এই পোস্টটি 147 বার দেখা হয়েছে
![পরিবেশ দূষণ নাকি হৃদয় দূষণ?](http://csbtg.org/wp-content/uploads/2022/07/Untitled-2-2-scaled.jpg)
আমাদের এই বিশ্ব বৈশ্বিক আক্রমণে প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হচ্ছে। হরে কৃষ্ণ ভক্তরা কি এর প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে?
মুরারি গুপ্ত দাস
যখন আমার জাগতিক আন্টি মুম্বাইয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন তখন আমি তার সন্তানদের নিয়ে সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলাম। তিনি সমুদ্র দর্শন করে কিছুটা আর্তি স্বরে বললেন, “খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, এই সমুদ্র খুব শীঘ্রই সুন্দর ই শহরকে গ্রাস করে ফেলবে।”
তিনি একটি ম্যাগাজিনের রিপোর্টের কথা বলেছিলেন যার কাভারে একটি ছবি ছিল যার বিষয় বস্তু ছিল ইন্ডিয়া গেইট স্তম্বটি জলে অর্ধ নিমজ্জিত হয়েছে। ম্যাগাজিনটি জাতিসংঘের পরিবেশ দূষণ সূচক গবেষণার কথা উল্লেখ করেছে আগামী ২০৫০ সালে মুম্বাই এবং অন্যান্য সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ সামদ্রিক জীবদের আবাসস্থলে পরিণত হবে। বিশেষত শীত প্রধান অঞ্চলগুলোতে দ্রুত বরফ গলে যাওয়ার কারণে বহু সমতল স্থান দিনে দিনে জলে ডুবে যাচ্ছে। সেই সাথে সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে কৃষিক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধন হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে খরাসহ নানাবিধ দুর্যোগের করাল গ্রাস মানুষকে দগ্ধীভূত করছে। হিমালয়ের হিমবাহ গলনের ফলে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যখন হিমালয় সম্পূর্ণ গলে যাবে তখন গঙ্গা, যমুনা এবং অন্যান্য নদী সমূহের উৎপত্তি বিলীন হয়ে যাবে। এর ফলশ্রুতিতে বিশ্ব ব্যাপী প্রচণ্ড খরার উদ্ভব হবে, খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট প্রকট হয়ে উঠবে। ৩০-৪০ শতাংশ উদ্ভিদ এবং প্রাণীকূল পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। অবশিষ্ট প্রাণীকূল তাদের অস্থিত্ব লড়াইয়ের কারণে শীঘ্রই অস্থিত্বহীন হয়ে পড়বে। এর ফলে পৃথিবীর বাস্তু সংস্থানের অপমৃত্যু ঘটবে তখন আমরা সবাই পরিণত হব একেক জন কবর খাদকে (যে ব্যক্তি খাদ্যের জন্য কবর খুড়ে)।
এই গবেষণার তথ্যগুলো কারো কারো কাছে প্রতারণাপূর্ণ মনে হতে পারে কিন্তু কেউই দূষণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যের কথা অস্বীকার করতে পারবে না। যদিও আমরা পরিবেশ দূষণের কথা বহু আগে থেকেই শুনে আসছি তথাপিও আমরা পরিবেশ দূষণ রোধে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারি না। পৃথিবীতে আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ানরা পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। কিন্তু তারা সেটি জানা সত্ত্বেও তাদের অনর্থক জীবনযাত্রার চাতুর্যকে হ্রাস করার পক্ষপাতী নয় । অন্য দিকে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ শুধুমাত্র উন্নত দেশগুলোর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করা ছাড়া তারা বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতে রাজী নয়। তারা বলে, “আপনারা (উন্নত দেশ) বহু পূর্বকাল থেকে পৃথিবীর পরিবেশকে জগাখিচুড়ি বানিয়েছেন, এবার আমাদের পালা!”
