এই পোস্টটি 184 বার দেখা হয়েছে
এবার তোমাদের জন্য শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের এক সুন্দর লীলা কাহিনী বর্ণনা করছেন : শ্রীমৎ শচীনন্দন স্বামী মহারাজ
৭২৭ খ্রিষ্টাব্দের কথা। দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরে ধনঞ্জয় মেহতা নামে এক অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। সে তার ধনসম্পদের জন্য অত্যন্ত গর্বিত ছিল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে ভগবান জগন্নাথদেবের উপর তার কোন বিশ্বাস ছিল না, কিন্তু শ্রী শ্রী জগন্নাথধাম, পুরীর নানা মাহাত্ম্য শ্রবণ করে তার পুরীধাম দর্শন করার ইচ্ছা জাগলো। আর তাই সে সপরিবারে একবার পুরীতে বেড়াতে এল। সেখানে এসে কাঠ দ্বারা নির্মিত শ্রীজগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর অদ্ভুত মূর্তিকে সে চ্যালেঞ্জ জানানোর সিদ্ধান্ত নিল । মন্দিরে প্রতিদিন তিনবার ভাগ নিবেদন করা হয়। ধনঞ্জয় মেহতা সকল তীর্থযাত্রী জনসাধারণের সামনে ঘোষণা করল “আমি জগন্নাথকে এক লক্ষ টাকা দান করব কিন্তু শর্ত হল সেই একলক্ষ টাকা দিয়ে একটিমাত্র পদ রান্না করে একবারই জগন্নাথকে ভোগ নিবেদন করতে হবে।
সে সময় শাকসব্জী ও ফল অত্যন্ত সস্তা ছিল। আজ থেকে প্রায় তিনশত বৎসর আগে সেই সময় ১০০ টাকারই মূল্য ছিল অপরিসীম। ল্যবান সামগ্রী দিয়ে ভোগ রন্ধনের জন্য ১০০ টাকাই যথেষ্ট আর এক হাজার টাকার তো কথাই নেই; তা ছিল প্রায় সারা মাসের জন্যই অনেক টাকা হয়েও ব্য কিনে অতিরিক্ত। তাই মন্দির কর্তৃপক্ষের কেউই চিন্তা করে কুল পাচ্ছিল না যে এক লক্ষ টাকা দিয়ে কি এমন খাদ্য শ্রীজগন্নাথকে নিবেদন করা যেতে পারে। বিষয়টি বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের পূজারীদের কাছে এক বিরাট সমস্যা হয়ে উঠল। এক তথাকথিত ভক্তের এমন চ্যালেঞ্জিং মনোভাব দর্শন করে তাঁরা নিশ্চিতভাবেই ব্যথিত হয়েছিলেন। পুরোহিতগণ আলোচনা করছিলেন “আমাদের কি তাকে বলা উচিত যে এত বিশাল পরিমাণ টাকা প্রকৃতপক্ষেই অত্যন্ত বেশী? আমাদের কি তাকে স্বল্প পরিমাণ অর্থ দান করার জন্য বলা উচিত? তাকে এইভাবে বলা কি খুব একটা অস্বস্তিদায়ক হবে? আমরা জানি ভগবান জগন্নাথ হচ্ছেন মহিমাময়, তাঁর মন্দির হচ্ছে রাজকীয়, তাঁর আরাধনা, ধর্মীয় সংস্কারাদি হচ্ছে দিব্য, তাই কিভাবে লোকটিকে কম টাকা দেবার জন্য বলতে পারি। যাতে আমরা এই সাধারণ নম্বর জীবেরা তা পরিচালনা করতে পারি?” আমরা ঐ ধনী সেই সময় সকল উপাদানের মধ্যে মাখন ছিল অত্যন্ত দামী। কেবলমাত্র ঘি থেকে আর কতরকম প্রসাদ প্রস্তুত করা যায়? মাখন, নারকেল আর তাল দিয়ে মিষ্টি ও সবচেয়ে দামী প্রসাদ প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে দশ হাজার টাকার মধ্যে। কিন্তু হায়দ্রাবাদের এই কোটিপতি চাইছে এক লক্ষ টাকা মূল্যের প্রসাদ। জগন্নাথ মন্দিরে আদিকাল থেকেই, মন্দিরের আনন্দবাজারে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে মহাপ্রসাদ বিতরিত হয়ে থাকে। বহু রকমের সুস্বাদু প্রসাদের প্রাচুর্য সেখানে।
