বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯

দ্যুতক্রিয়া ও শকুনি সমাচার

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ | ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ | ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ
দ্যুতক্রিয়া ও শকুনি সমাচার

সমাজে যতগুলি খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভয়াবহ দিকটা অগত্যা ভারতের রাষ্ট্রশক্তি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন সেটি হল জুয়াখেলা, যার আধুনিক জনপ্রিয় নামটি দেওয়া হয়েছে “লটারি”। ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় তথ্য আবেদনই জানিয়ে এসেছেন, তাস-পাশা-লটারি ও সকল ধরনের জুয়া খেলা সারা পৃথিবীতে বৃহত্তর জনস্বার্থে একেবারে বর্জন করা উচিত। জয় শ্রীল প্রভুপাদ! আজ আপনার নিরলস প্রচেষ্টা, আপনার দুর্দমনীয় নির্ভীক দাবি এত বছর সমাজবিজ্ঞান সম্মত এবং বাস্তবিকই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সমস্যা হল এই যে, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।’ তাই লটারি তথা জুয়াখেলা সারা দেশে বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব সরকারিভাবে সুদৃঢ়ভাবে ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবে ও সম্প্রচার মন্ত্রী মহোদয় শ্রীপ্রমোদ মহাজন (১৯৯৮-১৯৯৯) ঘোষণা করেছেন, দেশজুড়ে সব রকমের সরকারি লটারি নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় সংসদে (পার্লামেন্টে) আইন বিধিবদ্ধ করবার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের সর্বজনশ্রদ্ধেয় জগদ্গুরু শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ব্যাপী জগৎ জুড়ে ঘুরে-ঘুরে এই পরে ভারতভূমির মতো এক বিশাল উপমহাদেশের শতকোটি মানুষের মঙ্গলবিধানার্থে অটল রাষ্ট্রশক্তিকে সমূলে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। এখন ইস্‌কনের সমর্থক, সমালোচক সকলে অবশ্যই স্বীকার করতে সম্মত হবেন যে, আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের সদস্য, ভক্ত, শিষ্য তথা সমস্ত অনুগামীদের যে বিধিবদ্ধ জীবনযাপন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, তা কতখানি আসুরিক শক্তির ফোঁসফোঁসানি আকাশে বাতাসে বেশ গরম হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। হুমকি দিয়েছে “অখিল ভারতীয় সরকারি লটারি ব্যাপারি মহাসংঘ”, আর কলকাতা শহরের বুকে জুয়ারিদলের পক্ষ থেকে “পশ্চিমবঙ্গ লটারি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন” মিছিল, বিক্ষোভ আর সমাবেশের ডাক দিয়েছে। ভাবখানা এই যেন জুয়াখেলা বন্ধের ধুয়ো তুললে তারাও একহাত দেখে নেবে আসুরিক প্রবৃত্তির লোকেরা চিরকাল যা করে এসেছে, তাই আর কী! এরা যেন ঠিক মহাভারতের যুগের সেই ছলচাতুরি আর শঠতায় পূর্ণ শকুনি মামারই মতো চোখ রাঙিয়ে আর ভয় দেখিয়ে বাজিমাৎ করতে চায়। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন একইসাথে পুত্রস্নেহান্ধও বটে। তাই জুয়া খেলার মাধ্যমে পঞ্চপাণ্ডবদের সর্বস্বান্ত হতে হয়েছিল!
