প্রকৃত জন-কল্যাণ কিভাবে হয়?

প্রকাশ: ২ নভেম্বর ২০২১ | ১২:৩১ অপরাহ্ণ আপডেট: ২ নভেম্বর ২০২১ | ১২:৩১ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 216 বার দেখা হয়েছে

প্রকৃত জন-কল্যাণ কিভাবে হয়?
শ্রীমৎ গৌরগোবিন্দ গোস্বামী
ইন্দ্রিয় সুখের বিধান করে দিলে প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ হয় না। যার পরিণতি দুঃখপ্রদ তা কিরূপে কল্যাণকর হবে?

আজকাল জন-কল্যাণ, জন মঙ্গল, পরিবার কল্যাণ ইত্যাদি বহু কথা সব শোনা যাচ্ছে। লোকসেবা মণ্ডল, জনসেবা সমাজ প্রভৃতি বহু অনুষ্ঠান আছে; যার কর্মকর্তাগণ তথাকথিত জন-কল্যাণকর কর্মে ব্যাপৃত আছেন। কেউ কেউ বুভুক্ষুকে অন্নদান করছেন। কেউ কেউ রোগীর সেবা করছেন, রোগ উপশম করার জন্য প্রচেষ্টা করছেন। কেউ কেউ চক্ষু চিকিৎসা শিবির খুলে অন্ধদের অন্ধত্ব দূরীকরণ করার জন্য কার্য করছেন। কেউ কেউ দীন দরীদ্রদের অর্থদান করে তাদের দারিদ্র্য নিবারণের চেষ্টা করছেন। এই ভাবে নানা প্রকারের তথাকথিত জন কল্যাণ কার্য চলছে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনেতা বা রাষ্ট্রের শাসকবৃন্দও নাগরিকদের কল্যাণ করার জন্য নানা প্রকার ভৌতিক যোজনা প্রণয়ন করছেন। আর্থিক অভিবৃদ্ধি যোজনা, শিল্প যোজনা, কৃষি যোজনা বা (খাদ্য উৎপাদন যোজনা), পরিবার কল্যাণ যোজনা আদি নানাবিধ যোজনা প্রণয়ন করছেন এবং সেগুলি কার্যকারী করাচ্ছেন। সেগুলি জনকল্যাণের মধ্যে পরিগণিত হয়েছে।

কিভাবে প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ সাধিত হয়েছে?

এর দ্বারা কি প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ সাধিত হয়েছে? এগুলির দ্বারা কেবল সাময়িক কিছু শারীরিক কল্যাণ সাধিত হয়েছে, না আর অধিক কিছু হয়েছে? এ বিষয়ে বিবেকী লোকের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিৎ; কেবল ইন্দ্রিয় তৃপ্তির ব্যবস্থা করে দিলে বা শারীরিক কল্যাণ বিধান করলে কি প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ হয়?
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (৫/২২)-তে বলা হয়েছে অর্থাৎ “যার সংস্পর্শে এলে দুঃখই মিলবে বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার সংস্পর্শে আসেন না। জড়েন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে এলে তুমি দুঃখই পাবে। (ইন্দ্রিয় সুখই দুঃখের কারণ)। হে কুন্তীপুত্র! এ প্রকার সুখ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সুখের আরম্ভ আছে এবং পরিসমাপ্তিও আছে। সেজন্য বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাতে আনন্দিত হন না।” ইন্দ্রিয় সুখের বিধান করে দিলে প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ হয় না।


যার পরিণতি দুঃখপ্রদ তা কিরূপে কল্যাণকর হবে? চক্ষু চিকিৎসা শিবির খুলে চক্ষুচিকিৎসা করে দিলে অবশ্য সাময়িক দৃষ্টিশক্তি লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু সেই অন্ধ ব্যক্তিটি মৃত্যুর পর যখন আবার একটি জড় শরীর পাবে তখন তো আবার তার চক্ষুরোগ হতে পারে। তাহলে তার কল্যাণ হলো কি? যে পর্যন্ত জড় শরীর আছে।সে-পর্যন্ত দুঃখ আছে। এ জড়-শরীরটাই হচ্ছে ক্লেশ-পরিপূরিত। জড় শরীর দূর না হওয়া পর্যন্ত ক্লেশ বা দুঃখ দূর হবে না। জড়-শরীরে জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যধি বরাবর আছে। তাই সাময়িক ইন্দ্রিয়সুখ বিধানের বা শারীরিক সুখ-বিধানের ব্যবস্থা কিরূপে কল্যাণ হলো যার পরিণতি হচ্ছে দুঃখ? তাই যা অন্তিম সুখ বা আনন্দ না দেয় তা প্রকৃতপক্ষে কল্যাণ নয়।

