এই পোস্টটি 454 বার দেখা হয়েছে
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দশরথ মহারাজের গৃহে আবির্ভূত হলেন চার পুত্রের রূপ ধারণ করে।
শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী
তস্যাপি ভগবানেষ সাক্ষাদ্ ব্রহ্মময়ো হরিঃ।
অংশাংসেন চতুৰ্ধাগাৎ পুত্রত্বং প্রার্থিতঃ সুরৈঃ ॥
দেবতাদের অনুরোধে ভগবান শ্রীহরি অংশের অংশসহ আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁদের নাম রাম, লক্ষ্মণ, ভরত এবং শত্রুঘ্ন। এইভাবে ভগবান চার মূর্তিতে মহারাজ দশরথের পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
আমরা সুন্দর সমাজ তৈরি করতে চাই, রামের সময় যেরকম সমাজ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু রামকে বাদ দিয়ে কি করে রামরাজ্য হবে? রামের নাম নিয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন চলছে বিভিন্ন প্রকারের রামজন্মভূমি নিয়েও বিভিন্ন আন্দোলন চলছে। কিন্তু রামের প্রতি শরণাগত কয়জন হয়েছেন? রামের নির্দেশ তাঁর শরণাগতির ও শিক্ষার ওপরে আমাদের জীবনকে কতটা প্রতিষ্ঠিত করেছি সেটা বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে না। সাতকাণ্ড রামায়ণ রয়েছে।
বাল্মীকি মুনি প্রথম রামায়ণ রচনা করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন রামায়ণ রচনা করার সময় নিজেদের মনগড়া কিছু মতবাদ সেখানে অনৈতিকভাবে যুক্ত করে ইচ্ছেমতো বিকৃত করেছেন। এসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্তিতে ভুগছে। রামায়ণে রাম থেকে অন্যান্য দেবতাদের প্রাধান্যকে বাড়িয়ে দিয়ে বিভিন্নভাবে বিকৃত করা হয়েছে।
বাল্মীকির রামায়ণ হচ্ছে আসল রামায়ণ। সেই রামায়ণে রামচন্দ্রের লীলা বর্ণনা করা হয়েছে যে, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দশরথ ছিলেন অযোধ্যার রাজা। সসাগরা পৃথিবীকে তিনি সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি এমন ভাবে রাজ্য শাসন করছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে কোনোকিছুর অভাব ছিল না। ঐশ্বর্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। রাজ্যের অধিবাসীদের কোনো দুঃখ ছিল না, অকাল মৃত্যু ছিল না, প্রকৃতিতে খুব সুন্দরভাবে ছয়টি ঋতু প্রকাশিত হতো।
রাজা দশরথ রাজ্য শাসন করতেন মুনিঋষিদের নির্দেশ অনুসারে। বশিষ্ট ঋষি তাঁর কুলগুরু ছিলেন। সবকিছু ভালোমতে চললেও রাজা দশরথ প্রায়ই বিমর্ষ থাকতেন। কারণ রাজার শান্তা নামে এক কন্যা থাকলেও কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। রাজা সর্বদাই চিন্তিত ছিলেন, এত বিশাল সাম্রাজ্য কে দেখবে? একদিন তিনি বশিষ্ট ঋষি এবং অন্যান্য ঋষিদেরকে ডেকে বলছেন, আমার অতুল ঐশ্বর্য, অনুগামী ভৃত্য থাকলেও পুত্রহীন হওয়াতে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। মুনি ঋষিদের সুপরামর্শে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। দশরথের মন্ত্রি ছিলেন সুমন্ত্র। সুমন্ত্র রাজা দশরথকে বললেন, আমি সনৎকুমার থেকে জেনেছি, আপনি শীঘ্রই চার তেজস্বী পুত্র লাভ করবেন।
