এই পোস্টটি 476 বার দেখা হয়েছে
বৈষ্ণব শাস্ত্র থেকে সংগৃহীত ভগবানের বিশ্বরূপের পাঁচটি দৃষ্টান্ত
সত্যরাজ দাস
রাজীব ও আমি অনেক বছরের বন্ধু এবং আমাদের কথোপকথনে প্রায়ই রম্যরস হয়। আমরা স্বল্পভাবে নির্দিষ্ট প্রহসন আস্বাদন করি যা সর্বদা আমাদেরকে একে অপরের সন্নিকটে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে তার রসবোধ পারমার্থিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটায়। যেমন- সে সম্প্রতি আমাকে বলল যে, তার জীবন একেবারেই যথাযথ। প্রায় প্রতিটি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে, দুর্ভাগ্য তার আনন্দে বাগড়া দেয়। আমি বললাম কেন তার এরকম মনে হচ্ছে?
“ও, এর কারণ আমি তো ভগবান, তুমি জান না?”
যদিও কথাটি কৌতুক মনে হচ্ছিল, কিন্তু তার সেই মন্তব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার রসদ যুগিয়েছিল। আমরা বলাবলি করছিলাম, যেখানে রাজীব জন্মগ্রহণ করেছে সেখানে অনেক ‘ভগবান’ দেখা যায় যা এক ধরনের দৈব প্রকাশ বলে অভিহিত করা হয়।
‘কথিত ভগবান’ নিয়ে এ সমস্যাটি পশ্চিমা বিশ্বে এক প্রকার প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে, কিন্তু সমস্যাটি এখানেও রয়েছে। আমরা অনেক অহংকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানি। আমরা অনেকেই অহংকারী মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্পর্কে অবগত। তারা নিজেদেরকে চরম ভোক্তা হিসেবে জাহির করে। তাদের এই প্রকার মনোভাবকে আমি চরম ‘দৈব ইস্যু’ হিসেবে অবহিত করতে পারি। তারা এটি প্রত্যক্ষভাবে না বললেও আচরণে প্রতিফলিত হয়। এক্ষেত্রে পরমেশ্বর হওয়ার চিন্তা-চেতনাটি ধীরে ধীরে বিশালত্বে রূপ নেয়।
এই ব্যাপারে আধ্যাত্মিক গুরুরা, কে ভগবানের প্রকাশ আর কে নয় বিষয়টি নিয়ে প্রামাণিক তথ্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন অনুভব করে। রাজীবের সাথে আমার সেই কথোপকথনে আমি উল্লেখ করি, ভগবানের অবতারদের সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে ভবিষ্যৎবাণী শাস্ত্রে পূর্ব থেকেই উল্লেখ রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আগমনের ভবিষ্যৎবাণী বায়ু পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, যেখানে তার মতো শচীদেবীর নামও উল্লেখ রয়েছে। ঐ একই শ্লোকে যে স্থানে তিনি আবির্ভূত হবেন সেই নবদ্বীপের কথা এবং তার মিশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে : হরি নাম কীর্তনকে কেন্দ্র করে সংকীর্তন আন্দোলনের সূচনা করবে। যখন বৈদিক শাস্ত্রে ঠিক বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করা হয় না, তখন সেখানে কোনো অবতারের দৈহিক বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তিগতভাবে কিছু লক্ষণের কথা উল্লেখিত হয়, যার মাধ্যমে সেই অবতারকে চিহ্নিত করা যায়
বিশ্বরূপের সূচনা