প্রকৃতপক্ষে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরই হল পৃথিবীর একমাত্র মন্দির যেখানে বিগ্রহ দর্শন থেকে মহাপ্রসাদকে অধিক মূল্যবান মনে করা হয়।। সকলেই সেই প্রসাদ গ্রহণ করতে পারে। সেখানে জাতি, বর্ণ, বংশ কোন ভেদাভেদ নেই। কিন্তু কখনও এই ধরনের সমস্যার উদ্ভব হয় নি। এ সমস্যার সমাধান মন্দিরের পাচকগণের চিন্তারও বাইরে। এমন কোন প্রসাদ নেই যার প্রস্তুতের খরচ এক লক্ষ টাকা হতে পারে। অবশেষে মন্দির কর্তৃপক্ষের সকলে মিলে সিন্ধান্ত গ্রহণ করলেন “চলো, এই সমস্যাটি আমরা স্বয়ং ভগবান জগন্নাথকে জানাই, তিনিই যা করার করবেন।” এখন সকলে মিলে একত্রে জগন্নাথদেবের কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন। প্রধান পাতা বা পুরোহিত আকুলভাবে ভগবানের কাছে সমস্যার কথা নিবেদন করে অবিরাম প্রার্থনা করতে লাগলেন “হে ভগবান, দয়া করে আমাদের জানিয়ে দাও একলক্ষ টাকা দামের কোন্ প্রসাদটি তুমি পছন্দ করছে।
এদিকে সেই ধনী ধনঞ্জয় মেহতাও হায়দ্রাবাদে তার ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ফিরে যাবার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। সে আর বেশি দিন পুরীতে থাকতে চাইল না। সুতরাং সে পরদিন সকালে তার কাছে এসে পাতাদের জানাতে বললো এক লক্ষ টাকার প্রসাদ বিষয়ে তারা কি সিদ্ধান্ত নিল। উত্তরে পাণ্ডারা জানালো তারা স্বয়ং ভগবানের কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ধনী ধনঞ্জয় মেহতা ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটুক, তা চাইছিল। তাই সে পুরীতে আর ও কিছুদিন থাকতে রাজী হলো। প্রকৃতপক্ষে, এইভাবে ভগবান সেই অহংকারী ধনীকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন যে প্রথমে আমাদের ভগবানের ইচ্ছাটি অবগত হয়ে সেই অনুসারে আচরণ করা উচিত।
এক লক্ষ টাকা অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের মালিক ভগবানের কাছে অতি ক্ষুদ্রবং প্রায় কিছুই না বলা চলে। যাই হোক, অবশেষে জগন্নাথদেব পাণ্ডাদের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিলেন। তিনি স্বপ্নাদেশ দিলেন ঐ ধনী ব্যক্তিটিকে বলো, আমাকে একটি পান নিবেদন করতে। কিন্তু সেই পান পাতাটি ভেতরে চুন মিশ্রিত সুপারি থাকবে না। বরং চুনের বদলে থাকবে কেবল মিহি মুক্তা-পূর্ণ। আর সেই মুক্তা-পূর্ণ যে সে মুক্তা-চূর্ণ হলে চলবে না। সেই মুক্তাটিকে জন্মাতে হবে পুরুষ হাতীর কপালের অভ্যন্তরে ব্রাহ্মণ বা পাতাদের কাছ থেকে লাে এই স্বপ্নাদেশের কথা জনে ধন সম্পদে গর্বিত সেই ধনঞ্জয় মেহতার মুখ চুপসে গেল। পাণ্ডারা তাকে বললো, “জগন্নাথ আপনার কাছে কত সাধারণ একটি জিনিস চেয়েছেন। শুধুমাত্র একটি পান আর সুপারি। তবে শুধু সুপারিটি পুরুষ হস্তীর কপালের ভিতরে জন্মানো মুক্তা-চূর্ণ দিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত হতে হবে। M
