এই পোস্টটি 613 বার দেখা হয়েছে
যাদের অবদান, যারা অভিভূত
আজকের ভক্তিবেদান্ত মেনর ৪০ বছরের দীর্ঘ পথচলা ও ভক্তিমূলক সেবার প্রতিফলন। এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক কিছুই, কিন্তু তবুও থেমে থাকেনি কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রচার বা ভক্তিমূলক সেবা। ভক্তিবেদান্ত মেনরের ৪০ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বর্ষপূর্তি উদ্যাপন নিয়ে নিম্নের এই প্রতিবেদন। গুরুত্বপূর্ণ ছবি ও তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন ভক্তিবেদান্ত মেনর, ডেভিড ক্রিক ও তত্ত্ববিধ দাস।
রানি ভিক্টোরিয়ার দিনগুলোতে যখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য ছিল তখন হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের প্রপিতামহ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর সেই দিনের দিকে তাকিয়েছিলেন কখন ব্রিটিশরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করবে।
সে সময় ব্রিটিশরা ভারতের জাগতিক সম্পদ যেমন চা, তুলা এবং মশলার প্রতি বেশী আগ্রহী ছিল। এদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন লোক মি. জি ডব্লিউ উইলিয়ামস্ অন্য কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সেটি ছিল ১৮৮৪ সাল, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত এবং তার অর্থ ব্যয় করতে চেয়েছিলেন উত্তর হার্টফোর্ডশায়ারের গ্রাম্য এলাকার মনোরম পরিবেশে একটি পারিবারিক গৃহ গড়ে তোলার জন্য। তাই কাজ শুরু হলো একটি জমকালো গৃহ গড়ে তোলার জন্য এবং এর নামকরণ করা হয় পিগট্স মেনর। ১৯৩২ সালে, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের পুত্র শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ তাঁর পিতার লক্ষ্যকে ধারণ করে তিনিও চেয়েছিলেন যে, ব্রিটিশরা কৃষ্ণ সম্পর্কে শিক্ষা লাভের সুযোগ লাভ করবে।
তাই তিনি লন্ডনে তাঁর তিনজন শিষ্যকে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে সাউথ কেনসিংটনে এক টুকরো ভূমির কথা তাঁকে বলা হয়েছিল কিন্তু কয়েক মাস পরেই তিনি অপ্রকট হন। ১৯৬৯ সালে তাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্য পুনরায় লন্ডনে আসেন এবং সেখানে
কৃষ্ণের শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই শিষ্য এখন সারা বিশ্বে পরিচিত শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ হিসেবে এবং তিনি ১৯৬৯ সালে লন্ডনে প্রথম রাধাকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে, লন্ডন এত বড় একটি শহর যে, এখানে সহজেই অন্তত দশটি মন্দির গড়ে তোলা যেতে পারে। তিনি তাঁর শিষ্য ধনঞ্জয় দাসকে বললেন, লন্ডনের নটিং হিলে আরেকটি মন্দির গড়ে তোলার জন্য এবং দিল্লির রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের মত বিগ্রহ স্থাপন করতে ইচ্ছা করেন।
সেটি ছিল ১৯৭২, লন্ডনের আসল মন্দিরটিতে আশাতীত জনসমাগম হচ্ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন বার্তা ব্রিটেনের অনেক যুবকের কাছে বোধগম্য হয়েছিল এবং শহরের প্রাণকেন্দ্রে তখন একটি বিশাল পারমার্থিক গোষ্ঠি গড়ে উঠছিল। বিখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসন বলছিলেন যে, শহরের অন্য কোনো স্থান নয় বরং শহরের বাইরে মন্দির করলে ভালো হয়। যেখানে পর্যাপ্ত স্থান থাকবে এবং এর জন্যে নিজে আর্থিক সহায়তা প্রদান করবেন অনুসন্ধান শুরু হল। ১৯৭৩ সালে পিগট্স মেনর যেটি ভারতীয় অর্থে তৈরি করা হয়েছিল সেটি নির্বাচিত হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নতুন গৃহ হিসেবে।