আমার বন্ধুকে যে বিষয়টি সবচেয়ে আগ্রহান্বিত করে তোলে তা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ। রাজীব ভগবদ্গীতা সম্পর্কে অধ্যয়ন করে এবং সে জানত যে, একাদশ অধ্যায়ে কৃষ্ণের ভগবত্তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। কৃষ্ণ অর্জুনকে তার অতীন্দ্রিয় প্রকাশ প্রদর্শন করে যার মধ্যে রয়েছে, সৃষ্টি ও প্রলয়, বিভিন্ন ধরনের জীব, সর্বগ্রাসী কাল ও উপাদানসমূহ, যেগুলো সম্মিলিতভাবে এক স্থানে পুঞ্জীভূত হয়। কিন্তু রাজীব কখনো জানত না যে, এই বিশ্বরূপ হল একটি উত্তম পরীক্ষা যার মাধ্যমে কাউকে নির্ধারণ করা যায় প্রকৃতপক্ষে সে ভগবান কি না? তার সাথে কথোপকথন শেষ করে বাসায় ফিরে আসি শ্রীমদ্ভাগবতের (২/১/২৪) শ্লোকের প্রভুপাদ ভাষ্য ই-মেইল করি :
“অর্জুনের মঙ্গল সাধনের জন্য ভগবান তাঁর এই বিরাট রূপ প্রকাশ করেননি, তিনি তা করেছিলেন সেই সমস্ত নির্বোধ মানুষদের জন্য যারা যাকে-তাকে ভগবানের অবতার রূপে গ্রহণ করে বিপথগামী হয়। এই বিরাট রূপ প্রদর্শনের মাধ্যমে ভগবান তাদের শিক্ষা দিলেন যাতে তারা সেই সমস্ত তুচ্ছ অবতারদের অবতার বলে গ্রহণ করার পূর্বে তাদেরকে তাদের বিরাট রূপ প্রদর্শন করতে অনুরোধ করে।”
রাজীব ও আমি এতে সম্মত হই যে, এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে অনেক ব্যক্তিকে আটকানো যাবে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা উচিত তারা কি গীতায় বর্ণিত বিশ্বরূপের মতো বিশ্বরূপ প্রদর্শন করতে পারবে কি না? তখন তাদের ভিত্তিহীন দাবী সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারবে এবং ভগবানের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করবে, অনুশীলন না হোক অন্তত তত্ত্বগতভাবে।
রাজীব অবাক হয়ে গেল : অর্জুন কি এটি কল্পনা করতে পেরেছিল? এটি কি এমনও হতে পারে না যে কৃষ্ণ অর্জুনের সাথে ছল করতে এসব করেছিল?
ঐতিহ্য তা শিক্ষা দেয় না এবং যদি কেউ মহাভারতে বর্ণিত কৃষ্ণ ও অর্জুনের সম্পর্ক পর্যবেক্ষন করে তবে এটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কৃষ্ণ অর্জুনের সাথে ছল করেনি বরং তাকে পরিশুদ্ধ করে আলোকিত করেছিল।
উপরন্তু অর্জুনের মতো ব্যক্তির সাথে ছল করা অসম্ভব। তিনি ছিলেন উচ্চপদস্থ একজন ব্যক্তি এবং সুদক্ষ যোদ্ধা, তার অপ্রমত্ত ন্যায় বিচার এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণাবলীর জন্য তিনি ছিলেন সর্বজন বিদিত। সৃষ্টির শুরু বা শেষ সম্পর্কে পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও কিংবা নানাবিধ অদ্ভুত জিনিসের অস্তিত্ব এবং ভয়ংকর যুদ্ধ দর্শন করেও অর্জুনকে এই বিশ্বরূপ প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রবঞ্চনা করা সহজ নয়। রাজীব সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
পাঁচটি দৃষ্টান্ত
আমি আরো উল্লেখ করি যে, কৃষ্ণ আরো অনেকের কাছে তার বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেছিলেন, এর মাধ্যমে এর প্রামাণিকতা সুস্পষ্ট হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই বিশেষ রূপটি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পাঁচটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে।
কৃষ্ণ প্রথম তাঁর মাতা যশোদার কাছে এই বিশ্বরূপ দু’বার প্রদর্শন করেছিলেন।
