এই পোস্টটি 3738 বার দেখা হয়েছে
শ্রী কমললোচন গৌরাঙ্গ দাস
(পূর্বে প্রকাশের পর)
পূর্বের লেখাটি পড়ুন এখানে….
বৈদিক শাস্ত্রে মাংস আহার
সম্বন্ধে নিষেধাজ্ঞা
বৈদিক শাস্ত্র একমতে ঘোষণা করেছে সকল জীবই পরমেশ্বর ভগবানের অংশ এবং অহিংসা, দয়া, প্রেম ও ক্ষমা ইত্যাদি গুণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাংসাহার সম্পূর্ণভাবে ত্যাজ্য, দোষযুক্ত, আয়ুক্ষয়কারী ও পাপযোনিতে জন্মদায়ক বলা হয়েছে। মহাভারতের অনুশাসনপর্বে পিতামহ ভীষ্ম মাংস ভক্ষণকারী, মাংস বিক্রয়কারী এবং মাংসের জন্য জীব হত্যাকারী তিনজনকেই দোষী বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘মাংস ক্রয়কারী অর্থের সাহায্যে প্রাণী হিংসা করে, আহারকারী উপভোগ করে হিংসা করে এবং হত্যাকারী বেঁধে রেখে ও হত্যা করে হিংসা করে । এইভাবে তিন প্রকারে হত্যা হয়। যে ব্যক্তি মাংস আনে, যে অন্যকে দিয়ে আনায়, যে পশুকে কাটে, যে ক্রয় করে, যে বিক্রয় করে, যে রন্ধন করে এবং যে খাইÑতারা সকলেই মাংস আহারকারী (হত্যাকারী)।
(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ১১৫/৪০, ৪৯)
তিনি আরও বলেছেন অন্যের মাংস দ্বারা যেসব মানুষ নিজেদের মাংস বৃদ্ধি করে তারা যেখানেই জন্ম নিক তারা শান্তিতে থাকতে পারে না। যে প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করা হয় পরের জন্মে সেই প্রাণীই তাকে ভক্ষণ করে। বধ কালে সেই প্রাণী বলে ‘মাং স ভক্ষয়তে যস্মাদ্্ ভক্ষয়িষ্যে তমপ্যহম্্’ (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ১১৬/৩৫) অর্থাৎ ‘আজ ও আমাকে খাচ্ছে আমিও কখনো ওকে খাব’।
পদ্ম পুরাণে বর্ণিত পুনর্জন্মের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চুরাশী লক্ষ যোনি অতিক্রম করার পরই এই মানব জন্ম প্রাপ্তি হয়। সেই দৃষ্টিতে জগতের সকল জীবের সঙ্গে কোন না কোন জন্মে আমাদের কোন না কোন সম্পর্ক থাকে। সুতরাং কোনো জীবের মাংস আহার করার অর্থ নিজেরই কোনো আত্মীয়ের মাংস আহার করা।
অথর্ব বেদে (৪/৬/২৩) মাংস ভক্ষণ করা বা গর্ভনাশ করার নিষেধ এইভাবে করা হয়েছে –
য আমং মাংস মদন্তি পৌররূষেয়ং চ যে করিঃ।
গর্ভান্্ খাদন্তি কেশবাস্তানিতো নাশয়ামসি ।।
“অর্থাৎ যে কাঁচা বা রন্ধন করা মাংস খায়, যে গর্ভনাশ করে, এখানে আমি তাদের বিনাশ করি।”
মহাভারতে (অনুশাসন পর্ব ১১৫/৪৮) শ্লোকে তারই ইঙ্গিত করছে –
য ইচ্ছেৎ পুরুষোহত্যন্তমাত্মানং নিরুপ্রবম্্।
স বর্জয়েৎ মাংসানি প্রাণিনামিহ সর্বশঃ ।।
যে ব্যক্তি আত্যন্তিক শান্তি লাভ করতে চান জগতে তার কোনো প্রাণীর মাংস কোনো উপলক্ষ্যেই খাওয়া উচিত নয়।
বিভিন্ন প্রকারের ঘাতক
নিজে হত্যা না করেও অপরের দ্বারা প্রাণী হত্যার মাধ্যমে যে মাংস ভক্ষণ করা হয় সেও প্রকৃতপক্ষে প্রাণীঘাতকই হয়। মনু সংহিতায় (৫/৫১) সিদ্ধান্ত করা হয়েছে –
অনুমন্তা বিশসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী।
সংস্কর্তা চোপহর্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকা ।।
“পরামর্শ দানকারী, অঙ্গ ছেদনকারী, হত্যাকারী, মাংস বিক্রয়কারী, মাংস ক্রয়কারী, রন্ধনকারী, পরিবেশনকারী এবং আহারকারী এদের সবাইকে ঘাতক বলা হয়।”
সুতরাং মাংস-ভক্ষণ ধর্ম হননকারী হওয়ায় সর্বতোভাবে মহাপাপ। ধর্ম পালনকারীদের জন্য হিংসা ত্যাগ প্রথম সোপান। যার হৃদয়ে অহিংসাভাব নেই সেখানে ধর্মের স্থান কোথায়?