ঐ বছর লন্ডনের কাছাকাছি এই পিগট্স মেনর জর্জ হ্যারিসন শ্রীল প্রভুপাদ এবং আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকনের জন্য কিনে নেন। পরে এর নতুন নামকরণ করা হয় ভক্তিবেদান্ত মেনর শ্রীল প্রভুপাদ স্বয়ং এসেছিলেন সেখানে অনেক সপ্তাহ অবস্থান করার জন্য এবং
ব্যক্তিগতভাবে জন্মাষ্টমীর সময় ভগবানকে আমন্ত্রণ জানান। এই অপরূপ বিগ্রহের নামকরণ করা হয় রাধা গোকুলানন্দ। শ্রীল প্রভুপাদ এখানে অনেক সময় ধরে অবস্থানের ইচ্ছা প্রকাশ করায় ভক্তদের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু তাঁদের খুব কম অর্থই ছিল। আসলে তাদের এত কম অর্থ ছিল যে, প্রচণ্ড শীতের সময়েও মন্দিরে উষ্ণতার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, যবের মণ্ড (Porridge), বাঁধাকপি, আলু ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
এমন দিনও গেছে যে, বিগ্রহের বেদিতে কোনো পুষ্প পর্যন্ত নিবেদন হয়নি। তাই কিছু একটি করার প্রয়োজন ছিল। এজন্য হংসদৃত দাসের নির্দেশনায় তাঁরা নিকটবর্তী শহরগুলোতে
ধূপকাঠি, গ্রন্থ এবং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র ও ভজন সম্বলিত রেকর্ডিং বিক্রি শুরু করলো। ১৯৭৪ সালের মধ্যে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ ও শ্রীল এ. সি ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদ লন্ডন জুড়ে এবং ব্রিটেনের শহর জুড়ে পরিচিতি লাভ করতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং বিশাল বিশাল হলগুলোতে বিভিন্ন উৎসব মঞ্চায়িত হচ্ছিল। সুস্বাদু রবিবাসরীয় ভোজন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল এবং প্রথম গাভীকে নিয়ে আসা হলো গো-খামার গড়ে তোলার জন্য। ভজহরি দাস এবং প্রভাবিষ্ণু দাস ছিলেন সেসময় মন্দিরের অধ্যক্ষ। ১৯৭৫ সালে জনসমক্ষে প্রথমবারের মত জন্মাষ্টমী উৎসব আয়োজিত হলো সে সাথে দিওয়ালী উৎসবও যেখানে রামায়ণ নাট্য পরিবেশিত হয়েছিল।
মেনর উদ্বোধনের পর থেকে প্রভুপাদ দু’বার সেখানে এসেছিলেন এবং ভক্তদেরকে বলেছিলেন, ব্রিটেন জুড়ে থিয়েটারের মাধ্যমে কৃষ্ণভাবনা ছড়িয়ে দিতে। ভক্তরা এই নির্দেশনা একনিষ্ঠভাবে গ্রহণ করে নিয়মিতই বিভিন্ন নাটক মঞ্চায়িত করতে লাগলেন, সেখানে একটি কক্ষকে তারা থিয়েটার হিসেবে গড়ে
তোলে। পরবর্তী বছর থেকে প্রায় ৪০ জন তক্ত ভ্যানে করে ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার প্রভুপাদের গ্রন্থ বিক্রি শুরু করলো। ১৯৭৬ সালে জয়তীর্থ দাস হংসদূত দাসের প্রতিস্থাপন হিসেবে আমেরিকা থেকে আগমন করলো। তিনি মেনরের আমূল পরিবর্তন শুরু
করলেন।
ধীরে ধীরে মেনরের সৌন্দর্য আরো অধিক বৃদ্ধি পেতে লাগল। এই অগ্রগতি দেখে শ্রীল প্রভুপাদ খুশি হয়েছিলেন। পরবর্তী বছরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পাশেই বারি প্লেসে অবস্থিত লন্ডন মন্দির থেকে ভক্তরা বিতাড়িত হয়ে মেনরে চলে আসেন এবং তারা এর ৬টি ফ্লোর বাড়ানোর জন্য ১৮ মাসে যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ করলেন। সেসাথে গড়ে তোলেন রেস্টুরেন্ট, আশ্রম ইত্যাদি।
