
শ্রীমৎ ভক্তিস্বরূপ দামোদর স্বামী: আধুনিক বৈজ্ঞানিগণ, বিশেষভাবে প্রজনন শাস্ত্রবিদগণ এত বেশি এগিয়ে গেছেন যে, মনে হয় যেন মানব জাতির ভবিষ্যৎ তাঁদের হাতেই নিহিত রয়েছে। তাঁরা জোর দিয়ে দাবী করেন যে, ভবিষ্যতে আবশ্যকতা এবং চাহিদা অনুসারে তাঁরা মানব জাতির সৃষ্টি করবেন। পোলিস জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব (অর্থাৎ সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলি ঘূর্ণায়মান-এই যুক্তিবাক্য) ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই ধরনের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল। ই.ই স্নাইডার (E.E. Snyder) তাঁর ‘হিস্ট্রি অব দ্য ফিজিক্যাল সায়েন্সস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন- ”যেহেতু বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রাকৃত জগতের উপলব্ধি সম্ভব হয়েছিল, তা হলে বিজ্ঞানের মাধ্যমে এটাও সম্ভব যে, মানুষ তার নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী জগতের পরিবর্তন হতে সক্ষম হবে এবং এইভাবে তার প্রকৃতির বিকাশ করবে। তা হলে মানুষের প্রগতির ভার মানুষের উপরই পড়ছে, ভগবানের উপর নয়। ভগবান বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন এমনভাবে, যাতে তা কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে।
এই নিয়মগুলি মানুষ (বৈজ্ঞানিক) আবিষ্কার করেছিল। সুতরাং একমাত্র ব্যক্তিগত অর্থ ছাড়া ঈশ্বরের কোনো বিশেষ প্রয়োজন নেই।” আমার দেখাবার বিষয় হল যে, ঈশ্বর আজও চিরকালের মতোই আবশ্যক এবং স্বয়ং বিজ্ঞানেরই অধিকতর অগ্রগতি অত্যাবশ্যকভাবে এই বোধের উপর নির্ভর করেছে। আমাদের যান্ত্রিক সক্ষমতায় আমরা এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছছি, যেখানে মানব জাতি, যার স্বাতন্ত্র্য হল এই বৈজ্ঞানিক মহা সৌধের ভিত্তি প্রস্তর- সে তার নিজেরই সাফল্যের দ্বারা ভীত হচ্ছে। তাই ধ্বংসের কারণ আজ যথেষ্ট। কিন্তু এই যবনিকা, বোমার মাধ্যমে আসবে, নাকি পরিবেশ দূষণ কিংবা যান্ত্রিকতার একাকীত্ববোধের মধ্যে দিয়ে আসবে, অথবা তা আদৌ আসবে কিনা, এ সম্বন্ধে সন্দিহান থাকলেও এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শুধু মানবজাতির কাছেই সমস্ত সমাধান রয়েছে- এই ধারণার এক মৌলিক ভ্রম সংঘটিত হচ্ছে।
চিন্তা-কৌশলের একটি মৌলিক উপাদান হল এই পর্যবেক্ষণ এবং প্রকল্প গ্রহণ তথা বিজ্ঞান। অভাব হল একটি উদ্দেশ্যের এবং একটি বৃহত্তর বুদ্ধিযুক্ত ব্যবস্থাপনার, যার মধ্যে এই অভিজ্ঞতার অনুশীলন সম্পাদিত হতে পারে। “বিপ্লব” শব্দটি বিজ্ঞানের বর্ণনা করার পক্ষে যথোপযুক্ত। এর অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য হল কোন প্রকার কর্তৃত্বকেই নয়, বিশ্বস্ত, আত্মসমর্পণমূলক তথা অবরোহধর্মী স্বতঃসিদ্ধ চিন্তাধারাকে এবং সেই সব চিন্তাবিদ যাঁকে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কর্তৃত্বকেও তারা উচ্ছেদ করতে প্রয়াসী। এই মদোন্মত্ত বিপ্লবের প্রগতি সম্বন্ধে এখানে কোন দলিল দাখিল করার যুক্তি নেই।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, একবার যখন তা শুরু হয়েছিল, কেউ তাকে রোধ করতে পারেনি। শ্রীকৃষ্ণই যে সমস্ত কর্মের কেন্দ্রভূমি – একথা জেনে, ক্ষণস্থায়ী কলাকৌশলের প্রতি একজনের চেতনাকে নিবদ্ধ না করে প্রত্যেকেরই কর্তব্য হল, তার চেতনাকে পরম বৈজ্ঞানিক শ্রীকৃষ্ণের অভিমুখী করা। একটি সাধারণ কেন্দ্রের চারপাশে অসংখ্য এককেন্দ্রিক বৃত্তের অস্তিত্ব সম্বব। অনুরূপভাবে, শ্রীকৃষ্ণকে তাদের সমস্ত কর্মের কেন্দ্র হিসেবে রেখে সমস্ত বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ তথা বিভিন্ন প্রকারের ব্যক্তিগণ শ্রীকৃষ্ণভাবনায় নিযুক্ত হতে পারেন। পেশা যাই হোক না কেন, প্রত্যেকেরই কর্তব্য হল তার সমস্ত কর্মের কেন্দ্রস্থলে শ্রীকৃষ্ণকে স্থাপন করার বিজ্ঞান আয়ত্ত করা।
শ্রীকৃষ্ণভাবনামৃতের সংজ্ঞা নিরূপণে বলা হয়েছে, “পরমপুরুষ ভগবানের সঙ্গে একজনের নিত্যসম্বন্ধ, জীবনের পরম লক্ষ্য, যা হল ভগবৎধামে তথা আমাদের আসল বাড়ীতে ফিরে যাওয়া এবং সেই চিন্ময় জগতে প্রত্যাবর্তনের পন্থাই হল কৃষ্ণভাবনামৃত।” শূন্য যদি একা থাকে, তার কোন মূল্য নেই। কিন্তু তার সামনে যদি একটি এক বসানো যায়, তা হলে তা দশে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে, আমাদের সমস্ত কর্মে যদি শ্রীকৃষ্ণকে অন্তর্ভূক্ত না করা হয়, তাই হলে সেই সমস্ত কর্মের কোন মূল্যই নেই। এইভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণসম্বন্ধীয় বিজ্ঞানই হল একমাত্র প্রকৃত বিজ্ঞান যা শিক্ষা করা তথা আচরণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, নভেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত