এই পোস্টটি 291 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইস্কন) প্রতিষ্ঠাতা আচার্য
প্রবচনটি ১৯৭৩ সালে ৩০ জানুয়ারি কলকাতায়
ভারত চেম্বার অব কমার্স কর্তৃক আয়োজিত এক সভায় প্রদান করেন।
সম্মানিত সভাপতি মহোদয়-মহাদয়াগণ আমি আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাকে এরূপ একটি সভায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। আমি সর্বোচ্চ প্রয়াস দিয়ে আপনাদের সেবা করার চেষ্টা করব। আজকের বিষয় সংস্কৃতি এবং বাণিজ্য। আমরা ব্যবসা বলতে বুঝি বৃত্তির দায়ীনি কাজ। বৈদিক সংস্কৃতি অনুসারে বিভিন্ন রকম ব্যবসা আছে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ৪/১৩ অনুসারে-
চাতুর্বৰ্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্ ॥
প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারিটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।
সমাজে প্রতিটি মানুষের যোগ্যতা এবং কাজ করার ধরণ অনুসারে সমাজ ব্যবস্থাকে- চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়। এইগুলো হলো- ব্রাহ্মণ (মেধা ভিত্তিক যোগ্য ব্যক্তি ও উপদেশক) ক্ষত্রিয় (নেতা ও যোদ্ধা, সৈন্য বাহিনী) বৈশ্য (কৃষক ও ব্যবসায়ী) এবং শূদ্র (সেবক)। যে কোনো ব্যক্তিকে ব্যবসায় প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে জানা প্রয়োজন সে কিরূপ কাজ করতে যাচ্ছে এবং সে কি কাজে বেশি দক্ষ। প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন কর্মদক্ষতা রয়েছে এবং প্রতিটি মানুষ বিভিন্ন প্রকার কাজে তার এই কর্ম দক্ষতাকে যথার্থভাবে লাগাতে পারে। কিন্তু আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলেছি যেখানে প্রতিটি মানুষেই তার কর্ম-দক্ষতাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসারে ব্যবসায় নিয়োজিত হয় যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত নয়। একটি সমাজে প্রাক ঐতিহ্যগত একটি বিভাজন বিদ্যমান যা একটি মানব শরীরেও রয়েছে। সমস্ত শরীরকে যদি আমরা একটি একক কার্যালয় ভাবি তবে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো হচ্ছে বিভিন্ন দপ্তর। যেমন- মস্তিষ্ক, বাহু, উদর এবং চরণ এটা বেশ বিজ্ঞান ভিত্তিক। তাই একটি সমাজের মস্তিষ্ক দপ্তর ব্রাহ্মণ, বাহু দপ্তর ক্ষত্রিয়, উদর দপ্তর বৈশ্য, চরণ দপ্তর শূদ্র। ব্যবসাকেও এরূপ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভাজন করা উচিত। মস্তিষ্ক দপ্তর হচ্ছে সবচেয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি দপ্তর কেননা মস্তিষ্ক দপ্তর ছাড়া অন্যান্য দপ্তরগুলো বাহু, উদর ও চরণ কোনো কাজ করতে পারে না। যদি বাহু কিছুটাও দুর্বল হয় তবুও ব্যবসাকে চালিয়ে নেওয়া যায়। যদি চরণ দুর্বল হয় তবে ব্যবসাকে চালিয়ে নেয়া যাবে।
আপনার ভিত্তি অবশ্যই পরম পুরুষোত্তমের সন্তুষ্টি বিধানার্থে করা উচিত। আপনি একজন ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, আইনজীবি বা ডাক্তার হতে পারেন এটা কোনো বিষয় নয় কিন্তু আপনার বৃত্তি অনুশীলনের মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানকে সন্তুষ্ট করছেন কিনা সেটাই বিচার্য। অন্যথায় তা আপনার জন্য কালক্ষেপন ছাড়া আর কিছু নয়।