১৯৭৭ সালে মেনরে ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্টের একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হল এবং সে সাথে একটি নতুন ধারণার অগ্রযাত্রা শুরু হল, যার নাম দেয়া হল The art of living অর্থাৎ বেঁচে থাকার কৌশল। এক বক্সে তিনটি গ্রন্থ সমন্বয়ে এই নাম দেয়া হলো। তার পাশাপাশি আত্মজ্ঞান লাভের পন্থা ও আরেকটি নতুন মিউজিক্যাল রেকর্ড অ্যালবাম ভালোই বিক্রি হয়েছিল। এভাবে ব্রিটিশ জনগণের বিশাল সংখ্যক Friends of Lord krishna বা সংক্ষেপে FOLK এর সদস্য হতে এগিয়ে এল।
কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদের স্বাস্থ্য তখন খুব একটা ভালো ছিল না এবং সারাবিশ্বের ভক্তরা তাঁর আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা ক
রতে লাগলেন। তিনি মেনরে শেষবার পরিদর্শন
করাকালীন সমগ্র ইউরোপ থেকে ভক্তরা তাঁকে দর্শন করার জন্য এসেছিল সেজন্য একটি ব্যতিক্রমী কীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। নভেম্বরে যখন তিনি অপ্রকট হলেন তখন শোকের ছায়া নেমে এল।
লন্ডনের নতুন রেঁস্তোরার নাম দেওয়া হল Healthy, wealthy and wise এবং ১৯৭৮ সালের শুরু থেকেই এটি বেশ ভালই চলছিল। লোকেরা নিরামিষ তত্ত্বের নতুন ধারণার প্রতি আগ্রহী হয়েছিল। এভাবে
মন্দির যখন সমৃদ্ধ হতে লাগল তখন আবারো ভক্তদের স্থান সংকুলনের অভাব দেখা দিল। সেসময় বিচিত্রবীর্য দাস মন্দির অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি তা সুন্দরভাবেই ব্যবস্থাপনা করলেন। ১৯৭৯ সালে অনেক সংখ্যক ভারতীয় পরিবার মেনর পরিদর্শন
করে অভিভূত হন এবং তারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার উদ্দেশ্যে অবদান রাখতে শুরু করেন। Mahabharata cultural association প্রতিষ্ঠা হলো এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য Mahabharata youth club এর যাত্রা শুরু হলো যা অত্যন্ত সাড়া মেলে। ১৯৮০ সালে মেনরের অফিসিয়াল মালিকানা জর্জ হ্যারিসনের Material world Foundation থেকে ইসকনের কাছে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৮১ সালে রাম-সীতা বিগ্রহ স্থাপিত হয়। কৃষ্ণদাস স্বামী এর আয়োজন করেন এবং জয়তীর্থ দাস মহা অভিষেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
টেলিভিশন এবং দৈনিক পত্রিকাগুলোতে মেনরের কার্যক্রম প্রচারিত হতে লাগল। ভক্তরা মিডিয়ার সদস্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে লাগলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্থানীয় কাউন্সিল একটি ইস্যু দাঁড় করাল যে, মেনরে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না। এই বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ সমাধানের জন্য ১৫ বছর লেগে গেল। ১৯৮২ সালের শুরুতে জয়তীর্থ দাসের স্থলে নতুন নেতা হিসেবে আসেন ভগবান দাস।
