এই পোস্টটি 240 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য : আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বৃন্দাবনে প্রদত্ত প্রবচনের বঙ্গানুবাদ
এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ।
ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/৩০)
অর্থাৎ “এইভাবে শুদ্ধ-সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে ভক্তিযোগে যুক্ত হওয়ার ফলে যাঁর চিত্ত প্রসন্ন হয়েছে, তিনি সব রকম জড়বন্ধন মুক্ত হয়ে ভগবত্তত্ত্ব-বিজ্ঞান উপলব্ধি করেন।” পরম ব্রহ্ম হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান। এটি এমন কোন ভাবাবেগ নয় যে “ভোট দিয়ে কাউকে ভগবান বানালাম।” এটি হল ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানম্ প্রত্যেকের জানা উচিত, ভগবানের সংজ্ঞা কি? এমন নয় যে, কোন একজন লম্বা দাড়িওয়ালা লোক এগিয়ে এসে বললো “আমি ভগবান” আর অজ্ঞানীরা তাকে ভগবান বলে গ্রহণ করলো। বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ব্যতীত, ভগবান কি তা হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানম্ । এই বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞান কে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে? মুক্তসঙ্গস্য। যিনি জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের কলুষ থেকে মুক্ত, তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।
যারা তমোগুণ আর রজোগুণ দ্বারা কলুষিত, তারা নিজস্ব ভগবান সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ধরনের ‘ভগবান’ও রয়েছে। ভগবান মানে নিয়ন্তা। প্রত্যেকেই কিছুটা হলেও নিয়ন্তা তাই এক অর্থে প্রত্যেকেই ভগবান। কিন্তু প্রকৃত নিয়ন্তার অর্থ হচ্ছে যিনি অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন না। এই হচ্ছে ভগবান ।
দৈবী হোষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া (গীতা ৭/১৪), জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, প্রকৃতির এই সকল বিষয় দ্বারা আমি যদি নিয়ন্ত্রিত হই, তাহলে কি করে আমি ভগবান হতে পারি?. ভগবান কখনও নিয়ন্ত্রিত হন না। অতএব, ভগবনাকে যিনি হৃদয়ঙ্গম করবেন তাকে অবশ্যই এই জড়া প্রকৃতির কলুষ থেকে মুক্ত হতে হবে। মুক্তসঙ্গস্য। ভগবদ্গীতাতেও (১৮/৫৪) এই বিষয়টিও প্রতিপন্ন হয়েছে
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্খতি ।
সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ ॥
যখন কেউ ব্রহ্মকে হৃদয়ঙ্গম করেন, তখন তিনি প্রসন্নাত্মা হন, ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা। আমাদের বর্তমান আলোচ্য শ্লোকটিতেও সেই একই কথা বলা হয়েছে এবং প্রসন্নমনসো। এই বিষয়টিতে কোন বিরোধ থাকতে পারে না। প্রসন্নমনসো এবং প্রসন্নাত্মা একই জিনিস। তো, কি করে কেউ প্রসন্নমনসো বা ‘প্রসন্নাত্মা’ হতে পারে? সেটি এখানে বর্ণিত হয়েছে। ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ। এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ। আপনি যদি ভগবদ্ভক্তিযোগ, ভগবদ্ভক্তির পথটি গ্রহণ করেন, আপনি প্রসন্নমনসো হবেন। আমি যদি আনন্দিত প্রসন্নমনসো না হই, তার অর্থ হল মায়া আমাকে আক্রমণ করেছে। ভগবদ্ভক্ত কখনও অপ্রসন্ন থাকেন না। যদি সত্যিই তিনি কৃষ্ণের সংস্পর্শে থাকেন, তাহলে কিভাবে তিনি বিষণ্ণ থাকতে পারেন? যদি তিনি বিষণ্ণ বা অসুখী হন, তার অর্থ হল মায়া তাকে আক্রমণ করেছে। এটি একটি পরীক্ষা।
শ্রীল রূপ গোস্বামী তাই বলেছেন-‘উৎসাহ’। আমাদের সবসময় উৎসাহী হতে হবে। কিন্তু আমরা কৃত্রিমভাবে উৎসাহী হতে পারি না। সেই উৎসাহে অবশ্যই ভগবদ্ভক্তিযোগ থাকা চাই। ঠিক যেমন মন্দিরের এইসব দর্শনার্থীরা, দেখুন তারা কতটা উৎসাহী। তাঁরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যমুনায় স্নান করতে যাচ্ছেন আর তারপর তারা বহু মন্দির দর্শন করছেন, বিশেষ করে এই দামোদর মন্দির, কেননা এখন দামোদর মাস। ভোর ৩টা, ৪টা থেকে তারা উৎসাহী। আমরা যদি খুব ভোরে উঠতে না পারি, তার মানে আমরা মায়ার অধীনে রয়েছি। এটা পরীক্ষা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাই বলছেন—
জীব জাগো জীব জাগো গোরাচাঁদ বলে।
কত নিদ্রা যাও মায়া-পিশাচীর কোলে ॥
অতি নিদ্রা ঠিক নয়। তখন বুঝতে হবে যে আমি মায়ার বন্ধনে জড়িয়েছি, যত ঘুম তত জড়ানো। কেননা তমোগুণের লক্ষণ হলো অলসতা আর নিদ্রা। আর রজো গুণের লক্ষণ হলো-খুব কর্ম তৎপর। বাঁদরের মতো। বাঁদর খুবই সক্রিয়, কিন্তু তার সবই ক্ষতিকর। যেখানেই তারা বসবে সেখানেই উৎপাত” এক মুহূর্তের জন্যও তারা নিষ্ক্রিয় নয়, কিন্তু সবই মূর্খামি। আর সত্ত্বগুণ মানে জ্ঞান। যখন কেউ সত্ত্বগুণের স্তরে আগমন করেন তখন তিনি ‘প্রসন্নমনসো’ হন, কেননা তিনি তমো ও রজো গুণ দ্বারা আক্রান্ত নন, যার অর্থ হচ্ছে অলসতা, নিদ্রা ও মূর্খের সক্রিয়তা। কিছু না করার থেকে মূর্খের সক্রিয়তা অধিক ভয়ঙ্কর। কেননা কেউ যদি ভয়ঙ্কর হয়, তখন তার খুব বেশী সক্রিয় না হওয়াই ভালো, কারণ তার সক্রিয়তা ক্ষতিকর হয়ে উঠবে, ঠিক বাঁদরের মতো। বাঁদরদের সর্বদাই অতি সক্রিয় দেখা যায়, কিন্তু কেউই এদের পছন্দ করে না। যখনই কোথাও বাঁদর আসে, প্রত্যেকে তাদেরকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় ।
তাই আমাদের কখনও অলস ও নিদ্রালু হওয়া উচিত নয় এবং একই সঙ্গে মূর্খের মতো সক্রিয় হওয়াও উচিত নয়। আমাদের জীবনের প্রকৃত মান, সত্ত্বগুণের স্তর অর্জন করা উচিত। তখন আমরা ভক্তিপূর্ন সেবা শুরু করতে পারব। এই কথা ভগবদ্গীতাতেও (১৮/৫৪) প্রতিপন্ন হয়েছে।
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্খতি ।
সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ ॥
ব্রহ্মভূত হবার পর, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ এই কথাটি পরিস্কারভাবে হৃদয়ঙ্গম করার পর যে কেউই ভগবানের চিন্ময় প্রেমময়ী সেবায় নিযুক্ত হতে পারে, তার আগে নয়। তার আগে আমরা যদি ভক্তিযোগকে গ্রহণ করি, তাহলে অবশ্যই আমরা ধীরে ধীরে ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হব। ভক্তিযোগ এমনই সুন্দর বা চমৎকার যে তা কোন শর্তের ওপর নির্ভর করে না। অহৈতুকী অপ্রতিহতা। ‘অপ্রতিহতা’ মানে হল যা কোন অবস্থার অধীন নয় । আপনি যে কোন অবস্থানেই শুরু করতে পারেন। যে কোন জায়গা থেকে আপনি কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় শ্রবণ শুরু করতে পারেন । শ্রবণং কীর্তনম্। আপনি যদি নিষ্ঠার সঙ্গে ভগবদ্ভক্তিযোগের পন্থাটি অনুসরণ করেন, তাহলে আপনি সত্ত্বগুণের ঊর্ধ্বস্তরে অবস্থান করছেন। স গুনান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে (গীতা ১৪/২৬)
যে ঐকান্তিকভাবে ভক্তিযোগকে গ্রহণ করে সে ক্রমে ক্রমে মুক্তি লাভ করে
বাসুদেবে ভগবতি ভক্তিযোগঃ প্রয়োজিতঃ
জনয়ত্যাশু বৈরাগ্যং জ্ঞানং চ যদহৈতুকম্
(ভাগবত ১/২/৭)