কিন্তু যদি মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে যায় তবে সবকিছুতেই গণ্ডগোল হবে। যদি আপনার মস্তিষ্ককে কেটে ফেলেন তবে আপনার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ বাহু, উদর এবং চরণ সবগুলোই অকার্যকর হয়ে যাবে। মস্তিষ্ক দপ্তর চালিত হয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দ্বারা। সংস্কৃতি ছাড়া প্রতিটি ব্যবসায় বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং এটাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং বর্তমানে সমস্ত ব্যবসা বৃত্তি এক ধরনের জগাখিচুড়ি অবস্থা। তাই একটি সমাজে কিছু উপদেশক শ্রেণির ব্যক্তির প্রয়োজন যারা অন্যান্য দপ্তরগুলোকে উপদেশের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত হতে সহায়তা করতে পারে। আর এই উপদেশক শ্রেণির ব্যক্তিরা হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে বুদ্ধিমান যারা ব্রাহ্মণ নামে পরিগণিত হবে।
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্ ॥
শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য—এগুলি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম। গীতা ১৮/৪২
যারা সমাজরূপ দেহটির মস্তিষ্ক স্বরূপ তারাই সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সংস্কৃতি মানে “জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা।” জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য না জানা একটি মানুষের জীবন হাল বিহীন একটি নৌকার মতো।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে ব্যর্থ হয়েছি কেননা বর্তমান সমাজে মস্তিষ্ক শ্রেণি নেই। সমস্ত মানব সমাজ প্রকৃত ব্রাহ্মণ শ্রেণির অভাবে যথাযথ উপদেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যার ফলে সমাজের অন্যান্য শ্রেণিগুলোকে দিক-নির্দেশনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। অর্জুন হচ্ছেন একজন যথার্থ উদাহরণ, যিনি সমাজের ক্ষত্রিয় শ্রেণির সদস্য হয়েও আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য অবশ্যই উপদেশ গ্রহণ করা উচিত। তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা তার বৃত্তি হচ্ছে যুদ্ধ করা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি নিজেকে এই বৃত্তিতে যুক্ত রেখেছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়েও তিনি উপদেশ গ্রহণ করেছিলেন যথার্থ ব্রাহ্মণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট থেকে।
নমো ব্রাহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ ॥
ব্রাহ্মণদের আরাধ্যদেব, গাভী ও ব্রাহ্মণদের হিতকারী এবং জগতের কল্যাণকারী শ্রীকৃষ্ণকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি। শ্রীকৃষ্ণ ও গোবিন্দ নামে পরিচিত সেই পরমেশ্বর ভগবানকে আমি পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।
[বিষ্ণুপুরাণ ১/১০/৬৫]
এই শ্লোকটির প্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ‘গো’ অর্থাৎ গাভী এবং ব্রাহ্মণ (গো ব্রাহ্মণ) কেন তাদেরকে এত জোর দেয়া হচ্ছে? কেননা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও গো প্রতিরক্ষা ব্যতীত কোনো মানব সমাজকে উৎকৃষ্ট মানব বলা যেতে পারে না। তা শুধু বিশৃঙ্খল ও পাশবিক প্রবৃত্তি যুক্ত এক জঘণ্য সমাজ। এইরূপ একটি বিশৃঙ্খল সমাজে কোনো ব্যবসায়ী তার নিজের যথার্থ বৃত্তি অনুসরণ করতে পারে না। কোনো সমাজে ব্যবসা যথার্থভাবে করা সম্ভব নয় যদি না সে সমাজটি যথার্থ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত না হয়। যথার্থ সংস্কৃতিগত ব্যবস্থা সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতমে উপদেশ দেওয়া হয়েছে নৈমিষারণ্যের এক সভায় যেখানে বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তি ও ব্রাহ্মণেরা সমবেত হয়েছিলেন এবং শ্রীল সূত গোস্বামী এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি সমাজের ব্রাহ্মণ শ্রেণির প্রতি বেশ গুরুত্ব আরোপ করেন।