একটি পান ও সুপারি এ যুগেও কত সস্তা। বড় জোর আট আনা কি এক টাকা। শুধু সুপারিটি পুরুষ হাতীর কপালের ভেতরে জন্মানো মুক্তার মিহি চূর্ণ দ্বারা মিশ্রিত হতে হবে। আর এই ব্যাপারিটিই ধন গর্বে গর্বিত ধনঞ্জয় মেহতাকে শঙ্কিত করে তুললো । কেননা সাপের মাথার মণির মতোই পুরুষ হাতীর কপালে জন্মানো মুক্তা অত্যন্ত দূর্লভ। হাতী মরাই হোক আর জ্যান্তই হোক এক একটি হাতীর দাম এক লক্ষ টাকা। তাহলে এখন তাকে সেই দুর্লভ হাতীটিকে খুঁজে বার করার জন্য কত শত হাতী যে হত্যা করতে হবে তার ইয়ত্তা নেই। কেননা, কথিত আছে যে, প্রতি দশ লক্ষ হাতীর মধ্যে মাত্র ঐরকম, কপালের ভিতরে মুক্তার জন্ম দেওয়া হাতী হয়। সেই মুক্তাটিকে বলা হয়। ‘গজ-মুক্তা’। এক একটি হাতির পেছনেই এক লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। তাই এখন তাকে যে কত লক্ষ কোটি টাকা অমন মুক্তা সমৃদ্ধ হাতী অন্বেষণের জন্য খরচ করতে হবে, তা ভেবে তার মাথা ঘুরতে লাগলো। সে বুঝতে পারল, তার পরাজয় হয়েছে। সে ভগবানের চরণে অপরাধ করেছে। এমন কি ভগবানকে একটি সুপারি দান করার ও সে আর উপযুক্ত নয়। সে তার পাগড়ি আর চপ্পল খুলে, এক ব্যাগ ভর্তি এক লক্ষ টাকা হাতে নিয়ে মন্দিরের ভিতরে পাগলের মতো ছুটে গেল। মানুষের বিরাট ভিড় তাকে অনুসরণ করল।
সকলেই এই আশ্চর্য দৃশ্যটি দেখতে উৎসুক। তার নিজেরই ধনগর্বের খেলার প্যাঁচে ধনঞ্জয় মেহতা এখন ভগবানের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে চলেছে। তার সমস্ত অহংকার এখন চূর্ণ হয়েছে। সে জগন্নাথের কাছে গিয়ে প্রথমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তারপর শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে পরম ভক্তি ভরে সে বলতে লাগলো– “হে ভগবান, আমি তোমার সঙ্গে মূর্খ মানুষের মতো ব্যবহার করেছি তাই এখন আর তোমাকে একটি সুপারি নিবেদন করার ও সমর্থ আমি নই। তোমাকে নিবেদন করার আর কিই বা আছে? এই জগতের সবই তোমার এবং তুমিই সব । হে ভগবান, দয়া করে তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমি এক ক্ষুদ্র ও পতিত মানুষ তোমার শরণাগত হয়েছে। কৃপা করে আমাকে যথার্থ জ্ঞানী করে তোল। আমার যা কিছু আছে আজ সবই তুমি নিয়ে নাও। কেননা সবই তোমার ।”
চৈতন্য সন্দেশ অ্যাপ ডাউনলোড করুন :https://play.google.com/store/apps/details?id=com.differentcoder.csbtg