এই পোস্টটি 53 বার দেখা হয়েছে
ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর
দুর্গাপূজার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুর যুগল ত্রিভুবন এবং দেবগণের যজ্ঞভাগ হরণ করেছিলেন। দেবগণ রাজ্যভ্রষ্ট ও পরাজিত হয়ে নগরাজ হিমালয়ে গমনপূর্বক বিষ্ণুমায়া দুর্গার স্তব করেন-
দুর্গায়ৈ দুর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্ব্বকারিণ্যৈ।
খাত্যৈ তথৈব কৃষ্ণায়ৈ ধুম্রায়ৈ সততং নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥
এই কথা মার্কণ্ডেয়-পুরাণে সপ্তশতীর মধ্যে বর্ণিত আছে। দেবগণের যে-স্তরে অধিকার, অপেক্ষাকৃত হীনবীর্য্য মানবের সেই পূজ্যার স্তবাদিতেও অধিকার। আর্য্যাবর্তে ও দাক্ষিণাত্যে উভয় স্থানেই বহুদিন হতে দুর্গাপূজা চলে আসছে। বঙ্গদেশে শারদীয় দুর্গোৎসব সকল পর্বাপেক্ষা বড় পর্ব। বদ্ধাবস্থায় জীব কামনানুরূপ ফলভোগী, কিন্তু জীবাত্মা তাদৃশ ফলভোগী নহেন। ভগবদ্বিমুখ জীব বদ্ধাবস্থায় নানাপ্রকারের অভাবগ্রস্ত হয়ে বিবিধ কামনার আবাহন করেন। লৌকিক কামনা করে দেবীর নিকট হতে যে ফল লাভ করেন, তাহাই বদ্ধাবস্থা স্কুল ও সূক্ষ্ম উপাধিদ্বয়ে ভোগ করেন। বস্তুতঃ জীবাত্মা তাদৃশ কোন ফলভোগী হন না।
বিবিধ উপাসকের বিবিধ ফল এবং মায়ার হাত হতে উদ্ধারের পথ
সপ্তশতী ভগবদ্গীতা বলেন-
যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃন যান্তি পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্যাজিনোহপি মাম্ ॥
গীতা ৯/২৫
দেবতাদের উপাসকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হবেন; পিতৃপুরুষদের উপাসকেরা পিতৃলোক লাভ করেন; ভূত-প্রেত আদির উপাসকেরা ভূতলোক লাভ করেন এবং আমার উপাসকেরা আমাকেই লাভ করেন। গীতায় সপ্তম অধ্যায়ের চৌদ্দ নং শ্লোকেও বলা হয়েছে-
দৈবী হোষা গুনময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥
আমার এই দৈবী মায়া মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন। কৃষ্ণ ছাড়া অন্য দেবতার পূজা অবৈধ
গীতার নবম অধ্যায়ের তেইশ নং শ্লোকে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্তবিধিপূর্ব্বকম্ ॥
হে কৌন্তেয়! যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাঁদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধিপূর্বক আমারই পূজা করে।
শ্রীশ্রী দুর্গাদেবী ও অন্যান্য দেবীর তত্ত্ব- নিরূপণ
গৌতুমীয় কল্পে ভগবানের সাথে দুর্গার অভেদোক্তি দেখা যায়-
“যঃ কৃষ্ণঃসৈব দুর্গা স্যাদ যা দুর্গা কৃষ্ণএব সঃ। সাহি মায়াং শরূপা তদধীনে প্রাকৃতেহস্মিন্ লোকে মন্ত্ররক্ষালক্ষণসেবার্থং নিযুক্তা চিচ্চ্যাত্মক-দুর্গায়া দাসী তে নতু সেবাদিষ্ঠাত্রী।”