মাংসাহার সম্বন্ধে শাস্ত্র নিন্দা
যদিও শাস্ত্রে কোথাও কোথাও মাংসাহারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সেখানেও মাংস ত্যাগের বিষয়ে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলা হয়েছে। প্রায় সকল শাস্ত্রেই মাংসাহারের নিন্দা করে মাংস ত্যাগকেই অতি উত্তম বলে জানানো হয়েছে। এমন হাজার হাজার উক্তি আছে তার মধ্যে কিছু নিম্নে দেওয়া হল –
‘যে ব্যক্তি নিরাপরাধ জীবদের নিজের সুখের জন্য হিংসা করে, সে জীবিত থেকে অথবা মৃত্যুর পরেও (ইহলোক বা পরলোকে) কখনও সুখ পায় না। পশু-পাখির দেহ থেকে মাংস কাটার সময়ে প্রাণীদের প্রতি হিংসা এবং তাদের বেঁধে রাখার দুঃখ-কষ্ট দেখে মানুষের সর্বপ্রকার মাংসাহার ত্যাগ করা উচিত।’ (মনুস্মৃতি ৫/৪৫, ৪৯)
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে (১১৫/৩৫-৩৬, ৪৭) বলা হয়েছে-
‘লোভে কিংবা বুদ্ধি মোহগ্রস্ত হলে অথবা পাপীদের সংসর্গ করলে বল ও পরাক্রম লাভের জন্য মানুষের হিংসারূপ অধর্মে রুচি হয়।’
‘যে ব্যক্তি নিজের মাংস অন্যের মাংস দ্বারা বাড়াতে চায়, সে যে কোনো জন্মই প্রাপ্ত হোক না কেন সেখানে দুঃখী হয়ে জীবন-যাপন করে।’ ‘যে অজ্ঞ এবং অধম ব্যক্তি দেবপূজা, যজ্ঞ ও বেদোক্ত পথের আশ্রয় নিয়ে মাংসের লোভে জীব হিংসা করে সে নরক প্রাপ্ত হয়।’
বেদে কর্মকান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছে কেন?
কেউ কেউ বৈদিক শাস্ত্র থেকেই বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চান পশুবলি বেদ-শাস্ত্র অনুমোদিত। উপরিউক্ত বিষয়গুলো অধ্যয়ন করে পাঠকদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যদি পশু বলি দেওয়া পাপ হয় তাহলে কেন তা শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে?