জন-কল্যাণ বনাম আত্ম কল্যাণ

আমরা যে জগতে আছি তা মায়িক জগত। এটা ভগবানের মায়া শক্তির প্রকাশ। মায়াশক্তি খুব বলবর্তী। তা জীবের স্বরূপ বিস্মৃত করে দেয়। মায়া কবলিত হয়ে জীব মনে করে, “আমি এই শরীর” এটা ভ্রম। আমরা শরীর নই, আমরা দিব্য আত্মা। কিন্তু মায়া কবলিত হয়ে আমরা তা ভুলে গেছি। তাই জন-কল্যাণ নামে শরীর কল্যাণ করা হচ্ছে। (আত্ম কল্যাণের কথা কেউ চিন্তা করে না)। তাই সমগ্র পৃথিবীর লোকেরা শারীরিক দুঃখ ভোগকারী জনসমাজের প্রতি বড় সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন ও দয়া প্রদর্শন করছেন।
যাঁরা জনসেবা বা জন কল্যাণ জনিত কর্ম করছেন তাঁরা মায়াগ্রস্ত হওয়ার ফলে বুঝতে পাচ্ছেন না যে, লোকেদের ভৌতিক অবস্থা বা স্থিতি বদলানো (পরিবর্তন করা) অসম্ভব ব্যাপার। ব্যক্তির প্রারব্ধ কর্ম অনুসারে তা প্রাপ্ত হয়েছে। তা পরিবর্তন করা যেতে পারে না। যদি দুঃখ-ক্লেশ-প্রপীড়িত জনতার কেউ প্রকৃত কল্যাণ করতে চান, তাহলে তাদের চেতনার পরিবর্তন করা দরকার। তাদেরকে ভৌতিক চেতনার বা শরীর চেতনার স্তর থেকে আত্ম চেতনার বা কৃষ্ণ চেতনার স্তরে উন্নীত করালে প্রকৃতপক্ষে জন-কল্যাণ হবে। কারণ কৃষ্ণ চেতনা লাভ করলে ব্যক্তি আর ভৌতিক দুঃখ ভোগ করবে না।

প্রকৃত জনকল্যাণ কিভাবে হবে?

আমরা দেখতে পাই, ভৌতিকবাদী ব্যক্তিগণ আর্থিক অভিবৃদ্ধির জন্য দিনরাত খুব প্রচেষ্টা করছে। তারা তাতে কিছু লাভ পেলেও তা তাদের জীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারে না। তারাও জানে না, জীবনের সমস্যাগুলি কি। আত্মজ্ঞান শিক্ষার অভাবের জন্য এরূপ হয়েছে। বিশেষকরে বর্তমান যুগে প্রত্যেক লোক অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে। সকলে শরীর ধারণায় আছে। আত্মা সম্বন্ধে তাদের কিছু জ্ঞান নেই। আত্মার আবশ্যকতা কি, তা তারা জানে না। তাই শ্রীমদ্ ভাগবতে (ভা. ৫/৫/১৬) বলা হয়েছে, অর্থাৎ-“যারা নিজেদের মঙ্গল লাভের উপায় অবগত নয়, তারা নিত্যন্ত কামাসক্ত হয়ে বিবিধ ভোগ্য বিষয়ের জন্যই সর্বদা প্রযত্ন করে। সেই সমস্ত মূঢ় ব্যক্তিরা সামান্য ইন্দ্রিয় সুখের জন্য পরস্পরের মধ্যে শত্রুতাচরণ করে এবং তার ফলে ক্লেশ অনুভব করে, কিন্তু মূঢ়তা- বশতঃ তা তারা বুঝতে পারে না।” তাই এটাই হচ্ছে কথা। অবিদ্যাগ্রস্ত মানব মূঢ়তা বশতঃ বুঝতে পারে না যে, জনকল্যাণ নামে যা সে করছে তা প্রকৃতপক্ষে জন-কল্যাণ নয়। কারণ তার পরিণতি হচ্ছে দুঃখ। তাই ভৌতিক সুখ বা ইন্দ্রিয় প্রীতি বিধানের জন্য ব্যস্ত হওয়ার আবশ্যক নেই। যদি প্রকৃতপক্ষে জন কল্যাণ করেত চাও, তাহলে জনগণের ভগবৎ চেতনা বা কৃষ্ণচেতনা জাগ্রত করাতে বা বৃদ্ধি করাতে প্রযত্ন করো। তাতে প্রকৃত জন কল্যাণ হবে। তার ফলে ব্যক্তি ভগবানের কৃপা লাভ করে পারমার্থিক দিকে অগ্রগতি করতে পারবে।
মনে রাখতে হবে, আমরা শরীর নই, আমরা চিদাত্মা। তাই আত্ম-কল্যাণই হচ্ছে প্রকৃত কল্যাণ। যাতে আত্মা আনন্দ লাভ করবে বা সুখ পাবে, তা হচ্ছে প্রকৃত কল্যাণ। আত্মার সুখ বা আনন্দ কিসে? “…যতো ভক্তিরধোক্ষজে। অহৈতুক্য প্রতিহতা যয়াত্মা সুপ্রসীদতি।।” অর্থাৎ ভগবানের প্রতি ভক্তি আচরণ করলে আত্মা সম্পূর্ণরূপে প্রসন্ন ও তৃপ্ত হবে। কৃষ্ণভক্তি লাভ বা কৃষ্ণ চেতনা লাভই হচ্ছে জীবনের অন্তিম লক্ষ্য বা জীবের শ্রেয়। সেই শ্রেয় লাভের জন্য আমাদের জীবন ধারণ করতে হবে।

তাই সেটা প্রাপ্তির জন্য যিনি সাহায্য করেন তিনিই প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর কর্ম করেন। কৃষ্ণভক্তি বা কৃষ্ণ চেতনা লাভ করলে ব্যক্তি ভগবৎ ধামে ফিরে যেতে পারবে, যেখানে গেলে আর এই মৃত্যু-সংসারে জড় শরীর ধারণ করে দুঃখ ভুগতে আসবে না। সেটা প্রাপ্ত হওয়ার জন্য যে কর্ম করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর কর্ম এবং যাঁরা প্রকৃতপক্ষে জীবের দুঃখে দুঃখিত তাঁরা অবিদ্যাগ্রস্ত জীবদের কৃষ্ণচেতনা লাভের দিকে সাহায্য করুন; তাহলে তাঁরা প্রকৃত জন-কল্যাণ করবেন।


 

চৈতন্য সন্দেশ নভেম্বর-২০২১ প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।