অতঃ পুম্ভির্দ্বিজশ্রেষ্ঠা বর্ণাশ্রমবিভাগশঃ।
স্বনুষ্ঠিতস্য ধর্মস্য সংসিদ্ধির্হরিতোষণম্ ॥
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, তাই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, স্বীয় প্রবণতা অনুসারে বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির সন্তুষ্টি-বিধান করাই হচ্ছে স্ব-ধর্মের চরম ফল। শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/১৩
বৈদিক সংস্কৃতি সমাজকে চারটি বর্ণ (বৃত্তিমূলক বিভাজন) এবং চারটি আশ্রমের (জীবনের আধ্যাত্মিক স্থিতি) মাধ্যমে সুশৃঙ্খলায়িত করেছে। উল্লেখ্য যে, বর্ণগুলো হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। আশ্রমগুলো হলো ব্রহ্মচর্য আশ্রম (ছাত্র জীবন) গার্হস্থ্য (পারিবারিক জীবন) বানপ্রস্থ আশ্রম (অবসর জীবন) সন্ন্যাস আশ্রম (ত্যাগী জীবন)। যদি আমরা বর্ণাশ্রম ধর্মের এই উপদেশ গ্রহণ না করি তবে সমস্ত সমাজ বিশৃঙ্খল হতে বাধ্য। বর্ণাশ্রম ধর্মের অনুশীলন পরম পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান করে।
বর্ণাশ্রমাচারবতা পুরুষেণ পর পুমাণ্।
বিষ্ণুরারাধ্যতে পন্থা নান্যত্তত্তোষকারণম্ ॥
পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণু বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্মের আচারযুক্ত পুরুষদের দ্বারা আরাধিত হন। বর্ণাশ্রম আচার ব্যতীত তাঁকে পরিতুষ্ট করার অন্য কোনো উপায় নেই। [বিষ্ণুপুরাণ ৩/৮/৯]
এই শ্লোকটি অনুসারে প্রতিটি ব্যক্তি তার বর্ণ ও আশ্রম অনুসারে কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পরম পুরুষোত্তমকে সন্তুষ্ট করতে পারে। যেমন একটি প্রদেশে আমাদের কর্ম দ্বারা সরকারকে সন্তুষ্ট করি। যদি আমরা তা না করি তবে আমরা হলাম অবাধ্য নাগরিক এবং আমাদের দ্বারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। অনুরূপভাবে আমরা এই জগতের সমস্ত বস্তু ভোগ করছি, যদি এই জগতের যিনি স্রষ্টা তাকে সন্তুষ্ট না করি তবে সমস্ত ভৌতিক জগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। বৈদিক সংস্কৃতি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, “তুমি যাই করোনা কেন তা অবশ্যই পরম পুরুষোত্তমের সন্তুষ্টি বিধানার্থে কর।” এটাই হলো প্রকৃত সংস্কৃতি ।
স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ। আপনি যে বৃত্তি অনুশীলন করুন না কেন ব্রাহ্মণের বৃত্তি, ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি, বৈশ্যের বৃত্তি, শূদ্রের বৃত্তি। আপনার বৃত্তি অবশ্যই পরম পুরুষোত্তমের সন্তুষ্টি বিধানার্থে করা উচিত। আপনি একজন ব্যবসায়ী, অধ্যাপক, আইনজীবি বা ডাক্তার হতে পারেন এটা কোনো বিষয় নয় কিন্তু আপনার বৃত্তি অনুশীলনের মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানকে সন্তুষ্ট করছেন কিনা সেটাই বিচার্য। অন্যথায় তা আপনার জন্য কালক্ষেপন ছাড়া আর কিছু নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (৩/৯) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র। যজ্ঞ মানে হচ্ছে বিষ্ণু বা কৃষ্ণ। যিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান। বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয়! ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। (গীতা ৩/৯)
