দেবী দূর্গাকে সন্তুষ্ট করার পন্থা

প্রকাশ: ৯ অক্টোবর ২০২১ | ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৯ অক্টোবর ২০২১ | ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 253 বার দেখা হয়েছে

দেবী দূর্গাকে সন্তুষ্ট করার পন্থা

আমরা সকলেই ‘দুগা’ দেবীর সঙ্গে পরিচিত; এই ‘দুর্গা’দেবীকে ভগবান নারায়ণের শক্তি বলে বৈদিক শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে; চণ্ডী, দেবী ভাগবতাদিতে ‘বিষ্ণুশক্তি’ ‘নারায়ণী’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে হয়েছে। সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মার কথায় ভগবান অনন্ত শক্তিময়; তবে জড়া বা অপরা প্রকৃতি ও পরা প্রকৃতি রূপে তা বিদ্যমান। মূলতঃ দুটি শক্তি; এই জড় প্রকৃতি হচ্ছে অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড। ঠিক যেন এক থলি ‘সরিষা’র মতো। এক একটি ব্রহ্মাণ্ডকে এক একটি সরিষার দানার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
বৈদিক শাস্ত্রের বিবেচনায় এক একটি ব্রহ্মাণ্ডে আবার চৌদ্দটি ভুবন রয়েছে-ভূলোক, ভূবলোক, স্বর্গলোক, মহলোক, জনলোক, তপলোক, সত্যলোক এগুলি উপরের দিকে রয়েছে; আর নিচের দিকে রয়েছে- অতল, বিতল, সুতল মহাতল, তলাতল, রসাতল, পাতাল। এইভাবে চৌদ্দ ভুবনাময় এই জগৎকে দেবীধাম বলে; দুর্গাদেবী হচ্ছেন, এই দেবীধামের ‘অধিষ্ঠাত্রী’- যিনি দশভুজা, সিংহবাহিণী ও পাপমর্দিনী। তিনি মহিষাসুরকে বধ করেছেন। তাঁর এক পাশে জড় ঐশর্য-রূপ লক্ষ্মী ও অন্যাদিকে জড়বিদ্যারূপ সরস্বতী বিরাজ করছেন। তাঁর একদিকে শোভারূপ কার্তিক, অন্যদিকে সিদ্ধিরূপ গণেশ রয়েছেন। পাপ দমনের উদ্দেশ্যে বেদে উল্লেখিত নানা রকম ধর্মরূপ কুড়ি প্রকার দিব্য অস্ত্রে তিনি সুসজ্জিতা। সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মা ভগবান শ্রীহরির ভজনায় সিদ্ধি লাভ করে অর্থাৎ ভগবদ্ দর্শন লাভ করবার পর তিনি যখন শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা গান করেন, তাকে ‘ব্রহ্মসংহিতা’ বলে; ব্রহ্মসংহিতায় উল্লেখ করা হয়েছে-

সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়সাধনশক্তিরেকা
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভুর্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা
গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি॥

অর্থাৎ, “স্বরূপ শক্তি বা চিৎ শক্তির ছায়া স্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়সাধিনী মায়াশক্তিই ভুবন-পূজিতা ‘দুর্গা; তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
চিজ্জগতে যে দুর্গাদেবী আছেন- তিনি চিন্ময়ী কৃষ্ণদাসী। সেই দুর্গাদেবীর ছায়ারূপিনী হচ্ছেন এই জড় দুর্গাদেবী। পরমেশর ভগবান আদি-পুরুষ গোবিন্দের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গাদেবী ও শম্ভু একসঙ্গে কাজ করেন। এই শম্ভু ও কৃষ্ণ অভেদ হলেও তাঁদের মধ্যে পার্থক্য আছে; তা হচ্ছে শম্ভুর ঈশ^রতা আদিপুরুষ গোবিন্দের ঈশ^রতার অধীন। একটি উদাহরণের সাহায্যে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, কৃষ্ণকে যদি দুধের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে শম্ভুকে দধির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই শম্ভু হচ্ছেন পরম বৈষ্ণব; তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে “বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভু।” শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন-

দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ ॥

অর্থাৎ এই জগতে দু’রকম জীব রয়েছে, এক হচ্ছে দৈব গুণসম্পন্ন, আর একধরনের জীব হচ্ছে আসুরিক গুণসম্পন্ন। এদের মধ্যে যারা শ্রীভগবানের আনুগত্য স্বীকার করে না, তাদের বল হয় অসুর; তারা সবসময় নিজেই ভোক্তা ও কর্তা হতে চায়, ভগবানের কর্তৃত্ব তারা স্বীকার করে না। অথচ সকল শাস্ত্রগ্রন্থাদি থেকে আমরা জানি ভগবানই প্রধান কর্তা ও সমস্ত কিছুর ভোক্তা। ভগবদগীতায় (৫/২৯) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশরম্।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ॥
-রাজা যেমন তার রাজ্যে এক কারাগার তৈরি করেন; যারা রাজার নির্দেশ অমান্য করে তার কর্তৃত্ব স্বীকার করে না; তাদের স্থান হয় কারাগারে; ঠিক সেই রকম যারা ভগবানের নির্দেশ মানে না, যারা শাস্ত্র মানে না, তাদের কারাগাররূপ এই জড় জগতে আসতে হয়। কারাগারে দুঃখ-দুর্দশা রূপ শাস্তি ভোগ করতে হয়, তাই ভগবান এই জগৎকে ভগবদগীতায় বলেছেন- দুঃখালয়ম’। এই জগতে দুঃখ-দুর্দশা সকলকেই ভোগ করতে হবে। কেউ তা এড়াতে পারবে না। তাই শ্রীল সনাতন গোস্বামী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে জীবের আদর্শ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন-
‘কে আমি, কেনে মোরে জারে তাপত্রয়?” (চৈঃ চঃ মধ্য ২/১০২)

অর্থাৎ আমার স্বরূপ কি? কেন এই ভব সংসারে আমাদের ‘তাপত্রয়’ অর্থাৎ তিন রকম দুঃখ ভোগ করতে হচ্ছে? এই তিন রকম দুঃখ কি কি? শাস্ত্রে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক। সর্বোচ্চ লোক থেকে সর্বনিম্ম লোক পর্যন্ত এই জড় জগত জন্ম-মৃতুময় দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। এমনকি সমগ্র জীবকুলের মধ্যে এই জড় জগতের ব্রহ্মাও জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়। এই বিষয়ে ভগবান কৃষ্ণ ভগবদগীতায় একটি শ্লোকে (৮/১৬) সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন-

“আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন।

কিন্তু যারা কৃষ্ণানুশীলন করে কৃষ্ণকে লাভ করে তারা কৃষ্ণের ধামে যায়, সেখানে জীবন নিত্য জ্ঞান ও আনন্দে পূর্ণ। শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তের সদ্গুরুর আনুগত্যে, নিরপরাধে, নিষ্কপটে ও সম্বন্ধ জ্ঞানের সঙ্গে মহামন্ত্র সর্বদা কীর্তন করা উচিত।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥

শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তের সঙ্গে হরিনাম কীতর্নই এ যুগের ধর্ম। ভগবান কৃষ্ণ ভগবদগীতায় অর্জুনকে বলেছেনÑ ‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ’। অর্থাৎ এই জড় জগতে জন্ম হলে জীবের মৃত্যু নিশ্চিত। আবার মৃত্যুর পর আবার জন্ম অনিবার্য। তার মধ্যে সমগ্র জীবকুলকে ও রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি ভোগ করতে হয়। এগুলো থেকে কোন জীবেরই রেহাই নেই। তবে যারা ভগবান কৃষ্ণের চরণে প্রপত্তি করেন, কৃষ্ণের শরণাপন্ন হন, তারা এই সব দুঃখতাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন; যারা শুদ্ধ কৃষ্ণানুশীলনে দিনে ২৪ ঘন্টায় এইভাবে নিমগ্ন তারা জীবন্মুক্ত পুরুষ।
যারা ভগবান কৃষ্ণের আনুগত্য স্বীকার করে না, যারা অসুর তাদের এই কারাগার-রূপ ‘দুর্গ’ থেকে জন্ম-মৃত্যুময় আবর্তন থেকে বের হওয়া অতীব কঠিন। এই কারাগারের, এই জড় জগতের অধিষ্ঠাত্রী দুর্গাদেবী তাই এইসব কৃষ্ণদ্বেষী অসুরদেরকে ত্রিশূল দ্বারা আঘাত করেন অর্থাৎ তারা ত্রিতাপ জ¦ালা ভোগ করেÑ মানসিক ও অন্য জীব থেকে দুঃখ ভোগ করে; যেমন একান্ত প্রিয়জনের বিয়োগ জনিত দুঃখ, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, প্লাবন, সর্পাঘাত বা অন্য জীব থেকে প্রাপ্ত জ¦ালাযন্ত্রণা তাদের ভোগ করতে হয়।
ভগবান হচ্ছেন ‘স্বরাট’; কৃষ্ণ সম্পূর্ণ স্বাধীন; জীব ভগবানের অংশ হওয়ায় তারও স্বতন্ত্রতা রয়েছে; ভগবান হচ্ছেন বিভু, কিন্তু জীব হচ্ছেন অণু তবে স্বতন্ত্রতা সামান্য মাত্র; জীব যখন তার স্বতন্ত্রতার সদ্ব্যবহার করে, তখন সে কৃষ্ণোন্মুখ হয়; আর যখন সে স্বতন্ত্রতার অপব্যবহার করে, তখন সে কৃষ্ণবহির্মুখ হয়।
এই জড় জগতে জীবমাত্রই কৃষ্ণবহির্মুখ হয়ে ভোগ বাঞ্ছা করে; তারা দুর্গাদেবীর পূজা করে; তারা দেবীর কাছে ‘ধনং দেহি, রূপং দেহি, যশো দেহি’ ইত্যাদি প্রার্থনা করে; এইভাবে জীবকুল জড়জগতে নিক্ষিপ্ত হয়, তখন দুর্গাদেবী যে বর দেন, সেগুলি কিন্তু তার কপট কৃপা।

দৈবী হ্যেষ গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মামেতাং তরন্তিয়াত ॥ (গীতা ৭/১৪)

অর্থাৎ, “আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।” ভগবানের দিব্য দুরতিক্রম্য মায়াকে তার শরণাগতরা অতিক্রম করতে পারে। আর অন্য কেউ তা পারে না। কলিযুগে হরিনাম ছাড়া এই মায়াকে অতিক্রম করবার আর কোনো উপায় নেই। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছেÑ কীর্তনীয়াঃ সদা হরিঃ; আবার বলা হয়েছে-

হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা

এই শিক্ষাই কলিযুগপাবনাবতারী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগৎকে দিয়েছেন। কলিযুগে অন্য কোন পন্থা কার্যকর নয়, কেবল শ্রীহরি নামের শ্রবণ কীর্তন স্মরণেই সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। এই হল সর্ব-শাস্ত্রের মত। অনেক সৌভাগ্যের ফলে শুদ্ধ কৃষ্ণ ভক্ত সঙ্গের ফলে জীবের কৃষ্ণবহির্মুখ ভাব দূর হয়; কৃষ্ণভক্তের সান্নিধ্যে জীব তখন ভগবানের শরণাগত হয়। দুর্গাদেবী তখন তুষ্ট হন।

লেখক পরিচিতি: শ্রীমৎ সুভগ্ স্বামী ১৯৭১ সালে শ্রীল প্রভুপাদের থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হরিনাম দীক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৭০ সালে লন্ডনেই শ্রীল প্রভুপাদের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি ‘ভক্তিবেদান্ত স্বামী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়ে নবদ্বীপ মণ্ডলের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে প্রচার করছেন। শ্রীল প্রভুপাদের অনেক গ্রন্থ তিনি বঙ্গানুবাদ করেছেন। তিনি বৈষ্ণব শাস্ত্র সংস্কৃত এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তিনি ইংরেজী, বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার উপর দক্ষতার জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও তিনি ইস্‌কন ভক্তদের জন্য বিখ্যাত ‘পানিহাটি চিড়া-দধি উৎসব’ আয়োজন করেছিলেন।


 

ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২১ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।