এই পোস্টটি 226 বার দেখা হয়েছে
এটি এক অদ্ভুত কারাগার। যেখানে জড় জগতের জীবেরা বন্দী হয়ে রয়েছে। যদিও বিষয়টি কিছু বিজ্ঞানী উপলব্ধি করতে পেরেছে কিন্তু তারা আমাদেরকে এ কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো সঠিক পথ প্রদর্শন করতে অক্ষম। তবে কিভাবে এ মায়ার কারাগার থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব?
কুণ্ডলী দাস
আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, আপনার ইন্দ্রিয়গুলো অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করে। আপনি যখন কোনো এক মোহময় এক অবস্থায় থাকবেন তখন আপনার দর্শন, শ্রবণ, স্বাদ আস্বাদন, আঘ্রাণ গ্রহণ ও স্পর্শ করার মাধ্যমে আপনি মাঝে মাঝে প্রতারিত হতে পারেন। এগুলো অধিকাংশ সময় তথাকথিত বাস্তবতার একটি চিত্র প্রদান করে। তাছাড়া আপনি যা প্রাপ্ত হচ্ছেন তার কোনো ঘটনা ও বিষয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে একমত হওয়ার জন্য অন্য ব্যক্তিরা তা নিশ্চিত করে থাকে।
কিন্তু আপনার চোখ ও ইন্দ্রিয়গুলো কি আপনাকে বাস্তবতার প্রকৃত ছবিটা প্রদান করে? ছবি-১এর দিকে লক্ষ্য করুন। আপনি কোনো কিছু ভুল দেখছেন? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘আমাদের এই জগৎটি একটি উদ্দেশ্য নয় বরং একটি বিষয়। আবার অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে আমরা এই জগৎ সম্পর্কে যে তথ্য সংগ্রহ করি তা অনির্ভরযোগ্য কেননা সেগুলো মোহময়। এইগুলো এই জগতে আমাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে প্রবেশ করতে দেয় না, সেগুলো উদ্দেশ্যময় একটি মোহ প্রদান করে মাত্র। কৃষ্ণ এই প্রকার মোহকে বলেন ‘মায়া’। মাঝে মাঝে মায়ার ধারণাটিকে অনেকে এইভাবে গ্রহণ করে যে, এই জগৎটি হলো একটি ‘মায়া’ একটি ‘মোহ’। কিন্তু কৃষ্ণ ঠিক এইভাবে বলেননি, কৃষ্ণ বলেছেন “এই জড় জগৎটি বাস্তব, কিন্তু একটি আয়নার তৈরি গৃহের মতো যার উদ্দেশ্য হলো আমাদেরকে বিভ্রান্ত করা।” আয়নার তৈরি একটি গৃহে গৃহ ও পর্যবেক্ষণকারী উভয়ই বাস্তব, কিন্তু গৃহের মধ্যে ব্যবহৃত আয়না বাস্তবতাকে বিকৃত করে প্রকৃত ছবিকে মোহময় হিসেবে উপস্থাপন করে। ঠিক তদ্রূপ এই জড় জগৎটি হলো বাস্তব, আপনি ও আমি বাস্তব। কিন্তু সেই আয়নার গৃহটির মতো আমাদের জড় ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের প্রত্যক্ষ উপলব্ধিগুলোকে বিকৃত করে দেয়। গৃহটি কি দিয়ে তৈরি হয়েছে সেটি সম্পর্কে বিস্মরণশীল হওয়ার মাধ্যমে আমরা বিকৃত রূপটি বাস্তব স্বরূপ হিসেবে গ্রহণ করি। যেহেতু নিত্য জগতে প্রবেশের জন্য আমাদের সর্বদা ইন্দ্রিয়গুলির ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা সেই আয়নার গৃহের ফাদে বন্দী হয়ে থাকা ব্যক্তিদের মতো। আমরা ক্রমাগত মায়া অথবা মোহের মধ্যে লিপ্ত।
পশ্চিমা জগতে মায়ার এই ধারণাটি নিয়ে খুব কমই জ্ঞান রয়েছে। মাত্র কতিপয় ব্যক্তি যারা বৈদিক দর্শনের প্রতি আগ্রহী তারা কৃষ্ণের এই মায়া শক্তি নিয়ে অনুসন্ধান করেন। কোনো কোনো সময় ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা কৌতুহলোদ্দীপক হলেও মাত্র কতিপয় ব্যক্তি বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হতে চান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে বৈদিক প্রেক্ষাপটের দর্শন গুলি জড় বিজ্ঞানের মাধ্যমে গ্রন্থাকারে জনগণের নিকট পৌঁছাচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্য মূল উদ্দেশ্য হলো বিজ্ঞান ও পারমার্থিকতার মধ্যে সাদৃশ্য স্থাপন করা। পশ্চিমা বিজ্ঞান ও প্রাচ্যের দর্শনের মাধ্যমে একটি সারমর্মের দিকে এগোনো যাচ্ছে যে, এই গ্রন্থগুলো বিজ্ঞান ও পারমার্থিকতার মধ্যে ছন্দময় সম্মিলনের একটি আশা প্রদান করে।
তথ্য হ্রাস পদ্ধতি
বৈদিক দর্শন ও আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের মধ্যে আপাত সদৃশ সত্ত্বেও এবং এই বিষয়ে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সত্ত্বে অধিংকাশ লোকের ক্ষেত্রেই জীবন যে একটি মোহময় একটি অবস্থা সেই ধারণা অগ্রহণীয় রয়ে গেছে এবং পরিহাসময় হয়ে পড়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক চার্লস টার্ট এর মতে মায়ার ব্যাপারটি পরিহাসের চেয়ে বরং বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। দর্শন ও জীব বিজ্ঞানের গবেষকগণ গবেষণা লব্ধ তথ্যপুঞ্জ সাইকো বায়োলজি অফ কশাসনেস অনুসারে এবং টার্টের বিশ বছরের গবেষণানুসারে এই জড় জগতে কৃষ্ণ কর্তৃক সৃষ্ট আমাদের অবস্থা একটি গভীর মোহময় অবস্থা।
টার্ট একাই নন দ্যা স্যাইকোলজি অফ কশাসনেস এবং দ্যা রিয়েলিটি ইলুশনের লেখক রবার্ট অনস্টিন ও রিচার্ড স্ট্রাচ এর মতো গবেষকরা প্রত্যেকেই লিখেছেন যে, আমাদের এই জড় জগতটি হল মোহময় সৃষ্টি যেখানে কিছু মোহময় যন্ত্র প্রদান করা হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা পরিলক্ষণ ও বিশেষণ করি। সেই যন্ত্রগুলো হল আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ। এখনো পর্যন্ত চেতনা নিয়ে গবেষকদের গবেষণানুসারে প্রদর্শিত হয় যে, আমরা বাস্তব হিসেবে যা অভিজ্ঞতা লাভ করি তা হলো শুধুমাত্র আমাদের স্বকীয় মস্তিষ্কজাত তথ্য।
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি জড় জগত সম্বন্ধে নির্ভেজাল তথ্য প্রদানের পরিবর্তে বরং তথ্য প্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি সীমাবদ্ধ করে তুলে। তথ্যলাভের ফলাফলটি ভিত্তি নির্ভর করে আমাদের প্রত্যাশা, পূর্ব প্রচলিত বিশ্বাস ও অনুমান এবং পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য যা ব্যক্তিগতভাবে বাস্তবতা হিসেবে গঠন করে থাকে। দর্শন, শব্দ, গন্ধ ও পৃথিবীতে যত আকৃতির অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করে থাকি তার মধ্যে অনেক কিছুই আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করি। তাই বাস্তবতা যেমন সৌন্দর্য এটি নির্ভর করে দর্শন কারীর চোখের ওপর।
এই জগতে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি এমনভাবে কাজ করে যেরকম একজন ভাস্কর্য শিল্পি মার্বেলের ওপর কাজ করার মতো। তিনি তাঁর ছেনী দিয়ে যখন ভাষ্কর্য তৈরির জন্য মার্বেলের ওপর কাজ করেন তখন তিনি যতটুকু সম্ভব ভাষ্কর্য ফুটিয়ে তোলার জন্য অনেক মার্বেলের টুকরো বাদ দেন। এক্ষেত্রে ঐ মার্বেলের ওপর আরেকজন ভাষ্কর্য শিল্পি কাজ করো তবে তিনি অন্যভাবে সেটিকে উপস্থাপন করবে। অথবা, ঐ একই ভাষ্কর্য শিল্পি অন্য সময় অন্যভাবে সেটিকে রূপ প্রদান করবে। বিষয়টি আরেকটু ভালভাবে উপলব্ধির জন্য একটি মুখের ও ফুলদানির ছবি তুলে ধরা হয়েছে। ছবি-১ থেকে কোন্ ছবিটি আপনি বাদ দিবেন? দুটি সাদা মুখ নাকি একটি কালো ফুলদানি? এক্ষেত্রে দুটি ছবিই বর্তমান কিন্তু আপনি একই সময়ে দু’টি ছবিকে দর্শন করতে পারছেন না। চেতন বা অবচেতনভাবে আপনি এর কোনো একটি দর্শন করছেন আবার অন্যটি বাদ দিচ্ছেন। ছবি-২ ও অনুরূপ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করছে। উক্ত ছবিটি একজন বৃদ্ধা নাকি যুবতীর? এটি নির্ভর করছে আপনি কিরকম তথ্য বাছাই করছেন। এক্ষেত্রে পূর্বের মুখের বা ফুলদানির ছবিটির চেয়ে এই ছবিতে উভয়ই নারীর ছবি নির্ধারণ করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়েছে। যেটি আপনি দেখছেন সেই প্রসঙ্গটি কি সে বিষয়টিও গোচরীভূত হতে কিংবা ব্যাখ্যা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এবার ৩ নম্বর ছবিটি দেখুন, এটি কি একটি নম্বর নাকি একটি অক্ষর? প্রসঙ্গের ওপর নির্ভর করে আপনি এটিকে দেখার জন্য বাছাই করেন। কোনো প্রসঙ্গ ব্যতীত আপনি বলতে সক্ষম নন যে, এটি কি আসলে একটি ইংরেজি B অক্ষর নাকি ইংরেজির সংখ্যা 13। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো বিষয়কে বিকৃতও করে ফেলতে পারে এবং সেই সাথে কোনো তথ্য যদি দেওয়া না থাকে তাও সরবরাহ করে। যেমন ৪র্থ ছবিটি দেখুন, আমাদের চোখ কতগুলি সোজা দাগ কল্পনা করছে যেগুলো দিয়ে একটি সাদা ত্রিভুজ গঠিত হয়েছে।
আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণাও করে। যেমন-আমাদের জিহ্বা যখন একই তাপমাত্রায় কার্বোনেটেড জল ও সাধারণ জলের স্বাদ গ্রহণ করে তখন কার্বোনেটেড জল অধিকতর শীতল বলে অনুভব হয়। যদি দীর্ঘক্ষণ শুষ্ক বরফের সংস্পর্শে থাকা হয় তবে মস্তিষ্কে জলন্ত এক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এই ছাড়াও আমরা এমন শব্দ তরঙ্গ সম্পর্কে জানি যা আমরা শুনতে পারি না। তদ্রুপ, আমাদের চোখ আমাদের জানা মতে আলোক রশ্মির শুধুমাত্র ক্ষুদ্র একটি অংশ দর্শন করতে পারে মাত্র। একটি ব্যাঙের চোখ বাহ্য জগতে আমরা যা দেখতে পায় তার চেয়েও কম দেখতে পারে। পরীক্ষা মতে যখন কোনো একটি ব্যাঙের চোখের সামনে ৭ ইঞ্চি দূরত্বে শত শত রঙ আকার, আকৃতি ও অস্থির কোনো কিছু রাখা হয় তখন চার ধরনের বার্তা তাদের চোখ থেকে মস্তিষ্কে গমন করে। ব্যাঙের চোখ গুলি প্রথমত, পরিবেশের সাধারণ একটি ধারণা প্রদান করে, দ্বিতীয়ত, ছায়াগুলির হঠাৎ নড়াচড়ার বিষয়টি চিহ্নিত করতে সহায়তা করতে সাহায্য করে, তৃতীয়ত, হঠাৎ আলো কমে যাওয়ার ব্যাপারটি চিহ্নিত করতে সহায়তা করে।
এটি ক্ষুদ্র কালো বস্তুকে দর্শন করতে পারে যেমন মাছি বা অন্যান্য পোকা-মাকড় এর দিকে অগ্রসর হয়। একটি ব্যাঙের চোখের এমন ক্ষমতা রয়েছে যে, আমাদের চোখের ৭ ইঞ্চি দূরত্বে যা অস্তিত্বহীন বলে মনে হয় তা ব্যাঙেদের চোখে খুব সহজেই দর্শনীয়। ব্যাঙেদের জগতে হাতিগুলোর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না বরং সেগুলি ভূমি কাঁপানো ছায়া হিসেবেই প্রতিভাত হয়। ব্যাঙ কিংবা পিঁপড়া, গণ্ডার, শঙ্খচিল এরা তাদের নিজস্ব এক বাস্তব মোহময় বাস্তবতায় বসবাস করে।
মোহময় বাস্তবতায় সম্মতি
অনেকগুলো দৃষ্টান্তের মধ্যে এই কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হল যার মাধ্যমে বুঝতে পারি যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো ঠিক ততটা বিশ্বস্ত নয়। এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রদর্শিত হয়, যেমন একটি গাছকে আকাশ থেকে অন্যরকম দেখায় আবার ভূমিতে অন্যভাবে দেখায়। কোনো স্থায়ী তথ্য অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আবার একই তথ্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিভাত হতে পারে, কিংবা ঐ একই ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শন করতে পারে। যেরকমটি মুখ বা ফুলদানির ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। অথবা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে একই বিষয় একই প্রসঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দর্শন হতে পারে, যেরকম ছবি-৩।
ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান আহরণের পন্থার মধ্যে কিছু প্রশ্নের অবতারণা হয় সেগুলো হল, কি বিষয় আমরা প্রাপ্ত হচ্ছি, বিষয়টি প্রকৃত বাস্তবতা থেকে কতটুকু বিকৃত হচ্ছে? এই জগতের কতটুকু তথ্যই বা আমরা প্রাপ্ত হচ্ছি না? এবং দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা কতটুকু কল্পনা করতে পারি? সংক্ষেপে বললে কিভাবে আমরা মায়া বা মোহ থেকে প্রকৃত বাস্তবতাকে চিহ্নিত করতে পারি?