কিন্তু এ অনুমোদনের প্রকৃত অর্থ তারা অবগত নয়। আর অবগত হলেও স্বার্থান্বেষীরা শাস্ত্র থেকে শুধু তাদের ভ্রান্ত মতের অনুকূল অংশগুলো উদ্ধৃত দিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে।
শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে -“বলি দিয়ে মাংস খাওয়া ধর্মানুমোদিত মনে করে যদি কেউ মাংসাশী হয় তবে সে স্বধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মকে স্বধর্ম মনে করে।” (ভা ১১/৫/১৩) “ধর্মজ্ঞানহীন সাধুত্ব-অভিমানী দুর্জন ব্যক্তি নিঃশঙ্কচিত্তে পশুহিংসা করলে পরলোকে সেই পশুরাই ঘাতকদের অনুরূপভাবে ভক্ষণ করে থাকে।” (ভা. ১১/৫/১৪) “আর যে সব দাম্ভিক ব্যক্তি ইহলোকে ধন এবং প্রতিষ্ঠার গর্বে গর্বিত হয়ে দম্ভ প্রকাশ করবার জন্য যজ্ঞে পশুবলি দেয় পরলোকে তারা ‘বৈশস’ নামক নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। যমদূতগণ তাদের অশেষ যাতনা দিয়ে বধ করে।
(শ্রীদ্ভাগবত ৫/২৬/২৫)
মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১০০ তম অধ্যায়ে (২১-২৩) ভীষ্মদেব বলেনÑ“বিচক্ষণ ব্যক্তি কখনো মাংস ভক্ষণ করেন না। যে ব্যক্তি মোহ প্রভাবে পুত্রমাংসসদৃশ অন্য জীবের মাংস ভক্ষণ করে, সে অতি জঘন্য প্রকৃতির এবং তার সে জীবহিংসা কর্মই বহুবিধ পাপযোনিতে জন্মগ্রহণ করার একমাত্র কারণ।” এই অধ্যায়ে (৭৬, ৭৮, ৮৪) আরো বলা হয়েছে, “যে মাংসাশী দেবপূজা বা যজ্ঞাদিতে পশুবিনাশ করে তাকে নিশ্চয়ই নিরয়গামী (নরকগামী) হতে হয়। যারা হত্যা করার নিমিত্ত পশু আহরণ, পশুবিনাশে অনুমতি প্রদান, স্বয়ং বিনাশ, রন্ধন ও ভোজন করে, তারা সকলেই ঘাতকের তুল্য পাপে লিপ্ত হয়। অতএব নিরুপদ্রবে থাকতে ইচ্ছুক মানুষ জগতে সমস্ত প্রাণীর মাংসই বর্জন করবে।”
তাই আমাদের বুঝতে হবে বেদে উদ্ধৃত সব আচরণ বিধি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। সত্ত¡, রজো ও তমো – এ ত্রিগুণ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তির জন্য আচরণবিধিও ভিন্ন ভিন্ন। বেদে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি উভয় মার্গের কথা বলা হয়েছে। তাই শাস্ত্রোক্ত মাংসাহারের আপাত অনুমোদন কেবল তাদেরই জন্য যারা জড় ইন্দ্রিয় সুখভোগ থেকে সরাসরি নিবৃত্তির পন্থা গ্রহণে অসমর্থ এবং তা সেসব প্রবৃত্তি মার্গীয় লোকদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির বাসনা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। মানুষ যেন নীতিবিরুদ্ধ হয়ে যখন তখন নিরীহ পশুদের হত্যা করে মহাপাপের ভাগী না হয় এবং সেই সাথে ধীরে ধীরে তাদের পারমার্থিক উন্নতি হয় এবং সর্বোপরি মাংসাহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই শাস্ত্রে কোথাও কোথাও এই বিধান।
বৈদিক কর্মকাÐের উদ্দেশ্য হচ্ছে জনসাধারণের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা বেদের কর্মকান্ডের যজ্ঞে পশুবলি, সুরাপান বা মৈথুন জীবনের অনুমোদন করা হয়েছে। তবে সেটা প্রবৃত্তি মার্গের অনুগামী নিম্ন চেতনার ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণের জন্য। ঠিক যেমন অনেক সময় সরকার যত্রতত্র মদ্যপান, মৈথুনবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মদিরালয় বা বেশ্যালয় খোলার অনুমোদন দেয়। সরকারের এই অনুমোদন এটা নির্দেশ করে না যে যারা নেশা করে না, অবৈধ যৌনসঙ্গ করে না তাদেরও সেটা করা উচিত। এই অনুমোদনের মাধ্যমে এসব কার্যকে উৎসাহিত করা হয় না বরং নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন: মনুসংহিতায় (৫/৫৬) বলা হয়েছে
ন মাংসভক্ষণে দোষো ন মদ্যে ন চ মৈথুনে।
প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিং তু মহাফলা।।
অর্থাৎ “ মাংসাহার, মদ্যপান ও মৈথুনাচার সকল বদ্ধ জীবদের স্বাভাবিক প্রবণতা। এ ধরনের কার্যকলাপ শাস্ত্রবিধি অনুসারে অনুষ্ঠিত হলে ততটা দোষাবহ নয়। তবে এসব কার্য থেকে নিবৃত্ত হওয়াই মহা ফলদায়ক”।
বৈদিক যজ্ঞ কোনো সাধারণ অনুষ্ঠান নয়। বৈদিক আচার সম্পন্ন শুদ্ধ ব্রাহ্মণের আহŸানে যজ্ঞে স্বর্গের দেবতারা অংশগ্রহণ করতেন। যজ্ঞবিধি অনুসারে কখনো কখনো যজ্ঞে পশু বলি দেওয়া হতো। পশুবলি মাংসাহারের জন্য নয় বরং বৃদ্ধ পশুকে নতুন ও উন্নত জীবন দান করার জন্য এবং বৈদিক মন্ত্র যথাযথভাবে উচ্চারণ করা হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য। কখনো কখনো গবেষণাগারে ছোট ছোট পশুদের ওপর ঔষুধের প্রভাব পরীক্ষা করা হয় এবং তার ফলে পশুদের মৃত্যু হয়। ঔষুধ গবেষণাগারে পশুরা পুনরুজ্জীবিত হয় না। কিন্তু মনুসংহিতায় (৫/৪০, ৪২) বলা হয়েছে যজ্ঞস্থলে বলিকৃত পশু বৈদিক মন্ত্রশক্তির প্রভাবে পুনরায় উন্নত দেহ লাভ করে-
যজ্ঞার্থং নিধনং প্রান্তাঃ প্রাপ্নুবন্ত্যচ্ছ্রি তীঃ পুনঃ।
আত্মানঞ্চ পষুঞ্চৈব গময়ত্যুমাং গতিম্ ।।
তামস প্রকৃতির মানুষদের জন্য যাদের মাংস না খেলে চলেই না তাদের জন্য। শাস্ত্রের বিধান হচ্ছে অমাবস্যার গভীর রাতে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে মহামায়া দুর্গার উগ্ররূপা কালীমূর্তির সামনে একটি পাঁঠাকে বলি দিয়ে তার মাংস ভক্ষণ করা। তবে এতে যে তাদের কোনোই পাপ হয় না তা নয়। তবে মহাভারতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্রাহ্মণের অনুমতি সাপেক্ষে এরূপ তামসিক যজ্ঞে উৎসর্গীকৃত পশুর মাংস ভক্ষণে পাপ কম হয়। কিন্তু শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে তাদের মাংসভক্ষণ বা কসাইখানা খুলে পশুহত্যা শাস্ত্রে কোথাও অনুমোদিত নয়। তদুপরি মানুষ যেন নীতিবিরুদ্ধ হয়ে যখন তখন নিরীহ পশুদের হত্যা করে মহাপাপের ভাগী না হয় এবং সেই সাথে ধীরে ধীরে তাদের পারমার্থিক উন্নতি হয় এবং সর্বোপরি মাংসাহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই শাস্ত্রের এই বিধান। যেমন কেউ যদি সিগারেটের প্রতি অত্যধিক আসক্ত থাকে তবে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার হয়তো প্রথমাবস্থায় তাকে সম্পূর্ণভাবে ধূমপান ত্যাগ করতে বললে তার পক্ষে তা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই কারো যদি দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকে তবে ডাক্তার তাকে প্রথমাবস্থায় পাঁচটি তারপর তিনটি বা দুইটি সিগারেট অনুমোদন দিতে পারেন। যাতে ধীরে ধীরে তিনি সিগারেট খাওয়ার বদঅভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। সুতরাং মা কালীর সম্মুখে মাসে একবার সে বলির বিধান তাও মাংসাহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই অনুমোদিত।
তেমনি শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/১১) বলা হয়েছে –
“এই জড়জাগতিক পৃথিবীতে বদ্ধ জীব সর্বদাই মৈথুন অভ্যাস, আমিষ আহার এবং নেশা ভাং বিষয়ে প্রবণতা লাভ করে থাকে। অতএব ধর্মশাস্ত্রাদিতে কখনই ঐ ধরনের ক্রিয়াকলাপে উৎসাহ দেওয়া হয় না। যদিও শাস্ত্রীয় অনুশাসনাদির দ্বারা পবিত্র বিবাহরীতির মাধ্যমে মৈথুনাচারের সুযোগ, যজ্ঞাহুতির মাধ্যমে নিবেদিত পশুমাংস আহারের রীতি এবং যজ্ঞশেষে শাস্ত্রসম্মত সোমরস পানের রীতি অনুমোদিত হয়েছে তবে ঐ সকল অনুষ্ঠানাদি কোন মতেই নিরাসক্ত বৈরাগ্য সাধনের চরম উদ্দেশ্য সাধনে সহায়করূপে অনুমোদিত হয় না।” তা থেকে নিবৃত্ত হওয়াই বাঞ্চনীয় (নিবৃত্তিরিষ্টা)।
শ্রীল প্রভুপাদ তাৎপর্যে লিখেছেন -“আমিষাহার সম্পর্কেও নিয়ন্ত্রিত আচরণ বিধি নির্ধারণ করে অন্যান্য অনুশাসনাদি রয়েছে। যারা মাংসাহারে উন্মত্ত তাদের জন্য বিধান আছে বৈদিক যজ্ঞানুষ্টানের মাধ্যমে পাঁচ শ্রেণির পঞ্চ নখবিশিষ্ট পশু (যথা-গন্ডার, কচ্ছপ, খরগোশ, সজারু এবং টিকটিকির) মাংস ভক্ষণ করতে পারে। তেমনই বছরের বিশেষ দিনগুলিতে বিশেষ ব্যয় বহুল যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে অতি সতর্কভাবে আহুতি প্রদানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের আসব পান অনুমোদন করা আছে। পশুহত্যা অত্যন্ত জঘন্য কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে এবং যদিও অত্যন্ত উগ্রপ্রকৃতির মানুষদের জন্য কিছু শিথিলতা গ্রাহ্য করা হয়েছে তাহলেও এই নিষ্ঠুর কাজ সম্পূর্ণভাবে বর্জন করাই মানুষের উচিত। কারণ পশুহত্যার যজ্ঞানুষ্ঠানে সামান্যতম অনিয়ম হলেই মানুষের জীবনে বিপর্যয় ঘটে থাকে।”
কলিযুগে যোগ্য ব্রাহ্মণের অভাবে বৈদিক কর্মকাÐের যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। তাই শাস্ত্রে সংকীর্তন যজ্ঞ অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (কলৌ তৎ হরিকীর্তনাৎ)। কলিযুগে সারা পৃথিবীর মানুষেরাই মাংস আহরণের জন্য কসাইখানা খুলে পশুহত্যা করতে অত্যন্ত দক্ষ। যদি প্রাচীন ধর্ম অনুষ্ঠানগুলি পালন করা হয় তাহলে মানুষ আরও বেশি করে পশু হত্যা করতে অনুপ্রাণিত হবে। কলকাতায় অনেক মাংসের দোকান আছে যেখানে মা কালীর চিত্রপট রাখা হয়। আর মাংসাসী মানুষেরা মনে করে সে সমস্ত দোকান থেকে মাংস ক্রয় করাই সমীচীন কারণ তা হচ্ছে কালীর প্রসাদ। তারা জানে না মা কালী কখনো আমিষ আহার গ্রহণ করেন না। কারণ তিনি হচ্ছেন শিবের সাধ্বী স্ত্রী। শিব হচ্ছেন একজন মহান বৈষ্ণব এবং মা কালী সর্বদা শিবের উচ্ছিষ্ঠই গ্রহণ করেন। তাই তার পক্ষে কখনই আমিষ আহার করা সম্ভব নয়। এই প্রকার নৈবেদ্য ভূত, প্রেত, পিশাচ, রাক্ষস আদি কালীর অনুচরেরাই কেবল গ্রহণ করে এবং যারা মাংসরূপে কালীর প্রসাদ খায় প্রকৃতপক্ষে তা কালীর প্রসাদ নয় তারা ভূত ও পিশাচদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে এবং শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/১৮/২১) বলা হয়েছে – “যক্ষ-রাক্ষস, ভূত, প্রেত ও পিশাচরাই মাংসাশী হয়।”
মহাভারতে শান্তিপর্বের ২৫৯ তম অধ্যায়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীষ্মদেবের বিচখ্যুনৃপ সংবাদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে “অহিংসাই সমস্ত ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যে সকল মানুষ যজ্ঞে পশু হত্যা করে বৃথা মাংস ভোজন করে তাদের সে কর্ম নিন্দনীয়। ধূর্তরাই মদ, মাংস, মাছ ইত্যাদি খাওয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে। কিন্তু বেদে প্রকৃত অর্থে এসব ভক্ষণের বিধি নেই। বস্তুত কাম, লোভ ও মোহবশতই লোকদের এসব অমেধ্য দ্রব্যে প্রবৃত্তি হয়ে থাকে।”
কাদের জন্য পশুবলি অনুমোদন করা হয়েছে?
শ্রীমদ্ভাগতের (৪/২৬/৬) শ্লোকে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে কাদের জন্য পশুবধের অনুমোদন আছে তা
“রাজা যদি মাংস আহারের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হন তাহলে তিনি যজ্ঞ অনুষ্ঠানের শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুসারে বনে গিয়ে, কেবল বধ্য (যথা-গন্ডার, কচ্ছপ, খরগোশ, সজারু এবং টিকটিকি) পশুদের হত্যা করতে পারেন। অনর্থক ও অবাধে পশুহত্যা কখনই অনুমোদিত হয়নি। রজো ও তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত মূর্খ মানুষেরা যাতে অসংযতভাবে অবাধে পশুহত্যা না করে সেই জন্যই বেদে পশুবধের সুনিয়ন্ত্রিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এই শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ লিখেছেন – “নিয়ম মানুষের জন্য পশুদের জন্য নয়। রাস্তায় পরিবহনের নিয়ম মানুষদের বলে দেয় রাস্তার ডান দিকে অথবা বাঁ দিকে থাকতে। এই নিয়ম কেবল মানুষদের জন্য তা পশুদের জন্য নয়। কোন পশু যদি সেই নিয়ম লঙ্ঘন করে তাহলে তাকে কখনা দÐ দেওয়া হয় না। কিন্তু কোন মানুষ যদি তা করে তাহলে তাকে দÐ দেওয়া হয়। বেদ পশুদের জন্য নয়, মানুষদের উপলব্ধির জন্য। কোন মানুুষ যদি কোন রকম বিচার-বিবেচনা না করে বেদের বিধি-নিষেধগুলি লঙ্ঘন করে তাহলে যথাসময় তাকে দÐভোগ করতে হবে। তাই কাম-বাসনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইন্দ্রিয় সুখভোগ করা উচিত নয়।”
যুধিষ্ঠির বললেন “হে পিতামহ, নিতান্ত হিংসাশূন্য হয়ে মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করবে? ভীষ্মদেব বললেন – “বৎস, মানুষ যাতে শরীর বিনষ্ট না হয় এবং অহিংসা ধর্ম পালিত হয় সে কর্মই করবে।”
(মহাভারত, শান্তিপর্ব ২৫৯/১, ২)
কোন পশু যখন অন্য পশুকে হত্যা করে তাতে তার পাপ হয় না কিন্তু মানুষ যদি তার বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের জন্য কোন পশুকে হত্যা করে তখন সে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে অপরাধী হয়। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ, মুখবন্ধ)
বেদে নির্দেশ দেওয়া আছে মা হিংস্যাৎ সর্বা ভূতানি-কোন জীবের প্রতি হিংসা করো না। কোনও জীবের আত্মিক সত্তাকে হত্যা করা যায় না এই উপলব্ধি হওয়ার ফলে প্রাণিহত্যায় উৎসাহ লাভ করা উচিত নয়। বিনা কারণে অন্যায়ভাবে যখন পশু হত্যা করা হয় তখন তাতে অবশ্যই পাপ হয়। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে যেমন রাষ্ট্রের আইন অনুসারে হত্যাকারী শাস্তি পায়, ভগবানের আইনেও তেমনই তার জন্য শাস্তি পেতে হয়। (গীতা ২/১৯ তাৎপর্য)
পশুবলি সম্বন্ধে শিব-দুর্গার কথোপকথন
পরিশেষে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যাদের উদ্দেশ্যে আমরা পাঁঠা বলি দিই দুর্গা বা কালী পূজায় উনারাকি সন্তুষ্ট হন তার দ্বারা? মহাদেব শিব দেবী দুর্গার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন – হে মহাদেবী, তোমার ভক্তরা নাকি কামনার বশবর্তী হয়ে তোমার প্রীতি উদ্দেশ্য প্রাণীদেরকে বধ করছে? এই ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? দুর্গাদেবী বলেন –
মমোদ্দেশে পশূণ্ হত্বা সরক্তং পাত্রমুৎসৃজেৎ।
যো মূঢ়ঃ স তু পূয়োদে বসেদ্্যাদি ন সংশয়ঃ।।
“ যে মূঢ়রা আমার পূজার নাম করে আমার পূজার দোহাই দিয়ে জীব-হিংসায় তৎপর হয় তাদের এই কদর্য আচরণের জন্য অধোগতি হয়।”
দেবতান্তর-মন্নাম-ব্যাজেন স্বেচ্ছায় তথা।
হত্বা জীবাংশ্চ যো ভক্ষেৎ নিত্যং নরকমাপ্লুয়া ।।
“অন্য দেবতার কিংবা আমার নামের ভান করে যে ব্যক্তি ইচ্ছা পূর্বক জীবহত্যা করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে তাকে চিরদিন নারকীয় যাতনা ভোগ করতে হবে।
যূপে বদ্ধা পশূন্ হত্বা যঃ কুর্যাদ্রক্তকর্দমং।
তেন চেৎ প্রাপ্যতে স্বর্গো নরকং কেন গম্যতে।।
“যূপে বা হাড়িকাঠে বদ্ধ করে পশুদেরকে হত্যা করে রক্তময় কর্দম উৎপন্ন করে অর্থাৎ রক্তধারা প্রবাহিত করে সে যদি স্বর্গ পায় তা হলে নরকে কে যাবে? ”
উপদেষ্টা বধে হন্তা কর্তা ধর্তা চ বিক্রয়ী।
উৎসর্গ কর্তা জীবানাং সর্বেষাং নরকং ভবেৎ ।।
১) জীবদেরকে বলি দেবার জন্য যে ব্যক্তি উপদেশ করে ২) যে ব্যক্তি খড়গ নিয়ে বধ করে ৩) যে ব্যক্তি এই জীব-বলি অনুষ্ঠানের কর্তা ৪) যে ব্যক্তি বলির সময়ে পশুকে ধারণ করে ৫) যে ব্যক্তি বলির জন্য পশুকে বিক্রি করে ৬) যে ব্যক্তি বলির জন্য পশু উৎসর্গ উপযোগী।
মদ্ব্যাজেন পশূন্্ হত্বা যে ভক্ষেৎ সহ বন্ধুভিঃ।
ভদ্্গাত্রলোম-সংখ্যাব্দৈরসিপত্রবনে বসেৎ।।
“যে ব্যক্তিরা আমার পূজার নাম করে পশুদেরকে হত্যা করে পশুদেরকে হত্যা করে বন্ধুদের সঙ্গে পশুর মাংস ভোজন করে তারা ঐ পশুর লোম-সংখ্যক বৎসর যাবৎ অসিপত্রবন নামক নিয়ত গাত্রছেদনকারী যাতনা বিভাগে বাস করবে।”
মানবো যঃ পরত্রেহ তর্তুমিচ্ছেৎ সদাশিব।
সর্ববিষ্ণুময়ত্বেন ন কুর্যাৎ প্রাণিনাং বধঃ।।
“হে প্রভু সদাশিব! মানুষ যদি ইহলোকে ও পরলোকে পরিত্রাণ পেতে ইচ্ছা করে তাহলে সমস্ত জীবই বিষ্ণুময় জেনে তাদেরকে কখনও বধ করবে না।” পদ্মপুরাণের এই কথা অবগত হলে পরিষ্কার বোঝা যায় দুর্গা বা কালী পূজায় পশুবলি দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত পাপকর্ম।
অতএব এই কলিযুগে অন্য কোন যজ্ঞ অনুমোদিত নয় কেবল হরিনাম যজ্ঞ সকলের জন্য অনুমোদিত সেটি শ্রীমদ্ভাগবতে (১২/৩/৫২) উল্লেখ করা হয়েছে -কলৌ তদ্ধরিকীর্তনাৎ অর্থাৎ কলিকালে কেবলমাত্র ‘হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তনে সেই সকল ফল লাভ হয় যেফল সত্যযুগে ধ্যান, ত্রেতাযুগে যজ্ঞ করে লাভ হতো।”
হরে কৃষ্ণ