এটা সত্য যুগের কাহিনি। সেখানে বর্ণনা করা হচ্ছে, ত্রেতা যুগে দশরথ রাজা হবেন এবং ভগবান স্বয়ং তার পুত্র রূপে আবির্ভূত হবেন। তৎকালীন মৃগীর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ নামে এক ঋষি আছে। তিনি ঘন অরণ্যে থাকেন এবং খুব পবিত্র, শক্তিশালী ও ব্রহ্মতেজ সম্পন্ন। লোমপাদ নামে এক রাজা ছিল। এই লোমপাদ রাজার কোনো অপরাধের ফলে বহু বছর তাঁর সাম্রাজ্যে কোনো বৃষ্টি হয়নি। রাজা খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। রাজা সমস্ত মুনিঋষিদের ডেকে বলছেন, কৃপাপূর্বক কিভাবে আমার সাম্রাজ্যে বৃষ্টি হবে তার একটি বিহিত করুন। মুনিঋষিরা জানালেন, ঋষ্যশৃঙ্গ নামে এক তেজস্বী ঋষিপুত্র আছে। তার মহিমা সর্বজন বিদিত। তাঁর মতো নৈষ্ঠিক ঋষি বিরল। তাকে আপনার সাম্রাজ্যে এনে যজ্ঞ করালে এবং আপনার কন্যার সাথে বিবাহ করাতে পারলে আপনার বহুল আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হতে পারে। তখন রাজা বলছেন, আপনারা ঋষিকে আনার ব্যবস্থা করুন। মুনিঋষিরা বললেন, তাকে এখানে আনা দুরূহ হবে। ঐ মুনি থাকেন ঘন অরণ্যে। তিনি জন্ম থেকে পিতার দ্বারা কঠোর অনুশাসনে পালিত হয়েছে, পিতা ছাড়া আর কাউকে চেনে না। কোনো মানুষ দেখেনি, স্ত্রী পুরুষ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা নেই। তাকে আনা হবে কি করে? মুনি ঋষিদের এরকম কথা শুনে রাজা খুব চিন্তিত হয়ে গেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে, কে এই মুনিকে আনতে পারে! মুনিঋষিরা বললেন, একটা নৌকার ব্যবস্থা কর। নৌকার মধ্যে একটি সাজানো গোছানো সুন্দর কক্ষ থাকবে, আর তার মধ্যে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর ও দামী বস্ত্র এবং সুস্বাদু খাদ্য থাকবে সেসাথে থাকবে কিছু সুন্দরী গণিকা।
পরিকল্পনা সফল করতে গণিকারা চলল নৌকা করে জঙ্গলের দিকে। ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমের অনতিদূরে রাজার প্রেরিত দল নিরাপদ আশ্রয়ে দূর থেকে ঋষ্যশৃঙ্গের চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া পর্যবেক্ষন করছে। এদিকে রাজার দল আশ্রমের পাশের কয়েকটি গাছে ভাল ভাল মিষ্টি জাতীয় খাবার লেপন করে দিয়ে এসেছে। ঋষ্যশৃঙ্গ গাছের বাকল খেতে গিয়ে নতুন ধরনের স্বাদ আস্বাদন করে বেশ খুশী হয়ে যায়। একদিন পিতার অনুপস্থিতিতে পুত্র ঘুরতে ঘুরতে এই গণিকাদের নির্ধারিত স্থানে এসে গেছে। ঋষ্যশৃঙ্গ এরকম সুন্দর মানুষ দেখে নি। তিনি জন্মের পর থেকেই শুধু পিতা ও নিজেকে দেখেছেন। তাই কোমল নারী দেহের যে কেউ আছে তিনি সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তখন ঐ গণিকারা পরিচয় পর্ব সেরে নিল। ঋষ্যশৃঙ্গ সেই সব গণিকাদের আশ্রমে এনে তাদের পা ধুয়ে খুব অভ্যর্থনা করে তাদেরকে ফলমূল খেতে দিয়েছে। বিদায় লগ্নে গণিকারা বলছে তোমার অভ্যর্থনায় আমরা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি। তুমি যেমন আমাদের অভ্যর্থনা করলে, আমাদেরও একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে তোমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য। গণিকারা তাকে আলিঙ্গন করতে লাগল। সেসাথে সঙ্গে নিয়ে আসা সুস্বাদু মিষ্টি দিল ঋষ্যশৃঙ্গকে। ঋষিপুত্র মনে করেছে বোধহয় নতুন ধরনের ফল ৷ সেই মিষ্টি খেয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ অভিভূত হয়ে গেছে। কারণ জীবনে কখনো এ রকম সুস্বাদু মিষ্টি খায়নি।
