এই পোস্টটি 497 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণকেন্দ্রিক একটি বৈদিক গ্রাম
যেখানে জীবন ধারা হল অতি প্রাকৃতিক, যা কোনো বৈদিক সাহিত্য
অধ্যয়ন করলে, সেখানে বর্ণিত আদর্শের সঙ্গে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাবে।
অধিকর্তা দাস, রাধাকৃষ্ণ দাস, আন্দ্রাস কান, জিলভিয়া রিব এর তথ্য অবলম্বনে
ব্রজধাম হল বৃন্দাবনের আরেক নাম, যেটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য আলয় ও লীলাভূমি। ভারতে অবস্থিত সেই তীর্থভূমির ধারণা বহির্বিশ্বে বিস্তৃত করার জন্য এই নব ব্রজধাম কমিউনিটি প্রতিষ্ঠিত। বৃন্দাবনের মত ভগবান কৃষ্ণ নব ব্রজধামেও বিরাজ করে কেননা এখানে অহৈতুকী ভক্তির নিদর্শন রয়েছে।
হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে প্রায় দু’ঘণ্টার ভ্রমণ দূরত্বে এটি অবস্থিত। শ্রীল প্রভুপাদের বাসনা, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বৈদিক কমিউনিটি গড়ে তোলার লক্ষ্যেই নব ব্রজধামের প্রকাশ ঘটে। শ্রীমৎ শিবরাম স্বামীর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে এখানকার ভক্তবৃন্দ বৃন্দাবনের সেই ভাব বা প্রকৃতিকে এ নব ব্রজধামে ধারণ করতে সফল হয়েছে। ৪৫০ একর জুড়ে কৃষি ভূমিতে শত শত ফল বৃক্ষ এবং অনেক একর জুড়ে আঙ্গুর বৃক্ষ রয়েছে। ১৯৯৩ সালে এটি ক্রয় করা হয়, যেখানে বর্তমানে শত শত ভক্তের নিবাসস্থলী।
নব ব্রজধাম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম হয়ে উঠাই এর লক্ষ্য, কিন্তু এই অবস্থায়ও কিছু অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। এই অর্থ সংগ্রহ করা হয় হাঙ্গেরীতে প্রচলিত একটি বিশেষ আইনের মাধ্যমে, যেখানে জনগণরা তাদের ট্যাক্সের এক ভাগ দান করে তাদের পছন্দের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে। এই দানটি প্রদান করা হয় শুধুমাত্র বছরের প্রথম দুই মাসে। ঐ সময় অনেক ভক্ত এই বৈদিক ফার্মের জন্য অর্থ সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন। হাঙ্গেরীতে হরেকৃষ্ণ আন্দোলন এত জনপ্রিয় যে, এই অর্থ সংগ্রহ খুব সহজেই হয়।
শ্রীল প্রভুপাদের দূরদর্শিতা
জীবনের সর্বোত্তম পথে সমাজকে উত্তোলনের জন্য শ্রীল প্রভুপাদ অনেক পরিকল্পনা ছিল। তিনি বলেছিলেন, “গ্রন্থ হল হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের ভিত্তি এবং এজন্যে তিনি অনেক প্রাচীন ভারতীয় পবিত্র গ্রন্থ অনুবাদের জন্য অনেক সময় ব্যয় করেছিলেন। এই গ্রন্থসমূহ শুধু সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শন ও যুক্তি প্রদান করে না বরং এগুলোতে রয়েছে আমাদের বর্তমান যন্ত্রনির্ভর সমাজের চেয়েও উন্নত ভিন্ন এক জীবন পথের নকশা যা মানুষের জন্য অধিক উপকারী ।”
১৯৭৭ সালে তাঁর অপ্রকটের তিন মাস পূর্বে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর শিষ্যদের আগ্রহভরে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, মানুষ কীভাবে ভূমির ওপর সরল ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবন-যাপন করতে পারে, যেখানে কোনো কৃত্রিম সুযোগ-সুবিধার ওপর নির্ভরশীলতা থাকবে না। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও শ্রীল প্রভুপাদ এটি কীভাবে করা যায় তা দেখানোর জন্য আমেরিকার গীতা নগরী ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন। এই ‘গীতা নগরী’ হল গ্রামীণ পেনিসিলভানিয়াতে অবস্থিত একটি হরেকৃষ্ণ কমিউনিটি। দুঃখজনকভাবে তাঁর স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় সেই ভ্রমণটি হয়নি।
