এই পোস্টটি 1263 বার দেখা হয়েছে
গীতা জয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন
গোপীকান্ত দাস ব্রহ্মচারী: ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার; তাঁর নাম, ধাম, লীলা এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই সবই হচ্ছে পূর্ণ শুদ্ধ, নিত্য মুক্ত। অবাধ্য সন্তানেরা পিতাকে ভুলে গিয়ে যেমনটি কষ্ট পায়, তেমনি এই জগতের জীবেরা ভগবানকে ভুলে গিয়ে নানা প্রকার দুঃখ ভোগ করে। ভগবান তখন তাঁর কোন প্রিয় ভক্তকে নিমিত্ত করে জগতবাসীকে পথ প্রদর্শন করতে উপদেশ প্রদান করেন। ভগবানের সেই উপদেশই হচ্ছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার। যার আরেক নাম গীতোপনিষদ্। ‘গীত্’ মানে ‘গান’, ‘উপনিষদ্’ অর্থাৎ উপ মানে নিকটে, গুরুর নিকটে শ্রবণ করে যে জ্ঞান লাভ হয়।
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন আদি গুরু। আর সৃষ্টির প্রারম্ভে তাঁর অহৈতুকী কৃপার ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সূর্যদেব বিবস্বানকে তাঁর প্রথম শিষ্য রূপে গ্রহণ করে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই পরমতত্ত্ব দান করেন। ভগবানের নিকট থেকে শুধু শ্রদ্ধার সহিত শ্রবণ করার ফলেই তিনি তত্ত্ব জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করেন। একে বলা হয় শ্রুতি। যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ শুধুমাত্র বংশী ধ্বনির মাধ্যমেই আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয়ে দিব্য জ্ঞান প্রদান করেন। মানব সমাজ যাতে ভগবদ্ তত্ত্ব জ্ঞান লাভ করে চিরতরে দুঃখময় এই অনিত্য সংসারের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দময় গোলোক ধামে প্রত্যাবর্তন করতে পারে, সেই স্থায়ী বন্দোবস্ত করার জন্য ক্ষত্রিয় রাজাদের উপর এই জ্ঞান বিতরণের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। কারণ যিনি দেশের শাসক, তার কর্তব্য নয় নাগরিকদের শোষণ করা। ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য প্রজাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করা। ‘ক্ষৎ’ মানে হচ্ছে ‘আঘাত’, অর্থাৎ দুর্বল প্রজাদের যিনি অকারণে নির্যাতিত অবস্থা হতে রক্ষা করেন তিনিই ক্ষত্রিয়। যেমন স-সাগরা পৃথিবীর রাজা পরীক্ষিৎ একটি নিষ্পাপ গাভীকে একটি শূদ্র হত্যা করতে উদ্যত হলে তাকে তিনি মৃত্যুদ- দিতে তরবারি ধারণ করেছিলেন। এটাই ভগবানের আদেশ। আর এটাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, ক্ষৎ-ত্রায়তে ইতি ক্ষত্রিয়।
রাজা বা শাসক, পিতা, শিক্ষক এবং গুরু হচ্ছে মানব জাতির পথপদর্শক বা কর্ণধার। দেশের নাগরিকদের উচিত সর্বদা তাঁদের অনুসরণ করা। আর যারা দেশের কর্ণধার তাদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তের মাধ্যমে অর্থাৎ নিজে আচরণ করে জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়া। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (২/২১) উল্লেখ করেছে-
“শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তা অনুকরণ করেন। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, অন্যেরা তারই অনুসরণ করে।”
শাসক বা রাজা হচ্ছেন ভগবানের প্রতিনিধি। তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জাগতিক সুবিধার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক উন্নতি হচ্ছে কিনা তা ভালোভাবে দেখা। ভগবান চেয়েছিলেন রাজারা যেন প্রজাদের পারমার্থিক উন্নতির জন্য তাদের গীতার শিক্ষা অনুশীলন করার শিক্ষা প্রদান করে। তাহলে সমস্ত মানব জাতির ইহকাল ও পরকালের সমস্যার সমাধান হবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ শাসকের আসনে বসে গীতার শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ করার ফলে সমগ্র জগতে একটি দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই যারা বুদ্ধিমান মানুষ তাদের কর্তব্য হচ্ছে আর ক্ষণকাল বিলম্ব না করে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আশ্রয় গ্রহণ করা। তাহলে আমাদের জীবনের হতাশা, ভয় ও দুর্গতি থেকে অবিলম্বে মুক্তি পেতে পারি। তবে আমাদের মনে রাখা দরকার গীতার বহু ভাষ্য বাজারে পাওয়া যায়। তাই সাবধানতার সাথে যাচাই করে যথাযথ গীতা সংগ্রহ করতে হবে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২,০৪,০০,০০০ বছর আগে এই জ্ঞান সূর্যদেব বিবস্বানকে দান করেন কিন্তু কালের প্রভাবে এ জ্ঞান বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই পুনরায় অর্জুনের মাধ্যমে পুনরায় এই জ্ঞান দান করেন। কেননা না অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং তাঁর ভক্ত। আজ থেকে ৫০০০ বছর পূর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ভগবান স্বয়ং শুভ তিথি অর্থাৎ মোক্ষদা একাদশী তিথিতে এই মহান তত্ত্ব জ্ঞান অর্জুনকে উপলক্ষ্য করে বলেছিলেন। কেন বলেছিলেন এটা আমাদের ভালোভাবে বিবেচনা করতে হবে। ভগবান গীতার তত্ত্বজ্ঞান সমস্ত মানুষের জন্য দান করেছেন। এই গীতা হচ্ছে মনুষ্য জীবনের গাইড বই। কোন বিজ্ঞানী যখন কোন কিছু তৈরি করে তার সাথে একটা গাইড বই তৈরি করে যাতে সেটির ব্যবহার সকলে যথাযথভাবে জানে। তেমনি পরম স্রষ্টা শ্রীকৃষ্ণ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সুখ, শান্তি ও আনন্দের জন্য স্বয়ং কুরুক্ষেত্রে এই জ্ঞান দান করেছেন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা কোন মানুষের কাল্পনিক দর্শন নয়। এটি সম্পূর্ণ অভ্রান্ত। তার প্রমাণ হচ্ছে এই দিব্য গ্রন্থটি যতবার পাঠক পাঠ করবেন ততই তিনি নব নব তত্ত্ব উপলদ্ধি করে দিব্য আনন্দ সাগরে নিমগ্ন হবেন। এই গ্রন্থটি সম্পূর্ণ নির্ভূল তথ্য সমন্বিত একটি গ্রন্থ যাকে সমস্ত উপনিষদের সারাতিসার বলে বর্ণনা করা হয়। অর্জুন যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়, হতাশাগ্রস্থ শোক, হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ত্যাগ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীর দ্বারা তাঁর সমস্ত সংশয় নাশ করেন এবং অর্জুন পুনরায় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হন। অর্জুনের সমস্ত অজ্ঞান নাশ হয়েছিল এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণকে (গীতা ১৮/৭৩) অর্জুন বললেন– “হে অচ্যুত! তোমার কৃপায় আমার মোহ দূর হয়েছে এবং আমি স্মৃতি লাভ করছি। আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে এবং যথাজ্ঞানে অবস্থিত হয়েছি। এখন আমি তোমর আদেশ পালন করব।” অর্জুন এভাবে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করার ফলে তার যুদ্ধে জয় হয়েছিল। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য হচ্ছে অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসারে গীতা শ্রবণ করে শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করা। তাহলে জীবনের সমস্ত প্রকার অসুবিধা থেকে সে চিরতরে মুক্তি পাবে। তাই যে সমস্ত মানুষ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন করে ঐকান্তিকভাবে উপকৃত হতে চান, ভগবানের নির্দেশনায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার জন্য তাদের অবশ্যই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। হরেকৃষ্ণ!