মুক্তি মানে জ্ঞান ও বৈরাগ্য। জ্ঞান-পূর্ণ জ্ঞানের অর্থ হচ্ছে “আমি এই দেহ নই, আমি আত্মা, এবং দেহগত কার্যকলাপ আমার জীবনের পরম উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাকে অবশ্যই পারমার্থিক কর্মে যুক্ত করতে হবে।” একেই বলে জ্ঞান ও বৈরাগ্য । যখন কেউ জানতে পারে যে সে, এই দেহ নয়, তখন কেন সে দেহ প্রতিপালনের জন্য দিন রাত কঠিন পরিশ্রম করবে? এই হল জ্ঞান। কর্মীরা দেহ প্রতিপালনের চেষ্টা করে চলে। কখনও কখনও কর্মীরাও ভক্তিযোগ গ্রহণ করে। ঠিক ভক্তিযোগ নয়, তথাকথিত ভক্তিযোগ। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যটি থাকে কত সুন্দরভাবে এই দেহটিকে প্রতিপালিত করা যায়। সেটিও স্বীকার করা হয়েছে।
অকামঃ সর্বকামো মোক্ষকাম উদারধীঃ
(ভাগবত ২/৩/১০)
কেননা আপনি যদি এই দেহটিকে সুন্দরভাবে প্রতিপালনের জন্যও ভক্তিযোগকে গ্রহণ করেন, সেটিও হবে চমৎকার, কারণ ধীরে ধীরে ভক্তিযোগের প্রভাবে আপনি মুক্ত সঙ্গ, মুক্তের স্তরে আসবেন ভক্তিযোগ এমনই দৃঢ়।
তাই শাস্ত্র নির্দেশ হচ্ছে, আপনি কর্মী, জ্ঞানী বা যোগী হোন তবু ভক্তিপথকে গ্রহণ করুন। আপনার সকল আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে।
অকামঃ সর্বকামো মোক্ষকাম উদারধীঃ।
তীব্রেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ॥
(ভাগবত ২/৩/১০)
এই হল নির্দেশ। আপনার যদি কর্মী, জ্ঞানী বা যোগীর মতো আকাঙ্খা থাকে আপনাকে ভক্তিযোগ গ্রহণ করতে হবে। আপনি তখন ‘প্রসন্নমনসো’ হবেন আপনি তখন সন্তুষ্ট বা সুখী হবেন। আপনি আনন্দময় স্তরে অধিষ্ঠিত হবেন।
পারমার্থিক জীবনের অর্থ জ্ঞানের নিত্য আনন্দময় জীবন। এই জীবনটি অনিত্য, কিন্তু যখন আমরা চিন্ময় জীবনে রূপান্তরিত হই, সেটি নিত্য। সচ্চিদানন্দময় বিগ্রহ (ব্রহ্মসংহিতা ৫/১)।
আমরাও ‘সচ্চিদানন্দময় বিগ্রহ’ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিগ্রহ মানে রূপ। সচ্চিদানন্দ মানে নির্বিশেষ বোঝায় না। সেটি মূর্খতা। আনন্দ কখনই নৈর্ব্যত্তিক হতে পারে না। ধরা যাক আপনাকে একটি বড় কক্ষে রাখা হল, যেখানে আর কেউ আসবে না। তখন দীর্ঘ সময়ের জন্য আপনি খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন না। আপনি একাকীত্ব বোধ করবেন। আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। ঠিক যেমন আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি। প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে, আমরা যখন আকাশের অনেক উচ্চতায় উঠি, সেই অবস্থায় বড় জোর, আট থেকে দশ ঘণ্টার বেশী থাকতে পারি না। তখন আমরা অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠি তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
যেহন্যেহরবিন্দা বিমুক্তমানিন স্ত্বম্যস্তভাবাদবিশুদ্ধবুদ্ধয়ঃ ।
আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ পতন্ত্যবোধহনাদৃতযুস্মদঙ্ঘ্রয়ঃ ॥
যে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করে না, সে তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে অতি উচ্চ স্তরে উঠলেও, সে সেই স্তরে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না। সে হয়ত কৃত্রিমভাবে এই জগৎকে ত্যাগ করতে পারে। অনেকে বলে জগৎ মিথ্যা, কিন্তু তাকে পুনরায় এই মিথ্যা জগতেই স্কুল, হাসপাতাল তৈরির জন্য ফিরে আসতে হবে, কেননা সে ঐ নৈর্ব্যত্তিক ভাবে অবস্থান করতে পারে না। তথাকথিত ব্রহ্মবাদীরা বলে “আমরা মুক্ত হয়েছি।” কিন্তু তারা মুক্ত নয়। এটি কেবলমাত্র মিথ্যা অভিমান, বিমুক্ত মানিনঃ। তারা মুক্ত নয়। মুক্ত না হয়েও যদি কেউ বলে যে “আমি মুক্ত হয়েছি”, সেটি অবিশুদ্ধ-বুদ্ধয়ঃ, তার বুদ্ধিমত্তা পরিচ্ছন্ন নয় । মুক্তি কি তা সে জানে না। মুক্তি মানে হল প্রসন্ন মনসো, পূর্ণ-আনন্দময়, সেটিই মুক্ত। ভগবানকে আপনার সত্যভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। অতএব সত্যভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য, এটি একটি বিজ্ঞান। এটি কোন ভাবাবেগ নয়।