যদিও প্রভুপাদ সরল জীবন প্রসঙ্গে প্রচার করেছিলেন, তার মানে এই নয় যে তিনি যন্ত্রের শত্রু ছিলেন। এ সমস্ত যন্ত্র কৃষ্ণভাবনা প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার উদাহরণের সাহায্যে, প্রভুপাদ উচ্চ-প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন সরল জীবন-যাপন উন্নীত করতে। কেন? কারণ এ জিনিসগুলো কৃষ্ণভাবনা প্রচারের গতি বৃদ্ধি করবে এবং যার লক্ষ্য হল যন্ত্রের ওপর নয়, ভগবানের ওপর নির্ভরশীল হওয়া।
আজকাল অধিকাংশ লোকই সরল জীবন যাপনে ফিরে যেতে আপত্তি করে। তারা বলে আধুনিক জীবনধারা জীবনকে অধিক সহজতর, উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তারা বলে যে, পেছনে আবার ভূমির কাছাকাছি ফিরে যাওয়া মানে হল কম সভ্য ও আলোকিত যুগে ফিরে যাওয়া।
কেউ হয়তো একটির চেয়ে আরেকটির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করতে পারে, কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হল জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি, যেটি বর্তমান যুগের জন্যও সিদ্ধ যদি কৃত্রিমতার থেকে মনকে বিচ্ছিন্ন রেখে সরল জীবন-যাপন ঐ সমস্যাগুলোর সমাধান করি তবে নিশ্চিতভাবে সেটি অবশ্যই সর্বোত্তম হবে। যদি আমাদের অনেক সময় থাকে তবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে ভাবার জন্য ও তাঁর প্রতি সেবা নিবেদনের জন্য আমাদের জীবনকে পরিচালিত করি তাহলে আমরা অধিকতর সুখী হবো।
আমাদের প্রধান সমস্যা হল পশ্চিমা লোকেরা মনে করে তারা অধিক বুদ্ধিমান, কারণ তাদের অনেক অনেক যন্ত্র রয়েছে এবং শুধুমাত্র সহজ সরল মানুষরাই ভূমির সঙ্গে যাদের জীবনকে একাত্ম করে। এটি লজ্জাজনক যে, আধুনিক লোকদের ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী গ্রাম্য জীবনধারা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সেই গ্রাম্য পরিবেশ আজকালকার সমাজে খুব কমই বিদ্যমান, অথচ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বিশ্বকে প্রকৃতি নির্ভর করেছেন।
উন্নতির নামে তাঁর পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করা ও বিষয়গুলোকে অন্যভাবে ব্যবহার করা হয়তো সহজ জীবনের মোহ প্রদান করতে পারে, কিন্তু বর্তমান দিনের বাস্তবতায় সেটি খুব কমই আশা প্রদান করে। বস্তুত কেবলমাত্র অত্যন্ত দুর্বিষহ সমস্যাসমূহ সন্ত্রাস, পারমাণবিক যুদ্ধ, অ্যানথ্রাক্স এবং আরো কত কিছু এই যান্ত্রিক সমাজে বিচরণ করতে পারে।
যদিও নব ব্রজধাম কমিউনিটির সবে মাত্র যাত্রা শুরু হল এবং যেতে হবে আরো অনেক দূর যার মাধ্যমে এটি হবে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি মডেল, শ্রীল প্রভুপাদের আদর্শ ‘সরল জীবন ও উচ্চ চিন্তা আধুনিক লোকেদের সমস্ত সমস্যার ব্যবহারিক সমাধানসূচক এই বৈদিক কমিউনিটিতে রয়েছে অনেক অনেক দৃষ্টান্ত ।
নব বৃন্দাবনের জীবনধারা ও পরিবেশ
যদিও হাঙ্গেরীর সবার জন্য পরিচিত “ভ্যালি অব কৃষ্ণ” হিসেবে, কিন্তু যারা এখানে বাস করেন তাদের জন্য এ স্থানটি “নব বৃন্দাবন” হিসেবে পরিচিত। ভিতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে দুটি পাথরের শ্বেত হস্তি আপনাকে অভিবাদন জানাবে।
প্রবেশের পর আপনি দেখবেন সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন জগৎ। যেহেতু কৃষ্ণভ্যালি বৃন্দাবনের প্রতিবিম্বরূপে গড়ে তোলা হয়েছে, এখানে অবস্থিত লাল পারগোলা (বীথি কুঞ্জ দ্বারা এক প্রকার আচ্ছাদন বিশেষ) বৃন্দাবনের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০০ হেক্টর জমির ওপর এটি অবস্থিত, এই ভ্যালি বা উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় যমুনা নদী। ওখানকার বাসিন্দা নারী ও পুরুষ উভয়ই ভিন্ন ভিন্ন দিনে স্নান করে থাকে। মাঝে মাঝে রঙ বেরঙের ময়ূরদের এদিক সেদিক উড়ে বেড়াতে ও দৌড়াতে দেখা যায়। এদের সঙ্গে কিছু বন্য প্রাণীরাও হেঁটে বেড়ায়। বিস্তীর্ণ তৃণভূমিগুলো গাভী ও ষাঁড়দের বিচরণক্ষেত্র। অনেক পরিদর্শক প্রবেশ দ্বারে গাড়ি রেখেই এ সমস্ত সুন্দর দৃশ্যপট দেখতে দেখতে মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশে দেখা যাবে বিশাল বোটানিক্যাল বাগান। ভ্যালিটির চারপাশ পাহাড়ে ঘেড়া। আর ঝরণাগুলোর তীরে বিভিন্ন পাখিদের নিবাস। এ পর্যন্ত সেখানে ১১১ প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও ২,৫০,০০০টি বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট চারাগাছ রয়েছে। আরো যেতে যেতে একটি হলুদ রঙের স্কুল দেখা যাবে যেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। যেহেতু এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা স্বল্প, তাই ছেলেমেয়ে একত্রেই স্কুলে শিক্ষা লাভ করে। শুধুমাত্র শারীরিক শিক্ষার ক্লাসটি আলাদাভাবে নেওয়া হয়। তারা এখানে যোগ অনুশীলন করে, মার্শাল আর্ট শেখে ইত্যাদি ৷
এরপরে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রয়েছে আরেকটি সুন্দর দালান। দালানটি দেখে দর্শনার্থীদের মনে হতে পারে এটিই বোধহয় কৃষ্ণমন্দির। আসলে এটি গাভীদের আলয়। গাভীদের জন্য রয়েছে একটি পাঁচ তাঁরা হোটেল। এটি ইউরোপের সেরা গোলাঘর, এখানে ১৮টি গরু ও ১৯টি ষাঁড় রয়েছে। প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রানুসারে গরু যদি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে তবে পরবর্তী জন্মে সেই আত্মাটি মনুষ্যদেহ লাভ করবে। তাই গাভীদেরকে এখানে মানুষের মতোই যত্ন করা হয়। শাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, মানুষ যদি কোনো পশুকে হত্যা করে, তবে সে পরবর্তী জন্মে পশু হয়ে জন্ম নেবে এবং সেই পশুই মানুষ হয়ে তাকে হত্যা করবে। অথবা, পশু হত্যা করার জন্য এই জীবনেই সে নির্দয়ভাবে কোনো যুদ্ধে নিহত হতে পারে। শুধু বৈদিক শাস্ত্র কেন, এই বিষয়ে মহাত্মা গান্ধী, লিও টলস্টয়, আলবার্ট আইনস্টাইন দাবি তুলেছিলেন, পৃথিবীতে যুদ্ধ ততদিন বন্ধ হবে না যতদিন মানুষ মাংসাহার চালিয়ে যাবে। প্রাচীন বৈদিক প্রথা অনুসারে পশু হত্যাকারী মানুষ হত্যাকারীর মতই অপরাধী। তখনকার রাজারা