গণিকাদের কোমল আলিঙ্গন, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, সেসাথে নতুন ধরনের ফল খেয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ বিচলিত হয়ে পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে ঐসব স্মৃতি মনে পড়ছে। পরদিন ঋষ্যশৃঙ্গ পুত্র পুণরায় ঐ নারীদের কাছে গিয়ে তাদের প্রশংসা করল। এই সুযোগে গণিকারা তাকে আরো লোভ দেখিয়ে বললো, আমাদের কাছে আরো সুস্বাদু ফল আছে এবং আমাদের অদ্ভুদ এক মন্দির আছে যা জলে ভাসে। সরল ঋষিপুত্র গণিকাদের পাতানো ফাঁদে পড়ে তাদের সাথে অদ্ভুদ আশ্রম পরিদর্শনে নদীর মাঝে অবস্থিত বড় জাহাজে গিয়ে উঠল। ঋষিপুত্র জাহাজে উঠতেই জাহাজ চলতে শুরু করল। মহাতেজস্বী ঋষ্যশৃঙ্গ লোমপাদের রাজ্যে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই অবিশ্বাস্যভাবে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। খুশি হয়ে রাজা এই ঋষিপুত্রের সঙ্গে তার কন্যা শান্তার বিবাহ দিয়েছেন।
আসলে এই সান্তা হচ্ছে দশরথ মহারাজের কন্যা আর নিঃসন্তান লোমপাদ দশরথের বন্ধু হওয়ার দরুন তিনি নিজের কন্যা লোমপাদকে দিয়ে বলেছেন, তুমি একে কন্যা রূপে পালন কর। এটা পুরাণে উল্লেখ আছে, মহারাজ দশরথের মন্ত্রি সুমন্ত্র তাঁকে বলেছিল যে, ঋষ্যশৃঙ্গকে এনে যজ্ঞ করালে অবশ্যই তার পুত্র লাভ হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে গেছে লোমপাদ অশ্বমেধ যজ্ঞ করার জন্য। অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু হয়েছে। অশ্বকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সারা পৃথিবী ভ্রমণ করে অশ্ব ফিরে এসেছে। অশ্বমেধ যজ্ঞ করার পরে ঋষ্যশৃঙ্গ বলছেন যে, অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়েছে। আপনার মনের বাসনা পূর্ণ করতে হলে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করুন। রাজা প্রস্তাবে সম্মত হলেন।
সেই সময় অন্যদিকে চলছিল রাবণের উৎপাত। একদা সমস্ত দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বর্ণনা করছেন রাবণের উৎপাত ত্রিভুবনকে সন্তপ্ত করছে। রাবণ ব্রহ্মার বরে এত প্রতাপশালী ছিল যে দেবতাদেরকেও সে নিজের কাজে নিয়োগ করতো। দেবরাজ ইন্দ্রও নাকি ঐ রাবণের ঘোড়ার ঘাস কাটতেন। আর দেবগুরু বৃহস্পতি রাবণের ছেলেদেরকে পাঠশালায় পড়াতেন। শক্তিশালী শনিকে রাবণ পায়ের পাপে শ করে রেখেছিল। শনির পিঠের ওপর পা রাখত রাবণ। একদিন নারদ মুনি রাবণের প্রাসাদে গিয়ে বলছেন, রাক্ষসরাজ রাবণ শনিকে পায়ের নিচে রেখে তুমি খুব ভাল করছ, আমিও খুব আনন্দ পাচ্ছি, কিন্তু পিরে ওপর পা না দিয়ে ওর পেটের উপর পা রাখলে আরো ভাল হবে। আসল রহস্য হচ্ছে শনির মুখটা নিচু থাকাতে রাবণের ওপর শনির কুদৃষ্টির প্রভাব পরছে না। শনির দৃষ্টি পড়লে রাবণের শক্তি হ্রাস পাবে। তাই নারদ মুনি কৌশলে বলছে ওকে নিচু কেন করছ, উল্টিয়ে পেটে পা দাও। নারদ চাইছেন রাবণের ওপর শনির দৃষ্টি পড়ুক। রাবণ তো অসুর, বেশী নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করলে কি হবে, আসলে বুদ্ধি নেই। সঙ্গে সঙ্গে শনিকে উল্টিয়ে দিয়েছে এবং শনির দৃষ্টি পড়েছে রাবণের ওপর। রাবণের ধ্বংস হওয়ার এটিও একটি কারণ।
একসময় সমস্ত দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়েছেন। ব্রহ্মা বলছেন হ্যাঁ আমার আশীর্বাদে রাবণ এত বলীয়ান হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে বর চেয়েছিল সে গন্ধর্ব, যক্ষ-রাক্ষস সবার হাত থেকে রক্ষা পেতে। কিন্তু মানুষ আর বানরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বর চায় নি। ব্রহ্মা চিন্তা করছেন এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভগবানই উত্তম। হঠাৎ ভগবান বিষ্ণু সেখানে এসে বললেন, হ্যাঁ, আমি তোমাদের সমস্যা জানি। আমি দশরথের পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়ে দুরাচারী রাবণকে বধ করব। ব্রহ্মা দেবতাদেরকে বলছেন যে, ভগবানকে সাহায্য করার জন্য তোমরা বিভিন্ন অংশ রূপে মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ কর। বিশেষ করে বানর এবং ভল্লুক রূপে জন্মগ্রহণ কর।
