বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯

পরম দয়াল শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু (শেষ পর্ব)

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ
পরম দয়াল শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু (শেষ পর্ব)

শ্রীনিত্যানন্দের তীর্থ ভ্রমণ

নিত্যানন্দ প্রভু তৈর্থিক সন্ন্যাসীর সঙ্গে প্রথমে বীরভূম জেলার বক্রেশর তীর্থে গমন করে সেখানে শিবকে দর্শন করেন। তারপর বৈদ্যনাথ তীর্থে একাকী গমন করেন। প্রভু নিত্যানন্দ বক্রেশ্বরের পরে সমস্ত তীর্থ একাকীই ভ্রমণ করেন। বৈদ্যনাথ তীর্থ হয়ে গয়া তীর্থে গমন করেন। তারপর কাশীতে গমন করে গঙ্গা দর্শন পূর্বক স্নান-পানাদি করে অতি সুখী হলেন। কাশী দর্শন করে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু প্রয়াগে গমন করে মাঘ মাসে প্রাতঃস্নান পূর্বক পূর্বজন্ম স্থান মথুরায় গমন করেন। তথায় স্নানাদি করে ব্রজের দ্বাদশবন ভ্রমণ করেন। অতঃপর মদন গোপলদেব দর্শন করে হস্তিনাপুর গিয়ে শ্রীবলরামের স্মৃতি চিহ্ন দর্শন ও প্রণাম করেন তথা হতে দ্বারকা, সিদ্ধপুর, মৎস্যতীর্থ, শিবকাঞ্চী, বিষ্ণুকাঞ্চী, পৃথোদক, বিন্দু সরোবর, প্রভাস, সুদর্শন তীর্থ, ত্রিতকূপ, বিশালা, ব্রহ্মতীর্থ, চক্রতীর্থ, প্রাচী, সরস্বতী, নৈমিষারণ্য, অযোধ্যা, শৃঙ্গবেরপুর, সরযু, কৌশিক, গোমতী, গণ্ডকী, শোন, মহেন্দ্রগিরি, হরিদ্বার, পম্পা, ভীমা, গোদাবরী, বেণ¦া, বিপাসা, মাদুরা, শ্রীশেল, বেঙ্কটনাথ, কামকোষ্ঠীপুর, কাঞ্চী, কাবেরী, শ্রীরঙ্গম, হরিক্ষেত্র, ঋষভ পর্বত, মাদুরা কৃতমালা, তাম্রপর্ণী, উত্তর যমুনা, মলয়পর্বতে অগ্রস্ত্যাশ্রম, বদরিকাশ্রম, ব্যাসাশ্রম, কন্যাকুমারী, অনন্তপুর, পঞ্চঅপ্সরা সরোবর, গোকর্ণ, কেরল, ত্রিগর্ত, নিবিন্ধ্যা, পয়োষ্ণী, তাপ্তী, রেবা, মহিষ্মতী, মল্লতীর্থ, সূর্পারকাদি তীর্থ দর্শন করে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু পশ্চিম ভারতে গমন করে মাধবেন্দ্র পুরীর দর্শন লাভ করেন।

কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর, তাঁদের ভাবাবেশের একটু বিরাম হলে উভয়েরই নিজ নিজ গন্তব্য স্থানের কথা স্মৃতি পথে উদিত হলো। তখন শ্রীনিত্যাননন্দ প্রভু সেতুবন্ধ দর্শন করে ধনুতীর্থ, রামেশ্বর, বিজয়নগর, মায়াপুরী, অবন্তী, গোদাবরী, সিংহাচলম, তিরুমল, কুর্মক্ষেত্র দর্শন করে শ্রীনীলাচল ক্ষেত্রে জগন্নাথদেবকে দর্শন পূর্বক গঙ্গাসাগর সঙ্গমে আসেন। তথা হতে পুনরায় মথুরায় এসে উপস্থিত হন। এভাবে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বিভিন্ন তীর্থ দর্শন করে শ্রীবৃন্দাবনে এসে কোনও অভাব পূরণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

শ্রীশ্রীগৌর নিতাই এর মহামিলন

রামান্দনাচার্য ভবনে শ্রীশ্রীগৌর নিতাই এর মহামিলনে এক অপূর্ব মাধুর্য মণ্ডিত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁদের এই মধুর মিলনের মধ্য দিয়ে শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের ভক্তবাৎসল্য রসটি গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যে পর্যন্ত মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ নবদ্বীপে আত্মপ্রকাশ করেননি, সে পর্যন্ত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু নবদ্বীপে আসেননি ভারতের বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ করে তিনি শ্রীবৃন্দাবন ধামে এসে অবস্থান করেছেন। এসময়ে নবদ্বীপে শ্রীগৌরচন্দ্র আত্মপ্রকাশ করলেন। তার আত্মপ্রকাশে ভক্তগণের হৃদয়-সিন্ধু উচ্ছ্বাসময়ী তরঙ্গমালায় আলোড়িত হলো।

নামসঙ্কীর্তনের তরঙ্গধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল। সেই শ্রীকৃষ্ণনাম-সঙ্কীর্তনের প্রতিধ্বনি অতি শীঘ্রই শ্রীবৃন্দাবনে এসে গেল। নিত্যানন্দ প্রভুর হৃদয় সেই তরঙ্গে বিকম্পিত হলো তাঁর ভাবান্তর দেখা দিল, অচিরেই নিত্যানন্দ প্রভু বুঝতে পারলেন শ্রীধাম নবদ্বীপে তাঁর প্রাণ শ্রীগৌরচন্দ্রের উদয় হয়েছেÑশুধু তাই নয়, তাঁর মহাপ্রকাশ ঘটেছে।

তখন তিনি কালবিলম্ব না করে নবদ্বীপের অভিমুখে যাত্রা করলেন। মহাপ্রভু তখন শ্রীবাস এবং হরিদাস ঠাকুরকে সেই মহাপুরুষকে খুঁজে আনার জন্য পাঠালেন। শ্রীবাস এবং হরিদাস ঠাকুর নবদ্বীপের বিভিন্ন স্থানে তিন প্রহর যাবৎ খুঁজলেন কিন্তু কোথাও তাঁর দেখা না পেয়ে মহাপ্রভুর কাছে এসে জানালেন।

মহাপ্রভু বললেন, তোমরা যে সেই মহাপুরুষের দেখা পাও নাই তা আশ্চর্য নহে। মহাপ্রভু তখন সকলকে বললেন, তোমরা সঙ্গে এসো, আমরা সকলেই তাঁকে স্বচক্ষে দর্শন করব। একথা বলে সকলেকে নিয়ে সর্বজ্ঞ মহাপ্রভু শ্রীগৌরচন্দ্র পরম ভাগবত নন্দনাচার্যের গৃহে গমন করে তথায় শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে নয়ন গোচর করলেন।

জগাই-মাধাই উদ্ধার

নিত্যানন্দ প্রভুর লীলায় জগাই-মাধাই উদ্ধার এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং এটি তাঁর অসাধারণ কারুণ্য শক্তির প্রকাশ। পতিত উদ্ধারকার্যে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর দিব্য করুণা শক্তি কতখানি ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশালী হয়ে নিত্য প্রেমানন্দ দানে সকলকে ধন্য করেছেন, এই মহা পাতকী উদ্ধার লীলাই তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। হরিনাম সংকীর্তন শ্রবণ করে মাতাল জগাই-মাধাই “ধর ধর” বলে তীব্রবেগে নিত্যানন্দ ও হরিদাসের দিকে ধাবিত হয়। একপর্যায়ে মাধাই কলসির ভাঙ্গা অংশ দিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর কপালে সজোরে আঘাত করে।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

আবারও আঘাত করতে চাইলে জগাই তাকে বাঁধা দেয়। অন্যদিকে মহাপ্রভু খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ  উপস্থিত হয়ে মাধাইকে সুদর্শন চক্রের দ্বারা বধ করতে উদ্বত হলে নিত্যানন্দ প্রভু তার প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। তখন মহাপ্রভু বললেন, আমি জগাইকে ক্ষমা করলেও  মাধাইকে কখনোও ক্ষমা করব না। যদি নিতাই তাকে ক্ষমা করে তবেই সে উদ্ধার পাবে। একথা শুনে নিত্যানন্দ প্রভু শুধুমাত্র ক্ষমা নয় বরং নিজের সঞ্চিত সকল পূর্ণও প্রদান করলেন। আর এভাবে জগাই-মাধাই উদ্ধার হন।

চোর-দস্যু ও সুবর্ণ বণিককূল উদ্ধার

নবদ্বীপে এক মহাদস্যু ব্রাহ্মণ কুমার নিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীঅঙ্গে  বহু মূল্যবান অলঙ্কার দেখে দস্যুগণ সঙ্গে উহা অপহরণ করার জন্য যুক্তি করল। ধনাদি হরণের কামনায় নানাছলে সেই দস্যুগণ শ্রীনিত্যানন্দের সঙ্গে ঘুরতে লাগল। অন্তর্যামী নিত্যানন্দ প্রভু দস্যুর অন্তর জেনে নির্জনে হিরণ্য পণ্ডিত নামক এক অকিঞ্চন সুব্রাহ্মণের গৃহে অবস্থান করতে লাগলেন। একদিন সেই দস্যু ব্রাহ্মণ রাত্রিকালে দস্যুগণ সাথে একত্রিত হয়ে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু নিদ্রা গিয়েছেন কিনা দেখার জন্য একজন গুপ্তচর পাঠালেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তখন ভোজন করছেন এবং তাঁর পার্ষদগণ চারিদিকে মহানন্দে শ্রীহরি কীর্তনে মাতোয়ারা হয়ে হাস্য, রোদন, হুঙ্কার, গর্জন প্রভৃতি ভাব প্রকাশ করছেন। এই প্রকার সংবাদ পেয়ে দস্যুগণ তাঁদের ভোজনান্তে বিশ্রামের অপেক্ষায় এমন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হলেন যে, প্রভাত কালে কাক রবে তাদের নিদ্রা ভঙ্গ হলে তারা পলায়ন করল। আর একদিন দস্যুগণ উত্তমরূপে শ্রীচণ্ডীদেবীর পূজা করে গভীর রজনীতে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর বিশ্রামগৃহের নিকটে এসে প্রবল শক্তি সম্পন্ন বৃহৎ মূর্তি বিশিষ্ট বহু অস্ত্রধারী সৈন্যগণকে শ্রীহরিনাম সংকীর্তনরত অবস্থায় শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর প্রহরায় নিরত দেখতে পেল। সেদিনও তারা কোন উপায় না দেখে পলায়ন করল।

আবার বেশ কিছুদিন পরে গভীর রাত্রে হানা দিতে এসে দস্যুগণ অন্ধ হয়ে গেল, তাদের মন-বুদ্ধি হত হয়ে গেল, তারা কর্তব্যাকর্তব্য সম্বন্ধে বিচার হীন হয়ে জীবন্মৃতের ন্যায় হয়ে পড়ল। কেহ তখন গড়খাইয়ে মধ্যে পড়তে লাগল, কেহ উচ্ছিষ্ট গর্তের মধ্যে পড়ল, কারো গায়ে কাঁটা ফুটে গেল, কারো হাত-পাত ভেঙ্গে গেল, কেহ পোকা-মাকরের দংশনে যন্ত্রণা পেতে লাগল, কারো প্রবল জ্বর হলো।

এভাবে দস্যুগণের যৎপরোনাস্তি মহাবিপদ উপস্থিত হলে কিছু সময় পরে দস্যু সেনাপতি যে ব্রাহ্মণ কুমার অকস্মাৎ তার চেতনার পরিবর্তন হলো। তার মনে এই ভাব জাগ্রত হলো যে, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু সাধারণ মানব নহেন, পরন্তু ঈশ্বর। দস্যু ব্রাহ্মণ কুমার নিজের অপরাধ স্মরণ করে, মনে মনে স্বীয় দুষ্কর্মের জন্য অনুতাপ করে শ্রীনিত্যানন্দের চরণ স্মরণ করে একান্তভাবে তাঁর শরণ নিলেন।

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, ফেব্রুয়ারি ২০২0 সংখ্যা

সম্পর্কিত পোস্ট

About csbtg