এজন্যে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শুধু মানুষ নয় পশুদের জীবন রক্ষার জন্যও বাধিত থাকত। আজকাল অনেক মানুষই বিশ্বজনীন ভালোবাসা, ছন্দের কথা বলে বেড়ায় কিন্তু তারাই নিরীহ জীবদের নির্দয়ভাবে হত্যা করে খেয়ে থাকে। কৃষ্ণভ্যালির গাভীরা কোনো বাছুর ছাড়াই ৫-৭ বছর ধরে অবিচ্ছিন্নভাবে দুধ দিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু যারা জানেন যে, তাদেরকে মেরে ফেলা হবে তাদের কাছ থেকে সম্ভবত এ ধরনের দুধ সরবরাহ আশা করা উচিত নয়। এখানে গাভীরা যদি দুধ সরবরাহ নাও করে তাও কোনো সমস্যা নেই, কেননা তাদের গোবর বায়োগ্যাস ও কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয় ৷
অপরদিকে ষাঁড়রা হল কঠোর পরিশ্রমী প্রাণী। তারা নিজেদের পেশীশক্তির অনুশীলনে আনন্দ অনুভব করে।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পদ্ধতির জন্য প্রভুপাদ বৈদিক ভারতে প্রচলিত ট্যাক্স পদ্ধতির ব্যাপারটি সুপারিশ করেছিলেন। তখন শুধুমাত্র এক ধরনের ট্যাক্স বা কর প্রথার প্রচলন ছিল : প্রতিটি রাষ্ট্রে তাদের খাদ্য উৎপাদনের লাভের ওপর ভিত্তি করে ২৫% কর প্রথা চালু ছিল। যখন কর খুব একটি বেশি নয় তখন জনগণ রাষ্ট্রকে কর প্রদান করতে দ্বিধান্বিত হয় না। এভাবে তখন সেই রাষ্ট্র সমৃদ্ধশালী হয়। প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রে “অর্থ শাস্ত্র” নামে একটি বিভাগ রয়েছে, যেখানে শাসকদের জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে কীভাবে সর্বস্তরে সমাজের সমৃদ্ধি আনয়ন করা বা বজায় রাখা যায়, যা বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতি থেকে ভিন্ন।
বৈদিক আদর্শ অনুসারে কৃষ্ণভ্যালির সমস্ত বাসিন্দা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজেরাই উৎপাদন করে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করে। যদি পৃথিবীতে হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় কিংবা অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয় তবুও নব বৃন্দাবনের সুখী জীবন যাপনে কোনো পরিবর্তন আসবে না। এখানের বাসিন্দারা দুগ্ধজাতীয় পণ্য, খাদ্য শস্য, গম, যব, বাজরা (buckwheat), ভুট্টা ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে। তাঁরা সূর্যমুখী, শন, মিষ্টিকুমড়ার বীজ তৈল, আঙ্গুর বীজ তৈল থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে। অপরদিকে অনেক ধরনের শিমসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করেন। এখানে প্রায় ৩০-৪০ ধরনের সবজি ও ২০ রকমের ফল উৎপাদিত হয়।
এখানকার কমিউনিটির সমস্ত সদস্য তাদের নিজেদের পোশাক ও পাদুকা নিজেরাই তৈরি করে। এখানকার গৃহগুলো আধুনিক জীবনধারা থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম। কমিউনিটির কারোরই কোনো টেলিভিশন, রেফ্রিজেরেটর, এয়ার কন্ডিশনার এবং ওয়াশিং মেশিন নেই। পরিবেশ দূষক রাসায়নিক দ্রব্য, ডিটারজেন্ট নিষিদ্ধ। ব্যতিক্রম হল বিগ্রহের জন্য ব্যবহৃত ধূপকাঠি আনা হয় ভারত থেকে।