বানর হয়ে ভগবানকে সাহায্য করার কাহিনি শিব পুরাণে বর্ণিত আছে। সেই সব বানররা সাধারণ বানর ছিল না, তারা সব দেবতা ছিল। যেরকম বায়ু পুত্র হনুমান, বালি, অঙ্গদ এরা সব দেবতা পুত্র ছিল।
আর একটি শিক্ষনীয় কাহিনি মহারাজ এখানে বলেছেন। একবার নারদ মুনি হিমালয়ে গিয়ে তপস্যা করছিলেন। তপস্যা করে কামকে জয় করে ফেলেছিলেন। সেই তপস্যার ফলে তার মনে কামের কোনো প্রভাব নেই, কাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কাম থেকে মুক্ত হয়ে সারা ব্রহ্মাণ্ডে ঘুরে ঘুরে বলে বেড়াচ্ছেন, দেখুন আমি তপস্যা করে কাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছি। কামের কোনো প্রভাব আমার ওপরে নেই। শিব দেখলেন, বিষ্ণুভক্ত হয়ে নারদ এত অহঙ্কার করছে! বিষ্ণুভক্তের কখনো অহঙ্কার করা উচিত নয়। আসলে নারদ মুনি কাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছে। কেননা হিমালয়ের যে জায়গায় বসে তপস্যা করছিলেন ঐ জায়গায় পূর্বে শিব পার্বতী অবস্থান করতেন। একবার কামদেব সেখানে গিয়েছিল। কামদেবের কাজ হচ্ছে কামবাণ নিক্ষেপ করে প্রতিটি জীবের মধ্যে কামভাব জাগরণ করা। সে কামবাণ শিবের ওপরে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল। যে মায়া সারা পৃথিবীকে মোহিত করে রেখেছে সেই মহামায়া দুর্গাকে শিব নিয়ন্ত্রণ করছেন। শিব চোখ খুলে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। তাঁর ক্রোধাগ্নিতে কামদের সেখানেই ভস্মীভূত হয়ে গেলেন। কামদেবের পত্নী রতি স্বামীর মৃত্যুতে শোকার্ত হয়ে গেলেন। তিনি শিবের উপাসনা করেছেন। শিব আবার কামদেবের জীবন দান করেছেন এবং কন্দর্পকে বলছেন তুমি সারা জগতে তোমার প্রভাব বিস্তার করবে কিন্তু আমার এই জায়গায় কোনো দিন প্রভাব বিস্তার করবে না। আর নারদ ঐখানে বসে তপস্যা করছিলেন। সেখানে কামের কোনো প্রভাব নেই। তাই নারদ ভাবছেন কামকে জয় করে ফেলেছেন। শিবতো কম প্রভাবশালী নন। বিষ্ণু মায়া যেমন আছে, শিব মায়াও তেমন আছে। ভগবান শিব তাঁর মায়াতে বিরাট সাম্রাজ্য রচনা করেছেন। নারদ মুনি ঘুরতে ঘুরতে ঐ মায়ার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। মায়ার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে এক রাজার বাড়িতে গিয়েছেন। পরের দিন ঐ রাজার কন্যার স্বয়ম্বর হবে। নারদ মুনি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলে রাজা এসে নারদ মুনির চরণ ধৌত করে তাঁকে আসনে বসিয়ে আরতি করলেন। নারদ মুনি রাজার কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন। রাজা বললেন, আমার সবই কুশল তবে আপনার দর্শনে আরও বেশী প্রসন্ন হয়েছি।