সে সময় নর্দান আয়ারল্যান্ড থেকে আগত একজন ভক্ত অখগুধি দাস পরবর্তী ১৩ বছরের জন্য মন্দিরে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। সে বছরেই বিশাল জন্মাষ্টমী উত্সব আয়োজিত হয়। কিন্তু মেনরকে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল বছরে মাত্র ৬টি উৎসব আয়োজন করার জন্য এবং ১০০০ এর বেশী লোক সমাগমের ওপরও নিষেধাজ্ঞা ছিল। ভক্তরা তখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে লাগলেন যাদের মধ্যে চিন্তাশীল রাজনীতিবিদরা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিবর্গরাও ছিলেন। ভক্তরা সে সাথে কৃষ্ণপ্রসাদ বিতরণ কার্যক্রমও শুরু করলো যার মাধ্যমে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণ উপকৃত হচ্ছিল। ১৯৮৩-৮৫ সালে ভক্তরা নতুন বন্ধকী (Mortgaged) বিল্ডিং এর জন্য অর্থ পরিশোধ করতে তহবিল বৃদ্ধি করতে শুরু করলো। তাঁরা ধূপকাঠি, গ্রন্থ, হাতে খোদাইকৃত মোমবাতি তৈল চিত্র, সিল্ক চিত্র, পুষ্প এবং ফল ও বাদামের তৈরি এক ধরনের প্রসাদ মানসম্মতভাবে তৈরি করে বিক্রি করতে লাগলেন এবং এর মাধ্যমে ভালো অর্থও আয় হল।
যদিও এই সফলতা এ বিক্রির জন্য নয় বরং ভগবানের বাণী প্রচারের মাধ্যমেই হয়েছিল। এদিকে একই সাথে ইংরেজ ভক্তসংখ্যা ৩০০০ ছাড়িয়ে গেল এবং তাদের গৃহে ডাকযোগে নিউজলেটার, ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিন, মঙ্গলারতির
প্রসাদ পাঠানো হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বৈষ্ণবেরা তাদের গৃহ পরিদর্শনও করতেন। এ বছরগুলোতে জন্মাষ্টমী উৎসব আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং সে সাথে ভবিষ্যতের এক বিশাল পরিবর্তনের আভাস দেখা দিয়েছিল। ১৯৮৬
সালে স্থানীয় কাউন্সিলের কিছু লোক মেনরে কত লোক পরিদর্শন করছে তা পর্যবেক্ষণে গিয়েছিল। এরপর মেনরের ব্যাপারগুলো নিয়ে জনসমক্ষে বিভিন্ন তর্ক বিতর্ক শুরু
হয়েছিল। মার্চের দিকে জনপ্রিয় BBC চিলড্রেন’স্ টেলিভিশন অনুষ্ঠানে মেনরকে নিয়ে প্রচার করা হলো। এর মাধ্যমে ইতিবাচক সাড়াও মেলে। স্থানীয় কাউন্সিলরদের পরিকল্পনা ছিল এভাবে জনগণরা মেনরে আসা যাওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকলে পুরো মন্দিরটিই একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে যুদ্ধ চলতেই লাগলো। ইতোমধ্যে সর্বাত্মকভাবে ভগবদ্গীতা, কীর্তন ও প্রসাদ বিতরণ কার্যকম বর্ধিত হারে চলতে লাগলো। মেনরের ভক্তদের আয়োজনে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে নেলসন মেন্ডেলার ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশাল সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। বাটারসি পার্কে লন্ডন রথযাত্রা উপলক্ষে কৃষ্ণপ্রসাদ আস্বাদন ও কীর্তনের আয়োজন করা হলো এবং দিওয়ালী উৎসবে এভাবে কনসার্টের আয়োজন করা হলো যেখানে বিখ্যাত ভারতীয় গায়ক অনুপ জলোটা আমন্ত্রিত হন।
আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে তহবিল সংগৃহিত হয়। হাজার হাজার শুভাকাঙ্ক্ষী ও পুরাতন বন্ধুজনরা মেনর রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রিকেট তারকা সুনীল গাভাস্কার ও বলিউড ফিল্ম অভিনেতা ঋষি কাপুরের নেতৃত্ব ওয়েম্বলি থেকে মেনর পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ মাইল পদযাত্রা হয়। ঐদিন মেনরের জন্য হাজার হাজার পাউন্ড
অর্থ সংগৃহিত হয়।
১৯৯০ সালে পরিবেশ বিভাগ ঘোষণা করে যে, দু’বছরের মধ্যে মেনরে উৎসব ও আরাধনা বন্ধ করতে হবে এবং নতুন মন্দিরও খোলা যাবে না। তখন মেনর পুনরায় এর বিরুদ্ধে আপিল করে। এবার সরাসরি হাই কোর্টে, ট্রাফালগার স্কয়ার পার্কে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন স্বরূপ ২০০০ ভক্তের সমাগম ঘটে। তখন অনেক রাজনীতিবিদও মেনরকে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে মেনর জাতীয়ভাবে মনযোগ আকর্ষণ করে। সে সময়ের মন্দির অধ্যক্ষ অখগুধি দাসকে বিবিসি ও আইটিভি আমন্ত্রণ জানায়। তারা তাঁর সাক্ষাৎকারটি জনসমক্ষে সম্প্রচার করে। বিখ্যাত গায়ক বয় জর্জ তার Bow Down Mister অ্যালবাম রিলিজ করলে সেটিও জনপ্রিয় হয়।