এখানে ভক্তরা নিজেরাই বায়োগ্যাস উৎপাদন করে যেটি গোবর থেকে তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে কমিউনিটির সদস্যদের রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে এটি সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সৌরশক্তি থেকে। মূলত এ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় অফিসে। এই উৎপাদিত বিদ্যুৎ ডেক্সটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফ্যাক্স মেশিন ইত্যাদি চালানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
বাসিন্দাদের সবার জীবন পরিচালিত হয় ভগবৎ কেন্দ্রিক, কেননা প্রতিটি জীবই ভগবানের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের সমস্ত কর্মের একটাই উদ্দেশ্য ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করা। সবাই সরল জীবন ও উচ্চ চিন্তা এ আদর্শের ওপর জীবন পরিচালিত করে। ভবিষ্যতের জন্য কোনো কিছু সংরক্ষণের ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন নন। তারা জানেন বর্তমানে সম্পাদিত যথাযথ কর্মই সুভবিষ্যৎ গঠন করে এবং মানব প্রজাতির প্রধান শত্রু হল-আভ্যন্তরীণ স্বার্থপরতা ও আলস্যতা। এখানে প্রত্যেকেই এ জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ যে, কোনো কিছুই আমার নয়, সবকিছুই ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এবং অন্যদের সেবার মাধ্যমে ভগবান তুষ্ট হন। এই হল কৃষ্ণভাবনার সার। এখানের প্রধান বিগ্রহ শ্রীশ্রী রাধা শ্যামসুন্দর দেখতে অপরূপ। বিগ্রহই এই কমিউনিটির সমস্ত কার্যাবলীর কেন্দ্রস্বরূপ। সবকিছুই তাঁদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য সম্পাদিত হয় ।
এখানে সবাই সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে উঠে যায়। এ সময় পুরো মন্দিরটি বিদ্যুৎ নয় তৈলবাতির আলোকে আলোকিত হয়ে যায়। এই ব্যাপারটি অতি প্রাকৃতিক। ভোর চারটা পনের মিনিটে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রথম আরতি নিবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আরতি নিবেদন করা হয় সাতটা পনের মিনিটে। প্রথম আরতির পরপরই গভীর মনোযোগ সহকারে সকলে ভগবানের পবিত্র নাম হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে থাকে।
এখানে প্রতি গ্রীষ্মে কিছু উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঐ সময় ৬-৭ হাজার মানুষ এই কৃষ্ণভ্যালি ও উৎসবগুলো উপভোগের জন্য জড়ো হয়। এখানে দর্শনার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে কয়েকটি গেস্ট হাউস, যেখানে উন্নত সুযোগ সুবিধা রয়েছে। প্রতি বছর নব বৃন্দাবন দর্শনের জন্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার দর্শনার্থী ভ্রমণ করে থাকে। এ পর্যন্ত ১,৫০,০০০ দর্শনার্থী এখানে ভ্রমণ করেছে।
প্রাকৃতিক জীবন
বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন এখানে কোনো সমস্যা নয়। যদিও কিছু সৌর প্যানেল রয়েছে যেগুলো কম্পিউটারসহ আরো বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই এগুলো কৃষ্ণভাবনা প্রচার কার্যে ব্যবহৃত হয়।