কথা প্রসঙ্গে রাজা নারদমুনিকে বলেছেন যে, আগামীকাল আমার একমাত্র কন্যার স্বয়ম্বর। আমার কন্যা আপনার আশীর্বাদ প্রার্থী। রাজা ভেতরে গিয়ে কন্যাকে নিয়ে এসেছেন। সুন্দরী রাজকন্যা নারদ মুনিকে প্রণাম করে দাঁড়ালে নারদ মুনি অপূর্ব রূপবতী যুবতী রাজকন্যাকে দেখে মোহিত হয়ে পড়েন। নারদমুনি রাজাকে বলছেন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনার কন্যাকে আমার হাতে সমর্পণ করতে পারেন। রাজা আশ্চর্য হয়ে বললেন, আমার তো কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমি তো সংকল্প করেছি আমার কন্যার স্বয়ম্বর সভা হবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজকুমাররা আসবে এবং রাজকন্যার যাকে পছন্দ হবে তাকে বরণ মালা দেবে। আমার সৌভাগ্য হবে যদি আপনাকে জামাতারূপে পাই। আপনি স্বয়ম্বর সভায় আসুন, আমার কন্যা আপনাকে মালা দিলে আপনি বিবাহ করবেন। নারদ মুনি এটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বৈকুণ্ঠে চলে গেছেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। বৈকুণ্ঠে গিয়ে ভগবান বিষ্ণুকে বলছেন, প্রভু একটা শুভ সংবাদ যে, আমি একটা স্বয়ম্বর সভায় যাব। আপনি একটু আমাকে সুন্দর রূপ করে দেন, যেন ঐ রাজকন্যা দেখা মাত্রই আমাকে বরণ করে। বিষ্ণু চিন্তা করছেন, মুনির এই দুর্বুদ্ধি কি করে হলো? যে নারদ সর্বদা আমার গুণ গান গায় তার এরকম দুর্বুদ্ধিতে আমি হতবাক। তখন বিষ্ণু বলছেন, সত্যি নাকি, এ তো খুব ভালো সংবাদ, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আমার যোগমায়া শক্তিতে এখনই তোমাকে সুন্দর করে দিচ্ছি। ভগবান বিষ্ণু নারদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, আর নারদ দেখছেন তার শরীর ভগবান বিষ্ণুর মতোই খুব সুন্দর হয়ে গেছে।
নারদ মুনি উৎফুল্ল চিত্তে স্বয়ম্বর সভায় হাজির। শিব দুজন অনুচর পাঠিয়েছেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে। রাজকন্যা মালা ধরে বিভিন্ন রাজপুত্রদের দেখছে, কাউকে পছন্দ হচ্ছে না। নারদ মুনি ভাবছে, রাজকন্যা আমাকে দেখে অবশ্যই পছন্দ করবে। রাজকন্যা পর্যায়ক্রমে নারদ মুনির কাছে এসে, মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। নারদ মুনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এ ঘটনায় নারদ মুনি যথেষ্ট অপমানিত হয়ে রেগে স্বয়ম্বর সভা ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে শিবের অনুচরেরাও মুনির পিছু ছুটে ছুটে ঘটনা জানতে চাইল। নারদ মুনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে বলতে লাগল, রাজকন্যা আমার মতো সুপুরুষকে অপমান করল। তখন শিবের অনুচরেরা বললো, হে ঋষিবর, আপনার দেহ সুন্দর হলেও মুখটা বানরের মতো। ভগবান বিষ্ণু ইচ্ছে করেই আপনার দেহ এরকম করে দিয়েছেন। কারণ ভগবান বিষ্ণু চান না তার ভক্তের অশুভ পরিণত হোক। কোনো কোনো সময়ে ভক্ত আপাতদৃষ্টিতে মনে করে যে ভগবান আমার শত্রু, কিন্তু ভগবান সব সময় ভক্তের মিত্র। বানরমুখ দেখে নারদ মুনি খুব রেগে গিয়ে বলছেন আমি সারা জীবন বিষ্ণুর পূজা করেছি। শেষে আমাকে এইরকম অপদস্ত করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে নারদ বৈকুণ্ঠে গিয়ে গালমন্দ শুরু করে দিয়েছেন বিষ্ণুকে। ক্রোধে তিনি বলছেন আমাকে এরকম পত্নী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, আপনিও এরকম পত্নী বিরহে ভুগবেন। সেসাথে পত্নীবিরহ থেকে রক্ষা পেতে বানরদের সাহায্য আপনাকে নিতেই হবে। নারদমুনি ক্রোধে বলে ফেললেও তিনি ছিলেন ভগবানের অন্যতম শুদ্ধভক্ত। কিছুক্ষণ পরেই মুনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরে প্রভুর চরণে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। তখন বিষ্ণু মৃদু হেসে বললেন, না না তোমার কোনো চিন্তা নাই। আসলে আমি ধরাধামে লীলা প্রকাশ করতে যাব। আমি ধরাধামে লীলা প্রকাশ করতে যাওয়ার পূর্বে এই রকম লীলা করে থাকি। তোমার মধ্যে যা কিছু ভাব জেগেছে। তা আমিই তোমার অন্তরে জাগিয়েছি। তুমি এরকম মায়ার জগতে গিয়েছ। শিবের মায়া তৈরি করা হয়েছিল। জগত্বাসীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি এরকম লীলা করে থাকি। তাই ব্রহ্মা বলছেন তোমরা সবাই গিয়ে বানর হয়ে জন্মাও, তখন ভগবান বিষ্ণু চলে গিয়েছেন।