উত্তরটি হলো, আমরা জানি না। আমরা কখনো জানবোও না। কেননা বিশেষজ্ঞদের মতে এই জড় জগত সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রাপ্ত হওয়ার কোনো পন্থা নেই। এই বিষয়টি সতর্ক করে বৈদিক সাহিত্যে মাঝে মাঝে এই জগৎটিকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘দুর্গ’ বা ‘কারাগার’ হিসেবে। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় প্রদত্ত মোহের মাধ্যমে বন্দি হয়ে রয়েছি।
কিন্তু যদি আমরা উদ্দেশ্যময় বাস্তবতায় বসবাস না করি, যদি আমরা মায়াতে খুব বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি তবে কিভাবে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে একমত হতে সমর্থ হবো? তবে কিভাবে আমরা এই জড় জগতের বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা খুঁজে নিয়ে কথা বলতে পারি? জন্মের পর থেকেই আমাদের চারপাশের অন্য সবাই যা যা করে অনুসরণ করে তা দিয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো কোনো কিছু নির্বাচন করে থাকে কিংবা কোনো কিছু ব্যাখ্যা করে থাকে। যার মাধ্যমে গঠিত হয় মোহময় বাস্তবতা। এইভাবে একটি প্রচলিত একটি বিশ্বাস বাস্তবতা হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে। যখন একটি দল এই একই বাস্তবতা অনুশীলন করে তবে সেটিকে বলা হয় একটি সংস্কৃতি । সারা বিশ্বের বৈচিত্রময় সংস্কৃতিতে এই জড় জগৎকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেগুলো রয়েছে মোহময় বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এক্ষেত্রে কারো কারো ব্যক্তিগত বাস্তবতা প্রচলিত বাস্তবতার ব্যতিক্রম হতে পারে। যদি এমন কোনো সংস্কৃতির অস্থিত্ব থাকে যেটি আমাদের উদ্দেশ্যে বলে যে, আমরা মোহের মধ্যে বসবাস করছি, কিংবা এই মোহের ঊর্ধ্বে গমন করতে হবে এবং সেসাথে মোহ ও বাস্তবতা চিহ্নিত করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে সেই সংস্কৃতিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি। প্রশ্নটি হলো এই ধরণের সংস্কৃতি আদৌ রয়েছে কিনা? উত্তরটি হলো ‘হ্যাঁ’। এটি হলো বৈদিক সংস্কৃতি যেখান থেকে মায়ার ধারণাটির উৎপত্তি ঘটনা। অন্যান্য সংস্কৃতির মতো নয় বরং বৈদিক সংস্কৃতি বিশেষভাবে আমাদেরকে পরিচালিত করছে কিভাবে মায়া বা মোহ থেকে আমরা মুক্তি লাভ করতে পারি। এইজন্য এটি জীবন ধারনের একটি কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয় যার মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে গমন করতে পারি। যেরকমটি কৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন, প্রকৃত বৈদিক সংস্কৃতি নারী পুরুষ-শিশু সর্বস্তরের মানুষদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে কিভাবে এই আপেক্ষিক জড় জগতের স্তরে থেকে প্রকৃত বাস্তবতা চিন্ময় জগতের স্তরে উপনীত হতে পারি। যেমন যদি একটি ব্যাঙের বাস্তবতায় একটি হাতির অস্তিত্ব শুধুমাত্র ভূমি কাপানো ছায়া ছাড়া আর কিছু নয় তখন আমরা বৈদিক সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে পারি যে, দেব দেবী ও অন্যান্য উচ্চতর জীবের অস্তিত্ব রয়েছে, যদিও আমাদের বাস্তবতার তা অস্তিত্বহীন বলে মনে হয়। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর কারণে ভাবনাগুলো সীমিত হতে পারে কিন্তু তা উদ্ভট নয় যেরকম আমরা ব্যাঙের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারি। আমরা জানি যে আমাদের বাস্তবতায় পুষ্পের মধ্যে একটি পিঁপড়ার বসবাস যেমন নগণ্য, ঠিক তেমনিই পিঁপড়ার বাস্তবতায় আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে প্রতিভাত হয়। সেক্ষেত্রে আমরা কোনো বাগানে গিয়ে জল দেয়ার নামে কোনো পিঁপড়ার জীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারি না। তবে দেব-দেবীদের পরিপ্রেক্ষিতে কি আমাদের অস্তিত্ব বা অবস্থানটিও সেই পিঁপড়া বা ব্যাঙের মতো হতে পারে না? তাদের জন্য আমাদের জগতে যে বৃষ্টি হয় তা তাদের জগতের জন্য বাগানে জল দেওয়ার মতোই অবস্থা।
কে সেই যোগ্য ব্যক্তি?
প্রথমে আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে আমরা কিভাবে এতটা তুচ্ছ বা নগণ্য হতে পারি, কিন্তু যাইহোক প্রকৃতপক্ষে বৈদিক সংস্কৃতি যে কৃষ্ণভাবনা প্রদান করছে তার মাধ্যমে আমাদের এই তুচ্ছ বা নগণ্য অস্তিত্বের অবস্থান থেকে মুক্ত হতে পারি। শুধুমাত্র আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন ইত্যাদি পোকামাকড়ের ন্যায় জীবের অবস্থান থেকে আমাদেরকে উচ্চতর অবস্থানে উন্নীত করতে পারি। মায়ার কাছে আমাদের সমস্ত অর্জন নিতান্ত তুচ্ছ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় প্রারম্ভেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন যে, মোহময় বা মায়াময় স্তরের ঊর্ধ্বে প্রকৃত বাস্তবতার সম্পর্কে তথ্য লাভের একটি মাত্র পন্থা রয়েছে তা হলো যিনি মায়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছেন সে রকম উৎস থেকে তথ্য লাভ করা। যে রকম একজন ব্যক্তি যিনি সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন তাকে একমাত্র রক্ষা করতে পারেন তিনিই যিনি হাবুডুবু খাচ্ছেন না। এখন সমস্যাটি হলো এমন যোগ্য ব্যক্তি কে রয়েছে? সারা জগতে এইরকম কর্তৃপক্ষ বা যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য। বৈদিক শাস্ত্রানুসারে একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হলেন সেই যোগ্য ব্যক্তি যিনি হলেন এই জড়া প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক। পক্ষান্তরে দূর্গাদেবী হলেন সেই মায়া শক্তির পরিচালক। ভগবান এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও মায়া শক্তির অধীন নন বরং মায়াশক্তি তারই নির্দেশ পালন করছে মাত্র। একজন রাজা রাষ্ট্রীয় কারাগার পরিদর্শন করতে পারে তার মানে তিনি কয়েদী হয়ে যাননি। তদ্রুপ কৃষ্ণ যখন এই জড় জগতে অবতরণ করেন তিনি মায়া শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হন না। বরং তিনি এমন দিব্য জ্ঞান প্রদান করেন যা আমাদেরকে মায়ার কবল থেকে মুক্ত করতে পারে। এটি তিনি করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এই রকম প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হয়েছে: ইন্দ্রিয়গুলিকে কি অতিক্রম করা কি সম্ভব? এই মায়ার জগতের উদ্দেশ্যই বা কি? এই আপেক্ষিক জগতের ঊর্ধ্বে কি কোনো প্রকৃত বাস্তবতা রয়েছে? আমাদের পক্ষে কি সেই বাস্তবতা প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব? অর্জুন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শ্রোতার মাধ্যমে প্রতিপন্ন করেন যে, কৃষ্ণের চেয়ে এমন কোনো যোগ্য ব্যক্তি নেই যিনি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রদানের মাধ্যমে আমাদের সমস্ত সন্দেহ দূরীভূত করতে পারেন।