এই পোস্টটি 49 বার দেখা হয়েছে
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলেছেন, সমগ্র মহাজগতের চারভাগের তিন ভাগই চিৎ বৈকুণ্ঠ জগৎ আর বাকী এক ভাগ জড় ব্রহ্মাণ্ড জগৎ। সৃষ্টির এক ভাগ জুড়ে থাকা শুধুমাত্র এই জড় ব্রহ্মাণ্ড জগতে রয়েছে অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড ও গ্রহ নক্ষত্রের সমাবেশ। আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, ভূমি, অহংকার ও মহৎতত্ত্ব এই সপ্ত মহাআবরণ দিয়ে এক একটি ব্রহ্মাণ্ড গঠিত। ‘ব্রহ্ম’ অর্থ ‘বিশাল’ এবং ‘অণ্ড’ অর্থ ‘ডিম্ব’ অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ড মানে বিশাল গোলক বুঝায়। প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যবর্তী স্থানে সূর্য অবস্থিত। আমাদের এই ছোট ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাস ৬০০ কোটি কিলোমিটার। এই ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত শনি গ্রহ (Saturn) এর ১২ লক্ষ কিলোমিটার উপরে এবং ধ্রুবতারার ১২ লক্ষ কিলোমিটার নীচে মধ্যবর্তী স্থানে সপ্তর্ষিমণ্ডল অবস্থিত।
রাতের স্নিগ্ধ আকাশের দিকে তাকালে অনেক সময় কোটি কোটি তারার ভিড়ে ৭টি অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের সন্নিবেশ আলাদাভাবে চোখে পড়ে। বৈদিক শাস্ত্রমতে এই ৭টি নক্ষত্র সপ্তঋষি নামে পরিচিত। এরা হলেন-ভৃগু, মরীচি, অত্রি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, বশিষ্ঠ। তবে বিভিন্ন মনন্তরে সাতজন ঋষির পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে সপ্ত ঋষিগণ জীবের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রে পরিভ্রমণ করে থাকেন। সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মা তার মন থেকে এই সাতজন ঋষি সৃষ্টি করেন। এজন্য তাদেরকে ব্রহ্মার মানসপুত্র বলা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই সপ্তঋষিকে মানবসমাজে যথার্থ পারমার্থিক জ্ঞান প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। তাই তারা যুগেযুগে পথ প্রদর্শক ও আদি পিতা হিসেবে মানবজাতিকে সঠিক পথ সন্ধানে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যাও সপ্তর্ষিমণ্ডলের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত। গোলাকার অতি উজ্জ্বল এই সেভেন বেয়ার, গ্রেট বেয়ার (Great Bear) কিংবা বিগ ডিপার নামে পরিচিত। প্রতি ১০০ বছরে এটি প্রতি নক্ষত্রে গমনাগমন করে থাকে। গবেষণা মতে ৮০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত ৫টি নক্ষত্রে স্থান পরিবর্তন করেছে বিগ ডিপার। যা বৈদিক শাস্ত্র , হরাপ্পান সভ্যতা ও সপ্তর্ষি পঞ্জি মতেও সঠিক। এ প্রসঙ্গটি ১৯৬২ সালে উত্থাপন করেন বিজ্ঞানী ফিলোজেট। এছাড়া সেভেন বেয়ার খুব ধীর গতিতে পোল স্টারের (ধ্রুবতারা) এর চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে। জ্যোতির্বিদ্যা মতে, বিগডিপারসমূহ হচ্ছে পূর্বদিকে আলফা রশ্মি সমৃদ্ধ আলকাইড নক্ষত্র, ডেলটা রশ্মি সমন্বিত মিগ্ররেজ, এপসাইলন রশ্মি সমন্বিত পিকডা, ইটা রশ্মি সমন্বিত ধুবি নক্ষত্র, নিচে এই সাতটি নক্ষত্রের বৈদিক নাম দেওয়া হল।
আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে এই সাতজন ঋষির বংশীয় পরিচয় থেকে মানুষের বিশেষ বিশেষ নাম ও গোত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। বৈদিক জ্যোতির্বিদ্যায় বৈদিক রাশি ও গোত্রের সত্যতা এবং বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের সাথে সম্পর্কের ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন পুরাণ যেমন বিষ্ণুপুরাণ, মৎস্য পুরাণ, বায়ু পুরাণ, বেদ ও অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতমে সপ্তঋষির নাম, কার্যকলাপ ও বৈজ্ঞানিক গতিবিধির বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এসব পুরাণাদি শাস্ত্রে লিখিত সপ্তর্ষিমণ্ডলের বিবরণ সম্পর্কে অবগত হয়ে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী যেমন ভাস্করাচার্য, যমুনাচার্য, বল্লভ প্রমুখ সপ্তর্ষিমণ্ডল অস্তিত্ব সম্পর্কিত বহু গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে গেছেন। অতি আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পরবর্তীতে পশ্চিমা বিজ্ঞানীগণ, ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করেছেন এবং তাদের অনেকেই ভারতীয় বৈদিক সাহিত্য ও বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। ১৯৬২ সালে বিজ্ঞানী ফিলিওজেড গ্রেট বিয়ার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভাস্করাচার্যের অবদানের কথা বলেন এবং বিষ্ণু পুরাণ থেকে সুনির্দিষ্ট শ্লোকের অবতারণা করেন।
আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্রে সপ্তর্ষিমণ্ডলের অবস্থান নির্ণয় করে বহু ঘটনা ও ব্যক্তি অবস্থানের সঠিক সময় নির্ণয় করা হচ্ছে। খুব সম্প্রতি পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা সপ্তর্ষিমণ্ডলের ধারণা সমন্বিত আধুনিক “স্টার চার্ট সফটওয়্যার” আবিস্কার করে। এই সফটওয়্যারের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এটি এখনো পর্যন্ত কোন ভুল গণনা সম্পন্ন করেনি। এটি সূর্য, চন্দ্র, সপ্তর্ষিমণ্ডলের গতিবিধি অনুযায়ী সঠিক গণনাকার্য সম্পাদন করতে পারে।
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, আগস্ট ২০১০ ইং
পর্ব -০২ এর লিংকঃ