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে (১০/৭/৩৫-৩৭) বর্ণিত রয়েছে যে, যখন শিশু কৃষ্ণ একবার সানন্দে হাই তুলেছিলেন, তখন তাঁর মাতা কৃষ্ণের মুখগহ্বরে আকাশ, স্বর্গ, মর্ত্য্য, জ্যোতিষচক্র, দিকসমূহ, সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, সমুদ্র, দ্বীপ, পর্বত, নদী, বন এবং স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রাণীদের দর্শন করেছিলেন। অনুরুপ ঘটনা ঘটেছিল এর কিছু পরেই, যখন তার পুত্ৰ (কৃষ্ণ) মাটি খেয়েছিলেন (১০/৮/৩৭-৩৯)
“কৃষ্ণ যখন তাঁর মায়ের আদেশে তাঁর মুখব্যাদান করেছিলেন, তখন মা যশোদা তাঁর মধ্যে স্থাবর, জঙ্গম, অন্তরীক্ষ, দিক্, পর্বত, দ্বীপ, সমুদ্র, ভূতল, প্রবাহ বায়ু, অগ্নি, চন্দ্র, তারকা, জ্যোতিশ্চক্র, জল, তেজ, পবন, আকাশ, অহঙ্কারের বিকার থেকে সৃষ্ট সমস্ত বস্তু, ইন্দ্রিয়সমূহ, মন, তন্মাত্র, সত্ত্ব, রজ এবং তমোগুণ, জীবের আয়ু, স্বভাব, কর্মবাসনা এবং বিভিন্ন প্রকার শরীর দর্শন করেছিলেন। তিনি বৃন্দাবন-ধাম সহ সমগ্র জগৎ এবং সেই সঙ্গে নিজেকেও দর্শন করে তাঁর পুত্রের অনিষ্ট আশঙ্কায় ভীত হয়েছিলেন।”
একজন বিনম্র ভক্ত হিসেবে পরমেশ্বরের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আস্বাদনকারী যশোদা অর্জুনের ন্যায় কৃষ্ণকে তার প্রকৃত রূপ দ্বি-ভূজ রূপে দর্শন করাটাই প্রাধান্য বোধ করেছিলেন। ভগবানের এই বিরাট রূপের ধারণা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ভগবানের রূপ সম্বন্ধে ধারণা প্রদান করার জন্যই প্রদর্শিত।
এ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম পাঁচ স্কন্ধের বিভিন্ন শ্লোকে তা আলোকপাত করা হয়েছে। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে যে, ভগবানের বিরাট রূপ হল একটি অনিত্য প্রকাশ যেখানে সমস্ত সৃষ্টি অবস্থান করে। এটি বিশেষভাবে শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৩/৩০) এ উল্লেখ করা হয়েছে।
কেন ভগবান এই রূপটি উর্ধ্বস্তরের ভক্ত যশোদা ও অর্জুনের কাছের প্রদর্শন করেন? এর উত্তরটি সরল, যেরকম প্রভুপাদ প্রথমদিকে উক্ত করেছিলেন: এর মাধ্যমে কৃষ্ণ তাঁর ভগবত্তা নিয়ে অবিশ্বাসী ও সংশয়বাদী ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জন্য বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবে, এই প্রত্যাশায় প্রদর্শন করেছিলেন।
মাতা যশোদার কাছে দু’বার এই রূপ প্রদর্শনের পর অনেক বছর অতিবাহিত হয় এবং কৃষ্ণ পুণরায় তা প্রদর্শন করেন। বিরাট রূপের তৃতীয় দৃষ্টান্তটি প্রদর্শিত হয়েছে কুরুবর্গদের রাজসভায়, যা মহাভারতে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে উল্লেখ রয়েছে, কৃষ্ণ শান্তি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে বিধ্বংসী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ না হয়। চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি মতবাদের মতো দুর্মতি দুর্যোধন শান্তি প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে, উপরন্তু কৃষ্ণকে বন্ধী করার হীন চেষ্টা করেন। দুর্যোধনের দুঃসাহস দেখে ভগবান হাসলেন এবং তাঁর সেই রোমাঞ্চকর রূপের এক অংশ প্রদর্শন করেন, যিনি তা পরবর্তীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে প্রদর্শন করবেন। সেখানে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর অজস্র বাহুর প্রতিটিতে অস্ত্র সস্ত্র সজ্জিত ছিল এবং সেগুলো উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর রূপটি ছিল বিভৎস। তাঁর দ্যুতি ছড়ানো দিব্যদেহে বিভিন্ন দেবদেবী শোভা পাচ্ছিল। তাঁর সেই রূপে ছোট-বড় সমস্ত জীবের সার প্রদর্শিত হয়েছিল। তাঁর মুখ এবং চামড়ার মধ্যে বিদ্যমান অসংখ্য ছিদ্র থেকে অগ্নি নির্গমন হচ্ছিল, অতএব, তাঁকে সূর্যরশ্মির ন্যায় প্রতিভাত হয়েছিল।