সেই দশরথের বাল্যবন্ধু লোমপাদ। রাজা লোমপাদের জামাতা মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গ। দশরথের মন্ত্রী সুমন্ত্র শ্রী সনৎকুমারের কথা স্মরণ করিয়ে রাজা দশরথকে বললেন, মহাপ্রভাবশালী ঋষ্যশৃঙ্গকে আনিয়ে তাঁর দ্বারা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলে মহারাজের পুত্রলাভ হবে। কুলগুরু বশিষ্ঠের সঙ্গে আলোচনা করে দশরথ লোমপাদের জামাতাকে আনলেন। ঋষ্যশৃঙ্গ যখন যজ্ঞ করলেন সেই সময় যজ্ঞকুণ্ড থেকে এক বিরাট কৃষ্ণকায় পুরুষ, দেখতে খুব সুন্দর, শরীর গঠন চমৎকার, মুকুট পরেছেন, বলয় পরেছেন একটা পায়েসের কলস নিয়ে আবির্ভূত হলেন। সবাই খুব খুশি, অকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি হতে লাগল, যজ্ঞ থেকে উত্থিত সে পুরুষ একটা পায়েস ভর্তি পাত্র দশরথের হাতে তুলে দিয়ে অদৃশ্য হলেন। দশরথ সে পাত্রটি নিয়ে অর্ধেক কৌশল্যাকে দিলেন। আর যে অর্ধেক ছিল তার এক তৃতীয়াংশ কৈকীয়কে দিয়েছেন। আর এক অংশ সুমিত্রাকে দিলেন। বাকী এক অংশ কাকে দিবে বুঝতে না পেরে সুমিত্রাকে দিলেন। অতএব সুমিত্রা দু’ভাগ পেলেন। যখন রাণীরা এই পায়েস আস্বাদন করলেন, তখন তাদের শরীর দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে। ভগবান তাদের শরীরে আবির্ভূত হলেন রাম লক্ষ্মণ ভরত শত্রুঘ্ন রূপে। চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে কৌশল্যার একটি পুত্র জন্ম হলো। তার পরে কৈকেয়ীর একটি পুত্রে জন্ম হলো। দুই দিন পরে সুমিত্রার দুটি যমজ পুত্রের জন্ম হলো। রাম হচ্ছে কৌশল্যার পুত্র, ভরত হচ্ছে কৈকেয়ীর পুত্র, লক্ষণ ও শত্রুঘ্ন হচ্ছে সুমিত্রার পুত্র। এইভাবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দশরথ মহারাজের গৃহে আবির্ভূত হয়েছেন চার পুত্রের রূপ ধারণ করে। সেই দিন থেকে সমস্ত মঙ্গলময় লক্ষণ প্রকাশিত হল। সমস্ত মুনিঋষিরা আসছেন, স্বর্গ থেকে দেবতারা আসছেন। এইভাবে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন বড় হয়েছে এবং তাদের ১৬ বৎসর বাস হয়ে গেছে। এইভাবে রামের জন্ম কথা বাল্মিকী রামায়ণে বর্ণনা করা হয়েছে।
লেখক পরিচিতি : শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী ১৯৫৭ তে উড়িষ্যার জগন্নাথ পুরী ধামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে কলেজে ২য় বর্ষে অধ্যয়নকালে ইস্কনে যোগদানের পরের বছর শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের নিকট দীক্ষা প্রাপ্ত হন। ১৯৮৩ থেকে চার বছর তিনি ভুবনেশ্বর মন্দিরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বর্তমানে তিনি মায়াপুরের কো ডাইরেক্টর ও জিবিসি এর সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তাঁর প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো শ্রীজগন্নাথ, শ্রীমতী রাধারাণীর লীলামহিমা, ভগবান কে? এবং ছাত্রদের জন্য রচিত আরো অনেক গ্রন্থ। উল্লেখ্য, তিনি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেকে দেশে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের গুরুদায়িত্বে আছেন।