সেই শোচনীয় পরিণতি এতদিনে সর্বভারতীয় বিস্মরণ ঘটে। তাই শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের মতো ভারতীয় তথা বিশ্বনন্দিত সন্ন্যাসীকে অবিশ্রান্তভাবে লেখনী চালাতে এবং দিকে-দিকে, দেশে-দেশে সোচ্চারভাবে শাস্ত্রসম্মত প্রবচন প্রদান করতে হয়েছিল। তাস-পাশা-জুয়াখেলা লটারি সব বর্জন করা চাই, তবেই হবে মানুষের প্রকৃত শুদ্ধ-সাত্ত্বিক মনোবৃত্তির নব জাগরণ তথা পুনরুজ্জীবন। মানুষ ফিরে পাবে সৎপথে রুজি-রোজগারের সুস্থ রুচি।
আশার কথা এই যে, কিছুদিন আগে সারা ভারতের সমস্ত মুখ্যমন্ত্রীরা এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লটারি ব্যবসায়ের জুয়ারি মনোভাবের অসামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রায় সকলেই একমত হয়েছিলেন যে, লটারি ব্যবসায়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের যতই রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে থাকুক, এরফলে আপামর জনসাধারণ কিন্তু সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং এরফলে দেশের অনেক পরিবার প্রতিদিন সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
শকুনিমামা যেভাবে পাণ্ডবদের সাথে জুয়াখেলার সময় ক্রমে ক্রমে চাহিদা বাড়িয়ে চলেছিল এবং অবশেষে দ্রৌপদীকে পর্যন্ত বাজি রাখতে ডাক দিয়েছিল, ঠিক তেমনই দেখা যাচ্ছে, এখন এদেশের লটারি ব্যবসায়ীরা এমন কি পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এক টাকা দামের লটারি টিকিটের দাম বাড়াতে বাড়াতে সম্প্রতি একশ টাকা পর্যন্ত দাম তুলে ফেলেছেন। এতে মধ্যবিত্ত মানুষদের সর্বনাশের পথ দেখানোই তো হচ্ছে, তাই নয় কি?
এই তো সেদিন ‘হোলি বাম্পার’ নামের আড়ালে এই ধরনের সর্বনাশা ‘লটারি’ নামে কী ভয়ানক জুয়াখেলা সারা দেশে হয়ে গেল বেশ লক্ষ্য করা গেছে। লটারি তথা সরকারি জুয়াখেলার টিকিট একশ টাকার পুরস্কার একেবারে কোটি টাকার অঙ্কে ঘোষণা করা হয়েছিল।
সরকারি বেসরকারি সমস্ত লটারি তথা জুয়াড়ি সংস্থা থেকেই দোল উৎসবে বিপুল জনগণের উল্লাস-আনন্দের মানসিকতার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল। ফল কি হয়েছিল! হোলির পরের ক’দিন শিয়ালদহ, শ্যামবাজার, বড়বাজার থেকে শুরু করে সমস্ত জনবহুল এলাকায় প্রত্যেকটি লটারি তথা জুয়া পরিবেশক এবং বিক্রেতাদের দোকানের সামনে ফুটপাত আর রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছিল হাজার হাজার একশ টাকা দামের ছেঁড়া লটারির টিকিট অর্থাৎ হাজার হাজার প্রবঞ্চিত মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের হাহাকার! ফুটপাত ঢাকা পড়ে গিয়েছিল একশ টাকার ব্যর্থতা আর নিরাশায় কোটি টাকার উন্মুক্ত প্রবঞ্চনায়! ভাবতে পারেন কী সর্বনাশা এই খেলা!
আশ্চর্যের কথা এই যে, এমনই এক গুরুতর সামাজিক সমস্যায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ ইন্ধন জোগানোর দুর্লভ দুঃসাহস দেখাতে আনন্দবাজার পত্রিকা পণ্ডিতম্মন্য সম্পাদক মশায় পহেলা এপ্রিল তাঁর নির্বোধ হাস্যকর সিদ্ধান্ত “সম্পাদকীয় নিবন্ধ”-এ দেশবাসীকে “এপ্রিল ফুল” বানাবার খুব একটা বাহাদুরী নিতে চেষ্টা করেছেন যাহোক!
এ যেন গোদের ওপরে বিষফোড়া! সম্পাদক মশায় গণিতশাস্ত্রের মাস্টার মশায়ের মতো ‘থিয়োরি অভ প্রোব্যাবিলিটি’ (সম্ভাব্যতার তত্ত্ব) আউড়েছেন আর জুয়াখেলা তথা লটারি বেআইনী ঘোষণা করা নাকি ‘পর্বতপ্রমাণ নির্বুদ্ধিতা’, এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। ঐ সম্পাদক মশায়টির মতো পাণ্ডিত্যাভিমানী আরও অনেক বুদ্ধিজীবী এদেশে অবশ্য আছে বৈ কী। তাঁরা ‘সম্ভাব্যতার তত্ত্ব’ উদ্ভাবক ল্যাপল্যাস, বার্নোলি প্রমুখ গণিতজ্ঞদের কৃতিত্ব জাহির তো করবেনই। তাঁদের পাণ্ডিত্য জনসমক্ষে তুলে ধরার এই তো সুবর্ণ সুযোগ।
