য নয় বরং ছেলেমেয়েদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়ার জন্য। অথার্ৎ আপনি খেলা শুরু করার পর অনেক বাধার সম্মুখীন হবেন কিন্তু এসব বাধা ডিঙিয়ে আপনাকে পৌঁছাতে হবে ১০০ এর ঘরে যেখানে পৌঁছলেই আপনি মোক্ষ লাভ করতে পারবেন। খেলায় ব্যবহৃত বিষধর সর্পগুলোকে নির্দেশ করা হত ‘পাপকর্ম’ হিসেবে যাদের মুখে প্রবেশ করলেই আপনাকে আবার উপর থেকে নিচে নামতে হবে। অর্থাৎ জন্মমৃত্যুও চক্রে আপনি পতিত হয়েছে, সেখান থেকে আপনাকে আবারও মোক্ষ অর্জনের জন্য উপরে উঠতে হবে। কিন্তু সাবধান! আবারও মোক্ষলাভের পথে পিছিয়ে গেলেন। এভাবে তখন পাপকর্ম না করার জন্য শিক্ষা দেয়া হত। অপরদিকে ‘মই’ নিদের্শ করে ‘পূণ্য’ কর্ম হিসেবে। যদি আপনি পূণ্য কর্ম করেন তবে মোক্ষলাভের পথে আপনি দ্রুত অগ্রসর হতে পারবেন। এক্ষেত্রে শিশুদেরকে পাপ ও পূণ্য কর্মের পার্থক্য এবং পূণ্য কর্ম করার গুরুত্ব শেখানোর জন্য এটি ব্যবহৃত হত। এ সর্প খেলায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সংখ্যার বিশেষ মাহাত্ম্য লুকানো আছে। যেমন: ১২ নাম্বার ঘরটি হল ‘বিশ্বাস’ ৫১ ঘরটি ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ ৫৭ ঘরটি হল জ্ঞান এবং ৭৮ ঘরটি হল ‘তপস্যা’ এ ঘরগুলোর জন্য রয়েছে পূণ্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত ‘মই’। এর মাধ্যমে বোঝানো হত যদি আপনার এসব গুণগুলো থাকে তবে মোক্ষলাভের পথ সুগম হবে। অন্য দিকে ৪১ ঘরটি হল অনানুগত বা অবাধ্যতা, ৪৪ ঘরটি হল ‘অহমিকা’ ৪৯ ঘরটি হল ‘অশ্লীলতা’, ৫২ ঘরটি হল ‘নেশাদ্রব্যে আসক্ত’, ৬৯ হল ‘ঋণ’ ৮৪ ঘরটি হল ‘ক্রোধ’, ৯২ ঘরটি হল ‘লোভ’, ৯৫ ঘরটি হল ‘গর্ব’, ৭৩ ঘরটি হল ‘হত্যা’, ৯৯ ঘরটি ‘কাম’। এ সমস্ত ঘরে আপনার জন্য রয়েছে ‘বিষধর সর্প’। যদি আপনি এসব পাপকর্মের কোনটার অধিকারী হন তবে আপনাকে নিম্নস্তরে নেমে আসতে হবে এবং ধরে নেবেন সে সঙ্গে আবারও জন্ম মৃত্যু চক্রে পতিত হয়েছেন। মোক্ষলাভ আপনার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। মইয়ের উপরিভাগে অবস্থান করে কৈলাস, বৈকুণ্ঠ, ব্রহ্মলোক সহ ইত্যাদি উচ্চতর গ্রহলোক এবং এর নিন্মভাবে অবস্থান করে ‘সদগুণাবলী’। বিপরীতভাবে প্রতিটি সর্পেও মস্তকে রয়েছে নেতিবাচক গুণাবলী বা একজন অসুর। কিন্তু খেলায় অংশগ্রহনকারীর একমাত্র লক্ষ্য হল বৈকুন্ঠলোক প্রাপ্তি (১০০ ঘরটি)। যেখানে রয়েছে ভগবান বিষ্ণু ও তার অন্তরঙ্গ ভক্তবৃন্দ। এভাবে প্রাচীনকালে একটি বিশেষ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য পিতা-মাতারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে এ উপায়ে শিক্ষা দিত। তখন শিশুরাও একদিকে বিনোদন ও অন্যদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধ দুটোই অর্জন করত। যার মাধ্যমে তারা হয়ে উঠত একজন আদর্শ গুণাবলীর অধিকারী। শুধুই যে শিশুদের জন্য প্রচলিত ছিল তা নয়। সময়ে সময়ে নারীদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা ছিল। এভাবে ভারতে অনেক শতাব্দী ধরে এ খেলার প্রচলন হয় যা এখনও বিদ্যমান। ১৮৯২ সালে ব্রিটিশরা ভারত থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার পরপরই এ খেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য বা মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। এখনও খোদ ভারতীয়রাও এর প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে ততটা অবগত নয়। বাংলাদেশের এ খেলাটি শুধুই বিনোদনের বা সময় কাটানোর একটি ভাল মাধ্যম হিসেবেই প্রচলিত। তবে বর্তমান যুগের জন্য লুডু বা সর্প খেলাটি দ্যুতক্রীড়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ খেলাটি না খেলার জন্য শাস্ত্রে নিষেধাজ্ঞা আছে। কেননা কলি এসব খেলার মধ্যে প্রবেশ করে সাধারণ জীবদেরকে মায়ার বন্ধনে আটকে রাখতে সচেষ্ট। যার ফলশ্রুতিতে মানুষে মানুষে প্রতিযোগীতার মনোভাবের কারণে কলহ বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাই এই কলিযুগের জন্য এসব খেলা শাস্ত্রে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া এ খেলার প্রকৃত মূল্যবোধ স্মরণ রেখেও যদি কেউ খেলাটি খেলার চেষ্টা করে তবুও তা যথাযথ হবে না। হরে কৃষ্ণ।
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ২০১১ সালে জানুয়ারি প্রকাশিত)