এখানকার জীবন দেখে মনে হয় বিদ্যুৎ ছাড়াই অনেক শান্তিপূর্ণ। রান্না এবং উষ্ণতার জন্য ভক্তরা নিজেদের ভূমির কাঠ ব্যবহার করে। শুকনো গোবর এখানে বিখ্যাত জ্বালানি গ্যাস উৎপাদনের জন্য যা বিগ্রহের রান্নাঘরে ব্যবহৃত হয়। মন্দিরের বিগ্রহের বেদী এবং গৃহগুলোতে উষ্ণতার জন্য ব্যবহার করা হয় একপ্রকার বিশেষ চুল্লী। এমনকি স্নান করার জল গরম করা হয় জ্বালানী কাঠের সহায়তায়। কিছু জল আসে স্থানীয় গ্রাম থেকে, কিন্তু বিশ বা তার বেশি গৃহগুলোতে রয়েছে তাদের নিজেদের হস্তচালিত কূপ। কাঠের চুলা থেকে গরম পানি দিয়ে হাত দিয়েই কাপড় চোপড় ধোয়া হয়। (এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যে প্রচলিত কোনো ওয়াশিং মেশিন ব্যবহৃত হয় না)
প্রাকৃতিক জীবনধারা কৃত্রিম জীবনধারার চেয়েও অনেক কার্যাবলি রয়েছে। এখানে প্রতিটি দিনই এক একটি উৎসব। জন্মাষ্টমীর মতো বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে নৃত্য-কীর্তন, বিগ্রহ পূজা, মনোরম শাস্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রদান, নাটক, বিবাহ, আরো বিনোদনমূলক অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে জীবন চিন্ময় জগতের মতো প্রতিভাত হয় ৷
শ্রীল প্রভুপাদ ব্রিটিশ উইলিয়াম কাউপারের একটি উদ্ধৃতি দিতেন। “ভগবান গ্রাম তৈরি করেছে, আর মানুষ তৈরি করেছে শহর।” শহরের জীবন মানে অর্থনৈতিক উন্নতি ও কৃত্রিম প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা। অর্থ আয়ের মাধ্যমে কঠোর পরিশ্রম করে এ সমস্ত কৃত্রিম বিষয় কিনতে হলে প্রয়োজন রজোগুণ। অপরদিকে গ্রামীণ জীবন হল সত্ত্বগুণের। যেখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতা, ঝরণা ধারা, ভগবানের সৃষ্টির শান্তিপূর্ণ আবহ।
এক্ষেত্রে ভক্তরা শহরগুলোতে গ্রন্থ বিতরণ ও লোকেদেরকে কৃষ্ণভাবনাময় প্রচার করে। অধিকাংশ বিবাহিত ভক্তদের জন্য এখানে জীবন হল সহজ, স্বাস্থ্যসম্মত, অধিক শান্তিপূর্ণ, সন্তানদের লালন পালনে অনেক উপকারী এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতায় প্রদত্ত জ্ঞানাদর্শ অনুসারে সমাজ কাঠামোর জন্য উপযোগী। শ্রীমদ্ভগবদগীতা অনুসারে বর্ণাশ্রম পদ্ধতিতে চার শ্রেণির লোকের ওপর নির্ভর করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ গড়ে উঠে। যাদের একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা অত্যন্ত আবশ্যক এবং উপকারী। সেই সমাজের মস্তক হলেন ব্রাহ্মণ যারা সমাজকে তত্ত্বাবধান করেন। হস্তদ্বয় হল ক্ষত্রিয় যারা প্রতিরক্ষা করেন, পাকস্থলী হল বৈশ্য যারা গাভীদের সুরক্ষা করেন এবং পাদ হল শূদ্রগণ, যারা শ্রম ও অন্যান্য সেবা করতে থাকে। আধুনিক যুগে এ পদ্ধতিটি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। জন্মানুসারে না হয়ে কেউ চাইলে নিজেকে নির্দিষ্ট পন্থায় উচ্চতর অবস্থানে উপনিত করতে পারে। কোনো শ্রেণি অন্যদের চেয়ে উত্তম নয়, কারণ প্রতিটি শ্রেণিরই আবশ্যকতা রয়েছে। গাভী প্রতিরক্ষা ছাড়া জীবন অচল, তা না হলে খামার করার ক্ষেত্রে ট্রাক্টর ব্যবহারের প্রয়োজন. যার জন্য প্রয়োজন অর্থ এবং এর মাধ্যমে সমগ্র খামার প্রক্রিয়াটি ধ্বংস হয়ে যায়।
নব ব্রজধামে অনেক শিশু কিশোর রয়েছে। তাদের জন্য এখানে গড়ে তোলা হয়েছে সুদৃশ্য দালান, যেখানে তারা কীভাবে আরো বেশি ভগবানের সেবা করা যায় সেই শিক্ষা গ্রহণ করে। এ সমস্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জন্য পরিকল্পনা হল তারা যাতে নিজেদেরকে স্বাভাবিক মেধা ব্যবহারে যোগ্য হয়, সেটি মৃৎশিল্প, খামার, চিত্রাঙ্কন, শিক্ষকতা, অন্যদের সুরক্ষা অথবা রেস্তোরা পরিচালনা ইত্যাদি যেকোনো ক্ষেত্রে হতে পারে ।