১৯৯১ সালে ভক্তরা বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠা
নে অংশগ্রহণ করেন। এসময় বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দরা লন্ডনে জড়ো হন ইসকনের প্রতিরক্ষা প্রদানের জন্য। তারা বলেন গত ৩০০ বছরের মধ্যে সরকার কোনো আরাধনার স্থানকে বন্ধ করার পায়তারা করেছে। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে বিগ্রহ একবার যেখানে অভিষিক্ত হয় তা আর সরানো যায় না। অতএব মেনর হচ্ছে একটি পবিত্র স্থান। ১৯৯৪ সালে একটি কৃষ্ণ মন্দির সরকার কর্তৃক বন্ধ হয়ে গেলে সারা বিশ্ব থেকে এর প্রতিবাদে প্রায় ৩৬ হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী অংশগ্রহণ করে। তখন মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের এ বিষয়টি টনক নড়ে। তারা অবশ্য এর একটি সমাধান খোঁজেন। মে মাসে ১০ হাজার লোকের আরেকটি সমাগমে কিছু সংঘর্ষ ঘটে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাইরে ১২৭ জন পুলিশের এক ঘন্টারও বেশী সময় লেগেছিল পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অনেকজনকে গ্রেফতার করলে বিষয়টি মিডিয়াতে বেশ ফলাও করে প্রচার হয়। অক্টোবরে বিবিসির Everyman অনুষ্ঠানটি হরেকৃষ্ণ ভক্তদেরকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে।
১৯৯৫ সালে
আগস্টে হাইকোর্টের সুবিধা পাওয়ার জন্য এক রাতেই মোট ১০ লক্ষ ইউরো পরিমাণের বিশাল তহবিল সংগৃহিত হয়। এই তহবিল ব্যবহৃত হয় আইনি লড়াইয়ে ও মন্দিরের আনুসাঙ্গিক সেবায়। ১৯৯৪ সালে ভক্তরা জন্মাষ্টমী উৎসব উদ্যাপন করায় কোর্ট ভক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে ৩০ হাজারেরও বেশী অর্থ জরিমানা করে। এজন্যে লিউটনে কোর্টের বাইরে একটি আন্দোলন হয়। ইতোমধ্যে অখণ্ডধি দাস বিবিসি রেডিওতে আমন্ত্রিত হন সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য। ভক্তিবেদান্ত মেনর বন্ধ করার বিরুদ্ধে একটি সংগঠন করা হয় যার নাম দেওয়া হয় The Hare Krishna Temple Defence Movement এবং সারাবিশ্বে এটি প্রচার কার্যক্রম শুরু করে।
১৯৯৫ সালে, পাণ্ডব সেনা ইউথ গ্রুপ নামে একটি যুব প্রচার বিভাগ বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করে। যাদের মধ্যে অন্যতম হল সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ। একই বছরের আগস্টে মেনরের নতুন অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন দামোদর দাস। ১৯৯৬ সালের মে মাসে সেখানকার সাধারণ জনগণের সহায়তায় ও সারাবিশ্বের জনগণের প্রচেষ্টায় ভক্তিবেদান্ত মেনরের অভূতপূর্ব বিজয় হয়। ১৯৯৭ সালে সঙ্গ পোগ্রাম চালু হয় ও যার মাধ্যমে ভক্তরা শত শত গৃহে গিয়ে প্রভুপাদের বাণী প্রচার ও কীর্তন অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন। ২০১৩ সালে এরকম প্রায় ৪৫টি সঙ্গ গঠন করা হয় যারা নিয়মিতভাবে ২০ থেকে ৫০টি গৃহে পরিদর্শন করেন। এটি সমগ্র লন্ডন জুড়ে ৪৫টি নতুন মন্দির কার্যক্রমের সমপর্যায়ের মতোই। ১৯৯৮ সালে বিপ্রমূখ্য স্বামী মন্দিরের অধ্যক্ষ হন। মেনরে বর্তমানে ২৪টি গাভী ও ষাঁড় রয়েছে। এ সমস্ত গাভী ঐ বছর মোট ১২,২৫৪ লিটার দুধ সরবরাহ করে।