কিন্তু মহাশয়গণ, অষ্টাদশ শতাব্দীর ঐ সমস্ত গণিতজ্ঞরা তো আর পাঁচ হাজার বছর আগেকার মহাভারতের কাহিনী অতশত জানেন না, তাই ‘সম্ভাব্যতার সূত্র’ অবলম্বনে লটারি খেলার কোনো দোষ দেখতে পান না। তাই বলি, মহাভারতের “দ্যুত পর্ব” ভালভাবে অনুধাবন করে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন হতে চেষ্টা করুন যে, জুয়াখেলায় হেরে গিয়েও ‘আবার জিতব’ মনোভাবটি পাণ্ডবদের কতখানি সর্বনাশ করেছিল।
এই বিষয়ে শ্রীনারদ মুনির একটি সৎ পরামর্শ ভারতীয় সংস্কৃতির আকরগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১০/৮) সন্নিবিষ্ট হয়েছে, জড় জাগতিক ভোগ-উপভোগের যত রকমের আকর্ষণ এই জগতে রয়েছে, সেই গুলির মধ্যে শারীরিক আভিজাত্য, অভিজাত বংশে জন্ম এবং বিপুল জ্ঞানসঞ্চয়ের সৌভাগ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেও, ধনৈশ্বর্যের প্রতি আকর্ষণের মোহ মানুষের বুদ্ধিকে নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। বিশেষত মানুষ যখন অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত হয় অথচ ধনসম্পদ আহরণের মরীচিকায় বৃথা রজোগুণাশ্রিত হতে চেষ্টা করে, তখন তার যাবতীয় সম্পদ মদ, স্ত্রীসম্ভোগ আর জুয়াখেলার নেশায় ঢেলে দিতে থাকে। সুতরাং জুয়া তথা লটারি খেলা বন্ধের প্রয়াস মোটেই অযৌক্তিক ধ্যানধারণা নয়। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় উপদেশে বলা হয়েছে, “মানুষ যে কারণে লটারির টিকিট কাটে, তাহাতে কিছুমাত্র অনৈতিকতা নাই, বরং সম্ভাব্যতার সুযোগ নেয়ার একটি স্বাভাবিক এবং যুক্তিসংগত ইচ্ছা আছে।”
সম্পাদক মশায় ভাগবতের ঋষিবাক্য ‘এদেশে অচল এবং অযৌক্তিক’ বলতে দ্বিধা না করতে পারেন, কিন্তু তাতে তাঁর যুক্তির সারবত্তা কিছুতেই প্রমাণিত হয় না।
লটারির টিকিট ছেপে, বিক্রি করে, বিজ্ঞাপন দিয়ে, দালালি করে যারা রোজগার করছে, তারা কোটি কোটি মানুষকে মরীচিকার পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং লটারি বন্ধ করে তাদেরও সৎপথে অর্থ-উপার্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা দরকার। তা না করে, কোনও সাংবাদিক যদি লটারি বা জুয়ার ব্যবসায়কে সমর্থন করে, তা হলে বুঝতে হবে যে, ঐ সংবাদপত্রটি লটারি তথা জুয়া খেলার বিজ্ঞাপন থেকে বেশ কিছু উপার্জন করে। তাই তার এত কান্নাকাটি।
আনন্দের বিষয় এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজে লটারি ব্যবসায়ে বহু মানুষকে এ যাবৎ বিভ্রান্ত করে থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনের সিদ্ধান্তের পরে সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং পশ্চিমবঙ্গ লটারি বন্ধ করতে উদ্যোগী হচ্ছেন। এই সঙ্গে ঘোড়দৌড়ের জুয়াখেলা এবং অন্য সব রকমের বাজি ধরার অভ্যাস সমাজ থেকে একেবারে তুলে দিতে হবে। তবেই বহু দিনের একটা সামাজিক সমস্যা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। জয় হোক শ্রীল প্রভুপাদের দীর্ঘকালের নিরলস কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের।


 

চৈতন্য সন্দেশ জানুয়ারি-২০২২ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

About csbtg