যদি আমরা পরম পুরুষোত্তমের সন্তুষ্টি বিধানার্থে কর্ম না করি তবে আমরা কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কর্মজাত প্রতিক্রিয়া ভোগ করতে বাধ্য হব। (অন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ)। কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে আমরা এর প্রতিক্রিয়া হয় নিজ শরীর থেকে অথবা অন্যের কাছ থেকে পাবো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সময়ের মানুষেরা জানে যে, আত্মা নামে একটি বস্তু রয়েছে এবং এই আত্মাটি তার স্বভাবজাত প্রবৃত্তি অনুসারে এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ২/১৩ অধ্যায়ে এরূপ নির্দেশনা পাওয়া যায়।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তি : “মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী এক দেহ থেকে অন্য কোনো দেহে দেহান্তরিত হয়।”
আমি এই বিষয়ে অনেক স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক ও অধ্যাপকদের সাথে কথা বলেছি যারা মৃত্যু পরবর্তী সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ। কিন্তু বেদ থেকে আমরা জানতে পারি মৃত্যুর পরে একটি জীবন রয়েছে। আত্মার এই স্থানান্তর সম্পর্কে আমরা বর্তমান জীবনেও অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি। এটা একটি সাধারণ বিষয় একটি শিশু শরীর ধীরে ধীরে বালক-যুবক-ও বৃদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। বৃদ্ধ ব্যক্তিটি মৃত্যুর মাধ্যমে তার দেহ পরিত্যাগ করার পর নতুন দেহ পায়। এটি প্রাকৃতিক ও যৌক্তিক। আসলে আমাদের দু’টি শরীর রয়েছে। স্কুল ও সুক্ষ্ম শরীর। সূক্ষ্ম শরীরটি তৈরি মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার দ্বারা এবং স্থূল শরীরটি তৈরি মাটি, পানি, বায়ু, আগুন ও আকাশ, জল দ্বারা। আমাদের শরীরের হাড়, রক্ত ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এই পাঁচটি বস্তুর বিকার মাত্র। যখন মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের এই শরীরের পরিবর্তন হয়, তখন স্থুল শরীরের বিনাশ হয়, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীরটি অবিকৃত থাকে। এই সূক্ষ্ম শরীরটি পরবর্তীতে স্থুল শরীরে। এটা অনেকটা এই রকম যখন আমরা ঘুমায় তখন কি হয়? রাতে ঘুমে আমরা স্থুল শরীরটি সম্বন্ধে ভুলে যাই। স্বপ্ন যোগে আমাদের বিছানা, বাড়ি, এমনকি স্থানটি সম্পর্কে পর্যন্ত বিস্তৃত হই। যখন নিদ্রাভঙ্গ হয় তখন স্বপ্নেরও অবসান হয়। স্বপ্নের অবসানের মাধ্যমে আমাদের স্থূল শরীর সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠে। এটিই হলো প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা। তাই আমরা হলাম দর্শক কখনো সূক্ষ্ম শরীরে কখনো স্থুল শরীরের। উভয় শরীরের পরিবর্তন হয়। কিন্তু দর্শক হিসেবে আমরা সর্বদাই অপরিবর্তনশীল। আমরা হলাম আত্মা যা এই শরীরের মধ্যেই রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত আমাদের অবস্থা কি। রাত্রিতে আমরা স্থূল শরীরকে ভুলে যাই। আর দিনে সূক্ষ্ম শরীরকে ভুলে যাই। তাহলে আমাদের আসল শরীর কোন্টি? এটিই হলো যথার্থ প্রশ্ন যা আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত। এরূপেই আমরা ব্যবসা করতে পারি। যা করেছিল অর্জুন তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা বা ক্ষত্রিয়। তিনি তার সংস্কৃতি ভুলেন নি। তিনি তার গুরুর কাছ থেকে ভগবদ্গীতা শ্রবণ করেছিলেন। যদি আমরা শুধু ব্যবসা করে যাই এবং আধ্যাত্মিক জীবনের উৎকর্ষ সাধন না করি তবে আমাদের ব্যবসা সময় অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয় । আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সারা বিশ্বে এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো আমরা সংস্কৃতিগত জীবনটি বিস্মৃত হইনি। আমরা বলছি না যে, আপনারা ব্যবসা বন্ধ করে আমার মতো সন্ন্যাসী হয়ে যান। কৃষ্ণ কখনো বলেন নি যে, “হে অর্জুন তুমি যুদ্ধ পরিত্যাগ কর।” তিনি বলেছিলেন “হে অর্জুন যেহেতু তুমি ক্ষত্রিয় অবশ্যই তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে এবং এটাই তোমার ধর্ম।” এটাই ছিল অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের উপদেশ। অনুরূপভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রতিটি মানুষকে উপদেশ দিচ্ছে “আপনাদের ব্যবসা পরিত্যাগ করার প্রয়োজন নেই, নিজ নিজ ব্যবসা চালিয়ে যান, শুধু কৃষ্ণ সম্পর্কে শ্রবণ করুন।” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও শ্রীমদ্ভাগবতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতিগতাং তনুবাঙ্মনোভি” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কখনো বলেননি তুমি পদত্যাগ কর।
আপনি একজন ব্যবসায়ী হতে পারেন অথবা অন্য পেশার মানুষ কিন্তু আপনি জানেন না আপনি কে? আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কেন আপনি প্রাকৃতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছেন? মৃত্যুর পর কোথায় যাবেন? এই সম্বন্ধে যদি আমাদের জ্ঞান না থাকে তবে আমাদের সব বৃথা।
যে যে অবস্থানে আছে সেই অবস্থানে থেকে নিজের আধ্যাত্মিক প্রগতি সাধন করাটাই মূল বিষয়। পশুদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় কেননা তারা চেতনাকে বিকশিত করতে পারে না। যদি কোনো মানুষ তার আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে বিকশিত না করে তবে সে মানব দেহধারী পশু ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্মেণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ। তাই আমাদের শাশ্বত জীবন সম্পর্কে খুব সচেতন হওয়া উচিত। আমরা এই দেহ নয় শাশ্বত আত্মা। এটাই প্রকৃত পরিচয়। ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে শরীরের মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের মৃত্যু ঘটে না। এটাই হলো আমাদের জ্ঞানের বিকশিত অবস্থা। অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা যার অর্থ নিজের সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য সনাতন গোস্বামী যিনি ছিলেন নবাব হোসেন শাহের অর্থমন্ত্রী। তিনি মন্ত্রীপদ থেকে অবসর নিয়ে যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সম্মুখে উপনিত হন তখন তিনি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করেন, “হে প্রভু মানুষ আমাকে পণ্ডিত বলে (কেননা তিনি ব্রাহ্মণ কুলজাত স্বাভাবিকভাবে তাকে সবাই পণ্ডিত বলত যার অর্থ জ্ঞানী ব্যক্তি)। কিন্তু আমি পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও জানি না আমি কে? আমার কি করণীয়? এটাই হলো আমাদের অবস্থা। আপনি একজন ব্যবসায়ী হতে পারেন অথবা অন্য পেশার মানুষ কিন্তু আপনি জানেন না আপনি কে? আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কেন আপনি প্রাকৃতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছেন? মৃত্যুর পর কোথায় যাবেন? এই সম্বন্ধে যদি আমাদের জ্ঞান না থাকে তবে সব বৃথা ।