যার কারণে, দুর্যোধন ও কৌরব রাজারাও ভগবানের সেই জ্যোতির্ময় বিধ্বংসী রূপের দিকে তাকাতেই পারছিল না এবং ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল শুধুমাত্র ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, বিদুর, সঞ্জয় ও উপস্থিত সাধুবর্গ সেই দিব্য প্রকাশ দর্শন করতে সমর্থ হয়েছিল। সম্মতি দিলেন। এভাবে ভক্তরা একেক রকম পরিকল্পনা করে গ্রন্থগুলো বিক্রি করতে লাগলেন। ভক্তরা গ্রন্থগুলো বিতরণ করে খুব আনন্দ পেত। গ্রন্থ বিতরণ করতে করতে তাদের দর্শনের কথা মানুষকে বলতো এবং এর মাধ্যমে তারা গুরুদেবের দিব্য উপস্থিতি অনুভব করতো। মন্দির হতে মন্দিরে খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রন্থ প্রচারই হলো দুর্যোধনের পিতা জন্মান্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র তখনকার সেই আলোড়ন শুনতে পেয়ে কৃষ্ণের কাছে সেটি দর্শন করার দৃষ্টিশক্তি প্রার্থনা করলেন। কৃষ্ণ তখন সেই প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তাকে কিছু মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিশক্তি প্রদান করলেন, যার মাধ্যমে তিনি চিন্ময় ক্ষমতা বলে সেই রূপ দর্শন করেছিলেন।
কৌরবদের এভাবে বিমোহিত করার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বিরাট বিশ্বরূপ প্রত্যাহার করেন এবং যুদ্ধ অবধারিত জেনে সাত্যকী ও কীর্তিভর্মাকে সাথে নিয়ে প্রাসাদ প্রস্থান করলেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বেও কৃষ্ণ অর্জুনের কাছে তাঁর পূর্ণ বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেন। তখন চতুর্থবারের মতো তিনি এই রূপ প্রদর্শন করেন। আমি ইতোপূর্বে বলেছিলাম যে, কৌরব রাজসভায় কৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপের আংশিক প্রদর্শন করেছিলেন। আর আমি এখন বলছি “পূর্ণ বিশ্বরূপ” কারণ প্রভুপাদ ইঙ্গিত করেছেন যে, অর্জুনের সম্মুখে সেই বিশেষ বিশ্বরূপটি ছিল অদ্বিতীয়:
“অর্জুনের আগে কেউই ভগবানের এই বিশ্বরূপ দর্শন করেননি। কিন্তু অর্জুনকে দেখানোর ফলে অন্তরীক্ষে স্বর্গলোক ও অন্যান্য গ্রহলোকবাসীরাও এই রূপ দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বলা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কৃপা করে অর্জুনকে তাঁর যে বিশ্বরূপ দেখিয়ছিলেন, পরম্পরা ধারায় অধিষ্ঠিত অন্যান্য গ্রহলোকের ভক্তরাও তাঁর সেই রূপ দর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির প্রস্তাব নিয়ে দুর্যোধনের কাছে গিয়েছিলেন, তখন তিনি তাকেও এই রূপ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ কিছুটা বিশ্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই রূপ অর্জুনকে যে রূপ দেখিয়েছিলেন তার থেকে ভিন্ন। এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এই রূপ আর আগে কখনও কেউ দেখেনি। (ভগবদ্গীতা যথাযথ, ১১/৪৭ তাৎপর্য)