যে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করে না, সে তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে অতি উচ্চ স্তরে উঠলেও, সে সেই স্তরে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না। সে হয়ত কৃত্রিমভাবে এই জগৎকে ত্যাগ করতে পারে অনেকে বলে জগৎ মিথ্যা, কিন্তু তাকে পুনরায় এই মিথ্যা জগতেই স্কুল, হাসপাতাল তৈরির জন্য ফিরে আসতে হবে, কেননা সে ঐ নৈর্ব্যত্তিক ভাবে অবস্থান করতে পারে না।
ভগবদ্গীতাতেও কৃষ্ণ বলছেন জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং মোক্ষ্যসেহশুভাৎ (গীতা ৯/১)। ভাগবতে (৩/৯/৩১) বলছেন, জ্ঞানং পরমগুহ্যং মে যদ্বিজ্ঞানসমন্বিতম্। অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধীয় যে জ্ঞান তা অত্যন্ত গোপনীয়। যখন আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সত্যকে, পরম ব্রহ্মকে হৃদয়ঙ্গম করি তাকে বলা হয় ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানম্ । এই ভগবৎ-তত্ত্ব-বিজ্ঞান মুক্ত পুরুষ দ্বারাই উপলব্ধ হয়। যে মানবতাবাদ, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ব্যস্ত, যে রাজনীতি নিয়ে সর্বদাই অতি ব্যস্ত, সে কিভাবে ‘ভগবৎ-তত্ত্ব-বিজ্ঞানম’ হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে? সেটি অসম্ভব।
ভগবানকে উপলব্ধি করার কিছু পরীক্ষা রয়েছে। একজন রাজনীতিবিদ্ নিজেকে পারমার্থিক জীবনে খুব উন্নত বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু যখন আমরা দেখি যে কৃষ্ণের চেয়ে রাজনীতিতেই তার আগ্রহ বেশী তখন আমরা বুঝতে পারি তার অবস্থানটি ঠিক কি। এগুলি হচ্ছে পরীক্ষা । রাজনীতি বা সমাজতত্ত্ব হোক বা যে কোন কিছু, একজন শুদ্ধ ভক্ত সর্বদাই আগ্রহী থাকেন কৃষ্ণ কি করে সন্তুষ্ট হবেন। ঠিক অর্জুনের মতো। অবশ্যই, কেউ যখন ঠিক এভাবে আগ্রহী হবে, অন্য সব বিষয় যখন গৌণ বিষয়ে পরিণত হবে, সে এই স্তরে আসবে। ঠিক যেমন অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের এক মহান ভক্ত, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদও। কিন্তু তাঁর প্রথম আগ্রহী ছিল কৃষ্ণভক্ত হওয়া, কিভাবে কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করা যায় । এমন নয় যে, “রাজনৈতিক কারণে আমি কৃষ্ণকে ভালোবাসি।” না। আপনি কৃষ্ণকে ভালোবাসুন, তখন আপনার সমস্ত সমস্যা, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অন্যান্য বিষয়গুলির সমাধান হয়ে যাবে। এই হল কৃষ্ণভাবনামৃত। আপনার রাজনৈতিক কারণটিকে মুখ্য বিষয় করে কৃষ্ণভাবনামৃতকে গৌণ করার প্রয়োজন নেই। তাই আমরা বলি যে, যদি পৃথিবীর কিছু শতাংশ মানুষও কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তাহলে পৃথিবী অনেক নিরাপদ হবে। আমরা আশা করি না যে একশত শতাংশ মানুষ কৃষ্ণভাবনাময় হবে, কিন্তু কেবলমাত্র কিছু শতাংশ, ধরা যাক পাঁচ শতাংশ, পৃথিবীর জনসংখ্যার এইসব মানুষগুলি, যদি কৃষ্ণভাবনাময় হয়, তাহলে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যাবে। ঈশাবাশ্যম্ ইদং সর্ব-কেননা নেতারা যদি কৃষ্ণভাবনামৃতকে হৃদয়ঙ্গম করে এবং সেই অনুসারে কার্য করে, অন্যান্য মানুষও অনুসরণ করবে। যদ্ যদ্ আচরতি শ্রেষ্ঠস্ তৎ তৎ এব ইতরঃ জনঃ সাধারণ মানুষ নেতাদের অনুসরণ করে।