ধৰ্মঃ স্বনুষ্ঠিতঃ পুংসাং বিষ্বক্সেনকথাসু যঃ।
নোৎপাদয়েদ্য দি রতিং শ্রম এব হি কেবলম্ ॥
স্বীয় বৃত্তি অনুসারে বর্ণশ্রম পালন রূপ স্ব-ধর্ম অনুষ্ঠান করার ফলেও যদি পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তনে আসক্তির উদয় না হয়, তা হলে তা বৃথা শ্রম মাত্র । শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/৮
তাই সকলের প্রতি আমার এই অনুরোধ এই যে, যখন আপনি ব্যবসায় নিয়োজিত থাকেন কৃষ্ণ আপনাকে যে পদে অধিষ্ঠিত করেছে আপনি সেই দায়িত্ব ও ব্যবসা যথাযথভাবে সম্পন্ন করুন। কিন্তু কৃষ্ণ সম্বন্ধজাত জ্ঞান বিস্মৃত হবেন না। কৃষ্ণ সম্বন্ধজাত জ্ঞান অর্থ “ঈশ্বর চেতনা।” আমাদের অবশ্যই জানা উচিত ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশ মামৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ। আমরা কৃষ্ণের নিত্য, শাশ্বত অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আমরা এখন মন ও চেতনার সাথে সংগ্রাম করছি। এই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা কি? আমরা অবশ্যই এই নশ্বর জীবনে পরবর্তীতে যে শাশ্বত জীবন রয়েছে তার অনুসন্ধান করা উচিত। ধরা যাক এই নশ্বর জীবনে আমি অনেক বড় ব্যবসায়ী কিন্তু কত সময়ের জন্য? ২০/৫০ সর্বোচ্চ ১০০ বছরের জন্য। পরবর্তী জীবনে আমি যে আবার একজন বড় ব্যবসায়ী হবো তার নিশ্চয়তা কি? না। এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা এই সম্বন্ধে সজাগ নই। আমরা শুধুমাত্র বর্তমান জীবন নিয়েই সচেতন। বর্তমান জীবনের পরবর্তীতে এক শাশ্বত জীবন রয়েছে সেই সম্বন্ধে উদাসীনতাই হলো সবচেয়ে বড় ভুল। এই জীবনে হয়তো বা আমি অনেক বড় ব্যবসায়ী হয়েছি কিন্তু কর্ম প্রভাবে পরবর্তী জীবনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হতে পারি । পদ্মপুরাণ অনুসারে ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব রয়েছে।
জলজা নবলক্ষাণি স্থাবরা লক্ষবিংশতি ।
ক্রিময়ো রুদ্রসংখ্যকাঃ পক্ষিণাং দশলক্ষণম্।
ত্রিংশলক্ষাণি পশবঃ চতুর্লক্ষাণি মানুষাঃ ৷৷
নয় লক্ষ প্রকার জলজ প্রাণী রয়েছে। বৃক্ষ লতারূপে কুড়ি লক্ষ স্থাবর প্রাণী রয়েছে। কীট-পতঙ্গ ও সরীসৃপ রয়েছে এগারো লক্ষ। পাখি হচ্ছে দশ লক্ষ। ত্রিশ লক্ষ পশু এবং চার লক্ষ প্রকার মানুষ রয়েছে। [পদ্ম পুরাণ]
তাই এই মানব জীবন লাভ করার পূর্বে ৮ মিলিয়ন (৮০ লক্ষ) বিভিন্ন প্রজাতির শরীর প্রাপ্ত হতে হয়েছে। এই বিশাল জৈবিক পরিক্রমার মাধ্যমে আমরা এই দুর্বল মানব শরীর প্রাপ্ত হয়েছি।
কৌমার আচরেৎ প্রাজ্ঞো ধর্মান্ ভাগবতানিহ ।
দুলর্ভং মানুষং জন্ম তদপ্যধ্রুবমর্থদম্ ৷৷
প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মনুষ্যজন্ম লাভ করে জীবনের শুরু থেকেই, অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই অন্য সমস্ত প্রায়স ত্যাগ করে ভাগবত-ধর্ম অনুষ্ঠান করবেন। মনুষ্যজন্ম অত্যন্ত দুর্লভ। এবং অন্যান্য শরীরের মতো অনিত্য হলেও তা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, কারণ মনুষ্য-জীবনে ভগবানের সেবা সম্পাদন করা সম্ভব। নিষ্ঠাপূর্বক কিঞ্চিৎ মাত্র ভগবদ্ভক্তির অনুষ্ঠান করলেও মানুষ পূর্ণসিদ্ধি লাভ করতে পারে। [ভাগবত ৭/৬/১)
এই মানব শরীর খুব দুর্লভ তাই আমাদের শুধুমাত্র খুব বড় ব্যবসায়ী হয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়।
আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি আপনার জানতে চেষ্টা করুন আপনি কে? কৃষ্ণ কে? কৃষ্ণের সাথে আপনার সম্পর্ক কি? প্রকৃত জীবন কি? এবং আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কি? এটি ছাড়া আমরা যতই জ্ঞান অনুশীলন করি না কেন তা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের অবশ্যই জানতে হবে পরবর্তী জীবন কি? পরবর্তী জীবনে আমরা কোথায় যাচ্ছি? বিভিন্ন রকম মানুষ রয়েছে- কিছু মানুষ কর্মী, কিছু মানুষ জ্ঞানী, কিছু মানুষ যোগী, কিছু মানুষ ভক্ত নামে পরিগণিত। কর্মীরা জাগতিক সুখে সন্তুষ্ট তারা এই জীবনে সর্বোচ্চ সুখ উপভোগ করতে চায় এবং মৃত্যুর পর স্বর্গে উপনীত হওয়াই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। জ্ঞানীরা সুখ চায় তবে তথাকথিত জাগতিক পদ্ধতিতে নয়। তারা নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ব্রাহ্মণ্য স্থিতিতে নিমগ্ন করতে চায়। যোগীরা চায় অলৌকিক শক্তি অর্জন করতে। আর ভক্তরা চায় শুধুমাত্র ভগবানের সেবা করতে। কিন্তু অনেকের অজানা ভগবান কে? এবং কিভাবে তার সেবা করতে হবে। তাই ভগবৎ সম্বন্ধজাত জ্ঞান অনুশীলন করাই হলো সর্বোচ্চ সংস্কৃতি। বিভিন্ন রকম সংস্কৃতি রয়েছে কর্মীর সংস্কৃতি, জ্ঞানীর সংস্কৃতি, যোগীর সংস্কৃতি সর্বোপরি ভক্তের সংস্কৃতি। আসলে এই সমস্ত লোককে যোগী বলা হয় তাদের নির্ধারিত অনুশীলন করে। তাই তারা কর্মযোগী, জ্ঞানযোগী, ধ্যানযোগী ও ভক্তযোগী নামে পরিচিত।
যোগিনামপি সর্বেষাং মদ্গতেনান্তরাত্মনা ।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাংস মে যুক্ততমো মতঃ ॥
যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদ্গত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত। (গীতা ৬/৪৭)
কৃষ্ণ উত্তর দিচ্ছেন কে সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী? কৃষ্ণই উত্তর দিচ্ছেন, যে সর্বদাই আমার চিন্তায় মগ্ন। তার অর্থ দ্বারায় কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলনকারী ব্যক্তিরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার যোগী রয়েছে কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী হচ্ছে যে সর্বদাই পূর্ণ বিশ্বাস ও প্রীতির সহিত কৃষ্ণের চিন্তা করছে। যে ব্যক্তি ভগবানের সেবা করছে সে হচ্ছে প্রথম শ্রেণির যোগী। তাই আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি আপনারা জানতে চেষ্টা করুন আপনি কে? কৃষ্ণ কে? কৃষ্ণের সাথে আপনার সম্পর্ক কি? প্রকৃত জীবন কি? এবং আপনার জীবনের উদ্দেশ্য কি? এটি ছাড়া আমরা যতই জ্ঞান অনুশীলন করি না কেন তা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মাধ্যমে আমাদের দুর্লভ মনুষ্য জন্ম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমরা এই জীবনে জাগতিক জ্ঞান অর্জন করি কিন্তু মৃত্যুর সাথে সাথে সমস্ত জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়। কেউ যদি মৃত্যুর পূর্বে এই সমস্ত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজে পায় তবে তার জীবন স্বার্থক। একটি বিড়াল মরে যাবে, একটি কুকুর মরে যাবে এইভাবে সবাই মরে যাবে কিন্তু যদি কেউ মৃত্যুর পূর্বে কৃষ্ণকে জেনে যেতে পারে তার মৃত্যু স্বার্থক।
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ॥