প্রকৃতপক্ষে সেই যুদ্ধে অর্জুন ছাড়াও অনেকেই সেই বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন। ভগবদ্গীতার ১১/২০ এ বলদেব বিদ্যাভূষন ভাষ্য প্রদান করেন : এটি এখন বোধগম্য হয় যে, এ যুদ্ধ দর্শন করার জন্য দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, কিন্নরগণ ও অন্যান্য বন্ধুসুলভ বা নিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও সমবেত হয়েছিলেন শুধুমাত্র অর্জুনকেই দিব্যজ্যোতি প্রদান করা হয়নি। এই বিশ্বরূপ দর্শন করার জন্য তাদেরকেও দিব্যচক্ষু প্রদান করা হয়েছিল। যদি শুধু অর্জুনই দর্শন করতেন, তবে সেটি হতো অনেকটা একজন নিদ্রাচ্ছন্ন ব্যক্তির স্বপ্নে রথ ও অন্যান্য বস্তু দর্শন করার মতো, তখন অন্য কেউ দর্শন করতে পারত না। ভগবান প্রদর্শনীটি এমনভাবে করেছিলেন যাতে করে আরো অনেকেই তার ভগবত্তার স্বাক্ষ্য বহন করতে পারে।
পঞ্চম ও সর্বশেষ প্রকাশ
মহাভারতের বর্ণানুসারে (অশ্বমেধ-পর্ব ৫২-৫৪) উত্তাঙ্কের কাছে ভগবান তাঁর বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক পরে, কৃষ্ণ দ্বারকার উদ্দেশ্যে গমন করেন। পথিমধ্যে তার একজন পুরোনো বন্ধু উত্তাঙ্ক মুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথনে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিস্তৃত ঘটনা তাকে শোনাচ্ছিলেন। উত্তাঙ্ক সেই ঘটনাগুলোকে বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখেছিলেন যে, নিশ্চিতভাবে কৃষ্ণের শক্তি থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণ সেই বিশৃঙ্খলা বন্ধ করেন নি। এক পর্যায়ে যখন এ নিয়ে তাদের মধ্যকার কথোপকথন আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠল, তখন উত্তাঙ্ক তার যৌগ শক্তি বলে ভগবানকে অভিশাপ দেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাকে বলেন, তার এমন অভিশাপ নিষ্ফল হবে কেননা তিনি হলেন ভগবান, তিনি সমস্ত যৌগ শক্তির উৎস।
“অভিশাপ নিষ্ফল করার ক্ষেত্রে কৃষ্ণ কতটা শক্তিশালী তা নিয়ে উত্তাঙ্ক মুনি কৃষ্ণকে চ্যালেঞ্জ করলেন : তুমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু হলে তোমার বিশ্বরূপ দেখাও।”
কৃষ্ণ তখন তার বিরাট রূপ প্রকাশ করলেন। উত্তাঙ্ক বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। কেননা মহাভারতে (১৪/৫৪/৪) উল্লেখ আছে যে, পূর্বে যেরকম অর্জুনকে প্রদর্শন করেছিলেন, ঠিক সেই বিশ্বরূপ তিনিও দর্শন করেছিলেন।
হতভম্ব হয়ে, উত্তাঙ্ক তখন কৃষ্ণের গুণমহিমা কীর্তন করছিলেন এবং যশোদা ও অর্জুনের মতো তিনিও কৃষ্ণকে তার সেই বিমোহিত প্রকাশ প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করলেন। কৃষ্ণ তাই করলেন এবং তারপর উত্তাঙ্ককে একটি বর প্রদান করেন : যখনই তার জলের প্রয়োজন হবে উত্তাঙ্ক তা লাভ করতে পারবে এবং তিনি কখনো তৃষ্ণার্ত হবেন না।