এ দুধ দিয়ে বিভিন্ন সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা মেনর পরিদর্শন শুরু করে তারা মেনরের মনোরম পরিবেশ ও কার্যক্রম দেখে অভিভূত হয়। প্রতি বছর এখানে ২৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক পরিদর্শন করে। ২০০১ সালে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে বিখ্যাত গায়ক ও কৃষ্ণভক্ত জর্জ হ্যারিসন দেহত্যাগ করেন। তার স্মরণে মেনরের যে স্থানটি তিনি পছন্দ করতেন সে স্থানে একটি বাগান উৎসর্গ করা হয়। ২০০৩ সালটি ছিল উৎসবের বছর। উৎসব শুরু হয় মেনরের ৩০তম বর্ষপূর্তি উদযাপন দিয়ে। ঐ বছর দিওয়ালী উৎসব আয়োজিত হয় হাউস অব কমেন্স ও ভক্তিবেদান্ত মেনরের যৌথ উদ্যোগে, যেখানে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার যোগ দেন। ২০০৫ সালে বিভিন্ন কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে প্রধান ছিল বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মন্দির পরিদর্শন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলেন, শ্রীল প্রভুপাদের বিগ্রহে পুষ্পমাল্য পরিয়ে দেন এবং প্রসাদ গ্রহণ করেন। বাকিংহোম প্রাসাদ এবং উইন্ডসরের বিভিন্ন প্রতিনিধি ও সদস্য মেনর পরিদর্শন করেন। ২০০৯ সালে কৃষ্ণ অবস্তী স্কুল নামে নতুন একটি স্কুল স্থাপিত হয় যেটিকে জাতীয়ভাবে বেশ প্রচার-প্রচারণা করা হয়। স্কুলটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১১ সালে ইসকনের অন্যতম গুরু ও সন্ন্যাসী শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী প্রথমবারের মত ক্যানরি ওয়ার্ফে একটি প্রধান কর্পোরেট অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। ঐ মাসেই তিনি হাউস্ অব কমন্সে পার্লামেন্টের সদস্যদের কৃষ্ণকথা পরিবেশনের মাধ্যমে আকর্ষিত করেন। ২০১২ সালে রানির ডায়মন্ড জুবলী বছরে রানি স্বয়ং কৃষ্ণ-অবন্তী স্কুলটি পরিদর্শন করেন। তিনি কৃষ্ণ বলরাম বিগ্রহের সম্মুখে উপবেশন করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় নরোত্তম দাস ঠাকুরের ভজন শ্রবণ করেন। তিনি এটি শ্রবণ করার পর মৃদুভাবে হেসে অভিনন্দন জানান।
২০১৩ সালটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা ভক্তিবেদান্ত মেনরের দীর্ঘ ৪০ বছর পূর্তি উদযাপন। এ উদ্যাপনটি শুরু হয় হাজার হাজার ভক্তের উপস্থিতিতে অগ্নিযজ্ঞ ও পূজার মাধ্যমে। রামনবমী উদযাপিত হয় মেনরের সরোবরে রাঁজহাস নৌকা উৎসবের মাধ্যমে। জর্জ হ্যারিসনের প্রতি স্থায়ীভাবে শ্রদ্ধাস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত “A garden for George” উন্মুক্ত করা হয়।
এভাবে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, তাঁর পুত্র শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী এবং ইসকন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ নিশ্চিতভাবে প্রসন্ন হবেন যে, কৃষ্ণভাবনা অবশেষে ব্রিটিশ জনগণের মাঝে এসেছে এবং তা ভক্তিবেদান্ত মেনরের গত ৪০ বছরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেটি ব্রিটিশদের মাঝে আরো ছড়িয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত।