দিব্যজ্ঞান বিতরণ

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২১ | ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২১ | ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 258 বার দেখা হয়েছে

দিব্যজ্ঞান বিতরণ
গ্রন্থ বিতরণ হলো এক রোমাঞ্চকর বিষয়, আপনি জানতেই পারবেন না কি ঘটতে যাচ্ছে ?

করুণা ধরণী দেবী দাসী

প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিগুলো রাশিয়ার এক নবীন কৃষ্ণভক্তের। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে দিব্যজ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্র যে যার মতো সামর্থতা প্রদর্শন করতে পারে। এরই এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য এই যে, দিব্যজ্ঞান কেউ গ্রহণ করবে আবার কেউ হয়তো করবে না। কিন্তু ভক্তের প্রচেষ্টা ও সবার প্রতি কৃপাবর্ষন অব্যাহত থাকে।
গ্রন্থ প্রচার কৃষ্ণভাবনামৃতে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রীল প্রভুপাদ গ্রন্থ প্রচারের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন তাঁর গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের কাছ থেকে এবং তিনি তা সঞ্চালিত করেছিলেন তার সমস্ত শিষ্যদের মধ্যে।
আমি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানীয় আচার-আচরণের মধ্যে বেড়ে উঠছিলাম একসময় তা আমি ত্যাগ করেছিলেন কেননা এর মধ্যে কিছু পাশ্চাত্য গোঁড়ামী ঢুকে গিয়ে ছিল। স্নাতকোত্তর শেষ করার পর আমি জাপানে গেলাম বৌদ্ধ শিক্ষা লাভ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাও আমার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারলো না।
১৯৭৩ সালে ক্রিষ্টিনা, যিনি বর্তমানে পাবক দাসী। তিন লসএঞ্জেলস বিমান বন্দরে গ্রন্থ বিতরণরত এক ভক্তের কাছ থেকে শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা যথাযথ গ্রন্থটি তিনি পড়েন। গ্রন্থটি পড়ার পর তিনি শ্রীল প্রভুপাদের অন্যান্য গ্রন্থগুলো পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। পাবক দাসী ভাষ্য হতে জেনে শুধুমাত্র শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থের মাধ্যমেই আমি আমার হৃদয়ে অবস্থিত আত্মার অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং এই গ্রন্থগুলো ছিল আমার ভক্তিজীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা। শ্রীল প্রভুপাদ তার গ্রন্থের মাধ্যমে আমার গুরু হয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমানে পাবক দাসী লস্ এঞ্জেলস মন্দিরের একজন আজীবন সদস্য। পারক দাসী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক কৃষ্ণভক্তের কাছ হতে গ্রন্থটি পেয়েছিলেন। ভক্তটি সমস্ত পথিককে গ্রন্থগুলো দেখাচ্ছিলেন, কিন্তু গ্রন্থগুলোর প্রতি কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না, শত শত পথিকের মধ্যে একজন গ্রন্থগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখালো। ভক্তটি মন প্রাণ উজার করে দিয়ে, গ্রন্থগুলোর মহিমা বর্ণনা করলেন। সেই ভক্তের মাধ্যমেই সেদিন যেন আমি শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রাকৃত সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম।
সংস্কৃত ভাষাটি সারাবিশ্বে খুব প্রচলিত নয়। এমনকি ভারতবর্ষেও কিছু কিছু সৎ দার্শনিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিরা এই গ্রন্থটি তাদের গৃহে রাখতেন। বিশেষ করে ব্রাহ্মণরা ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে গ্রন্থটি তাদের গৃহে ও মন্দিরে রাখতেন। তৎকালীন সময়ে শ্রীল প্রভুপাদের গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি শিষ্যদের মধ্যে গ্রন্থ ছাপানো ও বিতরণের জন্য বিশেষভাবে প্রেরণা দিতেন। শ্রীল প্রভুপাদ অতি যত্নের সাথে বৈদিক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো অনুবাদ করেন এবং সমাজের সর্বস্তরে তা বিতরণের নির্দেশ দেন। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর গ্রন্থ বিতরণকারী ভক্ত ও শিষ্যদের জন্য তার কৃপার দুয়ার উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন। ভৃগুপতি দাস, যিনি একজন সার্বক্ষনিক গ্রন্থ প্রচারক। তিনি পঁয়ত্রিশ বছর যাবৎ গ্রন্থ বিতরণ করছেন। তার ভাষ্যমতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রীল প্রভুপাদ এই কথাটি বহুবার বলেছেন, “কৃষ্ণকে আকৃষ্ট করার একটি উপায় হলো গ্রন্থ প্রচার প্রচারক ভক্তদের প্রতি কৃষ্ণ খুব বেশী আন্তরিক হন ও খুব তাড়াতাড়ি তাকে তার নিজ জন বলে স্বীকার করেন। শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে আশ্রয় পাওয়ার এটি হলো একটি কার্যকরী উপায়, তোমাদের সবার এই সুযোগ গ্রহণ করা উচিত।”
আমি সর্বদা চেয়েছি কৃষ্ণ যেন আমাকে কৃষ্ণভাবনামৃত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করেন এবং এটি হলো আমার অনেকগুলো ভক্তিমূলক সেবার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেবা। শ্রীল প্রভুপাদ তার গুরুদেবের আদেশ শিরোধার্য করে গ্রন্থ প্রকাশ ও বিতরণের জন্য আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৫ সালে আমেরিকার উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করার পূর্বে যদিও তখন তার যথেষ্ট আর্থিক কষ্ট ছিল, সেই সময়েই শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতের অনুবাদ শুরু করেন এবং এর তিনটি খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন। তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের এই তিনটি খণ্ড ট্রাঙ্ক ভর্তি করে উত্তাল আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা যাত্রা করেন। পাশ্চাত্যে তার প্রথম দিকের একাকীত্ব সময়ে যে তার গ্রন্থের প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি তার কাছে গ্রন্থগুলো বিক্রি করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। ১৯৭২ সালে ম্যাকমিলন কোম্পানি শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ প্রকাশ করে। এটি অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিত কর্তৃক সাদরে গৃহীত হয় এবং বিশ্বের অনেক নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অধিভুক্ত হয় এবং খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। এটি বর্তমানে একশতেরও বেশী ভাষায় অনুদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এর জনপ্রিয়তার অনুপ্রাণিত হয়ে খুব শীঘ্রই লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ যা ইস্‌কনে কৃষ্ণ গ্রন্থ নামে পরিচিত। এটি টোকিও হতে প্রকাশিত হয়। এটি শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের সংক্ষেপ যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ৫০০০ বছর পূর্বে এই ধরাধামে যে লীলা করেছেন তার বর্ণনা বিধৃত হয়েছে। যখন শ্রীল প্রভুপাদের লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গ্রন্থের প্রথম কার্টন পৌঁছায় তখন তিনি দেখলেন নির্ধারিত সংখ্যক গ্রন্থ থেকে একটি গ্রন্থ কম আছে। তিনি তার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন তার এক শিষ্য (ব্রহ্মানন্দ স্বামী মহারাজ) বিমানযোগে কার্টুনটি আনার সময় বিমানের মধ্যেই একজন ব্যবসায়ীর কাছে একটি গ্রন্থ বিক্রি করেছেন। এটি শুনে তিনি আনন্দিত হন। ভক্তরা অবাক হচ্ছিলেন কিভাবে এতগুলো কপি বিতড়িত হবে। তখন এক ভক্ত একটি পরিকল্পনা করলেন। কোনো সি.এন.জি স্টেশনের কাছে যদি একটি বুক স্টল দেওয়া যায় তবে ভাল হবে। সেই পরিকল্পনার কথা সি.এন.জি স্টেশনের মালিককে জানালে তিনি সম্মতি দিলেন। এভাবে ভক্তরা একেক রকম পরিকল্পনা করে গ্রন্থগুলো বিক্রি করতে লাগলেন। ভক্তরা গ্রন্থগুলো বিতরণ করে খুব আনন্দ পেত। গ্রন্থ বিতরণ করতে করতে তাদের দর্শনের কথা মানুষকে বলতো এবং এর মাধ্যমে তারা গুরুদেবের দিব্য উপস্থিতি অনুভব করতো। মন্দির হতে মন্দিরে খবর ছড়িয়ে পড়ল গ্রন্থ প্রচারই হলো শ্রীল প্রভুপাদকে খুশী করার অন্যতম উপায়। ভক্তরা এই খবর শুনে আরও বেশী করে গ্রন্থ বিতরণে আত্মনিয়োগ করলো। তখনকার সময়ে আমেরিকাতে কিছু নিরামিষাশী ছিল যারা যোগ, কর্ম, গুরু সম্বন্ধে সামান্য কিছু কিছু জানতো। আমেরিকাবাসীরা তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সর্বদাই গর্বিত থাকতো। কিন্তু প্রভুপাদ তার গ্রন্থে এই ভগবান বিহীন অগ্রগতিকে সাগরের এক ঢেউয়ের আঘাতে তলিয়ে যাওয়া কোনো শহরের সাথে তুলনা করেছেন। কোনো একটি শহর খুব সুন্দরভাবে সজ্জিত হয়েছিল কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ এসে শহরটিকে এক মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস স্তূপে পরিণত করেছিল। ভগবান বিহীন জাগতিক অগ্রগতি ঠিক এই রকম। ১৯৭৭ সালে শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রকটের আগে গ্রন্থ বিতরণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতবর্ষে এক বিলিয়ন গ্রন্থ বিতরণ হয়েছে।
গত ত্রিশ বছর বছর ধরে নিদ্রা দাসী দে-নগরে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ বিতরণ করছেন। যদি কোনো জমিতে ভলভাবে চাষ দেওয়া হয়, ভাল বীজ রোপন করা হয় এবং জলসেচও পর্যাপ্ত হয় তবে সেই জমি হবে খুব উত্তম জমি, সেই জমি থেকে ভাল ফলন আসবেই। গ্রন্থ বিতরণকে আমার এমনই একটি জমি বলে মনে হয়, সকল বয়সের মানুষ এই সেবার প্রতি আকৃষ্ট। আমার কাছে কৃষ্ণভাবনামৃতের অন্যান্য সেবার মধ্যে এইটিকে উৎকৃষ্ট সেবা বলে মনে হয়। কেননা প্রতিটি গ্রন্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে এক দার্শনিকের মতো কাজ করে। শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন কেউ যদি কৃষ্ণের গ্রন্থগুলো গৃহে রাখে তবে তার গৃহও পবিত্র হবে।
শৈশবে পিটার এন্থোনাকসকে তার পিতা সেলফ্ হতে শ্রীমদ্ভাবগতের একটি কপি দেখিয়ে ছিলেন। তার ভাষ্যমতে যখন আমার বয়স ষোল, তখন আমি গ্রন্থ বিরতণকারীর কাছ থেকে শ্রীমদ্ভাগবতের একটি কপি পেয়েছিলাম। শীল প্রভুপাদ তার লেখনীর মাধ্যমে মায়া ও জড়জাগতিক বাসনাগুলোকে দূরীভূত করেছিলেন। এর কিছুদিন পর পুরানো লাইব্রেরি হতে চৈতন্য চরিতামৃতের একটি কপি পাই। একদিনেই গ্রন্থটি পড়ে শেষ করেছিলাম। আমাদের কলেজে শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য ঘনপতি মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তখন হতে দোনার মন্দিরে আমি সেবক হিসেবে যোগদান করি।
১৯৯৯ সালে ভানু নান্দুরী সেন্ট লুইস বিমান বন্দরে ধুতি ও কোর্তা পরিহিত একজনকে কিছু গ্রন্থ নিয়ে একটি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তার ভাষ্যমতে মধ্য পাশ্চাত্যে এই রকম কাউকে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি আমেরিকাতে গিয়েছিলাম ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশলের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেওয়ার জন্য। আমি সেই বুক টেবিল থেকে একটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ কিনলাম। আমি ভারতবর্ষে ভগবদ্গীতার অনেকগুলো ভাষ্যই পড়েছিলাম কিন্তু কোনোটিই আমার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি, যখন আমি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ পড়েছিলাম তখন আমার কাছে মনে হলো আসলেই এটি যথাযথ। তা আমাকে জীবনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতে সমর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে আমি তাঁর অনেকগুলো গ্রন্থ পড়েছিলাম। হুনুলুলু মন্দিরে গিয়ে তিনি ভক্তদের কাছে জপ করতে শিখেছিলেন এবং রামনবমীর উৎসবে ভক্তদের সাথে সেবা করেছিলেন। ভানু বললেন, এখন আমিও আমার সমস্ত পরিবার সন জয়েস ইস্কন কেন্দ্রের সাথে জড়িত। একটা সময় ছিল যখন আমি চাকরিটা নিয়ে খুব চাপের মধ্যে থাকতাম। কিন্তু আমি এখন এসব কিছু থেকে মুক্ত। কেননা আমি জানতে পেরেছি, হরিনাম জপ ও ভক্তসঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈয়াসখা দাস, সিলিকন ভ্যালি গ্রন্থ বিতরনের দলনেতা, তার ভাষ্যমতে যখন ভক্তরা গ্রন্থ বিতরণ করতে যায় তখন তারা একদিকে দেখে জড়জাগতিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে আমি কি রকম কষ্ট পাচ্ছি আর অপরদিকে দেখে মহাপ্রভুর অপার করুণা।

ভ্রাম্যমান ব্রহ্মচারীরা

ছয় ব্রহ্মচারী ২০০৭ সালে উত্তর আমেরিকা ও কানাডার প্রায় ৪০টি কনসার্টে গিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ গ্রন্থ বিতরণ করেছিলেন। তারা কনসার্টের আয়োজকদের গ্রন্থ বিতরণের অনুমতি প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের কিছু প্রসাদও দিয়েছিল। এই দলের ওংকার দাস বললেন এই ধরনের গ্রন্থ বিতরণ আসলে খুব চমৎকার আমরা যাদের কনসার্টে গেয়েছিলাম তারা ছিল যুব সমাজ। বন্ধু ভাবাপন্ন, ওংকার দাস সেই সময়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বললেন।
আমি এক যুবতীকে একটি গ্রন্থ নেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি নিতে চাইলেও তার পিতা বাধা দেন। তার পিতা ভেবেছিলেন আমরা মিশনারী। আমি তার সরল মেয়েকে ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান সমৃদ্ধ গ্রন্থ কিনতে বাধ্য করছি তারা এখানে এসেছে মাংস, মাদকদ্রব্য ও এলকোহল সেবন করার জন্য। আর সেখানে এই গ্রন্থ। যা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা তার পিতাকে বোঝালাম, অবশেষে তিনি গ্রন্থ কিনতে সম্মত হলেন।
গ্রন্থ বিতরনে আরেকটি খুব সুন্দর নাম আছে যা হলো শাস্ত্র দান। ভক্তরা বিউটি সেলুনে, ট্যাটোর দোকানে অপেক্ষারতদের কাছে গ্রন্থ বিতরণ করে। পঞ্চজন্য প্রজেক্টের মাধ্যমে ভক্তরা এক মিলিয়নের বেশী শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ বিতরণ করেছিল সাগর তীরে অবস্থিত বিভিন্ন বিলাসবহূল মোটেল গুলোতে। সি ব্রীজ মোটেলের মালিক দিলীপ প্যাটেল পঞ্চজন্য প্রজেক্টের ভক্তদের কাছ থেকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নিয়ে ছিলেন এবং তার নিজের ঘরে সবসময় সেই গীতা শোভা পাচ্ছে। দিলীপ প্যাটেল বললেন আমি প্রথমেই একজন অহিন্দুকে গীতা বিতরণ করতে দেখে আশ্চর্য হলাম, পরে ভাবলাম এরাই আসল গীতার জ্ঞান গ্রহীতা।

ছাত্ররা প্রকৃত জ্ঞানেরই অনুসন্ধান করছে

কলেজে গ্রন্থ বিতরণ শিক্ষক ও ছাত্রদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছিল । বিজয় দাস, যিনি আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে দুই দিন করে বুকটেবিলে নিয়ে বসত। বিজয় দাসের ভাষ্য মতে গ্রন্থ বিতরণ হলো এক রোমাঞ্চকর বিষয় আপনি জানতেই পারবেন না কি ঘটতে যাচ্ছে। একদিন একটি ছাত্র আমার টেবিলের কাছে এসে গ্রন্থগুলো দেখতে লাগলো। আমি তাকে কৃষ্ণের সাথে পরিচয় করালাম। তাকে কর্মচক্র ও জন্মমৃত্যুর চক্রগুলো ব্যাখ্যা করছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি নিজের ইচ্ছায় কিছু বলছি না, কেউ যেন আমাকে বলাচ্ছে, ছাত্রটি আমার মতো একজন ক্যাম্পাসে দেখে অবাক হয়েছিল কেননা বিশেষত এরকম লোক ক্যাম্পাসে আশা করা হয়। না। সে আমার কাছ থেকে কিছু গ্রন্থ নিল। আমি তার ই-মেইল এড্রেস রাখলাম।
যদি কোনো জমিতে ভলভাবে চাষ দেওয়া হয়, ভাল বীজ রোপন করা হয় এবং জলসেচও পর্যাপ্ত হয় তবে সেই জমি হবে খুব উত্তম জমি, সেই জমি থেকে ভাল ফলন আসবেই। গ্রন্থ বিতরণকে আমার এমনই একটি জমি বলে মনে হয়, সকল বয়সের মানুষ এই সেবার প্রতি আকৃষ্ট।
কয়েকদিনের মধ্যেই সে মন্দিরে প্রথম বারের মতো আসলো। আরেকটি অনুষ্ঠানে সেই ছাত্রটিকে আমি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা দিয়েছিলাম। সে আমাকে বললো, শ্রীল প্রভুপদের একটি গ্রন্থ কলেজে তার ডেস্কে রেখেছিল। তার ক্লাসের অধ্যাপক ডেস্কের সামনে আসলো এবং গ্রন্থটি খুলে দেখতে লাগলো, তিনি মাথা নিচু করে আমার কানের কাছে চুপি চুপি করে বললেন তুমি এই গ্রন্থের মধ্যে থাকা অদ্ভুত ছবিগুলো দেখেছ? তিনি একটি একটি ছবি আমাকে দেখিয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। বিজয় এই রকম সাতশো ছাত্রের ই-মেইল ও ঠিকানা সংগ্রহ করেছে। সে প্রতি সপ্তাহে তাদের কৃষ্ণভাবনামৃতের সংবাদ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বার্তা পাঠায়।
শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, ছাত্র জীবন হলো জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধানের প্রকৃত সময়। এদেরই একজন হলো স্টীভ সেইনরড। সে ছিল তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাকে বিভিন্ন খেলনা কিনে দিত ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। স্টীভ বললেন, আমার ঘুরতে যেতে ভালোই লাগতো, কিন্তু যখন যাওয়ার পূর্বে সবকিছু বোঝানো হতো, তখন আমার ভিতরটা কেমন জানি খালি খালি মনে হতো।
এক সময় আমার পিতা-মাতার বিচ্ছেদ হয়।
তারপর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমি বিভিন্ন ধর্মের আধ্যাত্মিক জ্ঞান অনুসন্ধান করছিলাম। একদিন আমার এক বন্ধু আমাকে শ্রীল প্রভুপাদের একটি গ্রন্থ (Path of Perfection) দেখালো। আমি ও আমার বন্ধু মিলে সেই ভক্তটিকে খুঁজতে লাগলাম যিনি বইটি দিয়েছিলেন। খুঁজে দেখতে পেলাম কিছু লোক একটি ভ্যানে করে অনেকগুলো গ্রন্থ নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা তার কাছে গিয়ে দেখলাম শ্রীল প্রভুপাদের অনেক গ্রন্থ। আমি ভগবদ্‌গীতা যথাযথ নিলাম এবং দেখতে লাগলাম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর একটি লাইনে আমার চোখ আটকে গেল।

অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া ।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ ॥

অজ্ঞতার গভীর অন্ধকার আমার জন্ম হয়েছিল কিন্তু আমার গুরুদেব জ্ঞানের আলো দিয়ে আমার চক্ষু উন্মীলিত করলেন তাকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি। এই লাইনটির মায়াতে পড়ে যাই আমি, আমিও তোমার মত ব্রহ্মচারী হয়ে গ্রন্থ বিতরণ করতে চাই ।
স্টীভ এখন সানডিয়াগো হরেকৃষ্ণ মন্দির একজন সেবক, সে অনেকগুলো সেবার মধ্যে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ মানুষের কাছে পৌঁছে দেখার সুমহান দায়িত্ব কাধে নিয়েছে। এই সেবাতেই তার সবচেয়ে আনন্দ।

লেখক পরিচিতি : করুণা ধরণী দেবী দাসী শ্রীমান বীর বাহু দাসের একজন শিষ্য। তিনি ১৯৭৯ সালে ইস্‌কনে যোগদান করেন।


 

জানুয়ারি-মার্চ ২০১৬ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।