এমনকি বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবেশ দূষণ রোধে বহু কঠোর আইন প্রণয়ন করা সত্ত্বেও বাস্তবে তার কোনো স্থায়ী সমাধান আসছে না। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে হয়তোবা সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার সমাধান করা যায় কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান কিংবা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকরী কোনো সমাধান দিতে পারে না। তাই পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমাদের নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং সর্বাপেক্ষা স্থায়ী সমাধান হিসেবে সেই নতুন আইনটি হবে আমাদের সকলের সূক্ষ্ম হৃদয়ের পরিবর্তন।
শ্রীল প্রভুপাদ চেয়েছিলেন ইস্কন সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক যে কিভাবে তারা প্রকৃতির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে তাদের জীবনযাত্রাকে সাজিয়েছে ফার্ম কমিউনিটির মাধ্যমে। এই ধরনের কমিউনিটি খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, বিদ্যুৎ এবং অন্য কোনো কিছুর জন্য শিল্প কারখানার ওপর নির্ভরশীল হয় না।
হৃদয়ের বাস্তু সংস্থান
প্রকৃতি শোষণের ফলে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং এই শোষণের পেছনে মানুষের লোভ কার্যত দায়ী। লোভের বশবর্তী হলে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে পেলে। অতৃপ্ত লোভের তাড়নায় মানুষ অন্ধভাবে অন্যের ক্ষতির মাধ্যমে নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করতে করতে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলতা বয়ে আনছেন। তারা এটি ভাবে না যে, এই সকল কর্মকাণ্ড ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর কি ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। দূষিত হৃদয় তার চারপাশে ব্যাপকভাবে দূষণ ছড়ায় ।
তাই পরিবেশ দূষণ রোধে সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান হলো আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়কে লোভ, কাম এবং অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত করে শুদ্ধ করার প্রচেষ্টা। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমেই আমাদের চিন্তার শুদ্ধি প্রয়োজন। শুদ্ধ চিন্তা আমাদের শুদ্ধ কর্মে অনুপ্রাণিত করে। নিজ ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য স্বার্থপর কর্ম পরিত্যাগ হবে যদি আমরা সবকিছুই ভগবানের সন্তুষ্টির জন্য করি। এরপর আমাদের জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনা দরকার বিশেষত উচ্চতর চিন্তাময় সাধারণ জীবন। কেননা অপরিসীম লোভ কিন্তু পরিমিত বস্তু থাকার কারণে খুব শীঘ্রই বিস্ফোরণ ঘটবে। কিন্তু যদি আমরা সন্তুষ্ট থাকি এবং স্বতঃস্ফূর্ত আমাদের কাজ করি, সকলের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সাধারণ জীবন অতিবাহিত করি এবং সকলেই ভগবানকে সন্তুষ্ট করার জন্য একে অপরের সহযোগিতাই কাজ করি তবে পৃথিবীতে কখনোই বিস্ফোরণ ঘটবে না। যদি আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় বসবাস করি তবে প্রকৃতি মাতা আমাদের সকল মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তুর সংস্থান করবেন। কিন্তু তা না করে যদি আমরা স্বার্থপরতা দেখায় তখন প্রকৃতি মাতা আমাদের মুখে চড় সদৃশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অস্থিতিশীল বাস্তুসংস্থান প্রদান করবেন।
মানব জীবন সৃষ্টি হয়েছে কর্তব্যকর্ম সম্পাদানের জন্য। আমাদেরকে যা কিছু শ্রেয় অথবা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন তাই করতে হবে। আমাদের প্রেয় তথা ক্ষণিকের সুখ ও লাভের আশা পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদেরকে সমস্যার সমাধান সামাজিকভাবে কর্মের নিয়মানুসারে সাধন করতে হবে।
আমরা তখনি দুর্দশাগ্রস্থ হই যখন আমরা অজ্ঞানী হই কারণ আমরা ভগবানের সাথে মিলিতভাবে বসবাস করি না। কিন্তু আমরা হতে পারি একজন উন্নত আত্মা যে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কর্ম সম্পাদন করেন। যদি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এই প্রকার চেতনায় অধিষ্ঠিত হয় তবে পৃথিবীতে কোনো পরিবেশ ও হৃদয়ের দূষণ ঘটবে না। তখন আমরা পরিবেশকে একটি ভারসাম্য অবস্থায় রাখতে সক্ষম হব। কিন্তু হৃদয়ের এই বিশেষ অবস্থা লাভের জন্য আমাদের গভীর মনোযোগের সহিত ভগবানের নাম জপ করতে হবে।
কার্যকর বাস্তুবিদ্যা
শ্রীল প্রভুপাদ চেয়েছিলেন ইস্কন সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক যে কিভাবে তারা প্রকৃতির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে তাদের জীবনযাত্রাকে সাজিয়েছে ফার্ম কমিউনিটির মাধ্যমে। এই ধরনের কমিউনিটি খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, বিদ্যুৎ এবং অন্য কোনো কিছুর জন্য শিল্প কারখানার ওপর নির্ভরশীল হয় না। পক্ষান্তরে তারা তাদের জীবন যাত্রার প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রকৃতি থেকে আহরণ করে। যদিও এই প্রকারের দৃষ্টান্ত এখনো পৃথিবী ব্যাপী মানুষের মাঝে অজানা রয়েছে কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের সকলেই ভগবান কৃষ্ণের শক্তি এবং এই প্রকৃতিকে সুষ্ঠভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধে সহায়তা করে চলেছে।
কেউ হয়তো বলতে পারে একজন নৈতিক নাস্তিকও পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে পারে, তাই কেন ভক্তদের প্রয়োজন? তার কারণ হলো যদি সেই নাস্তিককে জিজ্ঞাস করা হয়, আপনি কেন পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত? তাহলে তিনি তার স্বপক্ষে দুইটি কারণ নির্দেশ করবে-হয় পরিবেশবাদ তার মনে আনন্দের খোরাক জমায় অথবা বিভিন্ন পরিবেশগত দিক তাকে এই কাজে প্রলুব্ধ করে। যেহেতু তার দর্শন এবং পরিকল্পনা মন থেকে এসেছে কিন্তু সেই ধারণা সঠিক দর্শনগত ভিত্তিহীন তাই তার সকল কার্য অসঙ্গত এবং পরিবর্তনশীল। আজ হয়তো সে নীল তিমিকে বাঁচাতে চায় তো কাল কালো পাণ্ডা পর দিন সবুজ বন। তার উদ্দেশ্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক। পৃথিবীর ওজন স্তরের ক্ষয়রোধে সে হয়তো বা গাভী হত্যা রোধে সম্মত হতে পারে কেননা গাভী হত্যার কারণে যে মিথেন গ্যাস উদ্গীরণ হয় তার কারণে ওজন স্তরের ফাটল সৃষ্টি হয়। কিন্তু সে তার সর্বোচ্চ ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য দ্রুত গতিতে বর্ধমান শিল্পায়নকে বাধা প্রদান করে না যদিও এটি আরো মারাত্মক ক্ষতির কারণ। তার কর্মের আইন সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই, কর্তব্য সম্বন্ধে উপলব্ধি নেই এবং সহজ সরল জীবন যাপনের ইচ্ছা নেই। তার প্রচেষ্টাটি হলো ব্যান্ড এইড সমাধানের মতো- এটি দেখতে আকর্ষণীয় মনে হলেও রোগ প্রতিরোধে অক্ষম।
একবার একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ এবং ভারতের একজন মন্ত্রী বিমান বন্দরে একজন ইস্কন ভক্তের সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি বললেন, “ইস্কন একটি বৃহৎ সংস্থা হয়েও কেন পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করছে না?” তখন সেই ভক্ত উত্তর দিল, “আমরা আমাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরীন পরিবেশ দূষণ রোধের চেষ্টা করছি। যদি আপনারা কখনো বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণ রোধ করতে সক্ষমও হন কিন্তু আপনাদের হৃদয়ে থাকা লোভ এবং কাম খুব দ্রুতই পৃথিবীর পরিবেশ পুনরায় দূষিত করে দেবে। কিন্তু শুদ্ধ হৃদয়ে শুদ্ধ কর্ম ব্যতীত দূষিত কর্মের কোনো স্থান নেই এবং যখন আমাদের হৃদয় পরিষ্কার হবে দৃঢ়ভাবে ভগবানের নাম জপের মাধ্যমে তখন সেই ব্যক্তি বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণে আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।”
একটি শুদ্ধ আভ্যন্তরীন পরিবেশের অর্থ হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান, যেটি হলো একটি তৃষ্ণার্থ বৃক্ষে জল সিঞ্চনের মতো। এটি সমস্ত সমস্যার সমাধানের পথ।
লেখক পরিচিতি : মুরারী গুপ্ত দাস, শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামীর একজন শিষ্য। তিনি এম.বি.বি.এস ডিগ্রিধারী এবং ইস্কন চৌপাটি মন্দিরে ভগবানের সেবায় রত ও ব্যাক টু গডহেড হিন্দি ও ইংরেজি এডিশনের প্রোডাকশন টিমে সেবায় রত এছাড়াও তিমি মুম্বাইয়ের বিভিন্ন কলেজ শিক্ষার্থীদের মাঝে কৃষ্ণভাবনামৃত শিক্ষা দান করে থাকেন।