জীবনের আনন্দময় ভাবকে কিভাবে আনয়ন করতে হয় সেটি এখানে বর্ণিত হয়েছে। ভগবৎ ভক্তি-যোগতঃ। কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করতে হবে। এবং মুক্তসঙ্গস্য, ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে। জড়া প্রকৃতির গুণসমূহের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারলে কেউই কৃষ্ণকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না।
প্রদ্যুম্ন: “ভগবদ্গীতায় (৭/৩) বলা হয়েছে যে, হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কেবল দু’একজন সৌভাগ্যবান মানুষই জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়াসী হন। অধিকাংশ মানুষই রজ এবং তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত এবং তাই তারা সর্বদাই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অজ্ঞান এবং নিদ্রামগ্ন । এইরকম বহু মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কেউ মানব জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত হয়ে তার সেই কর্তব্য সম্পাদনে প্রয়াসী হয় ।…’
শ্রীল প্রভুপাদ : অতএব যে সকল মানুষ তমো ও রজগুণে অবস্থান করছে, তারা রজস্তমোভাবঃ কামলোভাদয়শ্চ যে। প্রকৃতপক্ষে একজন ব্যক্তি তখনই মানুষ বলে বিবেচ্য যখন সে সত্ত্বগুণের স্তরে অধিষ্ঠিত হয় অথবা সে একজন সদ্ ব্রাহ্মণের গুণাবলী অর্জন করে। তখন সে মানুষ বলে বিবেচিত হয় ।
প্রদ্যুম্ন : “আর এই রকম হাজার হাজার সিদ্ধিকামী মানুষদের মধ্যে কেবল দু’একজন মাত্র তত্ত্বগতভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে।”
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ, সে কথা ভগবদগীতায় উল্লেখ করা হয়েছে। মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে (গীতা ৭/৩)। যেহেতু আমরা পশু স্তর থেকে ক্রমবিকাশের পন্থায় মনুষ্য স্তর লাভ করেছি, শাস্ত্রে সেটি বলা হচ্ছে যে, জীবাত্মা বিভিন্ন নিম্ন শরীর থেকে ক্রমে মনুষ্য শরীর প্রাপ্ত হয়। ডারউইন তত্ত্ব বলছে যে বাঁদর থেকে। সেটিও ঘটনা যে বাঁদরের পর জীব মনুষ্য রূপে আগমন করে। কেউ বলছে সিংহের পর, কেউ বলছে গাভীর পর। তো পশু রূপ থেকেই আমরা মনুষ্য রূপে উন্নীত হচ্ছি। সেই মনুষ্য দেহটিরও যদি সংস্কারসাধন না হয়, তাহলে সে পশুই রয়ে যায়। সেই সংস্কারটি প্রয়োজন-সংস্কার, পুনর্গঠন, উৎসাহ, সাংস্কৃতিক জীবন। সেই সাংস্কৃতিক জীবনটি তৈরী হয় যখন কেউ বাস্তবিকভাবে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব হয়। সেটিই প্রকৃত সাংস্কৃতিক জীবন । জন্মগতভাবে নয়; জ্ঞান, শিক্ষা, প্রগতি, পারমার্থিক জ্ঞান চর্চার দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ স্তর লাভ করে।
অতএব মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিদ যততি সিদ্ধয়ে, এইটি হল সিদ্ধির স্তর। কিন্তু সবাই যোগ্য ব্রাহ্মণ হতে অনাগ্রহী। সকলেই শূদ্রই থাকতে চায়। কলৌ শূদ্রঃ সম্ভবঃ। ঠিক যেমন আমরা মানুষকে অবৈধ যৌনসঙ্গ, নেশা, জুয়া ও মাংসাহারের জঘন্য অভ্যাস পরিত্যাগ করে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণের জন্য বলছি, আর মানুষ হাসছে এবং বলছে, “সে কি! এটাই তো জীবন । এইসব বিষয়গুলি ত্যাগ করলে জীবনে আর কি থাকল?” বিশেষত পাশ্চাত্যবাসীরা মনে করছে উক্ত অভ্যাসগুলি ত্যাগ করা মানে জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি ত্যাগ করা। কলিযুগে এই চারটি বদভ্যাস ত্যাগ করা খুবই কঠিন। কিন্তু এটিই হল পূর্ণতার পথ, শুদ্ধতার পথ। কিন্তু তারা শুদ্ধতায় আগ্রহী নয়। তারা কুকুর শূকরের মতো এই পৃথিবীতে বাঁচতে চায় ।