হে অর্জুন! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধান লাভ করেন। (গীতা ৪/৯) তাই সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করে সবাইকে অনুরোধ করছি দয়া করে কৃষ্ণকে জানতে চেষ্টা করুন এবং এর মাধ্যমে আপনার জীবন স্বার্থক হবে। আপনি কি ব্যবসা করছেন এটা কোনো বিষয় নয়। বেঁচে থাকার জন্য আপনি বিভিন্ন কিছু না কিছু করতে পারেন। কৃষ্ণ বলছেন শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেদকর্মণঃ। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না। (গীতা ৩/৮) যদি আপনি আপনার কর্ম পরিত্যাগ করেন তবে আমাদের বিঘ্নিত হবে। জীবিকা অর্জনের জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি কিন্তু এর পাশাপাশি জীবনের সার্থকতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং তার যথার্থ অনুশীলন করা প্রধান কর্তব্য। জীবনের সার্থকতা অর্জন করা খুব সহজ। শুধুমাত্র কৃষ্ণকে জানার চেষ্টা করা। এটা কিভাবে করতে হয়? তা আমরা সারা বিশ্বে প্রচার করছি। এটা খুব কঠিন নয়। যদি আপনি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পড়েন তবে আপনি কৃষ্ণ সম্বন্ধে বুঝতে পারবেন। কৃষ্ণ সবকিছুই ব্যাখ্যা করেছেন। শিক্ষানবীশদের জন্য কৃষ্ণ বলছেন,
রসোহহমল্লু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়োঃ।
প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু ॥
অনুবাদ : হে কৌন্তেয়! আমিই জলের রস, চন্দ্র ও সূর্যের প্রভা, সর্ব বেদের প্রণব, আকাশের শব্দ এবং মানুষের পৌরুষ। (গীতা ৭/৮)
এখানে বলার প্রয়োজন নেই আমি ঈশ্বরকে দেখতে পারি না। সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বর আছেন। জলের স্বাদ হচ্ছে কৃষ্ণ। ঈশ্বর আমরা সবাই জল পান করি এবং এর স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে অনুভব করি। তারপরও কেন আমরা বলি, “আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই। না”। যদি আমরা সরাসরিভাবে ঈশ্বরের চিন্তা করি তবে তিনি অবশ্যই দর্শন দিবেন। শুধুমাত্র যদি আমরা ভগবদ্গীতার রসোহহমন্নু কৌন্তেয় প্রভাম্মি শশিসূর্যয়োঃ। (গীতা ৭/৮)
কৃষ্ণ বলছেন, আমিই জলের স্বাদ এবং চন্দ্ৰ সূর্যের আলো। কে সূর্য ও চন্দ্রের আলোকে দেখতে পায় না? কে জলের স্বাদ অনুভব করতে পারে না? এইগুলো যদি সব আমরা দেখতে ও অনুভব করতে পারি তবে আমরা কেন বলবো আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই না। যদি আমরা শুধুমাত্র ভক্তিযোগের অনুশীলন করি, তবে যখনি আমরা জলের স্বাদ অনুভব করবো তখন আমরা চিন্তু করবো ‘ও! এই হচ্ছে কৃষ্ণ। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকে মনে পড়বে। যখন আমরা সূর্যের আলো দর্শন করবো তখন আমাদের মনে পড়বে। যখন চন্দ্রালোক দর্শন করবো তখনও! যখন আকাশের শব্দ শুনবো তখনও মনে পড়বে “ও! এই হচ্ছে কৃষ্ণ, এভাবেই জীবনের প্রতিটি ধাপে কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারলে তবে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ যোগীতে পরিণত হব। সর্বোপরি যদি আমরা হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। এই মহামন্ত্রটি জপ করার অভ্যাস করি তবে আমরা খুব সহজেই কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারি। এটার জন্য কোনো কর দিতে হবে না। আপনাদের ব্যবসায়ে কোনো ক্ষতি হবে না। যদি আপনারা হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করেন। সবসময় কৃষ্ণকে স্মরণ করেন তবে ক্ষতি কি? কেন আপনার এটি করবেন না? এটাই হল যথার্থ সংস্কৃতিগত জ্ঞান। আপনারা যদি ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি কৃষ্ণ সম্বন্ধজাত এই জ্ঞান অনুশীলন করেন তবে আপনাদের জীবন হয়ে উঠবে সর্বতোভাবে সার্থক সমাজ হবে সুশৃঙ্খল। আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।