যেহেতু আমরা বর্তমানে এমন এক কৃত্রিম পরিবেশে বাস করছি এবং কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়েছি যে, অন্তত আমেরিকাতে অনেক শিশুর জন্যই এখন ঘুমের ঔষধ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যা তাদেরকে শান্ত রাখতে পারে। নব ব্রজধামে শিশুদের জন্য রয়েছে প্রচুর খেলাধুলার স্থান এবং প্রচুর গৃহ উৎপাদিত খাবার যা তাদের দেহ বেড়ে উঠার জন্য পুষ্টি প্রদান করে।
হাঙ্গেরীতে যদিও অনেক ইকো-গ্রাম রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সফল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কৃষ্ণভ্যালি। বিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেছে, পৃথিবীতে যে সঙ্কটকাল চলছে সেটি আরো শক্তিশালী হবে যদি মানুষ তাদের বর্তমান জীবনধারা পরিবর্তন না করে। কৃষ্ণভ্যালি বা নব বৃন্দাবনের রহস্য আসলে বাস্তব প্রেক্ষাপটে এটি কোনো রহস্যই নয় এখানে যা কিছু রয়েছে তা কোনো বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন করেও জানা যাবে। যদি সাধারণ জনগণ এ সাহিত্যসমূহে বর্ণিত আদর্শসমূহ অধ্যয়ন করে তবে তারা জড় জগতে প্রদত্ত সমস্ত সুবিধা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারবে। তাই তো আধুনিক বিজ্ঞান বিবৃতি দিচ্ছে : যদি আমরা ভগবান প্রদত্ত অমূল্য সম্পদসমূহ দূষিত ও নষ্ট করি, তবে এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সম্পদগুলো হারিয়ে যাবে।
কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকরা এখানে আসেন তাদের লেখাপড়া, বিভিন্ন শিক্ষা সম্বন্ধীয় গবেষণার জন্য। এই ভ্যালিটিকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অনেক প্রবন্ধ যা লোকেদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
এভাবে নব বৃন্দাবন একটি অত্যুজ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করা যায় এবং এভাবে তখন অন্তিমে নিত্য আলয় গোলক বৃন্দাবনে প্রত্যাগমনের পথ সুগম হয়।
জিলভিয়া রিব, একজন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন ইকো ভ্যালির বিভিন্ন ইকো-ওয়ার্কসপের ও প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রধান। তিনি একজন জীব বিজ্ঞানী।
রাধাকৃষ্ণ দাস, কৃষ্ণভ্যালির পরিচালক মণ্ডলীদের মধ্যে একজন সদস্য।
অধিকর্তা দাস, ১৯৭৪ সালে ইসকনে যোগ দেন। তিনি তাঁর সহধর্মিণী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে নর্থ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রভুপাদ ভিলেজে বাস করেন।
আন্দ্রাস কান, ইকো-ভ্যালির বৈজ্ঞানিক পরিচালক, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি হাঙ্গেরী অ্যাকাডেমি অব সাইন্সের ইকোলোজিক্যাল ইনস্টিটিউট এর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। তিনি এখানে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রসমূহ ব্যবস্থাপনা করেন।
ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জুলাই – সেপ্টেম্বর ২০১৪