এমনটিও নয় যে, যোগ্য ব্রাহ্মণের স্তর লাভ করলেই কেউ কৃষ্ণকে হৃদয়ঙ্গম করবে।
ব্রহ্ম জানাতি ইতি ব্রাহ্মণঃ। ব্রাহ্মণ ব্রহ্মকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু সেই বুঝতে পারাটা যথেষ্ট নয়। তাঁকে বৈষ্ণব হওয়ার জন্য, পরমেশ্বর ভগবানকে, পরম ব্রহ্মকে, ব্যক্তিরূপে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আরও শুদ্ধ স্তরে পৌঁছতে হবে। বৈষ্ণব মানে হল পরম ব্রহ্মকে ব্যক্তি রূপে হৃদয়ঙ্গম করা, নির্বিশেষ রূপে নয়। ব্রাহ্মণ স্তরে যদিও তাঁরা ব্রহ্মকে হৃদয়ঙ্গম করেন, সেটি নির্বিশেষ দর্শন। কিন্তু এরও ওপরের স্তরে যেতে হবে। ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবান ইতি শব্দতে। ব্রহ্মের স্তর থেকে পরমাত্মার স্তরে অগ্রসর হতে হবে। তাহলে পরমেশ্বর ভগবানকে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে। অতএব কৃষ্ণ বলছেন যততামপি সিদ্ধানাম । যদি কেউ ব্রহ্মভূত স্তরে আসার চেষ্টা করা, সেটি হচ্ছে সিদ্ধ স্তর। কৃষ্ণ কেবলমাত্র উপলব্ধি হন এই পন্থায়-ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ।
এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ।
ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/২০)
ব্রাহ্মণের স্তর থেকেও মুক্ত হতে হবে। তাহলে সে কৃষ্ণকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। অতএব কৃষ্ণকে হৃদয়ঙ্গম করা অত সহজ নয়। সেটি খুবই কঠিন। কৃষ্ণ সে কথা বলছেন। কিন্তু কৃষ্ণের কৃপায়, যেহেতু তিনি স্বয়ং নিজেকে বিতরণ করতে চান, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের বিনামূল্যে কৃষ্ণকে প্রদান করেছেন। কৃষ্ণপ্রেমপ্রদায়তে। শ্রীল রূপ গোস্বামী বলছেন যে নমো মহাবদান্যায়। কৃষ্ণ অতটা উদার ছিলেন না। তিনি বলেছেন “শরণাগত হও”। তিনি নিজেকে বিতরণ করেন নি। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে তিনি নিজেকে বিতরণ করেছেন “কোন মূল্য ছাড়া আমাকে নাও, আমাকে গ্রহণ কর।” এই হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি স্বয়ং কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণচৈতন্য রূপে নিজেকে বিতরণ করার জন্য অবতরণ করেছেন। তাই তিনি নমো মহাবদান্যায়, পরম দাতা। অন্য কোন অবতারে, এমনকি রামচন্দ্র বা ভগবান কৃষ্ণ অবতারেও তারা এতটা উদার ছিলেন না। পাপী তাপী যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল। তিনি নিজেকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের মাধ্যমে বিতরণ করেছেন ।
তাই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের মাধ্যমে, পাশ্চাত্যবাসীরা, তারা কৃষ্ণকে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছে। সহস্রজনের মধ্যে কদাপি কেউ তা হৃদয়ঙ্গম করেন। কিন্তু এই যুগে আমরা যতটা পতিত কৃষ্ণ ঠিক ততটাই উদার। তাই এখনও যদি আমরা সুযোগটি গ্রহণ না করি, তাহলে আমরা যে কতখানি হতভাগা, সেটি আমরা বিবেচনা করতে পারি। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।