মায়ারূপা দুর্গা প্রাকৃত-রাজ্যে চিচ্ছ্যাত্মক দুর্গার অধীনে সেবাধিষ্ঠাত্রী না হয়ে মন্ত্ররক্ষা লক্ষণ সেবোদ্দেশে দাসীস্বরূপে নিযুক্তা।
ভগবানের পীঠাবরণ-পূজায় যে গণেশ, দুর্গা প্রভৃতি আছেন। তারা বিশ্বসেনাদির ন্যায় ভগবানের নিত্য বৈকুন্ঠসেবক। সেই বৈকুণ্ঠ- সেবক গণেশ দুর্গাদি দেবগণ মায়া শক্ত্যাত্মক গণেশ দুর্গাদির ন্যায় নহেন। তারা ভগবানের স্বরূপভূত-শক্ত্যাত্মক।
বিষ্ণু প্রসাদ-নির্মাল্য দ্বারা দেবদেবীর পূজা ও পিতৃতর্পণ বিধেয়
বিষ্ণযামলে লিখেছেন-
বিষ্ণুপাদোদকেনৈব পিতৃণাং তর্পণত্রিয়া।
বিষ্ণোর্নিবেদিতান্নেন ষষ্টব্যং দেবতান্তরম্ ॥
বিষ্ণুকে পূর্বে অন্ন নিবেদন করে, পরিশেষে সেই নিবেদিত অন্নের দ্বারাই দুর্গা গণেশাদির পূজা বিহিত।
নারদ পঞ্চরাত্রেও বলা হয়েছে-
লৌকিকী বৈদিকী বাপি যা ক্রিয়া ক্রিয়তে মুনে।
হরিসেবানুকূলৈব সা কাৰ্য্যা ভক্তিমিচ্ছতা ॥
ঐকান্তিক ভক্তগণ কখনই হরিসেবার প্রতিকূলে কোন লৌকিক বা বৈদিক অনুষ্ঠান করেন না, যা কিছু করেন, তা দ্বারা হরিসেবা করে থাকেন।
বিষ্ণুপূজায় দেবতা ও পিতৃপুরুষের পূজা হয়:
ভগবানের সেবা হইলেই সকল দেবতার পূজা হয়ে যায়, সকল পিতৃলোকের তর্পণ হয়।
যথা তরোর্মূলনিষেচনেন তৃপ্যন্তি
তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ।
প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং তথৈব
সর্ব্বার্হণমুচ্যতেজ্যা ॥
যেরূপ তরুর মূলে জলসেচন করলে সেই বৃক্ষের শাখা ও উপশাখা, ডালপালা, ফুল, ফল সকলেরই তৃপ্তি হয় এবং যেরূপ উদরে খাদ্য দিলে সর্বাঙ্গ শক্তি পায়, সেইরূপ বিষ্ণুপূজা করলেই সর্বদেবতার পূজা সিদ্ধ হয়। যিনি স্বতন্ত্রভাবে পূজা করতে ইচ্ছা করেন, তিনি বিষ্ণুর অবশেষ দ্বারা পূজা করিতে পারেন। তবে সেখানেও ভোগাদির কামনা বর্জনীয়। ভগবানের অর্চন করে যিনি ভগবদ্ভক্তের পূজা করেন না, তিনি ভক্তির অভাবে দাম্ভিক বলে প্রতিষ্ঠিত হন। (ভাঃ ৪/৩১/১৪)
বেদের যার উল্লেখ নাই, এরূপ দেবগণের পূজা করবে না। বেদের লিখিত দেবগণের স্বতন্ত্রভাবে পূজা নিষেধ। বিষ্ণুর নির্মাল্যদ্বারা বৈদিক দেবগণের পূজাবিহিত। পদ্মপুরাণে উত্তরখণ্ডে-
অর্চ্চয়িতা জগদ্বন্দ্যং দেবং নারায়ণং হরিম্।
তদাবরণসংস্থানং দেবস্য পরিতোর্চ্চয়েৎ ॥
হরের্ভুক্তাবশেষেণ বলিং তেভ্যো বিনিক্ষিপেৎ।
হোমঞ্চৈব প্রকুৰ্ব্বত তচ্ছেষেণৈব বৈষ্ণবঃ ॥
ভগবৎপীঠাবরণ-দেবতা-মধ্যে ভূতাদির অবস্থান নাই, সুতরাং ভূতাদির পূজা করিবে না। মদ্য- মাংস দ্বারা পূজা করিবে না-
যক্ষাণাঞ্চ পিশাচানং মদ্যমাংসভূজাং তথা।
দিবৌকসাং পূজনন্তসুরাপান-সমং স্মৃতম্ ॥
পদ্মপুরাণ উত্তরখণ্ড।