এরকম উদ্ভট বর লাভের কারণ বোধগম্য হয়েছিল যখন কয়েক বছর পর উত্তাঙ্ক কোনো কারণবশত মরুভূমিতে অবস্থান করেন। তৃষ্ণায় তার মৃত্যু প্রায় অবশ্যম্ভাবী ছিল, সেই অবস্থায় যখন তার জলের প্রয়োজন হয় তখন অদ্ভুতভাবে বৃষ্টি হয়। এখনও ভারতে যখন মরুভূমিতে কিংবা খড়া চলাকালীন মেঘের আবির্ভাব ঘটে, তখন সেটিকে ‘উত্তাঙ্ক মেঘ’ নামে উল্লেখ করা হয়।
রাজীব আমাকে স্মরণ করে দিয়েছিল যে, কৃষ্ণের আরেক অবতার বামনদেব একবার এক মহান রাজার সম্মুখে বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেছিলেন।
“বামনদেব প্রথমে নিজেকে তাঁর বিরাটরূপে বিস্তার করেছিলেন এবং তারপর পূর্বের মতো বামনরূপ ধারণ করেছিলেন। এভাবে তিনি ঠিক শ্রীকৃষ্ণের মতো আচরণ করেছিলেন, যিনি প্রথমে অর্জুনকে তাঁর বিশ্বরূপ প্রদর্শন করার পর তাঁর আদি কৃষ্ণরূপ গ্রহণ করেছিলেন। ভগবান তাঁর ইচ্ছানুসারে যে কোনো রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন, কিন্তু তাঁর স্বরূপে তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ (কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্)। ভক্তের ক্ষমতা অনুসারে ভগবান বিভিন্ন রূপ ধারণ করেন যাতে তাঁর ভক্ত তাঁকে উপলব্ধি করতে পারেন। এটিই তাঁর অহৈতুকী কৃপা। ভগবান বামনদেব যখন তাঁর আদি রূপ গ্রহণ করেছিলেন, তখন ব্রহ্মা এবং তাঁর পার্ষদেরা তাঁর প্রসন্নতা বিধানের জন্য তাঁর পূজার বিবিধ উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন।” (শ্রীমদ্ভাগবতের ৮/২১/৫ এ শ্রীল প্রভুপাদের তাৎপর্য)
এটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, বিশ্বরূপ প্রকাশের আরেকটি দৃষ্টান্তকে : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার অন্তরঙ্গ ভক্তদেরকে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন। চৈতন্য-চরিতামৃতে (আদি ১৭/১০) উল্লেখ আছে, অদ্বৈত আচার্য বিরাট রূপ দর্শন করেছিলেন। চৈতন্য ভাগবতে (মধ্য ১৪) এ বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে, শ্রীঅদ্বৈত ও নিত্যানন্দ প্রভু এই রূপ দর্শন করেছিলেন এবং তা দর্শনের পর উল্লেখিত ময়ূরের ন্যায় নৃত্য করেছিলেন। তারা অনুভব করেছিলেন, বিশ্বরূপের কারণে এখন থেকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভগবত্তা সম্পর্কে বিশ্ব সচেতন থাকবে।
আলোচনা শেষে, রাজীবকে বললাম, “যুক্তরাষ্ট্রে, একাদশ অধ্যায়কে দেউলিয়াপনা (bankruptcy) হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং গীতাতে একাদশ অধ্যায়টি এক ধরনের দেউলিয়াপনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের পারমার্থিক দেউলিয়াপনা যারা নিজেদের ভগবান বলে দাবি করে।”
সত্যরাজ দাস (স্টিভেন জে. রোজেন) একজন আমেরিকান লেখক। শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম একজন শিষ্য এবং শ্রীমৎ ভক্তিতীর্থ স্বামী মহারাজের অন্তরঙ্গ জন। বৈদিক শাস্ত্রের বিবিধ বিষয়ের ওপর ২০টিরও বেশী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি জার্নাল অব বৈষ্ণব স্টাডিজ এর প্রধান সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক ব্যাক টু গডহেড এর সহ সম্পাদক। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হলো, শ্রীমৎ ভক্তিতীর্ণ স্বামী মহারাজের জীবনী সম্বলিত ব্ল্যাক লোটাস : দ্যা স্পিরিচুয়াল জার্নি অব এন আর্বান মিস্টিক।